#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব
পর্ব -১২
চারপাশ থেকে খুব দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ভাইয়া মুখোমুখি দাড়ালাম। রিশাদ ভাইয়া এখনো থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিস্টি একটা হাসি দিয়ে ইম্প্রেশন করার ট্রাই করলাম। বেশি একটা লাভ হইলো বলে মনে হয় না।
-কি চাই?
– রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে এই প্রশ্ন। আমি এখন ভিতরে দাঁড়িয়ে আছি। পরের প্রশ্ন করো।
ফিক করে ভাইয়া হেসে দিলো। ইশ, একটা হার্টবিট মিস করলাম। সাব্বিরের সাথে বিয়ে না হয়ে ভাইয়ার সাথে বিয়ে হলে খারাপ হতো না।
-তুই আগের মতোই দুষ্টু আর কটকট করে কথা বলিস।
-আর তুমি আগের থেকে বেশি সুন্দর আর সেই লেভেলের ড্যাশিং হয়ে গিয়েছো।
– ৬ বছরে তুই প্রথম যে আমার রুমে ঢুকেছে।
– ছি!! কি দুর্ভাগ্য আমার। এই ময়লার ভাগাড়ে ঢুকছি। সিটি কর্পোরেশনের সব ময়লা কি তোমার রুমে এনে ফেলায়?
ভাইয়া এবার জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কি সুন্দর একটা সুপুরুষ কেমন নিস্পাপ শিশুর মতো হাসছে!!
-শোনো মেজো ভাইয়া বলসে বিয়ের পর তুমি নাকি আমাকে খাইয়ে দিবে। শুধু তার জন্যে বিয়েতে রাজি হয়ছি। না হলে সাব্বিরের মতো ভ্যান্দামার্কারে কে বিয়ে করবে।
-আমি কেন তোকে খাইয়ে দিবো? আর মামুন ভাই তোরে এই কথা বলছে? মিথ্যা কথা বলিস কেন? ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো
– আমি ভার্সিটির হলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ভাইয়া না হয় নিরা আপু আমাকে খাইয়ে দিতো। না খাওয়াই দিলে আমি না খেয়ে থাকতাম। ২দিন না খেয়ে ছিলাম। পরে আবার খাওয়াই দিতো। হলে যেয়েও বান্ধবিদের হাতে খাই।
-ছোট বেলায় তো নিজে হাতে খাইতি।। আমি দেখেছি।
-তখন তো বেয়াক্কেল ছিলাম, তার জন্যে নিজে হাতে ভাত খাইতাম।
-তুমি দয়া করে এই রুম থেকে বের হবা? আমার বমি আসতেছে গন্ধে। এইরকম রুমে তুমি কিভাবে থাকো? চিড়িয়াখানার গন্ধও এর থেকে ভালো। বলে ট্রে টা ভাইয়ার হাতে দিয়ে ভাইয়ার বাহু ধরে টানতে টানতে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এলাম।
সাইকোলজি বলে একজন মানুষের সাথে যত ইজিলি কথা বলা যার তার থেকেও বেশি দ্রুত তাকে কোন বিষয়ে কনভিন্স করা যায় যদি সে আপনার ব্যাপারে পজিটিভ থাকে ।
আপাতত আমার মিশন ছিলো রুমে ঢুকা। এর পরে অন্য কিছু ভাবা যাবে। বোনাস হিসেবে পেলাম ভাইয়ার হাতে ভাত খাওয়া।
খেতে খেতে অনেক কথাই বললো আমার সাথে। আমি চোখের কোন দিয়ে দেখেছি, ফুপি তাদের রুমের পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। হয়তো চোখে পানিও আছে।
-তুই তো ভালোই রান্না শিখেছিস। শুটকিটা পুরো মামির হাতের রান্নার মতো হয়েছে। মামি অনেক ভালো রান্না করতে পারতো, বলতে বলতে আমার শুকনো হাসির দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।
সরি সরি রে, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজকাল অনেক কিছুই ভুলে যাই রে।
-আপুকে তো ভুলো নাই
ভাইয়া খাওয়া বাদ দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো – ভালোবাসার মানুষকে কি আবার ভুলে থাকা যায় নাকি।
-তুমি না খাও, আমাকে তো খাইয়ে দাও।
-তুই মানুষ হবি না কখনো। নে হা কর।
উদাস গলায় বললাম মানুষ হয়ে আর কি করবো বলো, মানুষ হয়েও তো নিজের জন্যে কিছু করতে পারলাম না।
-কি করতে পারিস নি?
– এইযে, মালয়শিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশে এখনো ঘুরতে পারি নাই। দেশের কতো সুন্দর সুন্দর জায়গায় এখনো যেতে পারিনি। মালদ্বীপে যাওয়ার কতো ইচ্ছে আমার।
-সাব্বিরের সাথে যাবি।
-আর মানুষ পাও নাই তুমি। সারাদিনে একটা ফোন করার সময় যার নাই সে আবার আমাকে নিয়ে ঘুরে বেরাবে।
তুমি কোথায় কোথায় গিয়েছ?
এক মুহূর্তের জন্যে ভাইয়া থমকে গেলো। কারণ আমি জানি ভাইয়া ১১ বছর ধরে একপ্রকার নিজের ঘরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছে। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেলো।
-চাবিটা দিয়ে যেও। সিটি কর্পোরেশনের ময়লা ফেলার জন্যে আলাদা জায়গা আছে।
ভাইয়া হাসি দিয়ে চাবিটা ছুড়ে দিলো আমার দিকে। চাবিটা ক্যাচ করতেই ভাইয়া একগাল হাসি দিয়ে বললো আগে তো কিছুই পারতি না। তুই ক্রিকেট বল আনতে আনতে আমি এক ঘুম দিয়ে উঠতাম।
-এখন আমি সব পারি। সন্ধ্যায় বাসায় থাকবা?
-কেন?
-আমার ল্যাপটপটা একটু ঝামেলা করতেছে। একটু যদি দেখে দিতা।
-আচ্ছা এখনই নিয়ে আয়।
-তোমার এই ময়লার গোডাউনে আমি যাবো না। আগে ক্লিন করি তারপর। তুমি একটু ড্রইংরুমে আসো।
-আচ্ছা আয়।
ল্যাপটপে আসলে কোন প্রব্লেমই নাই। একটা জিনিস দেখাবো তাই এই বাহানা করতে হলো।
একটু পর ল্যাপটপ ওপেন করতেই করতেই ওয়ালপেপারে আমার আর ফয়সালের ক্লোজ হাস্যোজ্জল ছবি দেখে ভাইয়া আর একবার টাশকি খেলো। আজকে বিকেলে থেকে বেচারা টাশকি খেয়েই যাচ্ছে।
ভাইয়া হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো কি জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না।
-আমার বয়ফ্রেন্ড ছিলো। ৫ বছরের সম্পর্ক ছিলো।
-তাহলে সাব্বির?
-ওর সাথে আমার কিছুই নাই।
-তাহলে বিয়ে করলি কেন?
-প্রথমত এই বিয়েতে আমার কোনো মতামত নেয়া হয়নি। আর সেকেন্ডলি আমার বয়ফ্রেন্ড বিয়ের দিন আমার ফোন ধরে নাই। বাসায়ও গিয়েছিলাম।লাভ হয় নাই।
-তো তুই আছিস কিভাবে?
– এই ভালোবাসা ছাড়াও সুন্দর করে বাচার জন্যে আশেপাশে এর থেকেও বিশুদ্ধ অনেক ভালোবাসা আছে যেটা সারাজীবনেও শেষ হবে না। ঐ ভালোবাসার জন্যে কেন শুধু শুধু নিজের জীবনটা শেষ করবো। এমন না যে তার জন্যে আমার মনে কোন ভালোবাসা নাই, তাকে আমি এখনও অনেক ভালোবাসি। কিন্তু এর থেকেও গভীর ভালোবাসা আমার চারদিকে আছে। ওগুলো হলেই বাচার জন্যে এনাফ। কেনো শুধু শুধু নিজেকে কস্ট দিবো।
ভাইয়া চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই উঠে রুমের বাইরে চলে গেলো।
কি হলো দেখার জন্যে উঠে পিছন পিছন গেলাম। এতো প্ল্যান প্রোগ্রাম সব কি তাহলে ঘোড়ার ডিম প্রমাণিত হলো?
অনেক দিন পর খুব সুন্দর কিছু দেখে চোখে পানি চলে আসলো। এতোদিন তো দুঃখে আসতো। রিশাদ ভাইয়া ফুপিকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কান্না করছে। আহারে!!! আহারে!!!