চাদোঁয়া মহল পর্ব -০৭

#চাদোঁয়া_মহল
পর্বঃ০৭
#অত্রি আকাঙ্ক্ষা

—–“আমার ওপরে এখনো রেগে আছেন?কিছুটা তো ভরসা করাই যায়…কি বলেন!!আমাকে আপনার সুযোগ্য হয়ে ওঠার কি একটা চান্স ও দেওয়া যায় না??”

——“যায়।”

রেখার ভাবলেশহীন গলা।শারাফের মুখে হাঁসি ফুটে উঠলো।শারাফ চন্দ্ররেখার হার্ট শেপের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল।রেখা এবার নিজ থেকে বলে উঠলো,

—–“আপনি আমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলেন? আর আমার দিকে সবসময় এমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকেন কেন?”

শারাফ রেখার কিছুটা কাছে গিয়ে বসলো।দুজনেই মধ্যে দূরত্ব নেই বললেই চলে।কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

——“আপনি তো আর জানেন না!!আপনি অজান্তেই নিত্য আমাকে আহ্বান জানান।সেই আমন্ত্রণে, আমি চোখ দিয়ে সারা দেই।আমার দু’নয়ন ভরে আপনার সকল মুভমেন্ট অবলোকন করি।আমার অপ্সরাকে দেখতে আমার কোনো স্পেসিফিক কারণ লাগে না। ”

চন্দ্ররেখার মনে হলো তার সারা শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।কান থেকে বোধহয় ধোঁয়া বের হচ্ছে!!শরীর অসার লাগছে। আশ্চর্য!তার এমন লাগছে কেন?শারাফকে সে কেনো দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না?এটাই কি বৈধ সম্পর্কের সন্ধি!!চন্দ্ররেখা শারাফের অবয়বের দিকে এবার গভীর চোখে দৃষ্টিপাত করলো।পুরু ঠোঁট, সরু নাক,লম্বাটে মুখের গড়ন,মাথা ভর্তি খাঁড়া খাঁড়া মসৃণ চুল;সবমিলিয়ে সুদর্শন পুরুষ। চন্দ্ররেখার মনে হলো শারাফের চুল যেন কিছুটা ন্যাচারালি স্পাইক।বাতাসে চুলগুলো উড়ছে।

—–“আপনি কিন্তু আমাকে প্রথম প্রশ্নের উত্তর এখনো দেননি!কোথায় দেখেছেন আমাকে!!”

ক্ষীণ কন্ঠে শারাফ বললো,

——“আপনার খুব কাছের,খুবই আপন একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে আপনার ছবি দেখেছিলাম।উমম,, প্রায় দুবছর আগে হয়ত!!”

—-“আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ তো আমার বাবা। বাবার কাছে দেখেছেন??”

রেখা ভ্রু কুঁচকালো।শারাফের কথা তার বোধগম্য হয়নি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে শারাফের দিকে তাকালো রইল।

——“সময়কেও মাঝে মাঝে কিছুটা সময় দিতে হয়। সময় তখন নিজ থেকে আপনাকে উত্তর দিয়ে দিবে।”

চন্দ্ররেখা চুপ রইলো।কথার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করলো।বেশ কিছুসময় চুপ থাকার পর বিনা সংকোচে শারাফের কাঁধে মাথা রাখলো।মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

—-“কালকে বাবার কাছে একবার নিয়ে যাবেন?”

আদুরে কন্ঠে শারাফ জবাব দিলো

—-“যাবো।”

এরপর দুইজনই নিশ্চুপ।চন্দ্ররেখার মাথা এখনো শারাফের কাঁধে,সে একহাতে শারাফের হাত আঁকড়ে ধরে আছে। দুজনের মনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনারা কড়া নাড়ছে।এদিকের মানুষটি নিজের অস্তিত্বের সন্ধান করে নিজেকে ভারমুক্ত করতে চাইছে।অপরদিকে আরেকজন আপন মানুষটিকে চিরকাল নিজের কাছে আগলে রাখার পন্থা খুঁজছে।

———

জ্ঞান ফেরার পর থেকে দোয়া মির্জা ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদেই যাচ্ছেন।অবশ্য চাঁদোয়া মহলে তার কান্না নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপারের মধ্যে একটা।মায়ের কান্নার খবর শুনে তড়িঘড়ি করে হাফিজ মির্জা মায়ের কাছে উপস্থিত হয়েছেন।এসে দেখলেন প্রায় সকলেই উপস্থিত।মাসুক রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে।কেন হাসছে সে নিজেও হয়ত জানে না!!অনেক মানুষ খুব সিরিয়াস মোমেন্টেও হাসতে পারে,মাসুককে অনায়াসে তাদের কাতারে ফেলা যায়।এদিকে জিমি সিমি রুমে থাকা সোফায় বিবশ মুখে বসে আছে,অপরদিকে তাদের মা মোহিনী মির্জা শাশুড়ির সামনে জুস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।বেশ কয়েকবার বলেও তাকে কিছু খাওয়াতে পারেন নি তিনি।তার পাশে চিন্তিত মুখ নিয়ে লালি দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তার নাম লাইলি!!কিন্তু এ বাড়ির বড় ছোট সবার কাছে সে লালি।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের আবদার, বায়না,চাহিদা যেন শিশুর মতো হয়ে যায়!মানুষ তখন বুঝে কি না বুঝে, অবুঝের ন্যায় আচরণ করে বসে। হাফিজ মির্জার তার মায়ের আচরণে বিরক্ত? বিষয়টা কিন্তু মোটেও এমন নয়!তিনি ভাবছেন কি করলে তার মায়ের কান্না বন্ধ হবে!!তার ধারণা শারাফের অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের কথা শুনে মনে বেশ আঘাত পেয়েছেন তার মা।বড় ভাই হামিদ মির্জা থাকলে হইতো মাকে খুব সহজেই সামলে নিতো।হাফিজ মির্জা একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে,আবার আশেপাশে তাকাচ্ছে।স্বামীর অসহায় চেহারা দেখে তৃণা মির্জার বেশ মায়া হলো।তিনি কামরা ত্যাগ করলেন উদ্দেশ্য,সুধা মির্জার কক্ষ। তৃণা মির্জার পেছন পেছন অতি সন্তপর্ণে জারিফ,জিমি সিমিও বের হয়ে গেলো।

—-“আপা ভিতরে আছেন!আসবো আমি?”

বয়সে সুধা মির্জা তার দুই ভাইয়ের ছোট হলেও,ভাইয়েরা সব সময় তাকে আপা বলেই সম্বোধন করে আসছে।এ নিয়ে তাদের বাবা চাহান মির্জার কঠোর নির্দেশ ছিলো বৈকি!সেই সুবাদে ভাইয়ের বউয়েরা তাকে আপা বলেই ডাকে। সুধা মির্জা মাঝে মাঝে ভাবেন,এই ডাকের মাঝে কি আদোও কোনো সম্মান আছে? নাকি সকলে তাকে ভয় পায়!সুধা মির্জা কাউচে বসে ছিলেন।ঝিল্লিপুর বিধবা ফাউন্ডেশনের লিস্ট চেক করছিলেন তিনি।এসব বেশিরভাগ মহিলাদের স্বামী মারা গেছে, নয়ত নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।এসব মহিলাদের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তাদের সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে তিনি।যেসব মহিলা কাজ করতে চায় তাদের কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন।পুনরায় দরজায় কড়া নাড়লেন তৃণা মির্জা। সুধা মির্জা ভ্রু কুঁচকালেন। সচারাচর খাওয়ার সময় ছাড়া তাকে কেউ ডাকতে আসে না,আজকে হঠাৎ এমন সময়!!ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত নয়টা।তিনি জবাব না দিয়ে,কাউচ থেকে উঠে দাঁড়ালেন।শব্দবিহীন দরজা খুললেন।

—–“কিছু হয়েছে?”

—–“একটু মায়ের রুমে আসতে হতো যে!!আজকে বিকালে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি,উঠার পর থেকে কান্না করেই যাচ্ছেন।মাসুকের বাবা হাজার বুঝিয়েও থামাতে পারছেন না।কি হয়েছে কিছুই বলছে না,আপনি যদি একটু আসতেন??

এক সাথে এতো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠছেন তৃণা মির্জা।ঢোক গিলে গলা ভেজালেন।

—–“আপনি যান,আমি আসছি!!”

ননদের অনুমতি পাওয়া মাত্র তৃণা মির্জা স্থান ত্যাগ করলেন।অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন সুধা মির্জা।কতোদিন পরে এ ঘরে এসেছেন তিনি?প্রায় ছয়মাস হবে হয়ত!!একই বাড়িতে থাকা হলোও,প্রত্যেকের সাথে তার এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে।কেবলমাত্র শারাফের ক্ষেত্রে এ বিষয় ভিন্ন।অন্যদিকে দোয়া মির্জার ক্ষেত্রে এ দেয়ালের পুরুত্ব যেন অনেকটাই বেশি!!সবকিছুর জন্য একমাত্র দ্বায়ী তো কেবল তিনিই।

সুধা মির্জাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে একে একে বাকি সকলে বের হয়ে গেলো।মেয়েকে দেখে দোয়া মির্জার কান্না কিছুটা কমলেও,পুরোপুরি থামে নি।মেয়েকে ইশারায় বসতে বললেন।বেশ বিরক্তি নিয়ে সুধা মির্জা বিছানায় বসলেন।দোয়া মির্জা সোজা হয়ে বসলেন, দু’হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ফ্যাসফ্যাঁসনো গলায় বলে উঠলেন,

——“নতুন বউ…. সুধা;তাজওয়ারের মেয়ে।”

মূহুর্তেই সুধা মির্জার শরীর শক্ত হয়ে গেলো।চোখের সাদা অংশে আবছা আবছা রক্তিম আভা জমতে শুরু করলো।কতোদিন পর এই নামটা শুনলেন তিনি!!উহু….ঠিক দিন না বছর হবে।বক্ষের মাঝে যেন প্রকাণ্ড এক পাহাড় চেপে আছে।তার কি দম ফুরিয়ে আসছে!!এ কেমন নিদারুণ কষ্ট!!এতোবছর পরেও ক্লেশের মাত্রার বিন্দু পরিমাণ ঘাটতিও হয় নি।এক ঝটকায় দোয়া মির্জাকে সরিয়ে দিলেন তিনি।বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন,পর মূহুর্তে দোয়া মির্জার বাহু চেপে ধরলেন।দাঁতে দাঁত চেপে শীতল অথচ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলতে লাগলেন,

——“আর একবার যদি আপনার মুখ থেকে একই কথা বের হয়েছে,আর যদি কারো কানে গিয়েছে;এই চাঁদোয়া মহলকে জ্বালিয়ে দিতে আমার এক মিনিট সময় ও লাগবে না।”

ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেন দোয়া মির্জা,ক্রন্দনের মাত্রা বেড়ে গেলো।

—–“মারে মাইয়াডার কি দোষ!আমার পাপের শাস্তি ওরে কেন দিতাছোস?উনিশ বছর ধইরা মাইয়াডা কষ্ট পাইতাছে। মা থাইকাও মাইয়াডা এতিম ।”

সুধা মির্জা মাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।মুখ লাল হয়ে গেছে তার। দ্রুতবেগে শ্বাস নিতে নিতে বললেন,

—–“আপনার করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমার বাবা করেছে।আর এই মেয়ে এখনো তার আসল শাস্তি পায় নি।বরং যেদিন সব সত্য তার সামনে আসবে,সেদিনটি হবে তার জীবনের শাস্তি।আপনি যদি শারাফের আর তার স্ত্রীর মঙ্গল চান তাহলে সবকিছু চুপচাপ মেনে নিন।”

কথা শেষ হতেই ঝড়ের বেগে বের হয়ে গেলেন।মেয়ের যাওয়া দিকে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন দোয়া মির্জা।মনে মনে ভাবলেন,নিজের অতীত জীবনের করা পাপ যদি সংশোধন করা যেতো!সব ভুলে বর্তমানকে মাহাত্ম্য দিতে তো সকলেই চায়।কিন্তু দিনশেষে অতীত যে বর্তমানকেও ছাড় দেয় না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here