তীব্র প্রেমের নেশা পর্ব -১৩

#তীব্র_প্রেমের_নেশা (১৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

শোভার মেহেন্দি অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। শ্বাশুড়ি মায়ের অর্ডার অনুযায়ী কাজ করেই দিন পার হচ্ছে আমার। এতো কাজের মধ্যে ছোট মামী চুপচাপ বসতে বললেও শ্বাশুড়ির কড়া নির্দেশ যেনো সবার হাতে হাতে সব কাজ শেষ করি। তিহা কয়েকবার এসে ডেকে গেছে কিন্তু আন্টি যেতে দেননি৷ তিহা শেষমেশ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আমার কাছে এসে বলে,

‘অন্যসময় ভাবীরে সহ্যই করতে পারে না আর এখন শ’ত্রুর মতো খাটাচ্ছে। বিয়েতে এসেছে বলে এতো ঝামেলা করলো আর এখন যখন কাজের বেলা তখন সব প্রানেশাই করো। ফা’উ’ল ফ্যামিলি একটা।’

আমি ওকে চেপে ধরে থামিয়ে দিলাম। তিহা ফুঁসতে ফুঁসতে চলে যায়। আমি এখনো পর্যন্ত শাড়িও চেঞ্জ করিনি। কীভাবে করবো! আন্টি তো উঠতেই দিচ্ছে না। নিজের কাজ করে যাচ্ছি চুপচাপ এমন সময় গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে নান ভাইয়ের। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম নানাভাই, নানু, আঙ্কেল সবাই এসেছে। দ্রুত আঁচল টেনে মাথায় দিলাম। নানাভাই গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘নতুন বউকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে কে? নাত বউ এখানে বিয়ের কাজ করতে এসেছে নাকি মেহমান হিসেবে এসেছে?’

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কেউ কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে তিহা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘নানাভাই তোমার মেয়ের না আমার ভাবীর আরাম একদমই সহ্য হয় না। তাই জন্য সকাল থেকে মেয়েটাকে গরুর মতো খাটাচ্ছে। অথচ দেখো নিজে কিন্তু পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে আছে।’

তিহার কথায় আমি ওর দিকে তাকালাম। মেয়েটা কি আমাকে মা’রবে নাকি! নানাভাইয়ের সামনে কি বলছে এগুলো! এরমধ্যেই আন্টি ধমকে উঠলেন তিহাকে। রাগী স্বরে বললেন,

‘ভাবী এতো আপন হয়ে গেছে যে মায়ের নামে নানাভাইয়ের কাছে নালিশ করছিস! একেকটা রা’জা’কার জন্ম দিয়েছি আমি। তুই বাড়ি চল শুধু!’

আন্টির কথা শেষ না হতেই নানাভাই রাম ধমক দিলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ নানাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিললাম। তিনি আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে বললেন,

‘তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি তাফিয়া। তুমি একে তো এতো কিছু করেছো তাারওপর আমার সামনেই মেয়েকে ধমকাচ্ছো! আজাদ তীব্র কোথায়?’

আঙ্কেল নম্র গলায় বললেন, ‘ওকে তো কোথাও দেখিনি। মনে হয় নিজের রুমে আছে।’

নানাভাই কাউকে কিছু না বলে আমার দিকে দৃষ্টি দিলেন। আদেশসূচক স্বরে বললেন, ‘নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নাও। আর বাদ বাকি যা কাজ তা তাফিয়া আর এবাড়ির বউরা সামলে নিবে। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না।’

আমি কিছু বলতে চেয়েও বললাম না। নানাভাইকে এবাড়ির সবাই ভয় পায় আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। তাই তার কথায় মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ সরে আসলাম। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আন্টিকে নানু ঝাড়ছে। আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। চুপচাপ নিজের রুমে এসে দেখলাম তীব্র পায়ের ওপর পা তুলে ল্যাপটপে কাজ করছে। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,

‘এতো তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ? ছেড়ে দিলো তোমাকে? আমি তো ভাবলাম আজ সারারাত তোমার কাজ করতে করতেই শেষ হবে।’

আমি জ্বলে উঠলাম। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে একবার উনার দিকে তাকিয়ে কাবাডের দিকে এগোলাম। কাবাড থেকে একটা নতুন শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করার আগে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘দুই মা ছেলের চোখের বি’ষ যেনো আমি। সকাল থেকে কাজ করে ম’রছি ওইটা উনার চোখে পড়লো না। কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি চলে আসছি এটা তার চোখে পড়লো! খা’রুশ কোথাকার! মে’রে উগান্ডার টিকিট হাতে ধরিয়ে দেওয়া উচিত।’

বাইরে থেকে হুট করেই হাসির শব্দ পেলাম। ভ্রু কুঁচকে গেলো নিমিষেই। সারাদিন কাজ করায় গা থেকে এখনো গন্ধ আসছে। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে শাড়িটা শুধু কোনোরকম প্যাচিয়ে নিলাম। দরজা হালকা খুলে দেখলাম তীব্র এখনো বসে আছে। আমি ওভাবেই বের হয়ে আসলাম। তীব্রর দৃষ্টি তখনো ল্যাপটপের দিকে। গলা পরিষ্কার করে বললাাম,

‘বাহিরে যাবেন না আপনি? রুমে বসে আছেন যে নানাভাই তো আপনাকে খুজছিলো!’

‘কেনো? হঠাৎ নানাভাই কেনো খুঁজছে?’

উনার প্রশ্নে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘জানি না তো! আপনি গিয়ে দেখুন। যান যান!’

তীব্র এবার চোখ তুলে তাকালেন৷ কপালে ভাজ ফেলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলে, ‘ওহ আচ্ছা! এই ব্যাপার!’

আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি? কি ব্যাপার?’

উনি বাঁকা হেঁসে ল্যাপটপ রাখলেন। সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে হাই তুলে বললেন, ‘আমাকে তাড়ানোর কি আছে? আমি তো আগেই সব দেখে ফেলেছি বউজান।’

আমি উনার কথায় কয়েক সেকেন্ড চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকলাম। উনার কথার মাানে বুঝার সাথে সাথে দাঁতে দাঁত চেপে একটা বালিশ ছুড়ে মে’রে বললাম, ‘বে’হায়া, নি’র্লজ্জ লোক! বের হেন এক্ষুণি।’

তীব্র বালিশ ক্যাচ করে হাসতে থাকে। আমি আরো কিছু ছু’ড়ার প্রস্তুতি নিতেই উনি ভোঁ করে বের হয়ে গেলেন। আমি দ্রুত দরজা আটকে বড় করে শ্বাস নিলাম। লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে গেছে৷ সেদিন রাতের ঘটনার পর থেকে আমি এমনিতেই লজ্জায় তার থেকে পালাই পালাই করি আর সে বার বার সেই এক কথায়-ই বলে। মনে মনে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে শাড়ি পড়াতে মন দিলাম।
_____

নাচ, গান সবকিছুতেই মেতে উঠেছে পুরো বাড়ি। তিহা আর মিলি দুজনে জোড় করে হালকা সাজিয়েছে। চুলও তিহা-ই ঠিক করে দিয়েছে। এদের অবস্থা এমন! বিয়েট শোভার না আমার আর তীব্রর। তিহা আমাকে নিয়ে নিচে নামতে নামতে বলে,

‘ভাবী নিচে গিয়ে দেখবা নাটকের বন্যা বইয়া যাইতেছে।’

আমি ওর কথায় হেঁসে ফেললাম। ওকে চিমটি কে’টে বললাম, ‘আন্টি যদি তোমার এই কথা শুনে তাহলে তোমার সাথে সাথে আমার ক’ল্লাও কে’টে নিবে। আচ্ছা তখন আন্টি তোমাকে কিছু বলেনি তো?’

তিহা হাসতে হাসতে বলে, ‘তুমি যাওয়ার পর নানু এমন ভাবে ঝে’ড়েছে যে আম্মু আর আমাকে কিছু বলেনি। এখন বাড়িতে গেলে হয়তো আমার কপালে শনি আছে।’

ওর কথায় খানিকটা স্বস্তি পেলেও বাড়ি গিয়ে কি হবে এটা ভেবেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আন্টি আমাকে তেমন পছন্দ করে না তারওপর আজ এতো কিছু হলো! আন্টি কি আদৌও আমাকে ছেড়ে কথা বলবে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে দেখলাম শোভা মেহেন্দি দিচ্ছে। শোভার মেহেন্দি শেষ হলে তানহা, তিহা মিলে বসে পড়েছে। মিলি আমার কাছে এসে বলে,

‘দেখছেন ভাবী! আপনার ননদ আমাকে রেখেই মেহেন্দি দিতে বসে গেলো। ঠা’ডা পড়বে ওর ওপর হুহ!’

আমি হেঁসে ফেললাম ওর কথায়। তীব্রকে আশে পাশে খুঁজেও কোথাও পেলাম না। হুট করেই তানহা মেহেন্দি দেওয়া বন্ধ করে মেহেন্দি নিয়ে দৌড় লাগায় সিড়ি দিয়ে। ওর এমন হঠাৎ দৌড়ে যাওয়ায় বেশ অবাক হলাম। মিলি গিয়ে তানহার জায়গায় বসে পড়ে। আমি একবার চাারপাশে তাকিয়ে হাঁটা লাগালাম তানহার পিছু পিছু। তানহা ছাদের দিকে গেছে। আমি ছাঁদের দরজার কাছে আসতেই দেখলাম তীব্রও সেখানে আছে৷ দুজনেই একটা জায়গায় বসে। তানহার হাতে তীব্র মেহেন্দি দিয়ে দিচ্ছে। আমি ফ্যালফ্যাাল করে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। ইচ্ছে করলো দুজনকেই গিয়ে থা’প্রাইয়া আসি কিন্তু দাতে দাত চেপে দাঁড়িয়ে থাাাকলাম। বিষয়টা কতদুর যায় এটা দেখার অপেক্ষাতেই আছি আমি। তানহার হাতে মেহেন্দি দেওয়া শেষ করে তীব্র গম্ভীর মুখে বললো,

‘এখন যা!’

তানহা বিশ্বজয় করার মতো হেঁসে বলে, ‘যাবো একটু পর। তোমার সাথে একটু কথা বলি তীব্র!’

তীব্র জবাব দিলো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তানহা হুট করেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আমি চমকালাম। এ পর্যায়ে সহ্য হলো না। এগোতে নিলে তানহার কয়েকটা বাক্য কানে আসে,

‘তীব্র তুমি তো প্রানেশা এখান থেকে গিয়েই ছে’ড়ে দেবে তাই না? ওর সাথে বিয়েটা তো জাস্ট একটা ডিল বলো! তুমি তো ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করবে তাই না? তুমি তো ওকে ভালোবাসো না তাই না?’

থেমে গেলাম আমি৷ হুট করেই কৌতূহল জাগলো তীব্রর জবাবের। আমি জানি উনি আমাকে ভালোবাসে আর উনি আমাকে ছাড়বেও না। তবুও উনার মুখ থেকে শুনার জন্য অধীর আগ্রহে রইলাম। হার্টবিট বেড়ে গেছে তীব্রর মুখে আমাকে ভালোবাসার কথা শোনার আশায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিতেই তীব্রর কন্ঠ কানে আসে,

‘ছাড় আগে!’

তানহা না ছেড়ে যেনো আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করছিলো মেয়েটার সব চুল একটা একটা করে ছি’ড়ে দেই। শুধু একবার তীব্র বলুক সে আমাকে ভালোবাসে আর আমাকে ছাড়বেও না এরপর এই মেয়েকে আমি বুঝাবো প্রানেশা কি! হুহ। তানহা তীব্রর পিঠে মুখ গুঁজে বলে,

‘আগে বলো! আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’

তীব্র গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ ওর সাথে বিয়েটা শুধু একটা ডিল আর আমি ওকে ভালোও বাসি না।’

মুহুর্তেই যেনো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলাম তানহা আর তীব্রর দিকে। তীব্রর উত্তরে থম মে’রে গেলাম। এক মুহুর্তে মনের সব আশা শেষ হয়ে গেলো। এলোমেলো পায়ে ছাঁদ থেকে সরে এলাম। নিজেই নিজের তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলাম। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে টুপ করে দু ফোঁটা জল গড়ালো। তীব্র এক মুহুর্তে আমার সব স্বপ্ন, সব আশা ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন। উনি তো জানেন আমি উনাকে ভালোবাসি তবুও কত সহজে হয়তো আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবে নিচ্ছে। চুপচাপ নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। দরজার সাথে ঠেস দিয়ে বসে অপলক তাকিয়ে থাকলাম সিলিংয়ের দিকে।

চলবে..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here