#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩১তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
রাত প্রায় বারোটা, ফাহিম অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে। ম্যানেজার হিসেবে প্রায় মিটিংয়েই তাকে উপস্থিত থাকতে হয়। আজকেও একটা ভিনদেশী কোম্পানির সাথে মিটিং ছিল, ডিনারটাও সেখানেই সেরে এসেছে।
ফাহিমের গাড়িতে গান চলেছে,
পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি
সোজা পথের ধাঁধাঁয় আমি অনেক ধেঁধেছি
পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে
নয়ন মেলে পাবার আশায় অনেক কেঁদেছি
এই নয়নে পাব বলেই নয়ন মুদেছি…
(পথ হারাবো বলেই- হেমন্ত কুমার)
গানটার যেন ফাহিমের হৃদয়ের কথা বলছে। তার চোখে-মুখে অবিরাম আকুতি। কীসের আকুতি কে জানে? সে তো প্রিয়মানুষের থেকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, লয়ালটি বা আনুগত্য সবই পেতে ব্যর্থ।
হুট করেই গাড়ির ডান পাশের আয়নাতে খেয়াল করতেই দেখল একজন শাড়ি পরিহিতা মেয়ে তার গাড়ির পিছু পিছু ছুটছে। দ্রুত ব্রেক কষে সে। ততক্ষণে মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে।
ফাহিম সিটবেল্ট খোলে মেয়েটাকে যেয়ে ধরে। কিন্তু দেখতে পায় চেতনাহীন হয়ে পড়ে আছে সে। তবুও নিজের ব্যাগটাকে বেশ সামলে ধরেছে।
“ঐ শালা! এই মাইয়ারে ছাইড়া দে। আজকে রাইতের লিগা এই মেয়ে আমগো।”
কারো নেশাযুক্ত কণ্ঠে এই কথা শুনে মাথা ঘুরায় ফাহিম। দেখতে পায় দূর থেকে একঝাঁক নেশাখোর ঢুলু ঢুলু পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারে মেয়েটি সাহায্য চাইতেই তার গাড়ির পিছু পিছু ছুটছিল।
ফাহিম দ্রুত ব্যাগ সহ মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়। তাড়াহুড়ায় মেয়েটাকে কোলে নেওয়া অবস্থাতেই গাড়ি চালু করে। কিছু দূর যেয়ে বিপদমুক্ত হয়ে ফাহিম গাড়ি থামায়। মেয়েটাকে নিজের পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে পায়ের নিচে রাখা পানির বোতল বের করে পানির ছিটে দেয় মুখে।
তার প্রচেষ্টা সফল হয় আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরে মেয়েটির। মিটমিট করে চোখ খুলে তাকায় মেয়েটি। বিমোহিত হয় ফাহিম। কী ডাগর চোখ যুবতি! কোনো কবি সম্মুখে থাকলে নির্ঘাত বলে উঠতেন,
‘এলোকেশী কন্যা সে যে,
ডাগর ডাগর চোখ,
চাহনিতে বিজলি থাকে,
এমনই তার রূপ।’
ফাহিমকে এত কাছে দেখে ঘাবড়ে যায় মেয়েটি। মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দেয় তাকে। যুবকেরও ঘোর ভাঙে। ইতঃস্তত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি ঠিক আছেন না কি হাসপাতালে নিতে হবে?”
“জী, ঠিক আছি।”
“ভুল ভাবে নিবেন না। এত রাত করে বাড়ির বাহিরে বের হওয়া ঠিক না। ইট’স্ নট সেফ। যাই হোক, আপনাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। ঠিকানা বলুন।”
শেষ দুই বাক্য শ্রবণগত হতেই কেমন একটা ত্রাস লক্ষণীয় হয় যুবতীর চোখে-মুখে। দ্রুত নিজ শাড়ির আঁচলে মুখশ্রী মুছতে মুছতে বলে,
“না, না, আমি কোথাও যাব না। আসলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। ফিরে যাওয়া অসম্ভব।”
“মানে? পালিয়েছেন কেন? বিয়ে-প্রেম টাইপের কেস না কি?”
“তা হবে কেন? দুই মাস পরই আমার ফ্লাইটের ডেট। আমি কানাডার একটা ভার্সিটি ফুল স্কলারশিপে পড়ার চান্স পেয়েছি। কিন্তু আমার বাবা আমাকে এক টাকলা বিসিএস ক্যাডারের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাই…”
“বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এখন যাবেন কই?”
“আসলে আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোনো লজ বা গার্লস্ হোস্টেলে যদি থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন।”
অত্যন্ত অসহায় কণ্ঠ মেয়েটির। সহানুভূতিই বোধ হয় ফাহিমের।
“এখন তো হোস্টেল খোলা থাকবে না। আর একা মেয়ে লজে উঠা সেফও হবে না। আপনার কোনো অসুবিধা না হলে আজ রাতটা আমার বাসায় থাকতে পারেন। আমি, আমার মা আর আমার খালা থাকি।”
অজানা মেয়েটি বেশ খাণেক ক্ষণ খোশামোদী করেও রাজি হয়ে গেল। হয়তো উপায়হীন বলেই অচেনা এক পুরুষকে বিশ্বাস করল।
ফাহিম পুনরায় গাড়ি স্টার্ট করল। চালাতে চালাতে মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করল।
মেয়েটি এক শব্দে উত্তর দিল, “পূর্ণতা”।
এরপর আর কোনো কথা হয় না তাদের মাঝে। নিঝুম রাতে এয়ারপোর্ট গামী নিস্তব্ধ রোডে একজোড়া নরনারীর যাত্রা চলমান। কে জানে কোথায় এই যাত্রার সমাপ্তি।
___
“ছোটো মালকিন! ছোটো মালকিন! আপনার সাথে কারা যেন দেখা করতে এসেছে!”
একজন গৃহপরিচারিকার ডাক শুনে ওড়না দিয়ে দেহ ও মাথা আবৃত করে নিচে নামে বাসন্তী। বিরক্তির সুরে শুধায়,
“কোন মন্ত্রী-আমলা এসেছে যে এত জোরে জোরে ডাকছো! এমনিতেই নাহিবাকে কত ঝড়-ঝাপটা পেড়িয়ে ঘুম পারালাম, যদি উঠে যেত তবে…”
কথাগুলো বলতে বলতেই সোফার সম্মুখে দাঁড়ায় বাসন্তী। অতি পরিচিত এক খানা চেহারা চোখের সামনে স্পষ্ট হতেই থমকে যায় সে। আপনমনেই অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
“ম-মা?”
হ্যাঁ, বাসন্তীর মা বদরুন্নেসা দাঁড়িয়ে। পাশে তার বড় মামা মীর উদ্দীনও বসে। এতটা সময় পর মাকে দেখে কিছুটা আবেগপ্রবণই হয়ে পড়ে বাসন্তী। মায়ের উপর শত রাগ থাকুক, বাস্তবতা তো এটাই এই নারীটি তার গর্ভধারিণী।
সে ভাবে,
– নিশ্চিত তার কথা মামার কাছে শুনেই তাকে দেখতে ছুটে এসেছে মা! তাকে নিশ্চয়ই এখন বুকে আগলে মমতার ছোঁয়া সিক্ত করে নিবে। সেও কিছুটা অভিমান করব, পরে ঠিকই জড়িয়ে ধরবে মাকে।
কিন্তু না এমন কিছুই হলো না। বরং, বদরুন্নেসা গম্ভীর গলায় বললেন,
“কী শুনি এইসব বাসন্তী? তুই না কি বড় ভাই রে পার্টির থেকা বাইর কইরা দিতাসোস? আমগো মান-ইজ্জত ডুবায়া আরেক পোলার হাত ধইরা পলায়াও তোর মনে শান্তি লাগে নাই? এহন আরও ধ্বংস করতে চাস!”
বিধ্বস্ত হয় বাসন্তীর হৃদয়। মনে মনে বলে, “মানষ কোনোদিন বদলায় না”। তবে চেহারায় এই হতাশার রেশ মাত্রও আনে না। বরং, অত্যন্ত রাজকীয় ভঙ্গিমায় পায়ে পা তুলে তাদের সামনের সোফায় বসে।
“সরি, কে আপনি? আর আপনার সাহস কী করে হয় আমাকে তুই বলে সম্বোধন করার বা আমার সাথে এভাবে কথা বলার? বয়সও বড় বলে এই ভুল ক্ষমা করলাম। তবে দ্বিতীয় বার এই ভুল করার ভুল করবেন না। নাহলে পুরো পরিবার সুদ্ধ রাস্তায় নামানোর ব্যবস্থা করব। এটা যে আমার রাজ্য সেটা মাথায় ভালো মতোন ঢুকিয়ে নিন।”
“বেয়াদব মেয়েলোক কোথাকার! নিজের মামা-মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছিস!”
“মামা কে? মা কে? আমার মা তো আমি ছোটো থাকতেই মারা গেছে, সাথে আমার মায়ের চৌদ্দ গোষ্ঠীও। আর হ্যাঁ, আপনারা আসলে কথা শোনার মানুষ না। সিকিউরিটি! সিকিউরিটি! এদের ঘাড় ধরে বের করো! আর মি. মীর উদ্দীন আপনার এইবারের টিকেট তো আমি ক্যান্সেল করবই৷ এন্ড আই উইল মেক শিউর আপনি বেঁচে থাকতে আর কোনোদিনই রাজনীতিতে যোগ না দিতে পারেন।”
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কথাগুলো বলেই হনহন করে নিজের বেডরুমে চলে যায় সে। বদরুন্নেসা ও মীর উদ্দীনকেও আদেশ অনুযায়ী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় গার্ডরা।
বাসন্তী ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। দরজায় গা ঠেকিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“কেন আমাকে কেউ একটুও ভালোবাসে না? একটুও প্রাধান্য দেয় না কেন? আমার নিজের মায়ের কাছেও আমার কোনো মূল্য নেই! তার কাছে আজও তার ভাই-বোনই বড়। আমার প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া তার নেই৷
আমি ভেবেছিলাম এত বছর আমি নেই তার কাছে, একটু তো মায়ার সৃষ্টি হবে। আমার প্রতি ভালোবাসা না হোক, কিছুটা মমত্ব তো জাগবে। কিন্তু না! তেমন কিছুই হয়নি! মানুষ কখনোই বদলায় না।
যারা কষ্ট দিয়ে এসেছে, তারা সদাই কষ্ট দিবে। ভালোবাসা দেখালে তা শুধুই বানোয়াট, অভিনয়। যেমন অভিনয় করেছে নায়িম। যেমন অবহেলা করেছে মা। কাউকে ক্ষমা করব না আমি। কাউকে না! আমি ঘৃণা করি, সবাইকে ঘৃণা করি।”
___
নায়িম এক মনে বাসন্তী ও নাহিবার ছবিগুলো দেখছে। তার মুখশ্রী গম্ভীর ও হাসির ছোঁয়া মুক্ত।
আনমনেই বিড়বিড়ায় সে,
“কতোটা অভিমান জমিয়েছো বুকের কোণে?
তার চেয়ে দ্বিগুণ প্রণয়ের বীজ বুনব আমি,
প্রণয়ের তরুলতার শীতল ছায়ায় অভিমানের শুষ্কতা কাটাবো আমি।”
অনিমেষ পাশেই বসেছিল। নায়িনের কথা শুনে তার মুখশ্রীতে স্মিত হাসি ফুটে।
আবেগপ্রবণ গলায় সে বলে,
“হায়! কবে যে আমি প্রেমে পড়ব! প্রেয়সীর ভালোবাসার নেশায় ডুবে কবি হব।”
“রাসেল ভাইও জানে তোর কপালে প্রেম নেই রে মগা। তোর কপালে প্রেম নেই।”
বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গু নায়িমের। হয়তো বন্ধুকে হেনেস্তা করার প্রচেষ্টা।
“তুই আগে নিজের চিন্তা কর। তোর কি মনে হয় ভাবীর কাছ থেকে ক্ষমা পাবি এতসব হওয়ার পর?”
“জানি তো। যতটা করেছি আমি, যতটা সয়েছে সে, তারপরও শূণ্য থলি দিলে কে-ই বা করবে ক্ষমা?”
“তার মানে কি তুই ভাবীর কাছে ক্ষমা চাবি না?”
“আমি অনুতাপ বোধ করেছি, অনুতপ্ত আমি। ক্ষমা চাইব। ক্ষীণ আশা আছে ক্ষমা পাব। তবে না করলেও অভিযোগ নেই। দিনশেষে আমি অন্যায় করেছি বসন্তের প্রতি, আমি ক্ষমার যোগ্য কি না তা বিচার করার অধিকারও একান্তই তার। এতে ফরমায়েশি করার জো নেই আমার।”
কী একটা ভেবেই যেন বোকা বোকা হেসে অনিমেষ শুধায়,
“আমি কী বলি শোন? দেশে যাওয়ার পর ভাবী না চাইলেও তাকে জোর করে নিজের সাথে সাথে রাখবি, তবে মান-অভিমান সব ভুলে আবারও তোর প্রতি আসক্ত ও অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। ঐ যে গল্প-নাটকে তো এমনই করে নায়করা।”
“ভালোবাসাকে লালন করতে হয় জলের মতো। তাকে মুঠোবন্দী করে আটকে নয়, দুই হাতে আগলে রাখতে হয়। নাহলে তা বিলীন হয়ে যায়।”
গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় বলল নায়িম।
“মানে তুই এমন কিছু করবি না? তাহলে…?”
“ও জীবনে কিছুই নিজ ইচ্ছানুযায়ী করতে পারেনি। আমি সবসময়ই নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে আসছি ওর উপর। এখন যেহেতু নিজের মতোন থাকতে চাচ্ছে, তাতে দখলদারি না করলেই নয়। আমি ক্ষমা চাইব ওর কাছে আমার কর্মের জন্য। আল্লাহর কাছেও ক্ষমা চাব, দোয়া করব ওর মন জয় করার।
যদি মৃত্যুর পূর্বে কোনোদিন ওর তিক্ততার বরফ আমার প্রণয়ের উষ্ণতায় গলাতে পারি, তাতেই সই… তবে ওর ইচ্ছেকে আমি কখনোই দাবাবো না, যথাসাধ্য সম্মান দিব। বাকিটা ওর ইচ্ছে আর আল্লাহ যা কপালে রেখেছে। জোরাজুরি কখনোই করব না। কারণ জোরাজুরি করে কাজ সম্পাদন করানো যায়, ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
ভালোবাসা আর ক্ষমা উভয়ই মনের অধীনস্থ, আর মনের উপর জোর-জবরদস্তি চলে না।”
চলবে…
(বিঃদ্রঃ অধিকাংশের আশা ছিল নায়িম বাসন্তী বাঁচানোর জন্য ওসব বলেছে। আমি প্রথম থেকেই প্লটটাকে এবং প্রতিটি চরিত্রকে খুব স্বচ্ছ, raw রেখেছি। কোনো চরিত্রকেই জাস্টিফাই করার চেষ্টা করিনি। আমার মনে হয়েছে ঐরকমটা নায়িমের চরিত্রের সাথে যায় না এবং হলে নায়িমের ক্যারেক্টারকে হোয়াইট ওয়াশ বা যুক্তিহীন ভাবে ভালো বানানোর চেষ্টা করা হয়ে যেতে। আবার অতিরিক্ত নাটকীয়তাও হয়ে যেতো বটে।)
ছবিয়ালঃ @Jannatul Ferdouse