তোলপাড় পর্ব ১

তোলপাড়
লেখা- ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১
_________________
জৈষ্ঠ্যর ক্লান্ত দুপুর। সূর্য ঠিক মাথার উপরে, তার তির্যক উত্তপ্ত রশ্মিতে চারদিকে প্রখর গরম। দারোয়ান আহাদ মিয়ার নিমীলিতলোচন ঘুমে ঢুলুমুলু। অজ্ঞাত এক তরুণীর কণ্ঠ নিঃসৃত মিহি তরঙ্গধ্বনি দারোয়ানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।
“এখানে ফর্সা-লম্বা করে একজন ছেলে থাকে? চুল গুলো একটু বড়বড়, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঠোঁট গোলাপী। হাসলে একটা গেঁজ দাঁত দেখা যায়।”
চোখ খুলে সামনে দাঁড়ানো আগন্তুক তরুণীর দিকে তাকিয়ে মহাবিরক্তি নিয়ে দারোয়ান বলল, “ সব ব্যাচেলর ছেলেরা থাকে এইহানে,কার চেহেরা কি রহম সব কি আমি মুখস্থ কইরা রাখছি?”
অবসন্ন দুপুরে এমন অবন্তর প্রশ্ন শুনে দারোয়ান অমর্ষিত হলো খানিক।গেটের ভিতরের চার তলা আকাশি রঙের ভবন’টার দিকে বারংবার উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে অজ্ঞাত তরুণী। দারোয়ানের উত্তরে হতাশ হয়ে বলল, “আল্লু আর্জুনের মত খোঁচা খোঁচা দাড়ি,বড় বড় চুল, গোলাপী ঠোঁটওয়ালা কোন ব্যাচেলর ছেলে থাকে এখানে? আল্লু আর্জুন কে চিনেন তো? শুধু গেঁজ দাঁত’টা ব্যতিক্রম।এছাড়া একদম লুক অ্যালাইক আল্লু আর্জুন।”
তরুণীর কথা গুলো দুর্বোধ্য লাগলো দারোয়ানের কাছে।
দারোয়ান আপাদমস্তক এক নজর দেখলো তরুণী কে। বয়স ১৬-১৭ হবে। আলখোল্লার মত ঢোলাঢিলা হাঁটু ছুঁই ছুঁই বেগুনি রঙের একটা জামা পড়া,জিন্স প্যান্ট প্রায় হাঁটু অবধি তোলা।দুই কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো, ছোট ছোট সিল্কি চুল কাঁধ বরাবর গিয়ে পড়ে। চেহেরায় অস্থির ভাব,চোখে-মুখে চঞ্চলতার ঝিলিক। দারোয়ান সহজে ঝামেলা মিটাতে বলল, “আল্লু আর্জুন কেডায়? না,এই রহমের কেউ থাহে না।”
তরুণীর মুখো ব্যঁজন দেখে বুঝা যাচ্ছে দারোয়ানের এমন উত্তরে বিরক্ত সে। গলায় কিছু’টা রাগের ভাব এনে বলল, “আমি ভিতরে গিয়ে খুঁজে দেখি তাহলে।আমায় ভিতরে ঢুকতে দেন। জরুরি প্রয়োজন আছে।”
– “এইহানে ব্যাচেলর পোলাপাইন থাহে। কোন মাইয়া মানুষ এলাউ না।যে রাস্তা দিয়া আইছেন,ওই রাস্তা দিয়ে ভাগেন।”
একরোখা তরুণী ভিতরে ঢুকতে বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ায় কিছু’টা চেঁচিয়ে বলল, “আমিও তো ব্যাচেলর মেয়ে। ব্যাচেলর ছেলেদের খোঁজে তো ব্যাচেলর মেয়েরা’ই আসবে। নাকি বুড়ো বুড়ো বেটি’রা আসবে কোন’টা?”
আগন্তুক তরুণীর এরূপ আচরণে দারোয়ান অবাক হলো বেশ, “আজব মাইয়া মানুষ!এ্যাই আপনে কেডা?”
– “আমি অরূণী।আমায় যদি আজ এই বাসায় ঢুকতে না দেন তাহলে আপনার চাকরি খেয়ে ফেলব।”
চাকরি খাওয়ার কথা শুনে দারোয়ান অচিরেই ভীতিগ্রস্থ হয়ে পড়লো।অরূণী চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা রাখে কিনা সেটা ও ভাবলো না দারোয়ান। গলার স্বর নরম হয়ে আসলো।বলল, “বাসার সামনে বাগানে কার্তিক মশাই ফুল গাছে পানি দিতাছে। উনার লগে কথা কন,দেহেন ঢুকতে দেয় কিনা।”
এই টুকু বলে থেমে দারোয়ান গলা উঁচিয়ে ডাকল, “কার্তিক মশাই।ও কার্তিক মশাই।”
বুড়ো কার্তিকের কানের শ্রবণশক্তি বয়সের সাথে সাথে কমে এসেছে। কমপক্ষে দশবার ডাকতে হবে তাঁকে। দারোয়ান গলার আওয়াজ আরো বৃদ্ধি করে ডাকল। এগারো বার ডাকের মাথায় বৃদ্ধ কার্তিক জবাব দিলো, “কি হয়েছে দারোয়ান বাবু?”
কার্তিক কর্মকার দারোয়ানের ডাকে এগিয়ে আসতে লাগলো গেটের দিকে।বয়সের সাথে সাথে হাঁটার গতিও কমে এসেছে। অরুণী মহা চিন্তায় পড়ে গেল।মনে মনে ভাবছে, “কার্তিক মশাই কি বাসার কর্তা?”
অরুণীর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে দারোয়ান স্বস্তিপূর্ণ গলায় বলল, “যান এবার কর্তা বাবুর লগে কথা কন।ইনি বাসার মালিক কার্তিক কর্মকার।”
অরূণী তাকিয়ে দেখল সত্তরার্ধো বুড়ো এক লোক। চোখের মোটা ফ্রেমের চশমা দেওয়া। গলায় পৈতা ঝুলানো।কপালে তিলক কাটা। বয়সের ভারে শরীরের চামড়া কুঁচকে গিয়েছি।কালো,রোগা-পাতলা কার্তিক কর্মকার চমশা’টা মুছে চোখে দিয়ে অরুণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কি হয়েছে?কে তুমি?”
দারোয়ান এখন মনে মনে অপেক্ষায় আছে কখন কার্তিক কর্মকার অরূণী’কে বাসায় ঢুকতে না দিয়ে চলে যেতে বলবে। কিন্তু দারোয়ানের মনোবাসনা পূর্ণ হলো না। অরূণী বেশ সুললিত কণ্ঠে বলল, “কার্তিক মশাই আপনার সাথে কথা বলার জন্য সেই কখন থেকে ভিতরে ঢুকতে চাচ্ছি। কিন্তু আপনার এই চিমড়ে দারোয়ান ঢুকতেই দিচ্ছে না।”
অরূণীর এরূপ মিথ্যাচারের প্রত্যুত্তরে দারোয়ান এক নজর অরুণীর দিকে তাকায়,পরক্ষণে কার্তিক কর্মকারের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল, “কার্তিক মশাই এই মাইয়া একটু আগে কইল যে —-”
দারোয়ানের কথা কার্তিক মশাই থামিয়ে দিয়ে অরুণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আসো ভিতরে আসো তুমি।”
অরূণীর উপর রাগে দারোয়ান বিড়বিড় করতে লাগল। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল অরূণীর দিকে।
অরূণী কার্তিক কর্মকারে সাথে হেঁটে বাসার সামনে গেল।বাসার সামনে কিছু’টা জায়গা নিয়ে ফুল গাছ লাগানো।এর ভিতর সাদা গোলাপ’ই বেশি। ফাঁকে ফাঁকে তুলসী গাছের টব বসানো।লাল টকটকে সদ্য পরিস্ফুটিত গোলাপের দিকে অরূণীর দৃষ্টি আবদ্ধ।কার্তিক কর্মকার পানি দেওয়ার পাত্র’টা হাতে নিয়ে বলল, “নাম কি তোমার?কি বলবে বলো?”
অরূণী বুঝলো কার্তিক কর্মকার খুব ঠাণ্ডা মেজাজের ধীর স্থির প্রকৃতির মানুষ।অরুণী ভারি অবাক গলায় বলল, “কার্তিক মশাই আমি অরূণী। আমায় চিনেন না?”
কার্তিক কর্মকার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অরূণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “না তো চিনতে পারে নি।”
– “ভালো করে দেখুন। মনে করুন মশাই।”
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে চারদিক অবলোকন করছে অরূণী। যেভাবে হোক বাসার ভিতর ঢুকতে হবে।কার্তিক কর্মকার কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কি যেন ভাবলো। কয়েক মুহূর্ত পর চিন্তান্বিত চিত্তে বলল, “তুমি কি ইন্ডিয়া থেকে এসেছো?”
অরূণী সাত-পাঁচ না ভেবে বলল, “হ্যাঁ,হ্যাঁ কার্তিক মশাই আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি।”
কার্তিক কর্মকার একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলে আফসোস করে বলল, “ইন্ডিয়া থেকে চলে এসেছি বারো বছর হয়ে গেছে। কত পরিচিত মানুষ ছিলো সেখানে। এখন কারো সাথেই পরিচয় নেই।”
এত পূর্ব পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলে সবাই ই আনন্দে আটখানা দিয়ে যায় ।কার্তিক কর্মকারের চোখে-মুখে বিস্ময়। অতীতের স্মৃতি চারণায় একটু উদাস হয়ে গেল। অতীতে ফেলে আসা স্মৃতির কথা মনে পড়লে মানুষ স্বভানুসারে উদাস হয়ে যায়। কার্তিক কর্মকারের মনে কি চলছে অরূণী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তা বুঝতে চেষ্টা করল। আন্দাজে ঢিল মেরে কি ধরা খেলো?অরূণী খানিক’টা শঙ্কিত হয়ে বলল, “এবার চিনেছেন আমায় মশাই?আপনাদের পাশের বাসায় ভাড়া থাকতাম?”
কার্তিক কর্মকারের দিকে প্রশ্ন’টা ছুঁড়ে অজ্ঞাত এক শঙ্কা নিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো। কার্তিক কর্মকারের পাশের বাসায় ভাড়াটিয়া কি ছিলো? কার্তিক কর্মকার কিছু মুহূর্ত পর উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “এই তুমি সংকরের মেয়ে?”
অরূনীর চোখ-মুখে আনন্দ।ঢিল তাহলে ঠিক জায়গায় লেগেছে।
– “জ্বী মশাই। এতক্ষণে চিনলেন?”
কার্তিক কর্মকার চোখে-মুখে বিস্ময় আর গলায় আক্ষেপ। বলল, “কত ছোট ছিলে তুমি!আমার কোলে কত পটি করছ, হিসু করেছ।কত বড় হয়ে গেলে। এত বছরের ব্যবধানে নাম’টা ভুলে গেছি তোমার।”
এত পূর্ব পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হওয়ার কার্তিক কর্মকার প্রবল আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু মুহূর্ত পর কার্তিক কর্মকার অরূণীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। সগ্রহে বিস্মিত হয়ে বলে, “আচ্ছা অরূণী তুমি বাংলাদেশে আসলে কিভাবে?আমার ঠিকানা বা পেলে কোথায়?”
অরূণীর চটপট উত্তর দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। শেষমেষ ধরা খেয়ে যাবে? মস্তিষ্কের ভিতর থেকে হাতড়ে হাতড়ে বুদ্ধি বের করতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
– “কার্তিক মশাই আমি লেখাপড়া করতে আসছি বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আসার সময় আব্বা আপনার ঠিকানা’টা দিয়েছে।খুঁজবো খুঁজবো করে খোঁজা হয়নি। ভেবেছি আব্বার দেওয়া ঠিকানায় এখনো থাকেন কি থাকেন না তাই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম।”
কার্তিক কর্মকারের মুখে প্রসন্ন ভাব। কোটরগত ক্ষুদ্র হয়ে আসা তামাটে চোখ দুটো’টে খানিক চমক। আনন্দোচ্ছল হয়ে বলে, “চলো অরূণী বাসায় চলো। কয়দিন থেকে যাবে কিন্তু।”
অরূণীর ভিতরে ভিতরে বাঁধ ভাঙা আনন্দ হলেও বাইরে তোষামোদ ভাব। নিরুদ্বেগ ভাব নিয়ে বলল, “না মশাই, অন্যদিন আসবো।”
– “আহা অরূণী! চলো তো তুমি। কত্ত বছর বাদে দেখা। তোমার আব্বা’কে মনে পড়ে খুব।কি যে ভালো মানুষ ছিলো। আমরা প্রতিদিন সকালে এক সাথে হাঁটতে বেরুতাম, বয়সে আমার অনেক ছোট হলেও আমরা ছিলাম বন্ধুর মত।”
এই টুকু বলে থেমে কার্তিক কর্মকার আবার উদ্বেগপূর্ণ গলায় বলল, “সংকরের কাছে ফোন দেও তো অরূণী। এখুনি দেও। কথা বলি তোমার সামনে বসে।”
অরূনী ভড়কে গেল।ফোন নম্বর! কার ফোন নম্বর দিবে?অরূণী চটপট করে আহত গলায় উত্তর দিলো, “কার্তিক মশাই বাবা তো বেঁচে নেই। আমি বাংলাদেশে আসার কয়েক মাস পর মারা গিয়েছে।”
কার্তিক কর্মকার আঘাতপ্রাপ্ত হলো তীব্র ভাবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। খানিক পরে ব্যথিত হয়ে আফসোস করে বলে, “বড্ড ভালো মানুষ ছিলো সংকর! এত অল্প বয়সে মারা গেল?”
কার্তিক কর্মকার উন্মনা হয়ে গেল। ব্যথিত ভাব’টা গলায় আরো প্রখর ভাবে আত্মপ্রকাশ করল, “ঈশ্বর উনাকে স্বর্গবাসী করুক।”
অরূণী শুধু বার বার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মানুষ’টার খোঁজে। চোখে চঁচল ভাব। মনে মনে ভারি খুশি, অবশেষে বিল্ডিং এর ভিতর ঢুকতে পারবে। কার্তিক কর্মকার ঔদাস্য হয়ে রইল। অরূণী আস্তে করে ডাকে, “মশাই।”
কার্তিক কর্মকারের সম্বিত ফিরে। অরূণীর দিকে তাকিয়ে বলে, “চলো বাসায় চলো।”
__________________________
কার্তিক কর্মকার বাসার নিচ তলা’কে থাকে। আগে তিন তলায় থাকতো। কিন্তু এখন সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় ওঠতে ওঠতে কার্তিক কর্মকারের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। অরূণী আশাহত হলো। ভেবেছে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় আশেপাশের রুম গুলোতে উঁকি দিয়ে গেঁজ দাঁতওয়ালা কে খুঁজবে। কার্তিক কর্মকার ডোর বেল চাপতেই বিশাল দৈত্য আকৃতির মাঝ বয়সি এক মহিলা দরজা খুলে দেয়। মহিলার গায়ের রং টকটকে ফর্সা, অতিরিক্ত ফর্সার কারণে লাল ত্বক লাল দেখাচ্ছে। গাল ভর্তি পানের খিলি। পানের পিকে মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে। মহিলার দুই গালে যে পরিমাণ মাংস আছে অরূণীর সারা গায়ে সে পরিমাণ মাংস নেই। অরূণী একবার দরজার দিকে তাকায় আর একবার মহিলা’টার দিকে তাকায়।দরজা’টা বেশ চিপা।এই দরজা দিয়ে এই মহিলার চলাচল করতে যথেষ্ট অসুবিধায় পড়তে হয় বোধ হয়।কার্তিক কর্মকার কি রোগা পাতলা অথচ তাঁর মেয়ে! অরূণী হালকা হেসে কার্তিক কর্মকারের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার মেয়ে মশাই?”
অরূণীর কথায় মহিলা খ্যাক করে ওঠে। কার্তিক কর্মকারের মুখ থমথমে। বুঝা গেল অরূণীর কথায় সে অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে গেল। কার্তিক কর্মকার অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “না,না আমার স্ত্রী। ইন্ডিয়া থেকে চলে আসার দুই বছর পর আমার প্রথম স্ত্রী মারা যায়। তারপর আবার বাংলাদেশে বিয়ে করি।”
অরূণীর কানে স্ত্রী শব্দ’টা প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। অরূণী একবার কার্তিক কর্মকারের দিকে তাকায়, আর একবার কার্তিক কর্মকারের স্ত্রীর দিকে তাকায়। মনে মনে একটা আগাম ভবিষ্যৎ বাণী বের করে। কোন একদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে খবরের কাগজে দেখবে, “স্ত্রীর নিচে চাপা পড়ে কার্তিক কর্মকারের মৃত্যু।”
মনে মনে এই কথা’টা ভাবতে ভাবতে ফিক করে হেসে ওঠে অরূণী। কার্তিক কর্মকারের স্ত্রী সঞ্জিতা কর্মকার কঠিন চোখে তাকায় অরূণীর দিকে।অরূনীর হাসি তৎক্ষণাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর বোঝা গেল সঞ্জিতা কর্মকার আন্তরিক মানুষ। আর কার্তিক কর্মকারও অতিথির প্রতি বেশ মনোযোগী।
কার্তিক কর্মকার সঞ্জিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “সঞ্জিতা অরূণীর জন্য ভালো-মন্দ রান্না করতে বলো।”
সঞ্জিতা কর্মকার উত্তর দেওয়ার আগেই অরূণী বলে, “সেকি মশাই! মন্দ রান্না কেন করবে? শুধু ভালো রান্না করবেন।”
অরূণীর এরূপ কথায় সঞ্জিতা কর্মকার বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কার্তিক কর্মকারের মুখের ভাব নিতান্তই স্বাভাবিক। কিশোরীদের চটপটে স্বভাব কার্তিক কর্মকারের বড়ই পছন্দ। কার্তিক কর্মকার বলল, “অরূণী তুমি কি কি খেতে পছন্দ করো?”
অরূণী কাঁধে থাকা ব্যাগ থেকে খাতা কলম বের করে পছন্দের খাবারের তালিকা করে সঞ্জিতা কর্মকারের হাতে ধরিয়ে দিলো। সঞ্জিতা কর্মকার বিরক্ত হলো কিনা তা তাঁর মুখাবয়বে বোঝা গেল না।
সঞ্জিতা কর্মকার লিস্ট’টা হাতে রান্না ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল। গলা উঁচিয়ে হাঁকতে লাগলো, “মিতু, মিতু।” মিতু বাসার কাজের মেয়ে। রান্নাঘরে গরমে আর আগুনের আঁচে ঘেমে একাকার। হাতের পৃষ্ঠদেশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “জি খালা।”
সঞ্জিতা কর্মকার মিতুর হাতে লিস্ট’টা গুঁজে গিয়ে গোমরা মুখে বলল, “তোর কর্তা কোত্থেকে তাঁর ইন্ডিয়ান পূর্ব পরিচিত আত্মীয় ধরে এনেছে। দুপুর কি কি খাবে তার তালিকা করে দিয়েছে। কোনো সৌজন্যবোধ আছে বল?আবার আমায় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে মশাই এটা আপনার মেয়ে?”
শেষ কথা টুকু শুনে মিতু খুব কষ্টে হাসি চাপিয়ে রাখলো। কিছুতেই হাসা যাবে না সঞ্জিতা কর্মকারের সামনে। সঞ্জিতা কর্মকার চলে যাওয়ার পর মিতুর ভিতরে রুদ্ধ হয়ে থাকা হাসি বের হতে লাগলো, মিতু হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
__________________________
রান্না ঘর থেকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ আসছে। মুরগির রোস্টের ঘ্রাণ আসছে। অরূণী চোখ বুঁজে ঘ্রাণ শুঁকতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলছে, “ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজন।” কার্তিক কর্মকার বাসা থেকে বের হয়ে গেছে একটু আগে। মিতু রান্না করছে। আর সঞ্জিতা কর্মকার অরূণীর একটু তফাতে বসে আছে। অরূণীর সাথে টুকটাক কথা বলছে। বাসায় আসার পর প্রথমে সঞ্জিতা কর্মকার যে আন্তরিক ভাব দেখিয়েছে, খাবারের তালিকাটা দেওয়ার পর সে আন্তরিক ভাবটা বাষ্পকারে উড়ে গেল। অরূণীর ব্যাগের ভিতর থাকা ভাইব্রেশন করা ফোনটা কেঁপে ওঠছে। অরূণী দ্রুত ফোন রিসিভ করে আড়ালে চলে গেল। ওপাশ থেকে অস্থির গলায় তাইতি বলল, “অরূ তুই কই?শিপন স্যার আজ উচ্চতর গণিতের সাপ্তাহিক পরীক্ষা নিয়েছে প্রাইভেটে। স্যার আগেই বলেছে যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে না তাঁদের আর পড়াবে না। আজ তোর নাম সবার আগে বলেছে।”
অরূণী নিরুদ্বেগ ভাবে বলল, “বাসি-পচা কথা বাদ দে। এমন নাটক জুড়ে দিবো শিপন স্যার কেনো তাঁর বাপও পড়াবে।”
– “তুই কোথায় গিয়েছিস সেটা তো বলবি?”
– “ওইযে সেদিন একটা ছেলে দেখে প্রেমে পড়েছিলাম,গেঁজ দাঁতওয়ালা?ছেলে’টা সেদিন যে বাসায় ঢুকেছে আমি এখন সে বাসায়।”
তাইতি যথারীতি অবাক। তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল, “কি বললি? অরূণী তুই পাগল হয়েছিস? ওখানে সব ব্যাচেলর ছেলেরা থাকে। ওখানে তোকে ঢুকতে দিলো কে?আর ঢুকতে দিলেও তুই ওই বাসায় কেন ঢুকবি?”
তাইতি একটু থেমে হতবুদ্ধি হয়ে আবার বলল, “অরূ ওখানে সব ছেলেরা থাকে!তুই কি করিস সে বাসায়?”
– “কোন কিছু সম্পূর্ণ না শুনে এত হাইপার হস কেন? আমি কি ব্যাচেলর ছেলেদের রুমে?আমি কার্তিক কর্মকারের বাসায়। এই বাসার মালিক কার্তিক কর্মকার।”
তাইতির বিস্ময়ের পাল্লা আরো ভারি হয়ে আসে, “তোকে বাড়ির কর্তা তাঁর রুমে নিয়ে বসিয়ে রেখেছে?” তাইতি এইটুকু বলে থেমে নানান আশঙ্কায় উতলা হয়ে বলল, “অরূ তুই চলে আয় তাড়াতাড়ি। বাড়িওয়ালার উদ্দেশ্য খারাপ বোধ হয়। ওই ছেলে’কে আমি খুঁজে দিবো তোকে।তুই তাড়াতাড়ি…”
তাইতির কথা শেষ হওয়ার আগেই অরূণী চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলে, “মাথায় বুদ্ধি থাকলে শুধু বাসায় ঢুকতে দেওয়া না, রোস্ট বিরিয়ানি সব খাওয়া যায়।”
তাইতি কিছু বলতে গেলে অরূণী খ্যাক করে ওঠে আবার বলে, “বুঝে না শুনে না ছাগল বান্ধে ঠ্যাংগে‌। বাড়িওয়ালা হলো বুড়ো ধুন্দুল।”
অরূণী চট করে ফোনের লাইন কেটে ফোন’টা বন্ধ করে রাখে।অরূণী জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, উঁকি-ঝুঁকি মারছে কাঙ্ক্ষিত মানুষ’টা কে দেখছে না। কিছুক্ষণ পর রুমের ভিতর থেকে ডাক আসে, “অরূণী,অরূণী।”
কার্তিক কর্মকারের নিস্তরঙ্গ গলা। অরূণী সেদিকে এগিয়ে যায়। একবার ছাদের ওজুহাতে উপরে যেতে পারলো ভালো হলো। অরূণী কার্তিক কর্মকারের কাছে গিয়ে বলল, “কার্তিক মশাই, ছাদে কি ফুল গাছ আছে?”
কার্তিক কর্মকার ভারি উৎসুক হয়ে বলে, “ফুল গাছ, সবজি গাছ সব আছে। চল্লিশ জাতের ফুল গাছ আছে।”
– “আমি একটু ছাদে গিয়ে দেখে আসি?”
অরূণী কথা’টা বলার সাথে সাথে হুঙ্কার ছাড়ে সঞ্জিতা কর্মকার, “ছাদে ভাড়াটে ছেলেরা ক্যারম খেলে। বেড়াতে আসছো ভালো কথা, রুম থেকে এক পা এদিক-সেদিক বের হবে না।”
খাবারের তালিকা দেওয়ার পর থেকে অরূণীর প্রতি সুযোগ পেলেই উগ্র মেজাজ দেখাচ্ছে সঞ্জিতা কর্মকার।‌অরূণীর চোখে হতাশা। মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ উপচে পড়ছে। অনেক ছলচাতুরি করেও রুম থেকে বের হতে পারেনি। বাসায় এসেও খুঁজতে পারলো না।অরূণী উদ্দেশ্য অসিদ্ধি হলো। সঞ্জিতা কর্মকারের দিকে যতবার তাকায় ততবার’ই অরূণীর চোখ দুটো ফার্নেসের চুল্লির মত জ্বলে ওঠে। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং রুম থেকে সঞ্জিতা কর্মকার ডাকলো, “অরূণী খেতে আসো।”
আর যা হয়েছে আর না হয়েছে দুপুরে জম্পেশ খাওয়া হবে। এই ভেবে মন ভালো করে ডাইনিং রুমের দিকে গেল। গেঁজ দাঁতওয়ালা কে যেভাবে হোক খুঁজে বের করবেই। আজ না হয় কাল।
অরূণী গিয়ে টেবিলে বসে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো লিস্ট অনুযায়ী সব ঠিক আছে কিনা? সঞ্জিতা কর্মকার বলে ওঠল, “সব ঠিকঠাক আছে। খাওয়া শুরু করো।”
সঞ্জিতা কর্মকারের গলায় ব্যঙ্গাত্মক একটা ভাব ছিলো। অরূণী সেদিকে কান দিলো না। খাওয়া শুরু করল। সব খেয়ে শেষ করে টেবিল থেকে ওঠল। এত খেয়েছে পেটের ভারে হাঁটতে পারছে না, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মিতু হাসতে হাসতে বলল, “গায়ে তো দুই ছটাক মাংসও নাই! এত খাও ক্যামনে?খাও তো খাও মোডা হও না ক্যা?”
অরূণী মনে মনে ভাবছে, “মিতু কি অপমান করেছে আমায়?” অরূণী মিতুর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, “এমন চিকন হওয়ার জন্য প্রতিদিন সকাল সকাল দৌড়াতে হয়। তুমি বুঝবে কি?”
অরূণী কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো।বিকাল হয়ে আসল, অরূণী জানালার ফাঁক দিয়ে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। না, কাঙ্ক্ষিত মানুষ’টা কে দেখছে না। একটু পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে। কার্তিক কর্মকার বার বার বলছে, “অরূণী থেকে যাও।”
খুব জোর গলায় সাধছে। অরূণী হেসে বলে, “আবার আসব মশাই। ভালো- মন্দ খেতে।”
– “তুমি থাকো কোন জায়গায়?”
– “আপনার বাসার সামনে দিয়ে যে রাস্তা গেছে ওই রাস্তার ডান মোড়ে গেলে আরেকটা রাস্তা বামে মোড় নিয়েছে। সেখান দিয়ে সোজা দক্ষিণে দশ মিনিট হাঁটতে হবে। তারপর আবার বামে যেতে হবে। তারপর আবার সোজা রাস্তা। রাস্তার মাথায় বড় মসজিদ। মসজিদের পিছনে যে রাস্তা গেছে সে রাস্তা দিয়ে পশ্চিমে যাবেন। পশ্চিমে গিয়ে দক্ষিণে তারপরই আমার বাসা।”
কথা গুলো’তে কার্তিক কর্মকারের মাথায় জট পাকিয়ে গেল। কার্তিক কর্মকার হাঁ করে তাকিয়ে আছে অরূণীর দিকে। অরূণী হেসে বলল, “আচ্ছা আসি। আবার আসবো।”
__________________________
অরূণী বাসায় যায়।বিশাল আলিশান বাড়ি। নামকরা ইঞ্জিনিয়ার সাহেদ আহমেদের এক মাত্র মেয়ে অরূণী। গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু মায়াবী বটে। অরূণীর চঞ্চলতা যেন মায়া’টা আরো গাঢ় করে দেয়। অরূণী পা টিপে টিপে বাসার ভিতর খুব সাবধানে ঢুকে। আকাশ-পালাত ফাটিয়ে হঠাৎ সেলিনা আহমেদ চিৎকার করে ওঠে, “অরূণী।”
খুব লম্বা সে ডাক। সাঁওতাল শিকারীর কোচে ঘা খাওয়া গুঁইসাপের মত রাগে গড়গড় করছে সেলিনা আহমেদ। রোষপূর্ণ চোখে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, “কোথায় গিয়েছিলি তুই?কোথায় গিয়েছিলি? সারাদিন কোথায় ছিলি? আজ শিপন স্যারের কাছে তোর উচ্চতর গণিত পরীক্ষা ছিলো। আর পড়াবে না তোকে শিপন স্যার। কোনো টিচার এক মাস পড়িয়ে তোকে আর পড়াতে চায় না।”
সেলিনা আহমেদের রাগে অরূণীর মাঝে তেমন ভাবান্তর পরিলক্ষিত হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলে, “উচ্চতর গণিত আমার অপশনাল সাবজেক্ট। অপশনাল মানে কি? ঐচ্ছিক! আমার ইচ্ছা হলে দিবো পরীক্ষা নয়ত দিবো না।”
অরূণী আর এক দন্ড না দাঁড়িয়ে চলে গেল রুমের দিকে। সেলিনা আহমেদ তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে। অরূণীর কানে গেল, “আজ সূর্য আসুক!”
– “আম্মা এখন রাত হয়ে গেছে প্রায়। রাতের বেলায় সূর্য আসবে কোত্থেকে?”
অরূণীর গলায় রসিকতা। সেলিনা আহমেদের ক্রোধ আরো বৃদ্ধি পেল। অরূণী বিকট শব্দে দরজা আটকে দেয়। গোসল সেরে এসে বন্ধ করে রাখা ফোন’টা অন করে তাইতির কাছে কল করে। অরূণী হ্যালো বলতেই তাইতি বলে, “ সমস্যা কি রে তোর? ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি কেন তখন?”
– “তখন আমি কার্তিক কর্মকারের বাসায় ছিলাম।আর যাই হোক কার্তিক কর্মকার চমৎকার মানুষ। কিন্তু বউ’টা দেখতে মিষ্টি কুমড়া আর আচার-আচরণ বোম্বাই মরিচের মত।”
তাইতি গাঢ় স্বরে বলল “তুই কিভাবে কি করলি?একদম বাসার মালিকের বাসায় গিয়ে উঠেছিস?”
– “একেই বলে বুদ্ধির খেল। শুধু বাসায় যাওয়া না। রোস্ট, বিরিয়ানি সব খেয়ে এসেছি।”
অরূণী এইটুকু বলে থেমে হতাশ গলায় বলল, “শুধু যার খোঁজে গিয়েছি তাঁকে পাইনি।”
– “বাসা পর্যন্ত গিয়েও পেলি‌ না? আর তোর বাপের এত টাকা তাও তোর মানুষের বাসায় গিয়ে ওভাবে খেতে হবে কেন?”
অরূণী আক্ষেপ করে বলল, “কার্তিক কর্মকারের বউয়ের জন্য ঝামেলা’টা হলো ।ওভাবে খেতে ভালো লাগে। এডভেঞ্চর বুঝলি?”
– “তুই যে ওই গেঁজ দাঁতওয়ালা কে এভাবে খুঁজছিস ,এমন তাগড়া জোয়ান সুদর্শন পুরুষ তাঁর কি গার্লফ্রেন্ড নেই?গিয়ে দেখ বউও আছে। নাম- ধাম কিছুই জানিস না। শুধুই পাগলামী।”
অরূণী ধমক দিয়ে ওঠে। তাইতি হেসে বলে, “তুমি বৃথাই সেজেছো বৈরাগী।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here