#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১০)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________
কেটেছে প্রায় ১ সপ্তাহের মতো। আজ তীব্রর নানুরা সবাই চলে যাবে। আমরাও যেতাম কিন্তু তীব্র কাল রাতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে না যাওয়ার জন্য। নানুরা কেউই এতোদিন থাকতে চাননি শুধুমাত্র আমার অসুস্থতার জন্যই থেকে গেছেন। এই ক’দিনেই মোটামুটি অসুস্থ ছিলাম। অদ্ভুত ভাবে সেদিনের পর তীব্র আর আমার সাথে কথা বলেননি। সকালে বের হতেন আর আসতেন গভীর রাতে। একই বিছানায় ঘুমালেও দুজনের দূরত্ব ছিলো অনেকটা। আমাকে ছুঁয়ে দেখা তো দুর আমার দিকেও তাকান না ঠিকমতো। সেদিন তীব্রর সাথে খারাপ বিহেভের পর যখন তিহার কথাগুলো শুনলাম তখন থেকেই আমার মাথা যেনো ফাঁকা হয়ে আছে৷ মাথার মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন কিলবিল করছে। যতবারই তীব্রর সাথে কথা বলতে গেছি ততবারই সে আমাকে সন্তর্পণে ইগনোর করে চলে গেছে। সবসময় হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়-ই পাই না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিহার কাপড় গোছানো শুরু করলাম৷ তিহা মন খারাপ করে বলে,
‘ভাবী চলো না! তোমরা না গেলে আমার একা ভালো লাগবে না।’
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘তুমি যাও না! মিলি, তানহা, বিপ্লব, মুন্না সবাই তো আছে। আর কোন আপুর যেনো বিয়ে উনিও তো আছে! সবাই অনেক ইনজয় করো।’
মুন্না ‘চ’ এর মতো করে শব্দ করে। এরপর আফসোসের সুরে বলে, ‘মিস করলেন ভাবী। অনেক কিছু মিস করলেন।’
ওর কথার ধরনে আমি হেঁসে ফেললাম। বিপ্লব খুবই শান্ত স্বভাবের। এতোগুলো দিনে ছেলেটাকে খুব কম কথা বলতে দেখেছি। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি খুব একটা কথা বলো না বিপ্লব! সবসময় চুপ করেই থাকো?’
ছেলেটা বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকালো। পিটপিট করে তাকিয়ে বললো, ‘আমার বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না ভাবী।’
পাশ থেকে মিলি বললো, ‘ওটা পড়াকু ছেলে বুঝছো! ওর আম্মু কি যে জোড় করে পাঠিয়েছে তা যদি জানতে!’
মুন্না এ কথায় যেনো মজার কোনো টপিক পেলো। তাই সে আগ্রহ নিয়ে লাফিয়ে এসে বললো, ‘আসার দিন কি হয়ছে জানেন ভাবী! আম্মু ওরে…’
এটুকু বলতেই বিপ্লব ওর মুখ চেপে ধরে। রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু মুন্না ধস্তাধস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে পুরো রুমে দৌড়াতে দৌড়াতে একদমে বললো, ‘ওরে আম্মু বলছে, ‘তোমার ফুপু বাড়ি থেকে ঘুরে আসো।’ কিন্তু আমার ভাই তো আসতে নারাজ। সে আসবে না বলে সেই জিদ ধরে বসে আছে৷ আম্মুও তো ছাড়ার পাত্র না। শেষে যখন দেখে না তার আসতেই হবে তখন বাথরুমের দরজা আটকে বসে ছিলো। বলে, ‘সবাই ফুপু বাড়িতে চলে গেলে সে বের হবে নয়তো ওখানেই আজীবন থাকবে। সেখানেই নাকি সে সন্ন্যাস নিয়ে ধ্যানে বসবে।’
বিপ্লব বার বার নিষেধ করে দেওয়া স্বত্বেও যখন দেখলো মুন্না সব বলে দিয়েছে তখন সে গাল ফুলিয়ে বসলো। পুরো রুমে হাসাহাসির ঝংকার উঠে গেছে। আমাদের হাসাহাসির মধ্যেই দরজায় নক পড়লো। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম তীব্র দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত উনার কাছে আসতেই উনি অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,
‘নিজের লাগেজ গুছিয়ে নাও। আমরা যাচ্ছি সিলেট।’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলেন। পেছন থেকে তিহা বললো, ‘ভাইয়া না কালই বললো তোমরা যাবে না ওখানে। তাহলে হঠাৎ?’
আমি জবাব দিলাম না। মুখভঙ্গিতেই বুঝালাম ‘জানি না’। এরপর রুম থেকে বের হয়ে আমাদের রুমে আসলাম। তীব্র নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। উনি নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। আমি কয়েকবার গলা পরিষ্কার করে আমতা আমতা করে বললাম,
‘আমি করে দেই?’
উনি জবাব দিলেন না। এমন ভাব ধরলেন যেনো শুনতেই পাননি। আমার ভীষণ রাগ হলো। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বড় করে শ্বাস নিলাম। উনাকে ফের প্রশ্ন করলাম,
‘কাল না বললেন যাবেন না! তাহলে আজ হঠাৎ রাজি হয়ে গেলেন যে?’
উনি নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েই দু শব্দে বললেন, ‘কাজ আছে।’
ব্যাস। আর কোনো কথা নেই। এরপর আমিও আর কথা বাড়ালাম না। যে কথা বলতে চায় না তার সাথে জোড় করে কিভাবে কথা বলবো! বুকের পাশে হালকা চিনচিনে অনুভূতি নিয়েই নিজের সব গুছিয়ে নিলাম। ট্রেন প্রায় রাত ১০ টায় তাই এখন আর রেডি হলাম না।
______
ঠান্ডা বাতাসে গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। শা শা করে ছুটে চলেছে ট্রেন। গায়ের শালটা ভালোভাবে নিজের সাথে পেঁচিয়ে নিলাম। হিজাবের জন্য যদিও তেমন ঠান্ডা লাগছে না তবুও খানিক বাদে বাদেই কেঁপে উঠছি৷ পাশেই তীব্র চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে আছে। সামনে তিহা আর তানহা বসেছে। তানহার দৃষ্টি তীব্রর দিকে । মেয়েটাকে দেখলেই কেমন জানি রাগে গা জ্বলে। অন্যের বরের দিকে এমন করে তাকানোর কোনো মানে আছে! আমি পাশ ফিরে তীব্রর দিকে তাকালাম। তীব্র তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। তিহাও কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে আছে। আমি এই সুযোগে তীব্রর শার্টের এক কোণা চেপে ধরে টান দিলাম। তীব্র ভ্রু কুঁচকে চোখ মেলে তাকায়। কপালের ভাজ দৃঢ় করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললাম,
‘আমি ঘুমাবো।’
উনি গম্ভীর স্বরে আওড়ালেন, ‘ঘুমাও।’
আমি সাথে সাথে উনার বুকে মাথা গুজে দিলাম। লোকটা এতো লম্বা কেন! কাপলরা কি সুন্দর করে ঘাড়ে মাথা রাখে আর আমি তাকে নাগালেই পাই না। টানটান হয়ে বুক ফুলিয়ে থাকলে তাকে নাগালে কেমনে পাবো! বুকে মুখ গুঁজে দেওয়ায় আমার নিজেরই সর্বাঙ্গ যেনো কেঁপে উঠলো। তানহার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। আমি ঠোঁট চেপে হেঁসে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আচ্ছা এখন কি তীব্রর মুখটাও তানহার মতো হা হয়ে গেছে! ভেবেই অনেক হাসি পেলো। তীব্র সরালেন না আমায়৷ হয়তো তানহা সামনে বসে আছে বলেই উনি আমাকে সরালেন না। আমাদের মধ্যে যায়-ই হোক তা তানহা অব্দি যেনো না পৌঁছে এজন্যই তিনিও সন্তর্পণে জড়িয়ে ধরলেন। অজানা অনুভূতিতে কেঁপে উঠলাম। চোখ পিটপিট করে মুখ গুঁজে পড়ে রইলাম। হঠাৎ করেই মনে কড়া নাড়লো এক অদ্ভুত প্রশ্ন,
‘আমি কি তীব্রর প্রতি কোনো অনুভূতিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি? তীব্রর বলা সেই প্রথমদিনের বাক্যর মতো কি তাকে পু’ড়াতে এসে নিজে পু’ড়ে যাচ্ছি! তীব্রর প্রেমের নেশায় কি ডুবে যাচ্ছি? যদি এগুলোর উত্তর না হয় তবে কেনো এতো অদ্ভুত টান আমার? কেনো তার নীরবতায় আমি এতো অস্থির অনুভব করি? কেনো তানহা তার দিকে তাকালে আমার হিংসা হয়? কেনো এই মানুষটার বুকে মাথা রেখে এতো প্রশান্তি অনুভব করছি? কেনো রাতের পর রাত তার মুখ দেখতে আমার একটুও বিরক্ত লাগে না? কিন্তু সবশেষে যদি আমার সব প্রশ্নের উত্তর হয় ‘আমি তীব্রকে ভালোবাসি!’ তবে কি এটা আদৌও সম্ভব! যে মানুষটাকে আমি ঘৃ’ণা করে এসেছি এতগুলো দিন, যাকে আমি রে’পি’ষ্ট, খুনী বলে মেনেছি তাকে কি আদৌও আমার পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব নাকি এগুলো সবই আমার সাময়িক মোহ!’
প্রশ্ন আছে তবে কোনো উত্তর পেলাম না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাপ্টে ধরে রইলাম তীব্রকে। আজ ভীষণ করে চাইলাম, ‘তীব্র যেনো একদম নির্দোষ হয়। জিনিয়ার সবগুলো কথা যেনো তীব্র আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। এই সত্য মিথ্যার খেলায় হয়তো হেরে যাবো তবুও তীব্র জিতুক। তীব্র সত্যি নির্দোষ প্রমাণ হোক।’
পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে গেলো। আমি পুরোটা রাস্তা তীব্রর বুকে মাথা রেখেই এসেছি। কি অদ্ভুত এক অনুভূতি আর অদ্ভুত এক শান্তি! মনে হয়েছিলো রাস্তাটা যেনো কখনোই শেষ না হোক। কি বাচ্চামো ভাবনা আমার! নিজের ভাবনাতে নিজেই হেঁসে ফেললাম। নানুবাড়িটা দেখে বেশ অবাক হলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে বড় একটা বাড়ি। সামনে সরু রাস্তার দুপাশে বাগান করা। মুগ্ধ হয়ে চারপাশ টা দেখতে দেখতেই তীব্র কাছে চলে আসে৷ হাত ধরে গম্ভীর মুখে সদর দরজার সামনে দাঁড়ায়। তীব্রর ছোট মামা, মামি, ২ খালামনি, ২ খালু, আরো ৪/৫ জন কাজিন মিলে আমাদের বাড়ির ভেতর এনে বসায়। সারারাত জার্নির ফলে যে যার রুমে চলে যায়। আমি রুমে এসেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারা রাস্তা তেমন একটা ঘুম হয়নি৷ এখন ভালোমতো একটা ঘুম দেওয়া যাবে। কিন্তু ঘুমে ছাই ফেলে দিয়ে তীব্র গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘নিজে থেকে একটা রে’পি’ষ্ট, খু’নী, স্বার্থপর লোকের বুকে মাথা রাখতে ঘৃ’ণা লাগেনি?’
আমি চমকে তাকালাম৷ চোখ পিটপিট করে তাকিয়েই রইলাম। সেদিন রাগের মাথায় যা তা বলেছি আমি উনাকে। অথচ বোকার মতো এটা একবারও ভাবিনি যে দো’ষী কখনো তাকে খুঁজে পাওয়ার ক্লু চোখের সামনে রেখে যায় না৷ উনার দৃষ্টি তখনো আমাতে আবদ্ধ। আমি ঢোক গিলে মাথা নত করে নিলাম। বোকার মতো কত কি করে ফেলেছি এপর্যন্ত! আমি জানি এসবের পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে কিন্তু এই রহস্যর সমাধান যে নেই আমার কাছে। তীব্র বাঁকা হেঁসে বলে,
‘প্রেম প্রেম নেশা তবে লেগে গেছে প্রানেশা?’
উনার এই একটা কথাতেই থমকে গেলাম। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিললাম। তীব্র লাগেজ থেকে কাপড় বের করতে করতে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
‘যতটুকু অনুভূতি, মোহ, মায়া আছে তা এখানেই শেষ করো। তীব্র প্রেমের নেশার মতো তীব্র প্রেমের বিরহও কিন্তু ভ’য়ং’কর প্রাণ। তাছাড়াও তোমার আর আমার বিয়েটা তো কেবলই একটা ডিল। এখান থেকে ফিরার পর তোমাকে তোমার জায়গায় ফিরিয়ে দিয়ে আমি ফুল্লি ফ্রি হয়ে যাবো।’
হার্টবিট থেমে গেলো উনার বাক্যগুলোতে। নিজের অজান্তেই ছোট্ট মনে দাগ কেটে গেলো ‘আমাদের বিয়েটা ডিল’ শুনে। শক্ত হওয়ার চেষ্টা করলাম। চোখের পাতা ঝাপটালাম কয়েকবার। নিজেকে শক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা নাকি কান্না আটকানোর প্রচেষ্টা তা টের পেলাম না। তীব্র তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে আমার দিকে তার ফোন ছুঁড়ে মারলেন। একবার তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার ফোন হাতে নিলাম। উনি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করার পূর্বেই কু’টিল হাসি হেঁসে বললেন,
‘পিকগুলো দেখে আবার শ্বাস আটকে ম’রে যেও না যেনো! তোমার এখনো অনেক দেখা বাকি। তাই শ্বাসটুকু বাঁচিয়ে রাখো।’
উনার কথায় বেশ হলাম। কি এমন পিক যা দেখলে আমার শ্বাস আটকে যাবে! কৌতুহলে ফোনটা নিয়ে ভালোমতো পিকটা দেখতেই সত্যি মনে হলো আমার শ্বাস আটকে গেছে। জ্ঞানশূণ্যের মতো একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আরেকবার ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালাম। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়ালো আনমনেই। অস্পষ্ট স্বরে শুধু বেড়িয়ে আসলো,
‘জিনিয়া বেঁচে আছে!’
চলবে..
(