তোমারই আমি আছি পর্ব ১০

#তোমারই_আছি_আমি
পর্ব-১০
#SaraMehjabin

সারা ভাবনার ঘোরে এতটাই ব‍্যস্ত‌ ছিল যে আশেপাশের কোন শব্দ-ই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। অবশেষে পেছন থেকে বিকট হর্নের শব্দে যখন সারার ঘোর কাটল ততক্ষণে গাড়িটা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। গাড়ির সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগবে লাগবে এমন সময়ে একটা হাত সারাকে টেনে রাস্তার সাইডে দাঁড় করায়। ভয়ে সারার চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। চোখ খোলার সাথে সাথেই,,,

: এ ভাই আপনি পাগল না মাথা খারাপ,, কোনটা? বেচারা গাড়ির ড্রাইভার আপনার পেছনে হর্ন বাজাতে বাজাতে কাহিল,,, আপনার জন্য পুরো রাস্তার লোকের কানের পোকা বাহির হয়ে গেল। আর আপনার-ই কোন হুশ নাই। নাকি সুইসাইড টুইসাইডের প্ল‍্যানে ছিলেন? দেখেন আপু,,আমি ভালো মানুষ,, ভেবেছিলাম গাড়িটা আপনার উপর দিয়ে গেলে আপনি মরে যাবেন,,, তাও এত অল্প বয়সে তাই বাঁচিয়েছি। আপনার সুইসাইড করার প্ল্যান থাকলে ভেরি সরি। প্লিজ মাইন্ড করবেন না। এই দেখেন,,, রাস্তা দিয়ে কত সুন্দর সুন্দর গাড়ি যাচ্ছে,,, আপনি আপনার পছন্দমতো একটার নিচে ঝাঁপ দেন না। আল্লাহর কসম আপু এইবার সরাব না। প্লিজ মাফ করেন।

বলেই লোকটা দুইহাত জোড় করে। এদিকে এই একগাদা বকবক শুনে সারা তো অবাক। চেনে না জানে না একটা মেয়ের সাথে একটা ছেলে এত কথা বলে নাকি! লোকটা কি তার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টায় আছে। ঘটনা তো সেদিকেই।

: না আপু আপনার সাথে আলাপ করার ইচ্ছা থাকলে এমনিই করতাম। আমি শুধু আপনার কাছে মাফ চাচ্ছিলাম যদি আপনার সুইসাইডে ডিস্টার্ব করে থাকি তাইজন্য।

সারা চমকে তাকাল। এ্যা,,মনের কথা বোঝে নাকি?

: জ্বি একটু একটু বুঝি। স্পেশালি মেয়েদের।

সারার এবার হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে‌।

: তা আপনার সুইসাইডের কারনটা জানতে পারি?

: উফ,,কি সুইসাইড সুইসাইড শুরু করেছেন আশ্চর্য! আপনাকে কে বলল আমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম? আমি কি বোকা যে অন‍্যের জন্য নিজেকে শেষ করে ফেলব? আমি বেঁচে থাকতে যে আমার কথা ভাবে নি আমি মরে গেলে তার কি আসবে যাবে? বরং আমি না থাকলেই সে খুশি হবে; অনেক ভালো থাকবে। কেউ যদি আমাকে ছাড়াও ভালো থাকতে পারে,,,আমি কেন পারব না? অন‍্যের জন্য নিজেকে শেষ করব কেন? আমার জীবনটা এতোই সস্তা?

সারা একদমে এতগুলো কথা বলে ফেলল। লোকটা অবাক হয়ে সারাকে দেখছে। একদমে কথা বলে এখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সারা। চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। চোখগুলো কানায় কানায় পানি ভরা।

লোকটা মুচকি হাসল,বুঝেছি,, খুব অভিমান হয়েছে,,, আপনার তার ওপর।

সারা: দেখেন,, ফালতু কথা বলতে আসবেন না। বাঁচিয়েছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি বাসায় যাব।
: অবশ্যই যাবেন। ঐ যে নীল রঙের গাড়িটা পার্ক করা ঐটা আমার গাড়ি। আপনি যেয়ে বসেন,, আমি আসছি।

সারা: মানে??

: মানে আপনি আমার গাড়িতে আমার পাশের সিটে বসে বাসায় যাচ্ছেন।
: কিহ? আপনার মাথা ঠিক আছে? দেখেন আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভুলেও অসভ‍্যতা করার চেষ্টা করবেন না। আপনার সাথে কথা এখানেই শেষ। আসছি।

: দেখুন ভুল বুঝবেন না। আপনার ভালোর জন‍্যই বলছি। আপনার মনমেজাজ অত্যন্ত খারাপ। আপনাকে যদি হেঁটে বাসায় ফিরতে দেই তাহলে আপনি একটু আগের অঘটনটা আবার ঘটাবেন। প্লিজ আমার সাথে চলুন। আপনার জীবন বাঁচালাম আর আপনি আমার এইটুকু রিকুয়েস্ট রাখবেন না? আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। আমি মানুষ খারাপ না। খারাপ মানুষ হলে আপনাকে নিজের লাইফ রিস্ক নিয়ে বাঁচাতাম না।

সারা আর কিছু বলল না। সত্যিই তো লোকটা না থাকলে আজকে সারা মরেই যেত। লোকটা তার জীবন বাঁচিয়েছে প্লাস হেল্প-ও করতে চাইছে। নিজে বাসায় পৌঁছে দিবে বলছে। এখন মুখের ওপর না করা’টা খুবই অভদ্রতা দেখায়। তাছাড়া লোকটা মোটেও খারাপ না।

যদিও সারার মন একটুও সায় দিল না এর গাড়িতে উঠতে। কেন যেন অন‍্যরকম লাগছে। লোকটার কোন স্বার্থ নেই তো? সারা খুবই অসস্তি লাগছে।

লোকটা গাড়ি চালাতে চালাতে কথা শুরু করে, জানো তো আমাদের জীবনে মাঝে মাঝে এমন মানুষ আসবে যারা প্রথমে প্রচণ্ড ভালবাসে। এত ভালবাসে যে আমরা ভাবতে বাধ্য হই তার মতো আপন আমাদের আর কেউ নেই। তার হাতটা ছাড়া ধরার মতো ভরসার হাত আর একটিও খুঁজে পাব না। তারা আমাদের অন্তর-আত্মার সর্বস্বটুকু গ্রাস করে নেয়। একটাসময় আমরা তাদের ওপর এমনই নির্ভরশীল হয়ে পড়ি যে তাদের ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। আমাদের মনে হয় তারাই আমাদের জীবনের সবকিছু। এরপর যদি এই মানুষটা কখনো আমাদের ভুল বুঝে ছেড়ে যায় সেটা আমরা সহ‍্য করতে পারি না। একটা কথা কি সারা, যে তোমাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দেয় সে তোমাকে কখনো বুঝতেই পারে নি। আর যে তোমাকে কখনো বুঝতে পারে নি সে আসলে তোমাকে কখনো সত্যিকার ভালবাসে নি। সবটাই ছিল মোহ। সুতরাং তাকে ভুলতে হবে। উহু,,মুখে ভুলে গেছি বলে মনে মনে প্রতিটাক্ষন তাকে ভাবলে চলবে না। তোমাকে সত্যি সত্যি ভুলতে হবে। যেন সে আঘাত করলে কষ্ট নয় পাল্টা তাকে আঘাত দিতে পারো। যেটা আমি করছি…ও হ‍্যালো,, ম‍্যাডাম ও ম‍্যাডাম–

লোকটার কথাগুলোর মাঝে একদম হারিয়ে গিয়েছিল সারা। লোকটার প্রতিটা কথা সারা আর আকাশের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। সত্যিই তো, আকাশ কখনো তাকে বোঝে নি। ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তাকে বলেও নি কি তার দোষ। সারাকে দূরে ঠেলে ঠিকই আরেকজনকে কাছে টেনে নিয়ে ভালো আছে। আকাশভাইয়া তোমার কি একটুও মনে পড়ে না পুতুলের কথা? আমাদের কত স্মৃতি, একসাথে কাটানো কত মুহূর্ত, আমাদের সেই ঝগড়া,অভিমান, ভালোবাসা কোন কথাই কি মনে পড়ে না? কখনোই না? ভুলে যাওয়া এত্ত সোজা! তাহলে আমি কেন পারি না?

সারার চোখগুলো আবারও পানিতে ভরে আসে। ওড়না দিয়ে লোকটার আড়ালে সে চোখ মুছে নেয়। যদিও লুকিং গ্লাসে দৃশ‍্যটা দেখে মুচকি হাসি ফোটে লোকটার।

লোকটার কথাগুলো এমনভাবে সারার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে যে সে খেয়ালই করে না লোকটা নাম না জানা সত্বেও কথার ফাঁকে একবার ‘সারা’ বলেছে।

: ম‍্যাডাম তোমার নাম এখন থেকে ভাবনাকুমারী দিতে হবে। সারাক্ষণ কি এত ভাবেন বলেন তো। কখন থেকে ডাকছি।
: ওহ্ স‍্যরি।
: বাই দ‍্য ওয়ে, তুমি আমার থেকে অনেকটাই ছোট তুমি বলে ফেলেছি। কিছু মনে করো না।
: না অসুবিধা নেই।
: ওহ শিট,,এতক্ষণ একসাথে অথচ নামটাই জানি না তোমার?
: সারা, সারা মেহজাবিন।
: নাইস নেম। জানি তুমি জিগ্যেস করার মেয়ে না তাই নিজে থেকেই বলছি আমি তুরাগ। এহসানুল হক তুরাগ।

—————————————————————————–

খান বাড়ি। আনন্দের ঢল বয়ে যাচ্ছে আজকে। প্রায় আড়াই বছর পর খানবাড়ির সবার মধ‍্যমনি বেবিন খানের মা নূরুন্নাহার খান বাড়িতে ফিরে এসেছেন। সেই উপলক্ষে বিশেষ পার্টি দিবেন বেবিন খান।

মনীরা: আল্লাহ বাঁচিয়েছে আম্মা এসে গেছে। আমার আর কোন চিন্তা নেই। আম্মাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যেন ঐ ষাড়টার(আকাশের বাবা) গোবরপচা মাথা থেকে আমার সোনাবাচ্চাটার সাথে ঐ মেধা ডইনীটার বিয়ের ভূত নামায়। এমনে যতই খারাপ হোক ঐ ষাড়, মায়ের কথার অমান্য করে না। আম্মার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোলে ঐটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।

অদ্বিতী: বড়মা কিছু ভাবছ?

মনীরা: ভাবছি না আম্মাজান। ভেবে ফেলেছি। লেট’স গো। ফোলো মি।

নূরুন্নাহার খানম রেস্ট নিচ্ছিলেন। অনেকটা পথের জার্নি। যদিও ফ্লাইটে এসেছেন তবু এই বয়সে সহ‍্য হয় না।

মনীরা: আম্মা আসব?

মনীরা আর অদ্বিতীকে দেখে কাজের দুজন মহিলা যারা নূরুন্নাহার খানমের দেখাশোনা করে তারা বাইরে চলে গেল।

নূরুন্নাহার: পাগল দ‍্যাখ আমার ঘরে আসার লিগা অনুমতি নেয়? বড়দিদিভাই-ও আছে দেখি!

অদ্বিতী গিয়েই দাদীর পাশে দাদির গলা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল।
নূরুন্নাহার: ও মা,,আমার বড় দিদিভাই তো অনেক বড় হইয়া গেল। আমার এই একটা দিদিভাই-ই ভালো, সারাদিন আমার কাছেকাছে থাকে। লক্ষী মেয়ে একেবারে। আরেকটা যে কৈ যায় কি করে কোন খবর-ই পাই না।

মনীরা: বাদ রাখেন তো ওর কথা আম্মা। মাইশাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। যা মন চায় করুক, ওর বাপ যেমন আহ্লাদ করে মাথায় উঠিয়েছে তেমন মজা বুঝবে। তারমধ্যে জুটছে ঐ মেধা,,মেধাটার সাথে মিশে আমার মাইশাটা নষ্ট হয়ে গেল।

নূরুন্নাহার: মেধা? এইটা আবার কে?

অদ্বিতী: সেইটা বলার জন‍্য-ই আমি আর বড়মা তোমার কাছে আসলাম দাদু। এই মেধার সাথে বড়বাবা দাদার বিয়ে ঠিক করেছে। মেয়েটাকে খারাপ বললেও খারাপের অপমান হবে। এত্ত শয়তান এত্ত অসভ্য এত্ত বেলাজ মানুষ জীবনে একটাও দেখি নি। বেয়াদপ অসভ্য মেয়ে একটা। তুমি জানো দাদু ও তো দাদার ইয়ারমেট ছিল ফেলটু মারতে মারতে আমার ক্লাসে পড়ে। আর আমাদের সারা। কত্ত লক্ষী মিষ্টি একটা মেয়ে। মেধার তো চেহারা ছাড়া কোন গুন-ই নেই। তুমিই বলো দাদু চেহারাই কি একটা মানুষের সব? চেহারা সবকিছু হলে দাদা সারাকে এত ভালবাসত না। সারা তো দাদার পুরো হৃৎপিন্ড। দাদা মুখে যাই বলুক সব অভিমান দাদু। সারার দহন ওকে প্রতিনিয়ত পোড়ায়। প্লিজ দাদু প্লিজ তুমি কিছু করো। বড়বাবাকে বোঝাও।

মনীরা: সবচেয়ে বড় কথা আমি আমার ছেলেকে স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে দেব না। আব্বার ইচ্ছায় সারা আর আকাশের আংটি বদল হয়েছিল। আমরা কথা দিয়েছিলাম সারা বোঝদার হলেই ওকে এই বাড়িতে উঠিয়ে আনব। তাহলে আকাশের অন্য কারো সাথে কেন বিয়ে হবে? আব্বার জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল ওদের বিয়ে দেওয়া। আপনার ছেলে সব ভুলে গেছে।

নুরুন্নাহার: বৌমা এইসব তোমরা আমাকে বলছ কেন?আমার ছেলে যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি তাতেই সমর্থন করব। সারা কোনদিন খানবাড়ির বৌ হবে না। ওর বাবা আমার সহজ-সরল মেয়েটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করেছিল। আমাদের মান-সম্মান ডুবিয়ে মেয়েটা বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। ওর কারণে লজ্জায় ঘর থেকে বেরোতে পারতাম না। আমাদের বাড়ির কাউকে দেখলেই লোকেরা হাসাহাসি করত। সেদিন থেকেই আমার মেয়ে আমার কাছে মৃত। সেইসব দিন ভুলে গেছি? ঐ সর্বনাশী অকৃতজ্ঞ মেয়ের পেটের সন্তানকে আমি আমার বংশের বৌ করে আনব,,তোমরা ভাবলে কি করে?

মনীরা: থাক আম্মা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনার ছেলে যেমন আপনিও তেমন। কতবছর আগের ঐসব ঘটনা তাও মনে পুষে বসে আছেন। দোষ হলে সেটা সারার মা-বাবার সারা কি করেছে? একটা কথা জেনে রাখেন আম্মা,,আপনার ছেলে যা খুশি করুক,,, আমার ছেলের জীবনটা আমি নষ্ট করতে দেব না। সাতটা বছর বড্ড কষ্ট পেয়েছে আর না,,,এইবার আমি নিজের দায়িত্বে ওর সারাকে এনে দিব। দরকার পড়লে আপার দুলাভাইয়ের পা ধরব যেন সারাকে ভিক্ষা দেয়। সারা ছাড়া কারো সাথে আমার ছেলের বিয়ে হবে না। আমার ছেলের মনটা আমি পড়তে পারি। আমি জানি সেই মনে কার বাস।

‘—————————————————————————-

সারা খেয়াল করল তাদের গাড়িটা শহর ছাড়িয়ে গেছে। জঙ্গলের দিকে এগোচ্ছে। ধ্বকধব্ক বুকে সে তুরাগের দিকে তাকাল। গাড়ি সমানে এগিয়ে চলেছে। অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে সারার। কি হচ্ছে এসব?
সারা: আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? গাড়ি থামান,, এক্ষুনি গাড়ি থামান,,, আমি নামব।

শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগে গাড়ির দরজা ঠেলতে থাকে। তার আগেই তুরাগ ওকে টান নিজের ওপর ফেলে কতগুলো কাপড় দিয়ে শক্তভাবে সারার চোখ- মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর গাড়িটা থামিয়ে ওকে পেছনের সিটৈ শুইয়ে আবার গাড়ি চালানো শুরু করল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here