ঝরাপাতার দিনগুলো পর্ব ২৭

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব -২৭

সবচেয়ে আপন জায়গাটা ছিলো এই ক্যাম্পাসটা।
পাঁচ বছর কাটানো এই জায়গাটায় হয়তো আর আসা হবে না!! কত মধুর স্মৃতি, হাসি ঠাট্টা, কান্না, সপ্নগড়ার, সপ্নভাঙার সাক্ষী এই ছোট্ট ক্যাম্পাসটা!!
আপন মানুষগুলোকেও হারিয়েছি এইখানে এসে।
সুন্দর মুহূর্তগুলোর স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতার কস্টের নিচে চাপা পরে গিয়েছে।
সবকিছুকে ছাপিয়ে তাও কেন জানি হৃদয়ের কোথাও
একটা বিদায়ের করুন সুর বাজছে!!!
এই ক্যাম্পাসটা তো এইভাবে ছাড়ার কথা ছিলো না আমার!!!!
এই কথাটা মনে হলে আরোও বেশি কস্ট হচ্ছে।
কাউকেই বিদায় জানাইনি। তাহলে চোখের পানির স্রোত বয়ে যেতো!!
রাতে ২টা বড় বড় লাগেজ নিয়ে সি এনজি করে বের হলাম। রাত ১১.৩০টায় বাস।
সকালে আগে ভাইয়ার বাসায় গেলাম। ডিভোর্সের পর আমার জিনিসগুলো ফুপির বাসায় পরে থাকলে কি লাভ!!
মেজো ভাবি তো আমাকে দেখে একটু পর পর খোচা মেরে কথা বলছে। এখন তো ফয়সালের কথাও জানে। ভাগ্যিস ডিভোর্সের কথা জানে না। তাহলে হয়তো বাসাতেই ঢুকতে দিতো না!!
মেজো ভাইয়া অপরাধির মতো কাচুমাচু করছে। ডিভোর্সের কথা শুনলে কি করতো কে জানে!!
তারাতাড়ি বের হতে হবে। আবার গ্রামের বাড়িতে যেতে হবে তো!!
পিচ্চি পাচ্চা গুলোর জন্যে কিছু নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। এই বাড়িটাতে ঢুকলেই মনটা কেমন শান্ত হয়ে যায়। নিজের বাড়ি বলে হয়তো।
হাহ হা হা!!! নিজের কোনো কিছু বলতে কিছু আছে নাকি আমার!!!! দেখা যাবে কিছুদিন পর হয়তো এইখানেও আসতে পারবো না!!
বড় ভাইয়া আসছে বাড়িতে!!!
যাক একসাথে সবাইকেই দেখে যেতে পারবো।
আমিতো এসেছি আম্মু আব্বুর সাথে দেখা করতে।

আমার বড় ভাইয়া মাটির মানুষ। এই মানুষটার ঋণ আমি সারাজীবন দিয়েও শেষ করতে পারবো না।
বড় ভাইয়া একটা চাবি নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
-যখন মনে চায় এই বাড়িতে চলে আসবি। আমরা বাড়িতে থাকি আর না কি তুই আয়সা পরবি।
মাথা ঝাকিয়ে সায় দিলাম।
-পরশু সকালে আমাদের ফ্লাইট।
-চার জন?
-নাহ, তিনজন।
ভাইয়ার অসহায়ের মতো দৃষ্টিটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই উঠে আম্মু আব্বুর করবের দিকে গেলাম।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলাম ওখানেই। কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। ভাইয়ার ডাকে ঘুম থেকে উঠে উঠে দেখি সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছে।
ভাইয়ার চোখে পানি দেখে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বললাম
-আরে এতো দূরে যাবো, তাই একটু দেখা করতে আসছি।
-ঈদের পরের দিন তুই বাড়িতে আসছিলি তাই না?
ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি দিতে পারিনি।
কারণ উত্তর দিতে গেলেই হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিবো।
চলো বাড়ি যাই, বলেই ভাইয়ার আগে আগে চোখের পানি আড়াল করে চলে এলাম।
রাতে ভাইয়া খাওয়াই দিলো আমাকে। আগে তো ভাইয়ার হাতেই খেতাম। কি জানি কপালে আর আছে কি না এটা!!!
পরের দিন খুব ভোরে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হলাম।

বাসায় যেতেই কানের কাছে ফুপির বকর বকর শুরু হয়ে গেলো!!
কালকে ফ্লাইট, মেয়েটার কোনো আক্কেল বুদ্ধি নাই। এখনো কিচ্ছু গুছায় নাই।
ফুপির কথার যন্ত্রণায় রুমে যেয়ে সব গুছানো শুরু করলাম।
কিছু একটার সাউন্ড পেয়ে পিছন ফিরতেই দেখি সাব্বির।
ব্ল্যাক কালার টি শার্টে এতো বেশি সুন্দর লাগছে ওকে!!! চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো। বার বার ঝাপসা হয়েই যাচ্ছে।
খুব ইচ্ছে ছিলো ওকে খালি গায়ে দেখার। কি কপাল আমার!!! সাড়ে পাঁচ মাস সংসার করেও হাসবেন্ডকে খালি গায়ে দেখতে পারিনি এখনো!!
-আম্মা আব্বা যাচ্ছে বললে না তো একবারও?
-তোমার সাথে আমার কখনো কথা হয়?
-কথা ঘুরাচ্ছ কেনো? তোমার ইচ্ছে ছিলো না সে জন্যে বলতাম না।
এতক্ষণে ওর দিকে ফিরে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বললাম
-আমার কি ইচ্ছে করে সেটা জানতে চেয়েছিলে কোনোদিন? খুব কি দরকার ছিলো এতো ঝামেলা করার?
আরও অনেক কিছু বলার ছিলো ওকে।
একবার ভালোবাসি বললেই হাসতে হাসতে চলে আসতাম তোমার কাছে। ভালোবাসো নাকি অপছন্দ করো বুঝতেই তো পারলাম না কখনো!!
ওকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
বিরক্ত মুখে আমার সামনে থেকে চলে গেলো ও!!
কাকে কি বলবো আমি!! আমার প্রতি যার বিন্দুপরিমাণ ইন্টারেস্ট নাই!!!
একটাই প্রার্থনা করছি মনে মনে। আজকে রাতে যেনো ও এই রুমে না থাকে। তাহলে কি যে করে ফেলবো তার ঠিক নেই!!

সব কিছু লাস্ট চেক করে নিলাম। ফুপিদের কে সব টিকেট আর পাসপোর্ট দিয়ে আসলাম। রিশাদ ভাইয়াও জানুয়ারীর ২০ তারিখ চলে যাবে। অন্যদিনের মতো আজকেও সাব্বির নেই বাসায়। এতোটাই বিরক্ত লাগে আমাকে!!!
আর থাকতে হবে না বাইরে বাইরে। আজকে রাতটায় শুধ।
সন্ধ্যা হতে ছোট ভাইয়া আসলো বাসায়। ওকে নিয়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম।
-কিরে কি হয়েছে বলতো??
অবাক হয়ে বললো।
-সুহা, নুহা আর আয়ানের জন্যে ডিপোজিট করেছি আমি। এই প্যাপার গুলো রাখ তোর কাছে। আমি চলে যাওয়ার পরে দিস।
-তুই এসে দিস। আর এতো টাকা কোথায় পেয়েছিস তুই!!!
-আমার কাবিনের টাকা।
-তো খরচ কেনো করছিস!! আর সাব্বির কই?
-জানি না কই। আমি আসলে ও বাসায় থাকে না।
মাথা নিচু করে বললাম আমি।
-কেনো???
থমথমে গলায় ও বললো।
উঠে গিয়ে সাব্বিরের ড্রয়ার থেকে ডিভোর্স প্যাপারটা নিয়ে আসলাম। বেশি খুজতে হয়নি। সবার উপরেই রাখা ছিলো।
নিচের দিকে তাকিয়ে ওর হাতে দিলাম। চোখ ফেটে পানি আসছে।
-কিছু বলিস না প্লিজ!!! একবার কান্না করা শুরু করলে আর থামাতে পারবো না!!
চোখভর্তি পানি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
ভাইয়া আর কিছু না বলে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমায়।
আমি হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলাম ওকে ধরে।
ছোট ভাইয়াও কাঁদছে!!

অনেক্ষন পর নিজেকে সামলে বললাম ওকে
-আমি মনে হয় অনেক খারাপ তাই না রে!!
সেই ক্লাস সিক্স থেকে বাড়ির বাইরে বাইরে ছিলাম।
এখনো পর্যন্ত বাইরেই। আর এখন ফিরে যাওয়ার জায়গাও নেই আর মানুষও নেই যে কারো কাছে যাবো। জানিস আম্মু আব্বু থাকলে তাদের কাছে চলে যেতাম।
-আমি রাজি ছিলাম না তোর বিয়েতে। রাগ করে তাই ঐ দিনই সাভার চলে গিয়েছিলাম। তোর বিয়েতেও আসিনি।
কিন্তু মামুন ভাই কেনো এটা করলো!!!
-বাদ দে, আমার কপালে ছিলো এমন। আমি আর সাব্বির ছাড়া এখন শুধ তুই জানলি আমাদের ডিভোর্সের কথা।
-কাউকে বলিস নি কেনো? আর সাব্বিরকে তো এতো সহজে আমি ছারবো না!!
-যা করার আমি চলে যাওয়ার পরে করিস। ফুপিরা আগে আসুক তারপর করিস।
-আগে আসুক মানে তুই কই যাবি??
ওকে সব বুঝিয়ে বললাম।

-তুই এতো বড় হয়ে গিয়েছিস বুঝতে পারিনি রে!!
-কি করবো বল? কাউকেই তো পাশে পাইনি।
-তুই আর আসবি না দেশে?
অসহায়ের মতো বললো ও।
-জানি না রে। আমিও তো একটা মানুষ। সব কিছু সামলে নিতে সময় লাগবে। আর এইখানে আসলেই কোনো না কোনো ভাবে এদের সাথে দেখা হয়ে যাবে। কস্টের অতীতটাকে মনে করতে চাই না আমি।
৪ তারিখ কুয়ালালামপুর থেকে সিডনি ফ্লাইট আমার।
কাউকে কিছু বলিস না আমি কোথায় আছি, কেমন আছি, কি করছি এই ব্যাপারে। বাসার কাউকেও না।
-এমন কেনো করছিস বুঝতে পারছি। কিন্তু…
সত্যি কিছু সমাধান নেই এর। এবার তোর যা ভালো লাগে তাই কর। কারো কথা শুনতে হবে না।
-আমি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর ফুপিরা আসলে সবাইকে বলিস। ফুপিরা ব্যাক করবে। আমি করবো না। কালকে ফ্লাইট আমাদের।
-কখন ফ্লাইট? কে যাবে সাথে? সাব্বির যাবে?
-জানি না রে। সাতটায় ফ্লাইট, তুই আসিস একটু!!
-তুই না বললেও আসতাম। আর আমাকে ফাসিয়ে যাচ্ছিস তুই সবকিছু বলার জন্যে!! কস্টের দিন গুলোতেই শুধু আমার কথা মনে হয় তোর!!
ছোট বেলায় তোর মাইরের অর্ধেক খাইতাম আমি।
বিছানায় জায়গা নিয়ে ঝগড়া করতি আমার সাথে!!

শুকনো একটা হাসি দিয়ে বললাম
জানিস সাব্বিরের সাথে এখনো পর্যন্ত এক বিছানায় ঘুমাইনি কোনোদিন!!
ছোট ভাইয়া আর কিছু বলতে পারেনি আমার দিকে তাকিয়ে!! চোখভর্তি পানি নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো শুধু।
ফুপি অনেক্ক্ষণ ধরে দরজায় নক করছে।
দরজা খুলে দিতে ফুপি রুমে ঢুকলো আর ভাইয়া আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো মাথা নিচু করে!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here