তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -০৯

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

অনুভূতিশূণ্যের মতো নিজের রুমের ফ্লোরে বসে আছি। হাতে এখনো তীব্রর ব্রেসলেট। নিজের অজান্তেই যে তীব্রকে নির্দোষ ভেবে বসেছিলাম তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি৷ সে আমাকে এতো এতো টপিক দিয়ে বুঝালো অথচ আজও তার বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ রয়েই গেলো। ব্রেসলেটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময়। একটা সময় হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢোকে তীব্র। দরজার আওয়াজে সেদিকে তাকাতেই তার চিন্তিত মুখটা চোখে পড়লো। উনি ছুটে আসলেন আমার কাছে। হাটু মুড়ে বসে দুহাতে মুখ আগলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শুধালেন,

‘কি হয়েছে প্রাণ? তোমার এমন বিধ্বস্ত অবস্থা কেনো? তিহা বললো তুমি নাকি কান্না করতে করতে বাড়ি এসেছো! কি হয়েছে তোমার?’

আমি শুধু উনার চোখের দিকে তাকালাম। মানুষ চোখের ভাষা নাকি খুব বোঝে অথচ আমি এই মানুষটা চোখের ভাষা বুঝলাম না। বিভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো সে দৃষ্টি। তীব্র আমার ভাবনার মাঝে হয়তো আরো একবার প্রশ্ন করলেন কিন্তু আমার কানে সে প্রশ্ন আসলেনও না। আমি ঠোঁট এলিয়ে হাসলাম। হাতের ব্রেসলেট টা তীব্রর সামনে ধরলাম। তীব্র চুপ করে একবার ব্রেসলেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর ব্রেসলেটটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন,

‘এটা কোথায় পেলে? আমি তো কাল থেকে খুঁজছি কোথাও পেলাম না।’

আমি শব্দ করে হেঁসে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। পাগলের মতো শুধু হাসতেই থাকলাম। একদিকে হাসলেও আরেকদিকে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। শাড়ি এলোমেলো হয়ে গেছে। চুল গুলো শুধু খোপা করে রেখেছিলাম তাও খুলে গেছে। একদম বিধ্বস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। তীব্র কিছু না বুঝে আমার কাছে এগিয়ে আসে। আমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

‘কি হয়ছে? পাগলের মতো হাসছো কেনো?’

সে নিজেই চোখের পানিটুকু মুছে দিলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। তীব্র চমকালো। আমি চোখ পিটপিট করে ভীষণ শীতল গলায় বললাম,

‘আপনি না কাল বললেন আপনি জানেন না আন্টিরা কোথায়! তাহলে আপনার শখের ব্রেসলেট কিভাবে আন্টির বাসায় পেলাম?’

চমকে যায় তীব্র। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় আমার মুখের দিকে। আমিও তার দিকে তাকিয়েই ফের বললাম, ‘জবাব দিন!’

তীব্র কোনো উত্তর দিলেন না। তড়তড় করে রাগ বেড়ে গেলো আমার। উনার ওপরের রাগটা আমি পুরো রুমের ওপর ঝাড়লাম। পুরো রুমের জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে, ভেঙে ক্ষ্যান্ত হলাম। উন্মাদের মতো যা তা বলে চেচাতে চেচাতে সব এলোমেলো করে ফেললাম। এতোটাই উন্মাদ হয়ে গেলাম যে কখন পায়ে কাঁচ ঢুকে র’ক্তাক্ত হয়ে গেছে সেটুকুও খেয়াল করিনি৷ তীব্র আটকালেন আমায়। শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন। আমি ছোটার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করলাম। কিন্তু তার শক্তির সাথে পেড়ে উঠলাম না। ক্লান্ত হয়ে তার বুকের সাথে মিশে রইলাম। একটু শান্ত হতেই তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,

‘আমি কাল রাত থেকে আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম তীব্র। আমি ভেবেছিলাম আপনি নির্দোষ। আপনাকে বিশ্বাস করে আমি পুরো সত্য জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করার ফলটা আমি আজই পেয়ে যাবো তা ভাবতেই পারিনি। আপনি যদি আন্টিদের বিষয়ে কিছু না-ই জানেন তাহলে কেনো আপনার শখের ব্রেসলেট আমি ওখানে পেলাম? কেনো জিনিয়ার ওই অবস্থার জন্য মৃ’ত্যুর আগে সে আপনাকে দায়ী করলো? কেনো আপনাকে ভালোবেসে জিনিয়া ঠকে গেলো? কেনো আপনি জুথি আপুর হাজবেন্ডকে মা’রলেন? কেনোই বা জুথি আপুকে বার বার মা’রার চেষ্টা করলেন? আপনি এতোটা জ’ঘন্য কেনো তীব্র?’

তীব্রর হাত আলগা হয়ে গেলো। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তীব্রর দিকে তাকালাম। তীব্রর দৃষ্টি তখনো আমার চোখের দিকে। আমি ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়লাম তার দিকে। চোখ থেকে টপটপ করে তখনো জল পড়ছে। আমি সরে আসলাম দু’পা। রাগে চেঁচিয়ে বললাম,

‘আপনি একটা ধ’র্ষ’ক। একজন খু’নী। নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝেন না আপনি। প্রচন্ড রকমের ঘৃণা করি আমি আপনাকে। আপনি আমার হাজবেন্ড ভাবলেই আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে। আপনার একেকটা স্পর্শ আমার কাছে বি’ষাক্ত মনে হয়। আপনাকে দেখলেই আমার ঘৃণা লাগে। আপনি একটা বি’ষাক্ত কীট। আমি আপানকে ভীষণ রকমের ঘৃণা করি তাশজিদ শেখ তীব্র। আই জাস্ট হেইট ইউ।’

বলতে বলতেই ধপ করে বসে পড়লাম মেঝেতে। তখনো আমার চোখের জল থামেনি। কান্না করতে করতে হিচকি উঠে গেছে। তীব্র কিছু না বলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমি নিজের মতো বসে রইলাম। তীব্র হুট করেই আমার সামনে এসে বসলো। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম উনি ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে বসেছেন। আমার পায়ে হাত দিতেই আমি যখন ছাড়িয়ে নিতে গেলাম তখন উনি শক্ত করে ধরলেন। চুপচাপ কাঁচটা বের করলেন। ব্যাথায় আর্তনাদ করে উনার শার্ট চেপে ধরলাম। উনি কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। চুপচাপ পায়ে ওষুধ লাগিয়ে পা ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পুরোটা সময় দুজনই নির্বাক ছিলাম। উনি চুপচাপ নিজের কাজ করলেন আর আমি শুধু দেখলাম। এরপর ফাস্ট এইড বক্সটা সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। এক হাত ঘাড়ের পেছনে নিয়ে তার দিকে টেনে আনলেন। চুলগুলো কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দিয়ে ঠোঁট ছোয়ালেন কপালে। তার গভীর চুম্বনে আমি কেঁপে উঠলাম। উনি আমাকে ছেড়ে চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তার চোখ মুখ অদ্ভুত ভাবে যেনো নীল হয়ে গেছে। ব্যাথায় যেমন মানুষের চোখ মুখ হয় ঠিক তারও তেমন হয়েছে। চোখে মুখে যেনো বি’ষাদের হাসি। আস্তে করে আমাকে ছেড়ে শুধু দুটো কথায় বললেন,

‘থ্যাঙ্কস। আর ক’টা দিন সহ্য করে নাও প্রানেশা।’

এরপর উনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম। সে তো একা থাকা কালীন আমাকে বেশির ভাগ প্রাণ-ই বলেন তাহলে আজ হঠাৎ করে প্রানেশা কেনো বললেন! আর ক’টা দিন পর কি হবে! তার কথার মানে বুঝে উঠতে না পারলেও নিজের এতো চিন্তায় আমি ক্লান্ত। ফ্লোরে বসে মাথা হেলিয়ে দিলাম বেডের সাথে। কান্না করায় চোখ মুখ ফুলে গেছে। চোখ জ্বালা করছে খুব। চোখ বন্ধ করে ওভাবেই পড়ে রইলাম অনেকটা সময়। নিজের হাতে নিজের মাথা চেপে ধরলাম। আরো একবার দরজার খোলার শব্দে পিটপিট করে তাকালাম। চোখে পড়লো তানহাকে। সে অদ্ভুত ভাবে হেঁসে আমার পাশে এসে বসলো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে আফসোসের সুরে বললো,

‘তীব্রর ওমন রাগী ফেইস দেখেই বুঝলাম কিছু একটা হযছে। ভাগ্যিস লিভিং রুমে কেউ ছিলো না! তা তোমার এমন অবস্থা কেন গো? তীব্র বুঝি কিছু বলেছে!’

ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ আমাদের মধ্যে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা আমাদেরই বুঝতে দাও। আর তীব্র তোমার বড় ভাই হয় তাই ভালো করে বলো ‘তীব্র ভাই’ আর আমাকে ‘ভাবী’ বলবে! এখন বের হও আমার রুম থেকে।’

তানহা ফুঁসে ওঠে। রেগে আমার দিকে এগোতে নিয়েও এগোয় না। দাঁতে দাঁত চেপে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এরপর বাঁকা হেঁসে বলে, ‘দেখি আর কয়দিন তুমি তীব্রর বউ হয়ে থাকো প্রানেশা! উফস সরি ভাবী।’

নিজের মতো বের হয়ে যায় তানহা। আমি ধীরে ধীরে উঠে ব্ল্যাঙ্কেট জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। এতো রহস্যের মধ্যে যেনো আমি ডুবে গেছি। যত রহস্য থেকে বের হতে চাই ততটাই ডুবে যাই রহস্যের অতল গভীরে। তীব্রকে যতবার বিশ্বাস করতে চাই ততবারই তার বিরুদ্ধে কিছু না কিছু প্রমাণ পেয়ে যাই। সত্যি মিথ্যার জালে আমি এতোটাই বাজে ভাবে ফেসে গেছি যে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা জাজ করতেও আমার বেগ পেতে হচ্ছে! জিনিয়া, আমাকে বিয়েটা তীব্রর একটা ডিল, আন্টিরা নিখোজ, ফারদিন ভাই আর তীব্রর শ’ত্রুতা সবকিছুর মধ্যে আমি ফেসে গেছি৷ চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। চোখ জ্বালা করার কারণে এই অবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
_________

ঘুম থেকে উঠতে উঠতে ২ টা বেজে গেছে। এরমধ্যে কেউ বোধহয় আমাকে ডাকেওনি। পুরো রুম পরিষ্কার করা। হয়তো তিহা বা কোনো মেইড এসে করেছে। ধীরে ধীরে উঠতেই বুঝলাম দুদিনের জ্বরটা আজ মাত্রা ছাড়িয়েছে। পা ব্যাথাতে নাড়াতে পারছি না। মাথা ভার হয়ে আছে। তবুও কোনোমতে উঠে বসলাম। মাথা ঘুরিয়ে আসলো। চুপচাপ ওভাবেই শুয়ে পড়লাম আবার। কতক্ষণ পরই তিহা রুমে আসলো। আমার পাশে বসে বললো,

‘ভাবী এখনো উঠোনি যে! শরীর কি খুব খারাপ?’

কথা শেষ করে কপালে হাত দিতেই চমকে উঠলো। দ্রুত কাছে এসে বললো, ‘তোমার এতো জ্বর কেমনে হলো! দাঁড়াও ভাইয়াকে বলি।’

আমি ওর হাত টেনে ধরলাম। ধীর স্বরে বললাম, ‘প্রয়োজন নেই। তুমি শুধু এমনিতেই একটু ওষুধ দিয়ে যাও।’

‘খালি পেটে ওষুধ কেনো খাবা? দাঁড়াও আমি আসি!’

তিহা দৌড়ে চলে যায়। মিলি, বিপ্লব, মুন্না একসাথে রুমে আসে। ৩ জন মিলে বিছানা দখল করে বসে বলে, ‘ভাবী আপনার নাকি অনেক জ্বর!’

আমি হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ালাম। ওরা ৩ জন বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। তিহা খাবার নিয়ে এসে একটু খাইয়ে দেয়। এরপর ওষুধ খাইয়ে মিলি, বিপ্লব, মুন্নাকে বের করে দেয়। আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

‘তোমাকে একটা কথা বলি ভাবী?’

আমি ছোট্ট করে ‘হু’ বললাম। তিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি জানি না আজ তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কি হয়েছে কিন্তু এটা জানি তোমরা দুজনেই অনেক কষ্ট পাচ্ছো। সবার কথা, সব দেখা, সব শোনা সত্যি হয় না ভাবী। আমরা চোখের সামনে এমন অনেক কিছু দেখি যা আদৌও হয়ইনি বা নেই। আমাদের চোখের সামনে থাকা সব আপন মানুষরা কিন্তু আদৌও আপন হয় না। সব কিছুর পিছনেই কিছু সত্য থাকে যা সবার আড়ালে থাকে। এগুলো সত্য খুঁজে বের করতে হয়। তুমি কারোর কথায় এসে ভাইয়াকে ভুল বুঝো না। তুমি আমার ভাইয়াকে আসলে যেমন ভাবো সে তেমন না। তোমাকে এই মুহুর্তে কিছুই বলতে পারবো না আমি তবে এটুকু বলতে পারি ‘তুমি ভুল। ভাইয়া জিনিয়াকে কিছুই করেনি। বরং ভাইয়া সেদিন জিনিয়ার জন্যই ওখানে গেছিলো। জিনিয়াই যেতে বলেছিলো। পরে কি হয়েছে তা আমাকে ভাইয়া আজও বলেনি কিন্তু তুমি পরের যতটুকু জানো তা সম্পূর্ণ ভুল। খুব বেশি দেড়ি হওয়ার আগেই নিজের ভুল ভেঙে ফেলো ভাবী। ভাইয়াকে একবার হারিয়ে ফেললে আর ফিরে পাবে না।’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here