#জলারণ্যের_ওপারে
——————————
৬.
ফজরের নামায পড়ে রান্নাঘরের দিকে গেল রুহি। শ্বশুর-শাশুড়ীকে চা দিতে হবে। চায়ের পানি বসিয়ে আনমনে ভাবছিলো, গতকাল রাতে হুট করে আরাফাত এমন করলো কেন? বিয়ের প্রায় দু’মাস হতে চললো। এই প্রথম এমন অদ্ভুত আচরণ করলো সে। হুট করে কী হয়েছিলো তার? হঠাৎ চায়ের কথা মনে পড়তেই স্তম্ভিত ফিরে রুহির। চা বানিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির রুমের দিকে এগোলো সে।
আরাফাতের মা মহসিনা কোরআন তেলাওয়াত করছেন। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন আরাফাতের বাবা মাহবুব রাহমান। রুহি চা নিয়ে ঢুকতেই মাহবুব সাহেব বললেন, ‘আরে মা, এটা ভুল পড়েনা তোমার তাইনা?’
‘কীভাবে ভুলব, বাবা? এটা আমার কর্তব্য।’
‘আহ্! কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে গেল। নিজের পছন্দের উপর নিজেরই গর্ব হচ্ছে।’ কোরআন শরীফ বন্ধ করে জায়গামতো রেখে এসে বিছানায় বসলেন মহসিনা। রুহি চায়ের ট্রে থেকে একটা কাপ এগিয়ে দিলো মহসিনার দিকে। হাসিমুখে সেটা নিলেন তিনি। রুহি মাহবুব সাহেবের হাতেও দিলো চায়ের কাপ। তারপর দুজনকে বিস্কিটের পিরিচটা দিয়ে হেসে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। মহসিনা পিছু ডাকলেন, ‘বৌমা, আরাফাত উঠেছে?’
‘জ্বি, নামায পড়ছেন।’ বলে হেসে বেরিয়ে গেল রুহি। মহসিনা ও মাহবুব একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
★
গগনতলে মিলিয়ে যাচ্ছে অংশুমালী,
মন সায়রের উষ্ণ কম্পন, সাথে ঊর্মিমালীর গর্জন।
উত্তাল ঢেউয়ের বাধা পেরিয়ে-
যাবে জলকন্যা? আমার সাথে?
ঐ জলারণ্যের ওপারে!
ছেলেটি মেয়েটার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো বলছিলো। খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটি। অস্তরত সূর্যের সামনে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের শা শা গর্জনের সাথে মেয়েটির হাসি যেন চুড়ির রিনিঝিনি শব্দের ন্যায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো চারিদিকে। মেয়েটি হাসি থামিয়ে বললো, ‘বাহ, খুব কবি হয়েছো তো!’
ছেলেটি একগাল হেসে বললো, ‘তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা অনায়াসেই লিখে যেতে পারি।’
মেয়েটি আবারও হাসতে লাগলো রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে। ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরে হাঁটতে লাগলো, সমুদ্রের দিকে। দুজনে একসাথে সমুদ্রের ওপারে যাবে। যেইনা সমুদ্রের ঢেউ বড় হয়ে এগিয়ে আসলো ওদের দিকে, অমনি ছেলেটা মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলো। তারপর উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো। চিৎকার করতে করতে ছেলেটিকে ডাকতে লাগলো মেয়েটি। দৈত্যের মতো ঢেউগুলো যেন গভীর থেকে গভীরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। হঠাৎ অনুভব করলো বলিষ্ঠ দুটো হাত তাকে টেনে তুলেছে এই মরণ জায়গা থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে তীরে আবিষ্কার করলো সে। অচেনা সেই পুরুষকে দেখামাত্রই বিস্ময়ে ফেটে পড়ে সে বলে উঠলো, ‘আপনি!’
হুড়মুড় করে উঠে বসলো মোহনা। দুঃস্বপ্ন! এ-এমনটা কেন দেখলো? স্বপ্নের মানুষগুলো কারা ছিলো? এতো পরিচিত লাগছিলো সবাইকে। মনে হচ্ছিলো সমুদ্রে ডুবন্ত মেয়েটা যেন সে নিজে। আর… আর ধাক্কা দেয়া ছেলেটা… ডুকরে কেঁদে উঠলো মোহনা। ঘেমে একাকার হয়ে আছে সে। বিছানার পাশেই সৌমিক ফ্লোরে পুশআপ করছিলো। মোহনা এমন হুট করে কাঁদতে দেখে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। মোহনার পাশে এসে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হলো? ঘুম থেকে উঠেই কাঁদছো যে? কী…’
সৌমিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই মোহনা ঝাপিয়ে পড়ল তার বুকে। কাঁদতে কাঁদতে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো সৌমিকের খালি বুক। সৌমিক কিছু বললোনা। মোহনার মাথায় হাত বুলাতে থাকলো। কিছুক্ষণ কান্না করার পর শান্ত হলো মোহনা। সৌমিক বললো, ‘কী হয়েছে তোমার?’
মোহনা একইভাবে থেকে বললো, ‘দুঃস্বপ্ন দেখেছি।’
‘তাই বলে কাঁদতে হবে?’
‘কান্নার মতো স্বপ্ন দেখলে কি হাসবো আমি?’ কথাটা ধমক দিয়ে বললো মোহনা। সৌমিক থতমত খেলো। আস্তে করে বললো, ‘আচ্ছা আচ্ছা। কাঁদো।’
দু’তিন মিনিট কেটে যাওয়ার পর মোহনা ছিটকে সরে এলো সৌমিকের থেকে। সৌমিক আকস্মিক এমন কাণ্ডে খানিকটা অবাক হলো। এভাবে সরে যাওয়ার মানে কী? নিজেই তো ধরলো।
‘ছিঃ! আমার গাল, গলা, নাক-মুখ সব আপনার ঘামে ভিজে গেছে। ইয়াক! এতো খচ্চর কেন আপনি?’ মুখ বিকৃত করে বললো মোহনা।
সৌমিক অবাকের অষ্টম পর্যায়ে। চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকলো মোহনার দিকে সে। মোহনা আবার বললো, ‘তাকাচ্ছেন কী? এই ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে আমার কাছে এসেছেন কেন? এখন আমাকে গোসল করতে হবে। গোসল করলেতো আবার সবাই ভাববে রাতে ইয়ে করেছি। উফ!’
সৌমিক তাকিয়েই আছে এই মেয়েটার দিকে। এক্ষুণি না কাঁদছিল? আর এখন! সৌমিক উঠে দাঁড়ালো। তারপর বললো, ‘নিজেই ঝাপিয়ে পড়লে আমার ওপর। তারপর নাকের অশুদ্ধ ময়লা পানি আর চোখের বিশুদ্ধ নোনা পানি দিয়ে আমার বুকটা ভিজিয়ে দিলে। কিছু বলিনি, কাঁদছিলে বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আর তার এই প্রতিদান?’
‘হোও! আপনি আমাকে খোটা দিচ্ছেন!’ হা হয়ে অবাক হওয়ার ভঙ্গি করলো মোহনা।
‘খোটা দিচ্ছিনা। বলছি। আর শোনো, ঘামে ভেজা বলে নাক সিটকাচ্ছো না?’ কথাটা বলে সৌমিক মোহনার অনেক কাছে ঝুঁকে গেল। এতো কাছে যে একে ওপরের নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে। আর এই প্রথমবারের মতো মোহনার বুকের ভেতরটা কেমন আলোড়ন করে উঠলো। কেমন করে উঠলো হৃদয়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো। কেমন নেশাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে সৌমিক। মোহনার চোখে চোখ রেখে সৌমিক এবার ফিসফিস করে বললো, ‘একদিন এই ঘামে ভেজা শরীরটা দেখলেই তোমার ভেতরের কামনা জেগে উঠবে। আর সেদিনটা খুব একটা দূরে নেই।’
বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো মোহনার মুখ। সে ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আবার বাবা আমাকে একটা লজ্জাবিহীন অসভ্যের কাছে কীভাবে বিয়ে দিলো?’
কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল মোহনা। ওয়াশরুমের দরজাটা অনেক জোরে লাগালো। সৌমিক দরজার কাছে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বললো, ‘একটু তাড়াতাড়ি বেরোবেন ম্যাডাম। শ্বশুরবাড়ি যাবো তো! রেডি হতে হবে। ন’টা বাজতে চললো।’
ওয়াশরুম থেকে মোহনার ক্যাটকেটে গলা ভেসে এলো, ‘গেট লস্ট!’
সৌমিক হেসে উঠলো হো হো করে।
★
‘আপনারা সাথে আসলে অনেক ভালো লাগতো।’ মোহনা বললো নমিরুন বেগমের হাত ধরে।
‘আরে যাবো যাবো। সময় তো সবে শুরু হলো। বাড়িতে অনেক কাজকর্ম আছে। তোমরা যাও।’ বললেন নমিরুন।
‘ভাইয়া ভাবিকেও নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু ভাবির তো আজ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’
‘হ্যাঁ। বোঝোই তো, এই সময়টা একটু দেখে দেখে রাখা লাগবে ওকে।’
সৌমিক বললো, ‘চলো চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফুফু, ঠিকমতো থাকবেন আর নিজের খেয়াল রাখবেন। ফোন দেব, ভাবির খবর জানাবেন।’
‘সাবধানে যাস তোরা। আল্লাহ ভরসা।’
গাড়িতে উঠে বসলো দুজনে। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগে সৌমিক তাকালো মোহনার দিকে। মোহনা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশী রঙের একটা শাড়ি পরেছে মোহনা। হালকা গয়নাগাটি পরেছে। সাজগোজ খুবই কম। মেয়েটা যা-ই পরে তাকে অপ্সরী লাগে। এই মুহূর্তে সৌমিকের মনে নিষিদ্ধ চিন্তার উদয় হচ্ছে। মোহনার রক্তবর্ণের ওষ্ঠদয় যেন চুম্বকের মতো টানছে তাকে। তার কোমল শরীরের উষ্ণ স্পর্শ পাওয়ার জন্য সৌমিকের হৃদপিণ্ড কাঁপছে। আহ! আর কতদিন নিজেকে এভাবে সামলাতে পারবে সে?
‘কী ব্যাপার? গাড়ি স্টার্ট না দিয়ে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’ ক্যাট করে বলে উঠলো মোহনা। সৌমিক খানিক কেঁপে উঠলো। ঢোঁক গিলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার তাকালো মোহনার দিকে। তারপর সেদিন মোহনা যেভাবে বলেছিলো ঠিক সেভাবেই অবিকল নকল করে বলে উঠলো, ‘বিশ্বাস করুন, আমি লেসবিয়ান না। আমার ছেলেতে ইন্টারেস্ট।’
রাগে মোহনার পিত্তি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো। সে ফোঁস ফোঁস করে বললো, ‘আপনি, আপনি আস্ত একটা যা-তা!’৷ বলেই মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সৌমিক হাসতে হাসতে গাড়ি চালাতে লাগলো।
★
চলবে….
©ফারজানা আহমেদ