তৃতীয় ব্যক্তি,পর্ব:১১

0
428

#তৃতীয়_ব্যক্তি
লেখা: শরাবান তহুরা চৌধুরী
পর্ব: ১১

অজ্ঞাতনামা সেই লাশটা সুমনের ছিল, সেটা এখন প্রায় সকলের মুখেমুখে। সুমনের অফিস থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে, তার বাড়িতে খবর পাঠানো হলো। সুমনের বাড়িতে তেমন কেউ নেই। বাবা-মা বেচেঁ নেই। বাবা মারা গেছেন সুমন ছোট থাকতে। আর মা মারা গেছেন বছর দুই আগে।
সুমনের আপনজন বলতে এখন শুধুমাত্র একজন বড় ভাই জীবিত আছে। কোনভাবে তাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু জানা গেছে, সে দেশের বাইরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকে। সুমনের কবর এখনও সেই বেওয়ারিশ হিসেবেই রয়েছে।

অফিসার শীলা আনমনে বসে আছে। আজ তার মনটা ভীষণ এলোমেলো। সামিয়া কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে, ওকে নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি দুই অফিসারকে আজ আর সাথে রাখেনি অফিসার শীলা। সামিয়া চেয়ারে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। শীলা খানিক বাদেই বললো,
“তুমি কী আমাকে খুনের আসল কারণটা বলবে?”
সামিয়া একপলক শীলার দিকে তাকালো। সে কী বলবে বা কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। মিনিট পাঁচেকের নীরবতা ভেঙে সামিয়া বলতে শুরু করলো…।

“নিলয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ ভালো ছিল। আসলে আমাদের বিয়েটা হয়েছিল প্রেমের। এর কারণেই হয়তোবা দুজনের মধ্যে টান ছিল প্রচুর! নিলয় আমাকে অনেক ভালোবাসতো। এটা যদিও আমার ধারণা ছিল। পরবর্তীতে আমার ভুলটা ভেঙে যায়। বিয়ের প্রথম বছর বেশ আনন্দেই কেটে যায়। হানিমুন করা, যখন তখন বেড়াতে যাওয়া, সময়ে অসময়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া ছিল আমাদের রোজকার রুটিন। হুটহাট সে এসেই আমাকে চমকে দিতো। যাকে বলে সারপ্রাইজ! সে সারপ্রাইজ দিতে ভীষণ পছন্দ করতো। শেষ পর্যন্ত এই সারপ্রাইজই জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো।

নিলয় যে আমাকে আগের মত আর ভালোবাসছে না, সেটা আমি বুঝতে পারি মাস ছয়েক আগে। হঠাৎ করেই আমার প্রতি তার আগ্রহ কমে যায় আর অবহেলা বেড়ে যায়। আমি সেসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। সে ব্যস্ত থাকে, অফিসে কাজের চাপ থাকে, এসব ভেবেই সবটা মেনে নিতাম। ধীরে ধীরে এই মেনে নেওয়া যেন আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়ালো। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা মানুষটা গভীর রাতে বাড়ি ফিরতে শুরু করলো। বাসায় খাওয়া যার সবথেকে পছন্দের একটা বিষয় ছিল; সেটাও হুট করে পাল্টে গেল। সে বাইরে থেকে খেয়ে আসা শুরু করলো। সবটাই মুখ বুজে মেনে নিতাম।

এসব মেনে নিতে নিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছিলাম ভেতরে ভেতরে। এসব থেকে একটু মুক্তি পেতে গ্রামের বাড়িতে গেলাম। দিন সাতেক পার হলেও নিলয় আমাকে নিতে গেলে না। কিংবা কোন খবরও পাঠালো না আসার জন্য।
আগে যেখানে একটা দিন সে একা থাকতে দিতো না, সেখানে সাত সাতটা দিন পেরিয়ে গেল! আমি যেন অস্থির হয়ে পড়লাম। নিলয়ের খবরের তোয়াক্কা না করেই ফিরে এলাম ওর কাছে। হুট করে, কোন খবর না দিয়ে ওর কাছে ফিরে আসায় সেও যেন ভীষণ খুশি হলো।
আমাকে আবারও আগেরমত ভালোবাসতে শুরু করলো।

এভাবে চললো আরো দিন পনেরো। একদিন আমি আলমারিতে কাপড় নিতে গিয়ে একটা প্যাকেট পেলাম। প্যাকেটের মধ্যে একটা শাড়ি আর চিরকুট ছিল। আমার পছন্দের রঙের শাড়ি। শাড়িটা পেয়ে আমি ভীষণ বিমোহিত হলাম। এক দৌড়ে ছুটে গেলাম ওর কাছে। জড়িয়ে ধরলাম পরম আবেশে। ভাবলাম, এইতো সে! এইতো আমার নিলয় আবারও আমার হয়েছে! আবারও সে তার পুরনো অভ্যেসে ফিরে এসেছে!

কিন্তু, সেই আনন্দ আমার জীবনে স্থায়ী হলো না। পরেরদিনই জানতে পারলাম প্যাকেটটা নিলয় না, অন্য কেউ দিয়েছে। যে প্যাকেটটা দিয়েছে, সেই ফোন করে জানিয়েছে। আবারও আমার ঘরের দরজায় প্যাকেট পেলাম। এভাবেই প্রায় দিন সাতেক গেল। রোজ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলে, দরজা খুলতেই গিফট বক্স পাই। অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। এসব ধীরে ধীরে বেড়ে গেল আর নিলয়ও আগেরমত হতে লাগলো। নিলয় যত অবহেলা করতে থাকে, ওই অচেনা মানুষের সারপ্রাইজওর যেন তত বাড়তে থাকে। নিলয় কখন বাড়ি আসে, কখন আসে না, আমার বাসায় কী হচ্ছে, সবটা সে জেনে যায়। নিলয় বেশি রাতে বাড়ি এলেই, সে ফোন করে। ফোনে যদি বলি আমার হাজবেন্ডকে বলে দেবো, সে হেসে বলে হাজবেন্ড তো বাসায়ই নেই কাকে বলবে? আমি ভয় পেয়ে যাই। সে কিভাবে এসব জেনে যায় আমি বুঝতে পারি না।

এভাবে চলতে চলতে একদিন আমি সেই ছেলের সাথে দেখা করতে যাই। আমার জানার প্রয়োজন ছিল, সে কেন এমনটা করছে!
সেখানেই আমার সুমনের সাথে পরিচয় হয়। দেখতে সুন্দর, স্মার্ট, শিক্ষিত, ভালো চাকরি সব থাকতেও সে আমার পেছনে কেন সময় কষ্ট করছে জানতে চাইলে সে আমার চোখে চোখ রেখে সরাসরি বলে,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি”
আমি জীবনে আবারও একটা ধাক্কা খাই। ধীরে ধীরে নিলয়ের অবহেলা বাড়তে থাকে আর সুমনের সাথে আমার বন্ধুত্ব এগোতে থাকে। এক পর্যায়ে আমিও সুমনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। দূর্বল হয়ে যাই ওর ভালোবাসায়, যত্নে, কথার যাদুতে।
দুজনের মধ্যে চলতে থাকে ভালোবাসা।

এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল অফিসার শীলা। সে বুঝতে পারছে না, এখানে সামিয়া কতটা দোষী বা নিলয় কতটা দোষী। সে ভ্রু জুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললো,
“সুমন কেন এভাবে তোমাকে ভালোবাসলো? কেনো তোমাকে তোমার কষ্টের সময়ে আগলে রাখলো? আর নিলয়ই বা কেন এমন বদলে গেল! কিছুই মাথায় আসছে না আমার। এত সহজে কী ভালোবাসা হয়ে যায়? নিলয়ের অবহেলা, সুমনের ভালবাসা বা যত্ন তোমাকে সুমনের দিকে এগিয়ে নিয়েছে বুঝতে পেরেছি। তুমি নিজেও এই সম্পর্কে না জড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছো সেটাও বুঝেছি। কিন্তু শেষমেষ তুমি সেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলে। যার পরিণতি হিসেবে এই খুন!
এখানে আমি পুরোপুরি দোটানায় আছি। বুঝতে পারছি না, তুমি নিলয়কে ধোঁকা দিয়েছো না নিলয় তোমাকে! কিন্তু, এতটুকু বুঝেছি সুমন তোমাদের মাঝের সম্পর্কের এই টানাপোড়েন কে কাজে লাগিয়েছে। যার সুযোগ কোন না কোনভাবে হয়তো তুমিই দিয়েছিলে।”

সামিয়া শীলার কথায় হাহা করে হেসে উঠলো। সে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। শীলা অবাক নয়নে সামিয়াকে দেখছে। সামিয়া হাসি থামিয়ে থমথমে গলায় বললো,
“আমি জানতাম আপনি আমাকে এসবই বলবেন। শুধু আপনি না, সবাই এটাই বলবে। যত যাই হোক, যত ঘটনায় ঘটুক, সব কিছুর শেষে এই মেয়েরাই দোষী হবে। ছেলেদের কোন দোষ নেই। তাদের কোন দোষ মনে হয় থাকতেও নেই। অবশ্য এতে আপনারও কোন দোষ নেই, আপনি যতটুকু শুনেছেন ততটুকুই বলেছেন।”

শীলা অবাক হয়ে বললো,
“কিন্তু তুমি খুনটা কেন করলে?”
সামিয়া বিস্ফোরিত চোখে বললো,
“কখনো আপন মানুষের থেকে চরম পর্যায়ের ধোঁকা খেয়েছেন?”
শীলা মৃদু হেসে বললো,
“জীবনের সর্বস্ব দিয়ে যাকে আগলে রেখেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম, সেই তো অন্যের হয়ে গেছে! আর কী ধোঁকা খাবো?”
সামিয়া আবারও হাসলো। সে বললো,
“ভালোবাসার ধোঁকা! হ্যাঁ, আমিও খেয়েছি। কোনভাবে হয়তো দিয়েছিও। সমাজ সেটাই বলবে। কিন্তু, এই ধোঁকা বা পরকীয়া যেটাই বলেন, সেটা আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে। আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমি শুধু তাদের পাতানো জালে পা দিয়েছি। এবং সেই জালে আটকা পড়েছি।”

সামিয়ার কথার কোন মানে বুঝতে পারলো না শীলা। পাতানো জাল বলতে? সামিয়া আর শীলার কথার মাঝেই এসে হাজির হলেন থানার কর্তব্যরত অফিসার। তাকে দেখে সামিয়া নিঃশ্চুপ হয়ে গেল। শীলা অফিসারের সাথে বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে। কী যেন জরুরী কথা আছে। সামিয়া সেখানেই বসে রইলো। শীলা আবারও ফিরে আসবে। আজকেই সমস্ত জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করতে হবে। কালকেই রিমান্ড এর শেষদিন। সামিয়া নিষ্পলক তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ঘরটায় তেমন কোন জানালা নেই। ছোট্ট একটা খোপ আছে শুধু। সেই খোপও গ্রিল দিয়ে আটানো। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সামান্য আলো দেখা যাচ্ছে। সূর্যের কিরণ ভেসে আসছে। সামিয়া সেসবই প্রাণ ভরে দেখছে। কতদিন যে প্রাণভরে একটু নিঃশ্বাস নেয় না সে!
সে যেই কক্ষে থাকে, সেখানে কোন ফ্যান নেই। কোন জানালা নেই। সারাক্ষণ ভ্যাপসা গন্ধ আর গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায় কোথায়!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here