তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
প্রথম পর্ব
– এবারের নবীনবরণে কোন গানটা গাইব বলোতো ?
– তুমি যেটা গাইবে সেটাই ভালো লাগবে
– তুমি সব সময় এরকম বলো
– ঠিকই তো বলি I তুমি যেটা গাইবে সেটাই হিট
– তোমার সঙ্গে আর কথাই বলব না
– আচ্ছা, আচ্ছা I ঠিক আছে বলছি
কথা হচ্ছিল ডিপার্টমেন্টের করিডোরে বসেই I সামনেই নবীন বরণ I তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের উপর দায়িত্ব পড়েছে এবারের নবীনবরণের I সেই সূত্র ধরেই উপরোক্ত আলোচনা I কিন্তু এতক্ষণেও ঠিক হলো না কোন গানটা গাইতে হবে I দূর থেকেই কালচার কমিটির প্রধান হাসিবকে আসতে দেখা গেল I হাসিব সামনে এসে বলল
-আরে তোরা এখানে I আর তোদের আমি হারিকেন দিয়া খুজতাছি
এতক্ষণ রাগলেও হাসিবের কথা শুনে হেসে ফেলল অনিমা I তারপর বলল
– আমি কোন গানটা গাইব বল তো হাসিব
– আরে একটা গাইলেই হইল I তুমি যা গাইবা পাবলিক সেইটাই খাবে
– তুমিও একই কথা বলছ তাই না I এবার আমি গানই গাইবো না
বলতে বলতে অনিমা উঠে দাঁড়ালো I
মুনির অনিমার একটা হাত ধরে বলল
-আরে বস তো I সব কথায় এত রেগে যাও কেন ? আমি তোমাকে টেক্সট করে দেবো কি কি গান গাইতে হবে I
অনিমার রাগ এবার একটু কমলো I স্মিত হেসে বলল
-আচ্ছা
– এবার কাজের কথা শোন
হাসিব ওদের দুজনের মুখোমুখি বসতে বসতে বলল I
– কি ?
– উপস্থাপনা এবার তোকে করতে হবে মুনির
– আমি এসবের মধ্যে নেই I লেখালেখির কিছু থাকলে আমাকে বল I স্টেজে উঠতে পারব না
– আগে কার সঙ্গে করতেস সেইটা শুন মামু I তারপরে ডিসিশন নাও
– মানে কি ?
– এবার ডুয়েট উপস্থাপনা I তোর সঙ্গে নীলা থাকবে
– কি !?
– এইবার করবা তো ? হাসিব ভূরু নাচিয়ে বলল
মুনির চোখ নামিয়ে একটু হাসলো , লজ্জা পেয়ে I পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিল I কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে বলল
– দেখা যাক
– দেখাদেখির কিছু নাই মামু স্ক্রিপ্ট রেডি হয়ে গেছে I এই যে তোমার পার্ট I ধরো I রিহার্সাল করবা I কালকে ফাইনাল রিহার্সেল একসঙ্গে I অনিমা গানগুলি রেডি করে ফেলো I তোমার তো আর রিহার্সালের দরকার নাই I তুমি বিশাল শিল্পী I
অনিমা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে I মুনিরের অভিব্যক্তির পরিবর্তন ওর চোখ এড়ায়নি I সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে সবাই জানে মুনির একটা মেয়েকে ভালবাসে I কিন্তু সেটা কে তা কেউ জানে না I প্রথম থেকেই অনিমার সঙ্গে বন্ধুত্ব ওর I একটা সময়ের পর অনিমার ধারণা হয় যে সেই মেয়েটা আর কেউ নয় ও নিজেই I আর আজ সেই ধারণা যখন বিশ্বাসে পরিণত হতে যাচ্ছে ঠিক তখনই কেন এমন মনে হচ্ছে যে মেয়েটা আসলে ও নয় I অন্য কেউ I তবে কি নীলা ?
অনিমা মন খারাপ করে হলে ফিরে গেল I পরবর্তী কয়েক দিন মন খারাপ ভাবটা কাটলো না I মুনির অনেকবার জানতে চেয়েছে কি হয়েছে I অনিমা জবাব দেয়নি I তবে অনুষ্ঠানের দিন সকাল বেলা ওর সব মন খারাপ দূর হয়ে গেল I মনে হল এই পৃথিবীটা আরেকটু কম সুন্দর হলেও চলত I
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সকাল নটায় I সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠে ও গোসল করে নিল I অনিমা ঠিক করে রেখেছে সবুজ শাড়িটা পরবে I নবীন বরণ বলে কথা I সবুজ শাড়িই মানাবে I ঠিক আটটার সময় ওর কাছে একটা পার্সেল এল I অনিমার পরিবারের সবাই গ্রামে থাকে I ঢাকায় ওর তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই I তাহলে এরকম করে পার্সেল কে দিতে পারে ? অনিমা কৌতুহল নিয়ে পার্সেলটা খুলল I ভেতর থেকে একটা নীল রঙের শাড়ী আর একটা নীল খাম বের হলো I অনিমা দ্রুত হাতে খাম খুলে চিঠিটা বের করল I ভেতরে লেখা
তোমাকে শুধু তোমাকে চাই ,পাবো ?
এক জীবনে পাই বা না পাই ,তোমার কাছেই যাবো
তুমিও যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে আজকের অনুষ্ঠান এই শাড়িটা পড়ে এসো
মুনির
অনিমার মনে হলো ওর চারপাশে প্রজাপতি উড়ছে I বহুদূর থেকে ঝর্ণার শব্দ ভেসে আসছে I এক মুহুর্তে পৃথিবীটা কেমন বদলে গেল I এটা কি সত্যি ? না কোন স্বপ্ন I নাকি এত দিন ধরে দেখে আসা স্বপ্নের বাস্তব রূপ I যাই হোক না কেন ,এর থেকে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না I
অনিমা অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে সাজলো I নীল শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নীল রেশমি চুরি পরল I সঙ্গে নীল টিপ I মানানসই স্যান্ডেল পাচ্ছিল না বলে পাশের রুমের রেবার কাছ থেকে স্যান্ডেল নিয়ে এল I এত কিছু করতে করতে হঠাৎ লক্ষ্য করলো অনেকক্ষণ আগেই নটা বেজে গেছে I কি সর্বনাশ ! অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে I সকাল প্রায় দশটা বাজে I তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে রিক্সা নিয়ে নিল I
অনিমা যখন ডিপার্টমেন্টে ঢুকল তার অনেক আগেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে I স্টেজে মুনির আর নীলাকে দেখা যাচ্ছে I মুনির একটা আঙ্গুর রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে I সঙ্গে জিন্স I কি অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে I লাল শাড়িতে নীলাকে ও খুব সুন্দর লাগছে I স্টেজের পাশে হাসিবকে পায়চারি করতে দেখা যাচ্ছে I অনিমা দৌড়ে গেল I হাসিমুখে বলল
– সরি , দেরী হয়ে গেল I
– আরে তুমি আসছো I এত দেরি কেন ? এখনই তোমার গান শুরু হবে I
অনিমা মোট চারটা গান গাইলো I ওর গান শুরু হলে অডিয়েন্স থেকে রিকোয়েস্ট আসতেই থাকে I আজ ওর প্রত্যেকটা গান ছিল মুনির এর জন্য I কিন্তু মুনিরকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না কেন ? অনিমা এদিক ওদিক তাকিয়ে মুনীরকে খুঁজতে লাগলো I কিন্তু ওকে কোথাও দেখা গেলোনা I চতুর্থ গানের পরেও আবার ওয়ান মোর বলে চিৎকার শোনা গেল I কিন্তু অনিমা আর গাইল না I স্টেজ থেকে নামার সময় সিঁড়ির মাথায় নীলা আর মুনিরের সঙ্গে দেখা হলো I মুনির কেমন মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে I আর নীলার মুখ হাসি হাসি I অনিমা একটু অবাক হল I নীলা এগিয়ে এসে বলল
– তুই এটা কি করেছিস ?
– কি ?
– একটা পার্সেল এল আর তার উপর ঝাপিয়ে পরলি ? তুই ভাবলি কি করে মুনির তোকে ভালবাসে ? তোর মত একটা মেয়েকে ?
– মানে ?
অনিমা মুনিরের দিকে তাকালো I মুনির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে I এতক্ষণে ওর খেয়াল হলো সত্যিইতো পার্সেল এর উপরে তো কোন নাম লেখা ছিল না I অনিমার রুম নাম্বার চুয়াল্লিশ আর নীলার অষ্টআশি Iমুনির ইংরেজিতে লিখেছিল I তাই পার্সেলটা ওর কাছে চলে এসেছে I নীলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
– ওটা তোর জন্য ছিল না I অবশ্য তুই এটা রেখে দিতে পারিস I কারো পড়া কাপড় আমি পড়ি না I তোকে জানিয়ে দিলাম শুধু ,যাতে তুই কোন ভুল ধারণার মধ্যে না থাকিস I
অনিমার চোখে পানি এসে গেছে I লজ্জায় ,অপমানে ওর মরে যেতে ইচ্ছা করছে I এখন এই মুহূর্তে এই শাড়ি খুলে ফেলা ও সম্ভব না I অনিমা একহাতে মুখ চেপে ধরে দৌড়ে গেটের দিকে চলে গেল I মুনির ওকে থামানোর চেষ্টা করল কিন্তু কোন লাভ হল না I মনির পেছন ফিরে নীলাকে বলল
– ভাগ্যিস এই ভুলটা হয়েছিল I তা না হলে আমি জানতেই পারতাম না তুমি কেমন ?
– কেমন ?
মুনির জবাব দেবার জন্য দাঁড়ালো না I তাহলে আর অনিমাকে ধরতে পারবে না I যতক্ষণে ও গেটের কাছে পৌঁছল ততক্ষনে অনিমা রিক্সা নিয়ে নিয়েছে I পারকিং লট পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি নিতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে I আর ওকে ধরা যাবেনা I মুনির রিক্সা নিয়ে নিল Iতারপর রিক্সাওয়ালাকে বলল ওই রিকশার পেছনে পেছনে যেতে I
অনিমাকে এই অবস্থায় ও কোনভাবেই একা ছাড়বেনা I কোন ভাবেই না I কোনদিনও না I
চলবে…….