# তোমার_নেশায় !
.
.
(০৯)
,
,
কঠিন হৃদয়ের মেয়ে তৃষ্ণা!
,
,
,
শান্তিতে ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ মনে হলো ঘাড়ে বার বার ভেজা স্পর্শ অনুভব হচ্ছে। চমকে উঠে দেখি আমার শয়তান বর টা এতোক্ষন তার হাত ভিজিয়ে ঠান্ডা লাগাচ্ছিল যাতে আমি উঠে যাই। আর আমি উঠে পড়তেই এমন ভাবে চোখ বুজে শুয়ে আছে যেন সে খুব ইনোসেন্ট, কিছুই জানেনা। আমি ও কম না পাশের টেবিলে থাকা একগ্লাস পানি আস্তে আস্তে ওর মুখের উপর দিতে লাগলাম। একটু পর ও ঠান্ডা ঠান্ডা বলে লাফিয়ে উঠল।
আমি ওকে দেখে হাসা শুরু করলাম। আর ও আমাকে টেনে শুরশুড়ি দিতে লাগল। অনেকক্ষন দুষ্টমির বলল,
:– ব্রেকফাস্ট বানাবেনা?? ক্ষিদে পেয়েছে তো!
,
:– হুম যাচ্ছি।
,
:– আর শুনো!
,
:– ব্রেকফাস্ট খেয়ে রেডি থেকো, আমরা বের হবো।
,
:– সিঙ্গাপুর যাবে যে শপিং করবেনা নাকি???
,
:– সত্যি???? Thank you!!!!
,
:– আচ্ছা যাও! hurry up…
,
,
আমি আজ আমার বরের জন্য আলুর পরোটা বানিয়েছি। ওর খুব পছন্দের! ওকে খাইয়ে নিজে একটু খেয়ে নিলাম। তারপর ফুফির রুমে গিয়ে ওনাকে মেডিসিন খাইয়ে দিলাম। আমরা তো কতো কি খেতে পারি এই বেচারি তো শুধু ইন্সুলিনের মাধ্যেমে স্যেলাইন আর মেডিসিন খেয়ে বেচে আছেন। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় ওনার জন্য! আমি তো কখন ও মা কে দেখিনি যদি উনি সুস্থ থাকতেন তাহলে হয়ত আমাকে মায়ের মতই ভালবাসতেন। আমি ফুফির পাশে বসে কতক্ষন রুপাঞ্জনের ব্যেপারে গল্প করলাম, কিন্তু অবাক হলাম উনি আগের মতো ওনার চোখের ফলক ফেলে আমার কথা সায় দেননা। হয়ত আমরা ওনাকে ছেড়ে সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছি বলে ওনার মন খারাপ। আমি ওনাকে প্রমিস করলাম আমরা ফিরে এসে ওনাকে আবার এই বাসায় নিয়ে আসবো। তারপর হঠাৎ মনে হলো, যাওয়ার আগে যদি একবার বাবার সাথে দেখা করে যেতে পারতাম খুব ভালো হতো। রুপাঞ্জন আমায় ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর বাবা পেলে অনেক খুশি হতেন। কিন্তু আমি রুপাঞ্জন কে কি একবার বাবার সাথে দেখা করার কথা বলব? যদি রেগে যায়? থাক তাহলে। আমি রুমে এসে দেখি রুপাঞ্জন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করছে।আমি ও আলমারি থেকে একটা গাঢ় নীল কালারের ড্রেস বের করে পরে নিলাম। ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল ঠিক করছি। তখন রুপাঞ্জন আমার কাছে এসে জিজ্ঞাস করল,
:– কি হয়েছে রুপশা?? মন খারাপ???
,
:– না তেমন কিছু না।
,
:– আরে বলোনা প্লিস! তুমি না আমাকে ভালবাস তাহলে তোমার মন খারাপ কারন জানার অধিকার আছে না আমার?
,
:–হুম!!
,
:– Now come on! Tell me..what happened??
,
:– আসলে কাল তো আমরা সিঙ্গাপুর চলে যাচ্ছি তাই আমি চাইছিলাম যাওয়ার আগে একবার বাবার সাথে দেখা করে যাই। যদি আপনি রাগ করেন তাহলে থাক!
,
:– আরে তোমার দেখা করার ইচ্ছা হয়েছে তো করবে। শপিং এর পর তোমায় তোমাদের বাসায় নামিয়ে দিব দেখা করে নিও, কেমন? এখন একটু হাসো!!
,
:– হুম!!
,
:– গুড গার্ল! চলো লেইট হচ্ছে।
,
আমরা গিয়ে লিফটে উঠলাম। আজ প্রায় সাড়ে চার মাস পর আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি। আলাদা রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে মনে। সাড়ে চার মাস আগে বিয়ের দিন এই লিফটে উঠার পর পাশে থাকা মানুষ টার প্রতি ছিল শুধু ঘৃন্না আর এখন বুক ভর্তি ভালোবাসা। আসলে মানুষের মন কত তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে সে নিজেও জানেনা। এইসব ভাবতে ভাবতে আবার লিফট এর দরজা খুলে গেল আমরা গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এলাম। তারপরে আমরা গাড়িতে উঠে বসতেই রুপাঞ্জন গাড়ি স্টার্ট করল। গাড়ি ছুটে চলছে আপন গতিতে ভালো লাগায় ভরপুর আমার মন। কতদিন পর বাবা কে দেখবো আজ। শপিং মলে এসে রুপাঞ্জন আমায় হাত ধরে কার থেকে নামালো। আমরা পুরো মল ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু কেনাকাটা করলাম এরমধ্যে শীতের কাপড় বেশি ছিল কারন ওখানেও এখন শীত চলছে। শপিং শেষে একটা রেস্টুরেন্ট এ ডুকলাম। রেস্টুরেন্ট এ ডুকে দেখি কতগুলা প্রেমিক যুগল নিজেদের জন্য অন্ধকার সিট টাই বেচে নিয়েছে। আজ এদের দেখে খুব হাসি পাচ্ছে বিয়ের আগে আমার এদের দেখে খুব রাগ হতো, খেয়ে দেয়ে কাজ নেই বলেই এরা প্রেম করে এটা আমার ধারনা ছিল। কিন্ত এখন রুপাঞ্জনের প্রেমে পড়ে বুঝতে পারছি আসলে প্রেম কতোটা রঙিন। এখন আমার নিজেকে কলেজ পড়ুয়া কোনো প্রেমিকা মনে হচ্ছে যে নিজের বিএফ নিয়ে রেস্টুরেন্ট এ এসেছে। আমরা একটা সিট এ গিয়ে বসে পড়লাম। রুপাঞ্জন ঠিক আমার পাশে বসল, তারপর ও দুইটা হট চকলেট অর্ডার করল। আমি তো এই প্রেমিক যুগল দের দেখে হেসেই চলেছি। রুপাঞ্জন এটা খেয়াল করল তারপর আমায় গুতো দিয়ে জিজ্ঞাস করল,
:- কি,,,, ওদের মতো প্রেমের মজা নিতে ইচ্ছা করতেছে বুঝি???
এই বলে একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে আরো কাছে এসে বসল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
:- না একদম না! আমি এদের প্রেমের স্টাইল দেখে হাসছি! ওই দেখুন ওই ছেলেটা ওর গিএফ এর চুল ধরে কতো চাপা মারছে ওকে ইম্প্রেস করতে।বলে আমাদের সামনের টেবিলে বসা কাপল কে দেখালাম। ওরা আমাদের পাশে হওয়ায় ওদের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
,
:– জান তুমি চুলে কি শ্যেম্পু ইউজ করো???
,
:– সানসিল্ক! কেন?
,
:- আমার তোমার সানসিল্ক শ্যেম্পু কে খুব হিংসে হয়। কেমন তোমার চুলের গন্ধ তোমার সাথে সারাক্ষন মিশে থাকে, আমি ও যদি পারতাম তোমার সাথে এইভাবে মিশে থাকতে!…………
,
আমি তো হাসতে হাসতে শেষ। রুপাঞ্জন আমাদের বিল মিটিয়ে তারাতারি বেরিয়ে এলো আর বলতে লাগল, আর কিছুক্ষন থাকলে তুমি নিশ্চিত আমাদের ধোলাই খাওয়াতে।
,
তারপর বাবার বাসার নিচে এসে আমাদের গাড়ি থামল। বাসা টা কে এক পলক দেখতে চোখের কোন থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কেন জানিনা মনে হয়, এই বাসায় আমার মায়ের গন্ধ মিশে আছে। খুব আপন লাগে এই বাসা কে। নেম প্যেলেটে বড় করে লেখা,” প্রত্যাশা কানন”
আমার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে রুপাঞ্জন বলে উঠল,
:– রুপশা তুমি যাও, আমি এখানে তোমার জন্য ওয়েট করছি।
,
:– কেন আপনি উপরে আসবেননা?
,
:– না, আমি পারবোনা।
,
:– কেন পারবেননা?? আপনি তো আমায় ভালোবাসেন তাহলে আমার বাবার সাথে দেখা করতে পারবেন না কেন?
,
:– হ্যা, আমি তোমায় ভালোবাসি কিন্তু তোমার বাবা আমার ফুফির সাথে যা করেছে সেটা তো ভুলে যাওয়ার নয়। আমি যদি সব ভুলে গিয়ে তোমার বাবা কে ক্ষমা করে দেই তাহলে ফুফি আমায় সেল্ফিস ভাববে। আর তাছাড়াও আমি তোমার বাবা কে অনেক অপমান করেছি তাই ওনার সামনে যাওয়ার মতো মুখ নেই আমার।
,
আমি আর কথা বাড়ালাম না। লিফট এ উঠে পড়লাম। ঠিকই তো এত বছরের রাগ, অভিমান ভুলানো এতো সহজ না। আমাকে ও ভালবেসেছে কারন আমি এইসবের মধ্যে ছিলাম না আর বাবা কে ক্ষমা করা যেত যদি ফুফি সুস্থ হয়ে যেতেন। কি আর করার! আমি লিফট থেকে নেমে বাসার কলিং বেল বাজালাম। কিছুক্ষন পর বাবা এসে দরজা খুলে দিলেন, আর আমাকে দেখে অনেক ক্ষানি চমকে উঠলেন,
:– রুপশা মা, তুই এখানে? ওই শয়তান টা দেখেনি তো??
,
:– না বাবা, ওই আমায় এখানে এনেছে।
,
:– ও তোকে নিজে এখানে এনেছে?? মানে???
,
:– আগে ভিতরে চলো সব বলছি!
,
আমি বাবা কে নিয়ে গিয়ে ভিতরে বসালাম। তারপর একেএকে সব খুলে বললাম শুধু রুপাঞ্জন আমার সাথে কি কি অত্যচার করেছে ওগুলা বলিনি। বাবা শুনে অবাক হয়ে রইলেন। তারপর জিজ্ঞাস করলেন,
:– তুই সত্যি বলছিস, রুপাঞ্জন তোকে মেনে নিয়েছে??
,
:– হুম বাবা এটাই সত্যি। আর জানো ও কাল আমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে ঘুরতে। সেটাই বলতে এলাম তোমায়!
,
:– কিন্তু মা, ব্যেপার টা এতো সহজে মেনে নিতে পারছিনা আমি। রুপাঞ্জন খান আর আশ্রাফ খান দুই বাপ ছেলে সার্থ ছাড়া কিছু করেনা। আর সেই জায়গায় ওরা আমাদের নিজেদের সব থেকে বড় শত্রু মনে করে, রুপাঞ্জন তোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বিয়ে করে এতো সহজে মেনে নিয়েছে?
,
:– বাবা,তুমি ওদের নিয়ে নিজের মনে সব নেগেটিভ ধারনা পুশে রেখেছো তাই এমন মনে হচ্ছে। আর রুপাঞ্জন সত্যি মনের দিক থেকে অনেক ভালো মানুষ! আর আমি তো কোনো অন্যায় করিনি শুধুমাত্র তোমার মেয়ে বলে ও আমার উপর রেগে ছিল। কিন্তু দেখো সময়ের সাথে সব রাগ কেটে গেছে।
,
:– ওর যদি সব রাগ কেটে যেত তাহলে তোর সাথে এলোনা কেন??
,
:– বাবা, উনি তোমাকে অনেক অপমানন করেছেন, কোন মুখে আবার তোমার সামনে এসে দাড়াবে?
,
:– কি জানি মা! তবুও তুই সুখে থাকলেই আমি ভালো থাকবো।
,
:– হুম আসি তাহলে। নিজের খেয়াল রেখো……..
,
এইবলে আমি লিফট এ উঠে গেলাম।বাবা লিফট এর দরজা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত
আমায় হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলেন। লিফট এর দরজা বন্ধ হতেই আহসান চৌঃ ভাবতে লাগলেন,
:– কে জানে আমার মেয়ে কি সত্যি সুখের দেখা পেয়েছে নাকি অযথা মরিচিকার পিছনে ছুটছে। তবুও আল্লাহ তুমি ওকে ভালো রেখো!
,
আমি গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে দেখি রুপাঞ্জন গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে রাস্তার ওপাশে। আমি ওকে হাত নেড়ে ডাকলাম যে আমি আসছি। আমি রাস্তায় পা বাড়াতেই কোথা থেকে এক বাইকার আমার খুব কাছে চলে এলো আমি এখন খুব জোরে দাক্কা খাবো ভেবে ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।কিন্তু আমি দাক্কা খেলাম না উল্টো রুপাঞ্জনের চাপা আর্তনাদ শুনতে পেলাম। তারাতারি চোখ খুলে দেখি আমাকে বাঁচাতে রুপাঞ্জন বাইকের সামনে চলে এসেছিল ফলে ও দাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যায় আর ওর হাত বেশখানি কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। আমি ব্যেস্ত হয়ে পড়লাম।গাড়িতে একটা ফাস্ট এইড বক্স থাকে এটা আমি জানতাম তাই ওইটা নিয়ে এসে কাদতে কাঁদতে রুপাঞ্জনের রক্ত মুছতে লাগলাম!
রুপাঞ্জন দেখে বলল,
,
:- কাদছো কেন পাগলি??
,
:– কি দরকার ছিল ওইভাবে বাইকের সামনে আসার কিছু হয়ে গেলে কি করতাম আমি??
,
:– একি কথা তো আমি ও বলতে পারি, তোমার কিছু হয়ে গেলে কি করতাম আমি তাই আর কিছু না ভেবে বাইকের সামনে চলে এলাম।
আমি রুপাঞ্জন কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলাম। রুপাঞ্জন আমাকে হাল্কা দাক্কা দিয়ে বলল,
:– এটা রাস্তা আর সবাই দেখছে আমাদের!
,
আমার তো খেয়ালি ছিল না এটা রাস্তা আর আমাদের চারপাশে একটা ছোটখাট ভীড় তৈরী হয়ে গেছে এতোক্ষনে। আমি লজ্জা পেয়ে উঠে দাড়ালাম। রুপাঞ্জনের হাতে ব্যন্ডেজ করে দিলাম। না এবার যে যাই বলুক! আমার রুপাঞ্জন আমায় মন থেকে ভালোবাসে এই বিষয় কোনো সন্দেহ নেই আমার। আমি ওকে নিয়ে বাসায় চলে এলাম। ওর হাতে ব্যথায় বলে নিজেই ড্রাইব করলাম কার। বাসায় এসে দেখি কয়েকজন লোক ফুফির রুমের জিনিস সরাচ্ছে। ওহহ আজকে তো ওনাকে আমার শশুরের বাসায় শিফট করা হবে। আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। আর রুপাঞ্জন ফুফিকে বিদায় দেওয়ার কাজে লেগে পড়ল।
,
,
,
# ধন্যবাদ