ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ২৬

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব-২৬

সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রাতদিন ল্যাবে কাজ করা শুরু করে দিয়েছি। মাস্টার্স শেষ না করতে পারি কিন্তু একটা পেপার তো পাবলিশ করতে পারবো।
এর পরে আর ফয়সাল কথা বলার চেষ্টা করেনি।
হয়তো সবশেষ হয়ে গেছে বুঝতে পেরেছে!!
সাব্বিরের সাথে কথা হয়না প্রায় এক মাস হতে চললো। আজকে নভেম্বরের পঁচিশ তারিখ। আর একমাসের মতো আছি এই দেশে।
ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠলো!!!
আব্বু আম্মুকে সবসময় বলতাম, আমি বিয়ে করে ঘরজামাই নিয়ে তোমাদের সাথে থাকবো। আমি জীবনেও দেশের বাইরে যাবো না। তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না আমি!!
আর আজকে স্বার্থপরের মতো কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি পালাচ্ছি!!!
কিইবা করার আছে আমার। আমিও একটা মানুষ। আমার ভেতর কি চলছে সেটা তো কেউই বুঝবে না, আর বোঝার মতো কেউ নেই!!
আর কিছুদিন এখানে থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যাবো।
সবকিছু থেকে দূরে কিছুদিন দূরে থাকা প্রয়োজন।
এই স্কলারশিপটা না পেলে কি করতাম আমি ডিভোর্সের পর!!! ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে আমার!!
ফয়সালের উপর কতটা ডিপেন্ডেনট ছিলাম আমি!!
ভালো স্টুডেন্ট আমিও ছিলাম। ফার্স্ট সেমিস্টারে ৩.৮০ সিজিপিএ ছিলো আমার!! ফয়সালের সাথে রিলেশন হওয়ার পর সেটা নামতে নামতে ৩.৬৭ এ এসেছে। ভাবতাম ও তো টিচার হয়েই যাবে, না হলে ভালো একটা জব করবে, আমি টিচার হয়ে কি করবো!!
জব পাওয়ার মতো রেজাল্ট থাকলেই তো হলো!
কি গাধি ছিলাম আমি!!!
সবকিছুর জন্যে আল্লাহের শুকরিয়া আদায় করেও শেষ করা যাবে না। এই স্কলারশিপটার জন্যেই হয়তো আমাকে আর কারোর উপর ডিপেন্ডে করতে হবে না।

ক্লাসমেট গুলো খুব ভালো আমার। অন্য ডিপার্ট্মেন্টের হয়েও এতো হেল্প করেছে আমাকে!!ফয়সালের সাথে রিলেশন থাকার সময় কেউই আমার সাথে তেমন মিশতে চাইতো না। ছেলে হলে তো কথাও বলতো না আমার সাথে। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। সারাদিন ওদের সাথেই সময় কাটে। কেউই আর আগের কথা বলে আমাকে অসস্তিতে ফেলতে চায় না। ছেলে গুলো শুধু আফসোস করে বলে, ইশ মেহের তুই যদি আগে আমাদের সাথে এইভাবে মিশতি! ক্লাসের তুই একমাত্র মেয়ে যে কিনা নিঃস্বার্থ আর আমাদের সব কথা গুলোতে পজেটিভ। অল্প সময়ে ওদের উপর খুব মায়া জন্মে গেছে।
ঠিক হলো নেক্সট ইয়ার সবাই কই থাকি আর না থাকি, তাই ডিসেম্বরের থার্ড উইকে মাস্টার্স ফার্স্ট সেমিস্টার ফাইনাল শেষ করে বান্দরবান আর সাজেক মিলিয়ে সাতদিনের একটা ট্যুর দিয়ে আসবো।
ভার্সিটির ট্যুরের উছিলায় এই দুটো জায়গা বাদে চিটাগং এর বাকি সব জায়গা ঘুরা শেষ!!
সেন্ট মার্টিনেও দুইদিনের ট্যুর ছিলো।
তাই লিস্ট থেকে সেন্ট মার্টিন বাদ।
দেখতে দেখতে আমার রিসার্চ, ফাইনাল এক্সাম সব শেষ হয়ে গিয়েছে।
ম্যামের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নিয়েছি। এপ্রিলের লাস্টে এসে সেকেন্ড সেমিস্টারের সব মিড আর ফাইনাল এক্সাম একসাথে দিবো। তাহলে আমার একসাথে ডাবল মাস্টার্স হয়ে যাবে!!!

ফুপিকে ফোন করে ঘুরতে যাওয়ার জন্য পারমিশন চাইলাম।
-তুই সাব্বির থেকে না পারমিশন নিবি।
-আরে তুমি তো আগে দাও। তারপর ওকে ম্যানেজ করছি।
-টাকার দরকার হলে সাব্বিরকে বলিস।
মুচকি হেসে ফোনটা রেখে দিলাম। আমার যে টাকার দরকার হয়, আমি যে একটা মানুষ সেটা কি আর ওর মনে আছে!!!

মেঘের রাজ্য সাজেক সত্যি অনেক সুন্দর!!! এটা নিজ চোখে না দেখলে কারোর বলা কথায় বুঝা সম্ভব না।
নিলিগিরি থাকতেই এজেন্সি থেকে কল এলো। আমার সিডনি যাওয়ার ফ্লাইট ৪ তারিখ কুয়ালালামপুর থেকে।
সবার আগে থাইল্যান্ড, দেন সিঙ্গাপুর তারপর মালয়শিয়া। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ সকালে ফ্লাইট।
সেই হিসেব করলে ট্যুর থেকে যাওয়ার পর চিটাগং এ আমি আর মাত্র দু দিন আছি!!ফুপিকে ফোন করে সব গুছিয়ে নিতে বললাম।

আরেকটা কল এলো সাব্বিরের ফ্রেন্ড শুভ ভাইয়ার কাছ থেকে। আমার পক্ষ থেকে ডিভোর্স এ কোনো অব্জেকশন আছে কি না। বার বার আমাকে রিকুয়েষ্ট করলেন যেনো আমি রাজি না হয়।
কিন্তু যার থাকার কথা সেই যখন থাকতে চাইছে না, আমি আর একতরফা ভাবে কিভাবে থাকবো!!

খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ বাকি এখনো!!
সাজেক থেকে এসে রাতে ফয়সালকে ফোন করলাম।
– কি ব্যাপার!!! তুমি আমাকে কল দিয়েছ!!!
-একটু দরকার ছিলো ফয়সাল। কালকে দেখা করতে পারবে?
-আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না, তুমি আমাকে দেখা করতে বলছো!! আমার তো রাতে ঘুমই আসবে না!!
-ঘুমাও, ঘুমাও। না হলে সকালে ঘুমের জন্য দেখা করতে পারবে না। আগে যেটা করতা আর কি।
আর আমি পরশু রাতে ঢাকা চলে যাচ্ছি।
-এমন করে বলছো যেন আর আসবে না চিটাগং!!!
অনেকটা এমনই ফয়সাল, মনে মনে বললাম আমি।
-নাহ, পড়াশোনা শেষ করতে হবে না?
-এতো পড়ে কি করবে তুমি?
– এতো পড়াশোনা করি নাই বলেই তো খুব সহজে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছ তাই না? আজকে টিচার হওয়ার মতো সিজিপিএ থাকলে কি আর ভালোবাসা নিয়ে এমন জুয়া খেলতে পারতে!!!!
যাই হোক কালকে KGN রেস্টুরেন্টে চলে এসো।
বলেই ফোন কেটে দিলাম।
এই রেস্টুরেন্টেই আমি আর প্রথম অফিসিয়ালি দেখা করেছিলাম!!! আর এইখানেই অফিসিয়ালি লাস্ট দেখা করবো কালকে।

ছোট ভাইয়াকে কল করলাম। আব্বু মারা যাওয়ার পর প্রথম ওকে কল দিলাম।
-কিরে ভুল করে কল দিছিস নাকি????
-হুম।
-কি হয়েছে বাবু? উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো ও।
এই একটাই মানুষ আছে, যাকে আমি যাওয়ার আগে সব কিছু বলে যেতে পারি। এবং আমি জানি সব কিছু ও সামলে নিবে।
-কিছু না রে। ভাই, ২১ তারিখে তুই একটু বাসায় আসতে পারবি?
-নাহ, পারবো না।
বলেই ফোন কেটে দিলো
কিন্তু আমি জানি ও ঠিকই আসবে।
সব কিছু গোছগাছ করে লকারে ঢুকালাম। ভাগ্যিস জেনি বাসায় চলে গিয়েছে। না হলে ঠিক বুঝে যেতো যে আমি একেবারে চলে যাচ্ছি!!
অর্ধেকের বেশি জিনিস আর ড্রেস নিচের গার্ডে থাকা আপাদের দিয়ে দিলাম। সবই তো ফয়সাল কিনে দিয়েছে!!!
এতো জিনিস কেনো আমার!!
আমি নিজেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। পুরো ছোটখাটো সংসার একটা!! কি নেই এখানে!!
হল লাইফে কেউ কখনো ফ্রাই পেন, পোর্টেবল ব্লেন্ডার, হ্যান্ড মিক্সার,ছোট একটা আর এফ এল ওয়াড্রোব এতো কিছু একসাথে ইউজ করেছে!!!
এই সব কিছু তো আমার আর ফয়সালের সংসারের জন্যে একেবারে কিনেছিলাম। ভাবতেই কান্না চলে আসছে!!!

ফয়সাল আর আমি সামনা সামনি বসে আছি। ওর চুল গুলো কেমন উস্কোখুশকো আর চেহারা মলিন হয়ে আছে। অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। অপরাধবোধ চেহারায় স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
-কি হতো ফয়সাল টিচার না হলে!! আমি কি তোমাকে ছেড়ে যেতাম!!
ফয়সাল চুপ হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
আজকের পর তোমার আর আমার মনে হয় দেখা হবে না কখনো। চিটাগং এ আমি আর আসবো না। ঠিকই বলছো, পড়াশোনা করে কি করতে পেরেছি জীবনে!!
-শাস্তি দিচ্ছো আমাকে তাই না? আমরা আবার এক হতে পারি না মেহের!!!! প্লিজ মেহের, প্লিজ!!!
-সাব্বির সম্পর্কে তুমি তো সবই জানতে ফয়সাল, আমার এমন কোনো বিষয় নেই যা তোমার অজানা।
তারপরও তুমি এটা কিভাবে করতে পারলে!!!!

আমার কথা শুনে ফয়সাল আমার পায়ের কাছে বসে পরলো। আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না ওর!!!!! চোখ থেকে পানি আমারও পরছে।
কিন্তু ওর জন্যে কেনো জানি একটুও মায়া হচ্ছে না!!
রেস্টুরেন্টের সব মানুষ হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে!!!
অনেক্ষন পর ও নিজেই ঠিক হয়ে বসলো। হয়তো বুঝতে পেরেছে কোনো কিছুই আর আগের মতো ঠিক হবে না!!
-ফয়সাল কিছু সত্যি কথা বলবে আমাকে?? সাব্বির যে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়ছে বললাম না আমি। তাহলে পাগলামি শুরু করবে আবার।
ও মাথা ঝাকিয়ে জিগ্যেস করতে বললো।
তোমাকে সাব্বির কি বলেছিলো ঠিক একটু বলবে প্লিজ!!!!
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মাথা নিচু ও বলতে শুরু করলো
-তোমার আর সাব্বিরকে নিয়ে একটা সন্দেহ আমার মনের মধ্যে ছিলো সবসময়। হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে তো আরও বেশি। তোমার ছোটবেলার কাহিনী আমি সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম, তাই হয়তো।
প্রায় আট মাস আগে হঠাৎ সাব্বির আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে।
তারপর বলে যে তোমাদের মাঝে নাকি রিলেশন চলছে।
-আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে!!
কেনো ফয়সাল!!!! আমাকে একটা বার কিছু জানানোর দরকার মনে করলে না!!!
-তুমি আমার তুলনায় অনেক ভালো ছেলে ডিজার্ভ করো মেহের, এই হিনমন্যতায় সবসময় ভুগতাম আমি। তার উপর ভালো একটা জবও পাচ্ছিলাম না।
-তারপর বলো।
এই পাঁচ বছর কার সাথে রিলেশন ছিলো আমার!!!
-তারপর তো সবই জানো তুমি।
-তারপর আমি কি জানি!!! আমি কিছুই জানি না ফয়সাল!! বলো প্লিজ!!
-ও নিজে থেকেই আমাকে টিচার হওয়ার জন্যে সুযোগ করে দিলো।
-বিনিময়ে আমাকে চাইলো?
-না, সেরকম কিছু কখনোই বলেনি!! ও বললো আমরা যেনো অনেক সুখি হই!!
আমি হা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম!!! তাহলে এতোদিন আমি কি জানতাম!!!
তোমাকে এই কথা কে বললো?
-কেউ না।এর পর কি হয়েছে সেটা বলো।
-সাব্বির আমাকে বলেছিলো যেনো তোমার জন্মদিনে তোমাকে এপয়েনট লেটার গিফট হিসেবে দেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো দোষটা আমার মেহের।
বাসায় আমি টিচার হতে পারবো শুনে অনেক খুশি হয়েছিলো। আমার ছোট খালা চেয়েছিলো তার মেয়েকে যেনো আমি বিয়ে করি। বাসার সবাইও তাই চেয়েছিলো।
-তুমি এই কথা কখনোও আমাকে বলো নাই ফয়সাল!!!
অবাক হয়ে গেলাম আমি!!
-তোমার আব্বু মারা গিয়েছিলো তখন। এমনিতেই তুমি মেন্টালি প্রেসারে ছিলে।
-এখন তো অনেক সুখে আছি তাই না?
আর এরপর তুমি আমার সাথে ব্রেকাপ করে ফেললে তাই তো?
মাথা নিচু করে ফেললো ও।
-তোমার আম্মু মারা যাওয়ার পর আমার বাসা থেকে তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে মানা করে দিয়েছিলো।
যদি তোমাকে বিয়ে করি তাহলে আলাদা যেনো থাকি।
এরপর বাসায় ঝগড়া করে বাসা থেকে চলে আসি আর তোমার সাথেও ব্রেকাপ হয়ে যায়। কিন্তু বুঝতে পারিনি এবারের ব্রেকাপটা সিরিয়াস হয়ে যাবে।
কিন্তু সাব্বির তোমাকে কেনো বিয়ে করলো আমি জানি না!!!
হয়তো আমার চেয়েও ভালোবাসে তোমাকে। কিন্তু ও তোমাকে কেনো জানি সহ্য করতে পারে না।

ওর কথা শুনে মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছে আমার।
ফয়সাল সব সত্যি কথা বলেনি। সাব্বির ওকে ফোন করেনি, ফয়সাল ফোন করেছিলো সাব্বিরকে!!
এই মানুষটার সাথে আমার জীবনের পাঁচটা বছর নষ্ট করেছি!!! নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে খুব!!
ফয়সাল ফোন করার পর পরই সাব্বির প্রিমাকে ফোন করে আমাদের ব্যাপারে খোজ খবর নিয়েছিলো।
তবে লাস্ট কথাটা হয়তো সত্যি। ভালোবাসে কিন্তু সহ্য করতে পারে না। তার জন্যেই বোধহয় ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে!!
কান্না আসছে খুব, না সাব্বির, না ফয়সাল কেউই কোনোদিন ভালোবাসে নি আমায়!!
শান্ত গলায় বললাম আমি, সবার আগে ফোনটা তুমিই করেছিলে ফয়সাল, গাছের উপরের আর তলার দুটোই চেয়েছিলে তুমি!!! ফোন নাম্বারটাও নিশ্চয়ই আমার মোবাইল থেকে নিয়েছিলে!!
বলেই উল্টো দিকে ফিরে হাটা শুরু করলাম।
আল্লাহ এই বিশ্বাসঘাতকটার সাথে যেনো আর দেখা না হয়!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here