জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ৭

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

৭.
বাসায় আসার সাথেসাথে জামাই আপ্যায়ন সেই যে শুরু হলো আর থামাথামি নেই। মোহনা বাসায় ঢুকেই অবাক হয়েছে। এখনও বলতে গেলে পুরো বাসা মেহমানে গিজগিজ করছে। ফুফু-চাচা’রা কেউ এখনও যান নি। দুপুরের খাবারের পালা চুকে গেলে সবাই একে একে বিদায় নেবেন। মোহনা খাবার টেবিলে গিয়ে দেখলো সেখানে হুলুস্থুল কাণ্ড। সৌমিককে খেতে বসানো হয়েছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মোহনার ফুফুতো বোন, মামাতো বোন, তার বোন সোহানা, আর কিছু পিচ্চি। আর তার পাশে বসে আছেন আলতাফ চৌধুরী, মোহনার চাচা, ফুফু, মামা। সবাই একটু পরপর এটা ওটা তুলে দিচ্ছে সৌমিকের প্লেটে। বেচারার মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে আর নিতে পারছেনা। অভার হয়ে যাচ্ছে। মোহনার প্রচণ্ড হাসি পেলো। মজাও পাচ্ছে সে। এরইমধ্যে দেখা গেল তার মা মঞ্জুরা দই নিয়ে এসেছেন। মঞ্জুরার সাথে মোহনাও এগিয়ে গেল। মঞ্জুরা গিয়ে দই নিয়ে সৌমিকের পাশে দাঁড়ালেন। সৌমিক এক ঝলক তাকালো শ্বাশুড়ির দিকে। পাশে মোহনাকে দেখতে পেয়ে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা বোঝাতে চাইলো। মোহনা কী বুঝলো কে জানে! সে হেসে হেসে সৌমিকের পাশে গেল। তারপর সোহানাদের বললো, ‘সর তো তোরা। আর বোম্বাই মরিচের আচারটা আনলিনা তোরা?’

‘মরিচের আচার কেন?’ বললো সোহানা। মঞ্জুরা বেগমও বললেন, ‘হ্যাঁ, এখানে তো কেউ ওটা খায়না। ঝাল খুব।’

‘আরে উনিতো খুব পছন্দ করে ঝাল। আর বোম্বাই মরিচের আচার হলেতো কথাই নাই!’ গদগদ করতে করতে বললো মোহনা। সৌমিকের চোখে যেন বিস্ফোরণ ঘটলো। আসন্ন বিপদের আশংকায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলো সে। কিছু একটা বলতে মুখ খুলতেই মোহনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘মা, হালকা একটু গরুর মাংস দাও উনার প্লেটে আর এক চামচ ভর্তি করে বোম্বাই মরিচের আচার দাও।’

মোহনার কথা শুনে সবার চক্ষু চড়কগাছ। আলতাফ চৌধুরী বললেন, ‘পাগল হয়েছিস তুই?’

মঞ্জুরা বললেন, ‘কীসব আবোলতাবোল বলা শুরু করেছে। জামাই বাবা তুমি বলো, তুমি খাবে?’

‘আরে আমি জানিনা? আমি সংসার করছি আমি জানিনা কী খায় আর কী না?’ ক্যাটকেটে গলায় বললো মোহনা।

‘দু’দিন হলোনা বিয়ে হলো…’ কথাটা অর্ধেকেই থামালো মোহনার ফুফুতো বোন নুরা। তারপর কিটকিট করে হেসে উঠলো মোহনার বোনেরা। মোহনা সেদিকে তাকিয়ে চোখ রাঙায়। সোহানা ততক্ষণে আচার নিয়ে এসেছে। মোহনা সৌমিকের দিকে তাকিয়ে দেখে সৌমিক একধ্যানে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মোহনা সবকিছু অগ্রাহ্য করে সত্যি সত্যিই সৌমিকের প্লেটে তুলে দিলো আচারটা। সৌমিক তখন নিজের মধ্যে নেই। হুট করে সৌমিকের মনে হলো তার হৃদয় জুড়ে যেন রঙ বেরঙের অসম্ভব সুন্দর প্রজাপতির উড়াউড়ি চলছে। আর কারো কোনো কথাই যেন তার কানে যাচ্ছেনা। শুধু একটু আগে মোহনার বলা কথাটা বাজতে থাকে তার কর্ণকুহরে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৌমিক খেতে লাগলো সেই আচারটা। তাও শুধুই আচার, সাথে আর কিছু না। আলতাফ চৌধুরী হইহই করে বললেন, ‘কী করছ? এই এসব… আরে সরাও।’

সৌমিকের কানেই যাচ্ছেনা। এখানে অনেকেই অনেক কথা বলছে কিন্তু তার কিছুই কানে যাচ্ছেনা। তার কানে বাজছে মোহনার কণ্ঠ। খাওয়া শেষ করে একটা হাসি দিয়ে উঠে গেল সৌমিক সেখান থেকে। মোহনা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সৌমিকের গমনপথে। বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠলো। মঞ্জুরা বললেন, ‘সত্যি করে বলতো? ছেলেটা ঝাল খেতে পারে? মুখ দেখে তো মনে হলো না?’

মোহনার ফুফু বললেন, ‘আমারও তাই মনে হলো। জোর করে খেয়েছে। যা তো মা ওর কাছে যা৷ গিয়ে দেখ কিছু চায় কিনা।’

মোহনা কোনো কথা না বলে নিজের ঘরের দিকে গেল। বেশি করে ফেলেছে? অসুস্থ হয়ে যায় যদি মানুষটা?

অফিসের কাজে এতোটাই ডুবে ছিলো আরাফাত, যে এতোক্ষণ থেকে তিন-চার টা কল এসে ঢুকেছে তার ফোনে খেয়ালই নেই তার। পাঁচ নাম্বার কলটা যখন আসছে তখন পানি পান করছিলো সে। চোখে পড়ে টেবিলের ওপর তার মোবাইলের স্ক্রিনে লাইট জ্বলছে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো রুহির কল। রিসিভ করতেই রুহি বললো, ‘তুমি ঠিক আছো? কোথায় ছিলে? এতোক্ষণ থেকে ধরছিলে না আমার তো চিন্তা হচ্ছিলো। খেয়েছো দুপুরে? টিফিনের পুরো খাবার শেষ করেছো?’

মুচকি হাসলো আরাফাত। বললো, ‘একসাথে এতো প্রশ্ন করলে যে প্রথমদিকের প্রশ্নগুলো ভুলে গেছি।’

এবার রুহিও হেসে দিলো। আরাফাত আবার বললো, ‘ভালো আছি। ব্যস্ত ছিলাম ধরতে পারিনি। আর হ্যাঁ বউ সাহেবা, পুরো খাবার শেষ করেছি।’

‘গুড। কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি আসবা। বাবা আর মা ছোট খালার বাসায় গেছেন। আজকে থাকবেন। আমার একা ভয় হবে।’

‘আচ্ছা তাহলে সন্ধ্যার আগেই চলে আসবো। আমার এতো সুন্দরী বউটা একা ঘরে একলা থাকবে নাকি?’

‘হয়েছে হয়েছে। রাখছি।’

‘শোনো, বউ।’ মিষ্টি করে ডাকলো আরাফাত। রুহির কানে এই ডাকটা যেতেই একটা শিহরণ জাগলো। সে আস্তে করে বললো, ‘হু?’

‘তুমি খোঁপা করে রেখো, আমি বেলীফুলের মালা নিয়ে আসবো। যখন তোমার সর্বাঙ্গে বেলীফুলের সুবাস মো মো করবে, তখন আমি আলতো করে খোঁপার বাঁধন আলগা করে দেব।’ আস্তে আস্তে বললো আরাফাত। রুহির মনে হলো তার হাত পা জমে গেছে। এতো অনুভূতি ছিলো আরাফাতের এই কথাগুলোর মধ্যে! সে বললো, ‘তুমি এভাবে কথা কেন বলো? এভাবে বললে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।’

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়- লাইনটা শোনার সাথেসাথে একটা আবছা স্মৃতি এসে কড়া নাড়লো আরাফাতের মাথায়। চোখে ভেসে উঠলো একটা অস্পষ্ট, হৃদয়কাপানো চিত্র। আর তারপর একরাশ কালো মেঘ এসে ভীড় জমালো তার মনে। সে রুহিকে বললো, ‘রুহি, কাজ আছে। রাখছি।’ বলেই আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে কলটা কেটে দিলো সে। তারপর দু’হাতে চুল খামছে ধরে বসে রইলো অনেকক্ষণ। অনেক, অনেকক্ষণ।

মোহনা হাতে করে ম্যাংগো জুস নিয়ে গেল সৌমিকের জন্য। গিয়ে দেখলো সৌমিক ঠিক ফ্যানের নিচে রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কোমরে হাত দিয়ে। আর লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিচ্ছে। মোহনার কেমন মায়া হলো দেখে। সে সৌমিকের কাছে গিয়ে ডাকলো, ‘শুনছেন?’

মোহনার গলা শুনেই সৌমিক তাকালো না তার দিকে। এই মুহূর্তে রাজ্যের রাগ খেলা করছে তার মাঝে। একটু আগে গলগল করে বমি করে এসেছে সে। ঝালের ঠেলায় নাক মুখ পেট সব জ্বলছে। ঠোঁটে মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে। মোহনা আবার বললো, ‘এইযে এই জুসটা দিয়েছেন মা।’

‘আমি খাবনা।’

‘খেয়ে নিন।’

‘খাবনা।।’

‘ঝাল চলে যাবে।’

‘এটা ছাড়াও ঝাল যাওয়ার জন্য আরো অনেক খাদ্য আছে।’ এবার সৌমিক তাকালো মোহনার দিকে। মোহনা বললো, ‘ব-বলুন কী লাগবে। আমি এক্ষুনি দিচ্ছি।’

‘তাই? দেবে?’ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সৌমিক।

‘অ-অবশ্যই। কেন নয়। আসলে… আমি দুঃখিত। আমিতো মজা…’

‘তোমার ঠোঁট দাও।’ অকপটে বলে উঠলো সৌমিক।

‘অ্যাঁ?’ মোহনা যেন শুনতে পায়নি। তার মনে হচ্ছে ভুল কিছু শুনেছে।

‘ঠোঁট। ইংরেজি তে লিপ বলে। আরো পরিষ্কার ভাবে বললে, চুমু দাও। এরচেয়েও সাধারণ ভাবে বললে, লিপ কিস দাও। তারচেয়েও সহজ…’

‘থামুন থামুন। চুপ। এই আপনি যে একটা বিশাল আকারের অসভ্য সেটা আপনি জানেন?’ দাঁতে দাঁত চেপে বললো মোহনা।

‘তাই নাকি? জানতাম না তো। মাত্রই জানলাম।’ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললো সৌমিক।

মোহনা বিড়বিড় করে বললো, ‘বেহায়া বেলাজ।’ তারপর জোরে বললো, ‘কিছু খাওয়ার হলে বলুন এনে দিচ্ছি। নাহলে চলে যাচ্ছি।’

সৌমিক মোহনার হাত থেকে জুসের গ্লাসটা নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো। তারপর আকস্মিক এক টানে মোহনাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। মোহনা তখন অবাকের চাইতেও অবাক হলো। সে ছটফট করতে করতে বললো, ‘ছাড়ুন। ছাড়ুন বলছি। নাহলে আমি চিৎকার করব কিন্তু।’

সৌমিক আরো জোরে মোহনাকে আঁকড়ে ধরে বললো, ‘করো। তবে উহ আহ টাইপ শব্দ করো না। নাহলে সবাই আবার অন্য কিছু ভাববে।’

মোহনার মুখটা হা হয়ে গেল। সে বললো, ‘বেশরম ছেলে ছাড়ুন আমাকে। আপনার মুখে লাগাম নেই।’

‘থাকবে কীভাবে লাগাম? মুখে তো ঝালের রাজত্ব। তাইতো বললাম চুমু দিয়ে মিষ্টির রাজত্ব এনে দাও।’

মোহনা প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় আছে। এদিকে সে যতই চাইছে দূরে যেতে, সৌমিক নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে আরো নিজের কাছে নিয়ে আসছে। একটা সময় একে ওপরের অনেক কাছে চলে আসলো। এতো কাছে এসেই সৌমিকের বুকের ভেতরটা তোলপাড় শুরু করলো। সে কি এখন একটা চুমু খাবে? মোহনা তো তার বউ।

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here