জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ৫

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

৫.
সৌমিক টলছে। পায়ের তলা শিরশির করছে। মাথা হালকা ঘুরে উঠেছে। সে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মুখের কাছে এনে ডান হাতের তর্জনী আঙুল কামড়ে ধরেছে। সে মোটেও ভাবে নি যে মোহনা এরকম কিছু করতে পারে। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে তার। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখছে সে মোহনাকে। তার নিশ্বাস কি খানিক ভারী হলো?

সৌমিকের গাঁ জ্বালা হাসি দেখে মোহনা মাথায় কুচক্র এঁকেছে। সে হুট করে শরীরে পেঁচানো তোয়ালে সরিয়ে দিয়ে ভেজা চুলগুলো খোঁপা করে নিলো। তারপর ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে লোশনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসলো। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে হাতে, পায়ে, শরীরে লোশন মাখতে লাগলো। হাঁটু অবধি পাজামা তুলে রেখে লোশন মাখছে। সৌমিক বড় বড় চোখ করে দেখছে। শুধুমাত্র পাজামা আর অন্তর্বাস পরে আছে মোহনা। চুল খোঁপা করে নেয়ায় গলা থেকে বুক পর্যন্ত অনেকখানি জায়গা উন্মুক্ত। চর্বিহীন পেট উন্মুক্ত। পুরো পিট দেখা যাচ্ছে। সৌমিকের হৃদস্পন্দন বাড়ছে ক্রমশ। মোহনার শরীরের গাঁথুনি অনেক বেশি আকর্ষণীয়। চোখের সামনে এরকম সৌন্দর্য দেখে নির্বাক সৌমিক। লোশন মাখা শেষে নীল রঙের একটা কামিজ পরলো মোহনা। তারপর ওড়না শরীরে পেঁচিয়ে সৌমিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সৌমিক তখনও একইভাবে আঙুল কামড়ে বসে আছে। মোহনা সৌমিকের মুখের সামনে তুড়ি বাজালো। কেঁপে ওঠে সোজা হয়ে বসলো সৌমিক। গলাটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে তার। মোহনা বললো, ‘আমাকে ভালো থাকতে দিন। শুধুশুধু এসে লাগালাগি করবেন না।’ বলে বিছানায় যেতে লাগলো মোহনা। তখনই সৌমিক পেছন ডাকলো, ‘মিসেস মোহনা সৌমিক হাসনাইন।’

চমকে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো মোহনা। নিজের নামের সাথে সৌমিকের নামের জোড়া লেগেছে! ভাবতেই বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো তার। সৌমিক নিঃশব্দে হাসলো একবার নিচের দিকে তাকিয়ে। তারপর উঠে এসে মোহনার সামনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পরখ করলো মোহনাকে। তারপর বললো, ‘তোমার ক্লিভেজের মধ্যে উপরের দিকে একটা অনেক গাঢ় তিল আছে। আর নাভির কাছেই ডানদিকে একটা গাঢ় তিল। দুটো তিলই সবার আগে নজর কাড়ে। এইমাত্র একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। যেদিন থেকে পরিপূর্ণভাবে স্বামীর অধিকার পাবো, সেদিন থেকেই ঐ দুটো জায়গায় প্রতিদিন গভীর চুমু দেব। উম, কামড়ও দিতে পারি।’

কথাটা বলেই সৌমিক গুণগুণ করতে করতে ওয়াশরুমে গেল। পেছনে রেখে গেল হতভম্ব, স্তব্ধ মোহনাকে। হা হয়ে আছে তার মুখ। বিড়বিড় করে বললো, ‘একটা মানুষ কীভাবে এতো অসভ্য হতে পারে?’ তারপর ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ছিঃ! বেলাজ, বেশরম।’

রাত একটা। নিহানের ফোন ভাইব্রেশন হচ্ছে বিপ বিপ শব্দে প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে। বিরক্ত হয়ে কলটা রিসিভ করলো সে। ওপাশে মাহফুজের গলা, ‘এই নিহান, সৌমিকের হানিমুন ট্রিপ নিয়ে কিছু ভেবেছিস?’

বিরক্তির মাত্রা চরমে পৌঁছলো এবার নিহানের। সে ঝাড়ি মেরে বললো, ‘এশহোলের বাচ্চা, রাত বিরেতে আমারে এখন অন্যের হানিমুন নিয়ে ভাবতে হবে?’

‘তোর কি বউ আছে যে নিজে হানিমুন করবি?’

‘না থাকুক, এতো সুন্দর স্বপ্ন দেখতেছিলাম। ঘুমটা ভাঙায় দিলি।’

‘কী দেখতেছিলি?’

নিহান চোখ বন্ধ করে হালকা গলায় বলতে লাগলো, ‘একটা লাল শাড়ি পরা মেয়ে ফুলে ফুলে সাজানো বিছানায় বসে আছে। আমি তার পাশে গেলাম, ঘোমটা তুললাম। ও হাসলো। তারপর শাড়ির আঁচল ফেললাম। তারপর আস্তে আস্তে ওর ঠোঁটের কাছে যাইতেই… শালা তুই কল দিলি।’

কিটকিট করে হেসে উঠলো মাহফুজ। ফোনের ওপাশে ওর হাসির শব্দে নিহানের রাগ লাগছে। সে ধমকে বললো, ‘হাসবিনা, শালা কুত্তা।’

মাহফুজ হাসতে হাসতে বললো, ‘দোস্ত, চেক কর। আমি শিওর তোর স্বপ্নদোষ হইছে।’ বলে আবার হাসতে লাগলো। নিহান বললো, ‘তোর মতো এতো কমে হয়না। শালা সেই সময় দিলি কই?’

‘হয়েছে শোন। ভেবেছিস কিছু?’ মাহফুজের কণ্ঠ এবার স্বাভাবিক।

‘না, খুঁজতেছি। এই হিজরার বাচ্চাটারে হানিমুনে পাঠাইয়া শুধুশুধু টাকা খরচ করমু যতটা বুঝলাম।’ ঝাঁঝালো গলায় বললো নিহান।

‘হিজরা! কী বলিস এসব? আল্লাহ!’ ফোনের ওপাশ থেকে আঁতকে ওঠে মাহফুজ।

‘তা নয়তো কী? বিয়া করছে অথচ ফুলসজ্জা করেনাই। এটাকে কী বলা যায় আর?’

‘তাই বলে ওর পুরুষত্বে প্রশ্ন তুলবি তুই? এটা খারাপ, নিহান।’

‘বালের খারাপ। সতি সাজতেছেন উনি বউয়ের কাছে। উনি যে কী সতি সেটা…’

‘আহ, নিহান। চুপ কর। সিচুয়েশন বুঝে চলতে হয়। এখন জোর করে কিছু করা মানে মোহনার কাছে সারাজীবনের জন্য খারাপ হয়ে যাওয়া।’

‘হইছে ছাড় তো। কালকে একসাথে বসে জায়গা ঠিক করব। এখন ঘুমাইতে দে। স্বপ্নটা পুরা করতে দে আমারে। চুমুটা খাইতে বাধা দিলি। রাখ।’ বলেই কলটা কেটে মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখে দিলো নিহান। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

মধ্যরাতে বারান্দায় বসে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ানো একটা অন্যতম শখ আরাফাতের। সে এখন বসে আছে তার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায়। হাতে জলন্ত সিগারেট। একটু পর পর ধোঁয়া মুখের ভেতর নিচ্ছে আর বের করে উড়িয়ে দিচ্ছে। আকাশে একটা অর্ধচাঁদ দেখা যাচ্ছে। আর আকাশ ভরা অসংখ্য তারা মিটমিট করছে। সেদিকে তাকিয়ে আরো একবার সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে সেটা বাইরে ছুড়ে ফেলে হেসে দিলো শব্দ করে আরাফাত। তারপর পেছনদিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে দেখবে? কাছে আসতে মানা করেছে কেউ? আসো পাশে বসো।’

‘আমিতো একদম শব্দ করিনি। কীভাবে বুঝলে যে আমি এখানে?’ আরাফাতের হাত ধরে পাশে এসে বসে কথাটা বললো রুহি।

আরাফাত কোনো উত্তর দিলো না। চাঁদের মিটমিট আলোয় পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি স্থাপন করলো সে রুহির ওপর। তারই একটা শার্ট পরে আছে রুহি। হয়তো বিছানা ছেড়ে উঠে আসার সময় সামনে পেয়ে পরে নিয়েছে। চাঁদের আলো এসে পড়ছে রুহির ওপর। ফরসা শরীরটা চিলিক দিচ্ছে তার। শার্টটা তার হাটুর একটু উপরে এসে ঠেকেছে। ফ্লোরে পা ভাঁজ করে বসায় পুরো পা উন্মুক্ত হয়ে আছে যা চাঁদের আলোয় মোহনীয় দেখাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে হালকা মুচকি হাসলো আরাফাত। রুহি তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তাকিয়ে থেকেই মুগ্ধ গলায় বললো, ‘চাঁদটা কী সুন্দর লাগছে!’

রুহির কথাটা শুনে চাঁদের দিকে তাকালো আরাফাত। আস্তে করে বললো, ‘হুম। সুন্দর।’

রুহি ফিরে তাকালো গোলগাল সুন্দর চেহারার ছেলেটার দিকে। যার সবকিছু তার কাছে আকর্ষণীয় লাগে। যার আদর করার ধরন, কথা বলার ধরন, সবকিছু তাকে ভীষণরকম টানে। সে বললো, ‘তোমার এখন বলা উচিত ছিলো যে “তুমি এই চাঁদের থেকেও সুন্দর”। অথচ কী বললে! উফ, তুমি না, বড্ড আনরোম্যান্টিক।’

কপাল কুঁচকে তাকালো আরাফাত। বললো, ‘আনরোম্যানটিক?’

‘অবশ্যই।’

‘তাহলে চলো। আবার নতুন করে বুঝিয়ে দেই।’ বলেই রুহিকে এক টানে নিজের অনেক কাছে নিয়ে এলো সে। তারপর আবার বললো, ‘বললেই হতো, একটু আগের আদরে হয়নি। আরো চাই।’

রুহির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। এই মানুষটা যখন তার এতোটা কাছে আসে, তার দুনিয়া থমকে যায়। নিশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। সে ছটফট করতে করতে বললো, ‘আ-আমি এটা বুঝাইনি। আ-আমি বলেছি… উফ, সুড়সুড়ি লাগছে।’

রুহির গলায় মুখ ডুবিয়েছিলো আরাফাত। রুহির কথা শুনে ওভাবেই হেসে দিলো সে। তারপর রুহিকে ছেড়ে সরে বসলো। বললো, ‘এখন সুড়সুড়ি লাগছে, না? আর একটু আগেতো আমাকে…’

‘এই শোনো। তুমি সত্যিই একটা বিরাট আকারের অসভ্য।’ বলে মুখ ভেংচি দিলো রুহি। এই ‘অসভ্য’ শব্দটা শুনে হঠাৎ করে আরাফাতের বুকটা চিনচিন করে উঠলো। ঢোঁক গিললো সে। রুহির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘রুমে যাও, রুহি। আমি আরেকটা সিগারেট শেষ করে আসছি।’

‘আমি থাকি…’

‘রুহি, রুমে যাও।’ গমগমে গলায় বললো আরাফাত। রুহি আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করলোনা। সরে এলো সেখান থেকে। ভাবলো কী এমন বলে দিলো সে? রুহি যাওয়ার পরে আরেকটা সিগারেট ধরালো আরাফাত। পুরোনো কিছু স্মৃতি এসে আয়নার মতো ভাসছে চোখের সামনে।

চলবে…..
©ফারজানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here