ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ১১

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -১১

মেজো ফুপির বাড়িতে আমি বিয়ের দিন ছাড়া কখনও যাই নি। মেহনাজ আপু, তার পর আমাকে নিয়ে ছোট ফুপির বলা কথার জন্যে কোনদিন এই বাড়িতে আসতেও ইচ্ছে করেনি। কিন্তু এখন এটা আমার শশুড়বাড়ি। ইচ্ছে আর অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই এখানে। অবশ্য সাব্বিরের কথামতো বেশিদিন আসতে হবে না এইখানে।

দোতলা বাড়িটা অনেক বড়। বিয়ের দিনতো পুরো বাড়িটা দেখা হয়নি। মেজো ভাইয়া আমাকে দিয়ে চলে গিয়েছে। যাওয়ার আগে অবশ্য আমি এইখানে না এসে আমার বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য ফুপা ফুপির কাছে সরি বলেছে। সবাই কেমন জানি পর পর হয়ে গেছে।

ফুপুদের অবস্থাও আমাদের মতো। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের শশুড়বাড়ি ৩০মিনিট দুরত্বে। কিন্তু এই এই দুরত্বটা বছরে দু একবারের বেশি অতিক্রম করার সময় তাদের হয় না। কিন্তু বছরে তিন থেকে চার বারের বেশি তারা ফরেন ট্রিপ দিয়ে আসেন ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য । রিশাদ ভাইয়া থেকেও নেই। আর সাব্বির যতদিন চিটাগং ছিলো ততোদিন এইখানে আসলে সারাদিন রিতু আপুর এইখানেই থাকতো। আমাদের ভাইবোনদের কে ফুপি ফুপা অনেক বেশি আদর করতেন। সেইজন্য মাঝে মধ্যে ছোট ভাইয়া আর সেজো আপু এসে ফুপির বাসায় থাকতো।

ফুপির রুমে গিয়ে দেখি ফুপি সত্যিই অনেক অসুস্থ। একেবারে বিছানায় পরা। খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রাগে গজগজ করতে করতে বললাম
-নিজের মেয়ে তো আর মনে কর না। করলে তো আগেই ফোন করে বলতে পারতে যে তুমি অসুস্থ, তাই না। আমি না হয় ভুল করে বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি? দুষ্টু মহিলা।
-তুই চলে আসছিস না, এইবার ঠিক সুস্থ হয়ে যাবো।
-বাড়ি ঘর বানাইছো বড় ঠিকই। কিন্তু পুরো জংগল বানাই রাখছো।
-এখন থেকে এটা তোর সংসার। তোর যেভাবে মনে চায় তুই সেভাবে সাজিয়ে নিস।
-আম্মু রিশাদ ভাইয়া কোথায়? এই পর্যন্ত একবারও দেখি নাই।
কথাটা শুনেই ফুপির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। ফুপির কতো কস্ট হয়। এমন হীরের মতো ছেলের জীবনটা নিজের হাতে ধরে শেষ করেছেন বলেই হয়তো।

-আচ্ছা আম্মু উপরতলায় একটা রুম দেখলাম বাইরে থেকে বড় একটা তালা মারা। আবার আর একটা দেখলাম বাইরে থেকে লক করা।
-আর বলিস না। দুটাই রিশাদের রুম।
-উনি দুই রুম দিয়ে করে কি? আর তালা মারা কেন?
-তালা যেটাই মারা সেটাতে আগে থাকতো। রুমে কাউকে ঢুকতে দেয় না। আর যেটা লক করা সেটাতে এখন থাকে মাঝে মাঝে।
-কি বলো! কাউকে ঢুকতে দেয় না? তাহলে রুম পরিস্কার কে করতো।
-কি জানি। রুমের কি অবস্থা সেটা একমাত্র আল্লাহ আর সেই বলতে পারবে।
-তাহলে আমি শিউর যে রুমে আর থাকার মতো অবস্থা নাই তার জন্যে আর এক রুম দখল করছে। আচ্ছা কতদিন ধরে ঢুকতে দেয় না রুমে?
– ৬ বছর।
– ৬ বছর!!!! আমার মুখ হা হয়ে গেলো!!
তোমরা কেউ ঢুকতে চাও নি রুমে?
-যে পরিমাণ চিল্লাচিল্লি করছিলো। এর পর থেকে আর কেউ সাহস করে নাই।
-আম্মু সাব্বির এইখানে থাকে না কেন? সারাদিন রিতু আপুর বাসায় কি? বিয়ে করা বউ রেখে বোনের বাসায় কি?
-রিশাদ একবার সাব্বিরের গায়ে তুলেছিলো।অনেক মেরেছিলো ওরে। এরপর থেকে সাব্বির আর এই বাড়িতে থাকতে চায় না।
-তোমাদের এইটা বাড়ি না সার্কাসখানা? এতো বড় বাড়ি বানাইছো কেন?
– বাড়ি বানানোর সময় কি আর জানতাম এমন যে হবে। তুই এক কাজ করিস ৬টা বাচ্চা কাচ্চা নিবি। সারা ঘর দৌড়াদৌড়ি করবে। তখন আরও মজার মজার সার্কাস হবে।
– মাত্র ৬টা? ধুর আম্মু কি যে বলো না তুমি। আমি তো ভাবছি একটা ফুটবল টিম বানাবো। আর শুনো, বাচ্চা কাচ্চা যা হবে সব কিন্তু তোমাকে বড় করতে হবে। আমাদের ভাইবোনদের বাচ্চা কাচ্চার ঝামেলা দেখে আমি এমনিতেই বিরক্ত হয়ে গেছি।
ফুপি আচ্ছা বলে কি সুন্দর করে হাসতেসে!!!
এই হাসির জন্যে হলেও একটা বাচ্চা পয়দা করতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু যার এই বাড়িতে স্থায়িত্বই আর অল্প কয়দিন, তার আর যাই হোক সংসার করার চিন্তা মাথায় আনা উচিত না।

দুদিনে এই বাড়ির হাব ভাব মোটামুটি বুঝে নিয়েছি। সংসারের কাজ ভালোই পারি। পুরো বাড়িটাকে গুছিয়ে মানুষ বানানো শেষ। শুধু রিশাদ ভাইয়ার রুম থুক্কু ময়লার ভাগাড়টা পরিস্কার করা বাকি। একটু মাইর টাইর না হয় খাইলামই ।আরতো বেশিদিন থাকবো না এইখানে। কিন্তু চাবি ছাড়া ঢুকেবো কি করে। চিন্তা করতে হবে। থিংক মেহের থিংক। ফ্রেন্ডরা বলতো দুনিয়ার যতো আকামের বুদ্ধি সব নাকি আমার মাথায় আছে। আর এইটা তো শুধু রুমে ঢুকতে হবে।

ফুপি এখন মোটামুটি সুস্থ। আমি সারাদিন ফুপির পিছন পিছন ঘুরে বেরাই। মাঝে মাঝে জাপটে ধরি পিছন থেকে। ভালোই লাগে। কেমন জানি আম্মু আম্মু একটা স্মেল পাই। ইচ্ছে করে জড়িয়ে ধরে রাতে ঘুমাই। রুমে তো ফ্লোরে থাকা লাগে। শুরুতে মাঝে মধ্যে খাটে নিয়ে যেতো। কিন্তু এখন সকালে উঠে ফ্লোরেই ঘুমাইতেছি। খাটাইশ সাব্বির।

রিশাদ ভাইয়ার সাথে দেখাই হচ্ছে না। কখন যে রুমে ঢুকে আর বের হয় টেরই পাই না। উনার জন্যে টেবিলে খাবার বারা থাকে সবসময়।কখন খায় আল্লাহ জানে।
আজকে খাবার সব উঠিয়ে রেখেছি। দেখি কি করে এবার।

বিকাল ৪টার দিকে রিশাদ ভাইয়ার আম্মা আম্মা বলে চিৎকারে ছুটে গেলাম। আমাকে দেখে চুপ হয়ে গিয়েছে। ইশ কি সুন্দর হয়েছে দেখতে!! সেই আমি ক্লাস ফাইবে থাকতে লাস্ট দেখেছিলাম। তখন ভাইয়া বুয়েটে চান্স পেয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছিল। কতো আদর করতো আমাকে।আমি আর ভাইয়া মিলে ক্রিকেট খেলতাম, আমের ভর্তা খেতাম, ভাইয়া গাছে উঠে আম চুরি করতো আর আমি নিচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতাম। কত সুন্দর সুন্দর মেমোরি আছে ভাইয়ার সাথে । মেহনাজ আপুর সাথে কি সুন্দর মানাইতো, ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে জিগ্যেস করলাম
-কিছু লাগবে ভাইয়া?
“না কিছু লাগবে না, তুমি যাও ” বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো।
নাহ এতো সহজে তো দমে গেলে চলবে না। আমার সাথে কেনো জানি মনে হচ্ছে রাগ দেখাবে না।

আধাঘন্টা পরে ট্রেতে করে খাবার নিয়ে ভাইয়ার সেই বিখ্যাত রুমের সামনে গিয়ে নক করলাম। ভাইয়া দরজা খুলে আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। আমি উনাকে ঠেলে কিছু বলার আগেই রুমে ঢুকে গেলাম। কিন্তু রুমে ঢুকে বিশ্রী গন্ধকে উপেক্ষা করে চারপাশে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

পুরো রুম জুরে মেহনাজ আপুর ছবি। শুধু আপুর না। সাথে আপুর হাসবেন্ড আর বাচ্চা সহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here