জলঅরণ্যের ওপারে পর্ব ৮

#জলারণ্যের_ওপারে
——————————

৮.
‘আমি… আমি মজা করছিলাম। আমি দুঃখিত। কেঁদোনা প্লিজ।’ দ্বিধাগ্রস্তের ন্যায় বললো সৌমিক। ততক্ষণে মোহনাকে নিজের বাঁধন থেকে আলগা করেছে সে। মোহনা সৌমিকের থেকে সরে এসে দু’চোখ মুছে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো তার দিকে। তারপর বললো, ‘কান্না দেখতে ভাল্লাগে হ্যাঁ? খুব ভাল্লাগে?’

‘মানে?’ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো সৌমিক।

‘মানে এতোক্ষণ ছাড়লেন না। যেই না চোখে পানি আনলাম অমনি ছেড়ে দিলেন।’ দু’হাতে কোমর ধরে বললো মোহনা। সৌমিক থ বলে গেল। সে অবাক গলায় বললো, ‘এতো বিচ্ছু! তার মানে তুমি কাঁদছিলে না। তাইনা?’

‘না কাঁদলে চোখে পানি আসলো কীভাবে? এই দেখুন এই, চোখে পানি।’ মোহনা দু’চোখ বড় করে সৌমিকের দিকে তাকালো। সৌমিক হেসে দিলো। মোহনা আবার বললো, ‘আমার যখন রাগ আসে তখন আমি কেঁদে দেই।’

‘না কেঁদে রাগ ঝাড়লেই পারো।’

‘কীভাবে ঝাড়বো? এরকম সান্ডামারা শরীর আপনার। কিছু করা যায় নাকি?’ মুখ বাঁকিয়ে বললো মোহনা।

‘সান্ডামারা!’ বলে একবার নিজের উপর চোখ বুলালো সৌমিক। তারপর বললো, ‘এটা কেমন শব্দ? অশ্লীল অশ্লীল শোনাচ্ছে।’

‘তুই শালা মানুষটাই তো একটা অশ্লীল।’ বিড়বিড় করে বললো মোহনা।

‘কিছু বললে?’

‘না। জুসটা খেয়ে নিবেন। গেলাম।’ বলেই বেরিয়ে গেল মোহনা। সৌমিক নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে শেষ করলো সেটা।

আরাফাত বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের পর। কলিংবেলে চাপ দেয়ার আগেই রুহি দরজা খুলে দাঁড়ালো। আরাফাত দেখলো রুহি একটা সবুজ রঙের সিল্ক শাড়ি পরে আছে। হালকা সাজগোজ করেছে। চুলে খোঁপা করেছে। মেয়েটা সুন্দরী। একটু সাজলে তাকে আকাশ থেকে নেমে আসা পরীর মতো লাগে। আরাফাত চোখ সরিয়ে নিলো। বললো, ‘ভেতরে আসবো।’

‘হ-হ্যাঁ।’ বলে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো রুহি। তার চোখ-মুখ হাসছে। আরাফাত সোফায় বসে জুতা খুলছিলো। রুহি সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। আরাফাত বুঝতে পারলো রুহির মনের কথা। কিন্তু তার যে কিছু ভালো লাগছেনা। কষ্টরা বারবার দলা পাকাচ্ছে বুকের ভেতর। ঐ বিশ্বাসঘাতকটার কথা মনে পড়ছে বারংবার। আরাফাত তাকালো রুহির হাসিহাসি মুখের দিকে। ভাবলো, মেয়েটা তো তাকে সত্যিই ভালোবাসে। তার একটু ভালোবাসা, একটু আদর পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে। তাহলে সে কেন ঐ বিশ্বাসঘাতকতা যে করেছে তার জন্য মনমরা হয়ে থাকবে? আরাফাত মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দু’হাতে রুহিকে কাছে টেনে এনে তার কোমল অধরে ডুবে থাকলো কিছু মুহূর্ত। নাকে নাক ঘষে বললো, ‘তোমাকে সুন্দর লাগছে।’

‘ফ্রেশ হবেনা?’ নিচের দিকে তাকিয়ে বললো রুহি।

‘উহুম, একসাথে হবো।’

‘ফুল আনোনি?’ কম্পনরত গলায় বললো রুহি। আরাফাত কিছুটা থমকালো। তার মন ভালো ছিলো না। তাই কিছু করতে ভালো লাগেনি। রুহি অপেক্ষা করছিলো। এভাবে না বললে কষ্ট পাবে রুহি। আরাফাত আরো নিবিড়ভাবে রুহিকে নিজের সাথে লাগালো। এক হাতে রুহির খোঁপা খুলে দিলো। রুহির কানের নিচের হালকা লোমশ জায়গাটায় নিজের নাক ডুবিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘তোমার শরীরের মিষ্টি সুঘ্রাণ প্রাণভরে নিতে চাই। এক্সট্রা স্মেলের দরকার নেই।’

রুহির পায়ের তলা শিরশির করছে। নিজেকে এখন খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। তার স্বামী তাকে এতো ভালোবাসা দিচ্ছে! শরীরের প্রতিটি পশম আজ তাকে জানান দিচ্ছে, হ্যাঁ রুহি, তোমার স্বামী তোমাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। শুধু তোমাকেই ভালোবাসে।

আরাফাতের ছোঁয়ায় যেমন নিখাঁদ ভালোবেসে নিজের সর্বস্ব তুলে দিচ্ছিলো রুহি, ঠিক তেমনই রুহির শরীরের উষ্ণ উত্তাপে মিশে গিয়েও বিশ্বাসঘাতকতার দবদবে আগুনে পুড়ছিলো আরাফাতের বুক।

‘মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলেছিলে? আমার মেয়েটা সুখে আছে তো?’ আলতাফ চৌধুরী জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন। মঞ্জুরা বিছানা ঠিক করছিলেন ঘুমানোর জন্য। বিছানা করে সেখানে বসে একটা লম্বা শ্বাস নিলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘বলেছিলাম।’

আলতাফ ব্যস্ত পায়ে এসে স্ত্রীর কাছে বসলেন। বললেন, ‘কী বললো?’

‘বলেছে, সুখে থাকলেই কী আর না থাকলেই কী।’ কথাটা বলে মুচকি হাসলেন মঞ্জুরা। আলতাফ চৌধুরীও হাসলেন। বললেন, ‘আমার মেয়ে অভিমান করে আছে। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়না। একদিন সে বুঝবে। সৌমিকই তার জন্য উপযুক্ত। একমাত্র সৌমিকই ভালোবাসবে তাকে সত্যিকার।’

‘হুম।’ আস্তে করে বললেন মঞ্জুরা।

‘তোদের হানিমুন ট্রিপ নিয়ে ভেবেছি। সেন্ট মার্টিন যাবি তোরা। আমার আর নিহানের পক্ষ থেকে এই ট্রিপ উপহারস্বরূপ তোমাদের জন্য। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে রিটার্ন গিফট হিসেবে একটা ভাতিজা অথবা ভাতিজি দে ভাই।’- এই ম্যাসেজটা মাহফুজ পাঠিয়েছে সৌমিককে। মোবাইল হাতে নিয়ে মুচকি হাসছে সৌমিক। মোহনা পরখ করছে তাকে। সইতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, ‘কী ব্যাপার? এতো রসেরঙের হাসি হচ্ছে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। কেসটা কী?’

‘তার আগে আমাকে বলো রসেরঙে মানে কী?’ বললো সৌমিক মোহনার দিকে তাকিয়ে।

‘রসেরঙে মানে চোখ-মুখ হাসছে এমন।’

‘এতো সুন্দর কথাটাকে এভাবে অশ্লীল বানানোর মানে কী?’

‘এই আপনার সমস্যা কী? সব কথাতে অশ্লীল খুঁজেন কেন আপনি? আশ্চর্য!’ কপট রাগ দেখিয়ে বললো মোহনা।

‘আমার কী দোষ? শুনতে অশ্লীল লাগে।’

‘লাগবেই তো। অশ্লীল মানুষের সবকিছু অশ্লীল ই তো লাগবে।’

উত্তরে সৌমিক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো আর তখনই দেখলো- সোহানা, মোহনার ফুফুতো বোন নুরা, মামাতো বোন মাইশা এরা সবাই এসে ঘরে ঢুকেছে। সোহানার হাতে লুডু। সৌমিক বললো, ‘আরে বাহ! শালি বাহিনী দেখছি।’

‘হ্যাঁ। ভাবলাম ঘুমানোর আগে এক দান লুডু হোক।’ বিছানায় লুডুর বোর্ডটা ঠিকমতো রাখতে রাখতে বললো সোহানা।

‘মন্দ হবেনা।’ হেসে বললো সৌমিক। মোহনা চেতে উঠে বললো, ‘রাত্তির এগারোটা বাজে। এখন তোদের লুডু খেলার সময়? আমি ঘুমোবো।’

‘সারাজীবনই তো ঘুমাবি। আজকে একটু খেলি।’ অনুরোধের সুরে বললো নুরা। সোহানা ও মাইশাও আকুতি করলো। মোহনা বললো, ‘ঠিকাছে ঠিকাছে।’

সোহানা বললো, ‘আচ্ছা তাহলে তুই আর দুলাভাই এক টিম। আমি আর নুরা এক টিম। মাইশা হচ্ছে বিচারক। যে টিম হারবে সেই টিমকে নুরা একটা শাস্তি দিবে।’

‘দুলাভাই খেলা পারেন তো? টিমম্যাট কিন্তু কাঁচা।’ বললো মাইশা।

‘এই কী বললি?’ চোখ রাঙিয়ে তাকালো মোহনা। মাইশা মিইয়ে গেল। সৌমিক বললো, ‘আমি পারিনা এমন কিছু নেই। তবে টিম নিয়ে খেলায় তো ঝুঁকি থাকেই একটু আধটু।’

‘দেখা যাবে।’ বললো মোহনা। খেলা শুরু হলো। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে সৌমিক ইচ্ছে করে হারতে লাগলো। ইচ্ছে করে গুটির ভুল ভুল চাল চালছিলো। মোহনা বললো, ‘কী করছেন আপনি এসব? হেরে যাচ্ছি তো!’

সৌমিক পাত্তাই দিলোনা। অতঃপর, হেরে গেল দুজনে। উল্লাস করে উঠলো সোহানা ও নুরা। মোহনা বললো, ‘মানিনা আমি। ইচ্ছে করে হেরেছেন উনি।’

‘উফ, মোহনা! তুমি এতো বোকা। বাচ্চাদের জিততে দিতে হয়।’ বলে হাসলো সৌমিক। মোহনা মুখ ভেংচি দিলো। মাইশা বললো, ‘ওকে ওকে, তাহলে এবার হেরে যাওয়া দলের শাস্তির পালা। আপু আর দুলাভাই, তোমাদের শাস্তি হলো, দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে ত্রিশ সেকেন্ড।’

শাস্তি শোনে সৌমিক হেসে দিলো। মোহনা বললো, ‘এটা কেমন শাস্তি? ফালতু!’

‘যাই হোক। শুরু করো।’ বললো সোহানা।

সৌমিক আর মোহনা একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এক সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড… তিন সেকেন্ড… সৌমিকের চোখে কিছু একটা আছে। বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করে। চিকচিক করা ঐ হাসিহাসি চোখ দুটো একটা অদ্ভুত ভালোলাগার রঙ ছড়িয়ে দিলো মোহনার হৃদয়ে। না চাইতেই মোহনা ডুবে গেল ওখানে। ত্রিশ সেকেন্ড শেষ হতেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে সোহানাদের দিকে তাকালো সৌমিক। সোহানা, মাইশা, নুরা, তিনজনে তখন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মোহনার দিকে। মোহনা চোখ সরাচ্ছেনা সৌমিকের দিক থেকে। প্রায় এক মিনিট গড়াতেই সোহানা ধাক্কা দিলো মোহনাকে, ‘এই আপু!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সময় শেষ?’ কেঁপে ওঠে বললো মোহনা। তখনই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো সবাই। বেক্কলের মতো তাকিয়ে থাকলো মোহনা তাদের দিকে। আর সৌমিক তৃপ্তির দৃষ্টিতে তাকালো মোহনার দিকে। কিছু একটা তো অবশ্যই পরিবর্তন হচ্ছে!

ঘটনাটা ঘটলো পরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ। বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে মোহনা তখন শ্বশুরবাড়ি ফেরত যাওয়ার রাস্তায়। সৌমিকের গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক ফেইল করে। গাড়ি কন্ট্রোল হারিয়ে একটা বড় গাছের সাথে ধাক্কা খায়। ভাগ্য ভালো রাস্তার পাশের নদীতে পড়েনি। ক্ষনিকের জন্য মোহনা জ্ঞান হারিয়েছিলো। জ্ঞান ফেরার পর দেখলো গাড়ির চারপাশ ঘিরে অনেক মানুষ। তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তার সিটের ওপর উবু হয়ে আছে সৌমিক। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। মোহনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে কোনোমতে বললো, ‘তুমি ঠিক আছো?’ ব্যস এটুকুই। তারপর আর কিছু বলতে পারলোনা সে। জ্ঞান হারালো। মোহনা চিৎকার করে সাহায্য চাইলো। সবাই ধরাধরি করে বের করলো তাদের গাড়ি থেকে। সৌমিককে দেখে চিৎকার করে উঠলো মোহনা। পিঠের ওপর গাড়ির কাচ বিঁধেছে ওর। একজন বললো, ‘উনাকে এই পাঁচ মিনিট ধরে বলছিলাম বাহিরে বের হওয়ার জন্য। কথা শুনেন নি। বারবার বিড়বিড় করছিলেন যে আমার স্ত্রীর জ্ঞান কেন ফিরছেনা এটা বলে। আপনার ভাগ্য ভালো। ডালটা গ্লাসের ওপর এসে পড়তেই মনেহয় উনি আপনাকে বাঁচানোর জন্য আপনার উপরে চলে এসেছিলেন তাই আপনার জখম হয়নি। সব উনার পিঠের ওপর বিঁধেছে। ঐতো এম্বুলেন্স। আসুন আসুন, মাথায় বোধহয় আঘাত পেয়েছেন।’

মোহনার কপালের ডানদিকে হালকা রক্ত জমাট বেধেছে। বোধহয় ব্যথা পেয়েছে কোনোভাবে। মনে নেই তার। একজন নার্স এসে মোহনাকে ধরে এম্বুলেন্সে নিয়ে বসালো। সামনেই অজ্ঞান সৌমিককে শুইয়ে রাখা হয়েছে উপুড় করে। কাচগুলো দেখা যাচ্ছেনা। মনেহয় প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আচ্ছা, ও কি ব্যথা পেয়েছে? জ্বলছে খুব পিঠে? ঢোঁক গিললো মোহনা। অনুভূতিশূন্য লাগছে তার। শরীর অবশ হয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে সৌমিকের একটা হাত ধরলো সে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা জল।

চলবে…..
©ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here