তোলপাড় পর্ব ২০

ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২০
_________
সকালেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো অরূণীর পরিবারের সবাই। অরূণীদের মামার বাসার সবার মুখ থমথমে।সবার ধারণা সিফাজের বিষয়’টার জন্য সূর্য রাগ ধরে এভাবে চলে যাচ্ছে। সূর্য আর সাহেদ আহমেদ সিফাজের বিষয়’টার জন্যই ক্ষুব্ধ। কিন্তু অরূণীর মনে অন্য দুঃখ। সবকিছু বিষাদ লাগছে অরূণীর কাছে।কোথায়ও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে, মন’টা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে।কি এক শূন্যতা ঘিরে ধরেছে অরূণী’কে।অরূণী জানে এই শূন্যতা কখনো পূর্ণ হবে না। তবুও শূন্যতা নিজ নিয়মে অভাব অনুভূত করায়। রুদ্র’কে নিয়ে অরূণীর সব ধারণাই মিছে হয়।একটা মানুষ এতটা নিরাবেগ,কৌতূহলহীন! প্রখর অভিমানে অরূণীর মন বেদনায় ভরে ওঠে।এই অভিমান রুদ্র কখনো জানবে না,জানার চেষ্টাও করবে না।এ যেন বৃথা অভিমান।
বিকালের দিকে বাসায় পৌঁছে অরূণীরা।বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই দেখে শামীমা মেইন গেটে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে হাসির ঝলক। ওঁদের আসার খবর পেয়ে শামীমা আধা ঘন্টা আগেই এসে হাজির হয়েছে। সেলিনা আহমেদ মনে মনে রাগে গড়গড় করছে, কিন্তু প্রকাশ করার সাহস পাচ্ছে না।এই বয়সে একটা মেয়েকে পছন্দ করতেই পারে।এমন তো না যে অরূণী সিফাজের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। পছন্দ করে এই বিষয়’টা নিয়ে এত ঝামেলা করার কি দরকার ছিলো! বুঝিয়ে বললেই হতো।এই বিষয় গুলো মনে মনে ভাবলেও মুখের বলার সাহস নেই সেলিনা আহমেদের। সাহেদ আহমেদ যে তাহলে গিলে খাবে তাঁকে।
বাসার কাজের লোক ব্যাগ,লাগেজ নামাচ্ছে গাড়ি থেকে।সাহেদ আহমেদ গাড়ি থেকে নেমে শামিমার দিকে তাকিয়ে বলল, “শামীমা কেমন আছিস?”
শামীমা মুখে হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিলো, “ভালা না কাকা।আপনাদের ছাড়া ভালা থাকি কেমনে?”
অরূণী উদাস মনে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি অকারণে নিবদ্ধ করে রেখেছে গেটের দিকে। শামীমা জিজ্ঞেস করল, “কি অরূণী মন খারাপ?”
অরূণী ধ্যান ভেঙ্গে তাকালো শামীমার দিকে।হাসলো একটু,হাসতে ইচ্ছে করছে না তবুও।এই শামীমা মানুষ’টা যেন কেমন।অরূণী কখন কেমন মেজাজে থাকে এক পলকেই বলে দিতে পারে অনেক বছর ধরে কাজ করে অরূণীদের বাসায়।অরূণী’কে ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে তাই হয়ত বুঝতে পারে।অরূণী বলল, “না আপা মন খারাপ না।”
তারপর হাই তুলতে তুলতে অলস ভঙ্গিতে আবার বলল, “এক টানা কয়েক ঘন্টা গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে মাথাটা ঝিমঝিম করছে।”
হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে অরূণী।স্বপ্নের মত কয়েক’টা দিন কেটেছে,ঘুম ভাঙতেই সব যেন হারিয়ে গেল। রুদ্রের প্রতি রাগ, অভিমানে অরূণীর চোখ ছলছল। অস্থির লাগছে অরূণীর,নিজের উপর ক্ষোভ হচ্ছে। কেন নিজেকে দাবিয়ে রাখতে পারছে না?অরূণী বিছানা ছাড়ে। বারান্দায় অস্থির ভাবে পায়চারি করে।মনটা ছটফট করে।ছাদে যায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে।আবার রুমে গিয়ে বসে থাকে। রুদ্র’কে ভুলে থাকার বৃথা চেষ্টা!
_______
ভার্সিটি থেকে ফিরে লম্বা ঘুম দিয়েছে রুদ্র। রাতে বাসে ঘুম হয় নি,বিয়ের অনুষ্ঠানেও ঘুমানোর সুযোগ হয় নি। রাতে জার্নি করে ফিরে সকালে পরীক্ষা! সব মিলিয়ে নাকাল অবস্থা। সন্ধ্যায় কিরণের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। রুদ্র তীব্র বিরক্ত হয়ে চোখ জোড়া মেলে গর্জে ওঠে বলল, “সমস্যা কী তোর?”
– “মাগবিরের আজানের সময়ও ঘুমাবি তুই?”
রুদ্রের একটু টনক নড়লো।আরো কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকলো। লম্বা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গে। অলস ভঙ্গিতে বলল, “কয়েক রাত না ঘুমানোর কারণে শরীর’টা ক্লান্ত হয়ে গেছে।”
কিরণ ভারী উৎসাহ আর কৌতূহল নিয়ে বলল, “তোদের দেখা হওয়ার কাহিনী শোনার জন্য আমার পেটের ভাত হজম হচ্ছিলো না।আমি তো স্তম্ভিত,বিস্মিত হয়ে গেছিলাম।বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার! উফ্ দোস্ত ভাবতেই কি ফিল আসে।”
রুদ্রের গা ছাড়া ভাব, “আরে ভাই কোনো কাহিনী হয় নি।দেখা হয়েছে, একটু-আধটু কথা হয়েছে।এই তো।”
কিরণ সন্দিগ্ধ হয়ে বলল, “তোদের বাসায় থেকেছে,তুই ওঁর মামার বাসায় গিয়েছিস।আর ওই মেয়ে তোকে কিছু না করে ছেড়েছে?”
রুদ্র হো হো করে হাসে, “কী করবে আমায়?”
রুদ্রের গা ছাড়া ভাব দেখে কিরণ বিরক্ত হয়ে বলল, “সাহেদ আহমেদের মেয়ে!এত প্রতিপত্তি তাঁর।”
কিরণ একটু থেমে দরাজ কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তির মত টেনে টেনে আবার বলল, “সাহেদ আহমেদের আছে যত ধন-ধৌলত,টাকা-কড়ি, অর্ধেক তাঁর ছেলের আর অর্ধেক তো তোরই।”
কিরণের ভাব-ভঙ্গিমা দেখে রুদ্র না হেসে পারলো না।একটু হাসলো।হাসি’টা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব হলো না। গম্ভীর গলায় বলল, “মেয়েটা এত পাগলামি করে!আরে প্রেম-ভালোবাসা এভাবে হয়?”
– “প্রেম ভালোবাসা এভাবেই হয়। কিন্তু তুই তো ছ্যাকা খেয়ে চিৎ হয়ে গেছিস।”
রুদ্র বলল, “তোর গার্লফ্রেন্ডের মত গার্লফ্রেন্ড থাকার চেয়ে সিঙ্গেল থাকা মঙ্গল। গার্লফ্রেন্ডের পারমিশন ছাড়া টয়লেটেও যেতে পারিস না।”
– “এই কথার ভিতর আমার গার্লফ্রেন্ডের প্রসঙ্গ কোত্থেকে আসলো?”
রুদ্র মনে মনে বলল এটা ছাড়া তো আর তোকে থামানোর উপায় নেই। কিন্তু রুদ্রের ধারণা মিথ্যে করে দিলো কিরণ।সে থামলো না। অতি উৎসাহে ফেটে পড়ছে। কৌতূহলে মাখামাখি অবস্থা। বলল, “এখন তো আত্মীয় হয়ে গেল।মাঝে মাঝে বাসায় যাবি চোখাচোখি হবে! কি কাকতালীয় ব্যাপার।”
রুদ্র হালকা গলায় বলল, “হইছে থাম তুই!”
কিরণ তাঁর স্বভাবনুসারে থামে না। যতক্ষণে নিজের কৌতূহল না মিটবে কতক্ষণ থামবে না। অসীম কৌতূহল নিয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।বিষয়’টা নিয়ে রুদ্রের থেকে কিরণ যেন বেশি ভাবাবিষ্ট।
______
অরূণী শক্ত হলো।পনেরো দিন ধরে রুদ্র’কে ফোন দিলো না। কোনো রকম যোগাযোগ করলো না। কিন্তু ভালো থাকতে পারছে না।কিশোরী মনের প্রেম দমিয়ে রাখতে পারে ক’জন?তাও আবার এমন বাড়াবাড়ি রকমের প্রেম।অরূণীর এই হঠাৎ পরিবর্তন বাসার সবার চোখে পড়ে।রুমে একা একা চুপচাপ থাকা,তেমন হৈচৈ নেই। রুদ্র কি পারে না একবার ফোন দিতে? বন্ধু সমাজের সবাই অরূণীর এই পরিবর্তন সরু চোখে দেখে,কেউ কেউ যথারীতি বিরক্ত।একটা ছেলের জন্য এমন পাগলামী,পরিবর্তন হাস্যকর বটে! অরূণী ডায়েরি কিনে। মনের কথা গুলো সব ডায়েরিতে লিখতে শুরু করে। রাতে হুটহাট ঘুম ভাঙ্গতেই অসীম শূন্যতা অনুভূত হয়।ডায়েরি নিয়ে বসে। ধীর হাতে লিখে, “পরিবর্তন কাকে বলে বুঝতে হলে কিশোরী বয়সে সদ্য প্রেমে পড়া একটা মেয়ে’কে দেখুন।কেমন বাড়াবাড়ি রকমের অনুভূতি। এসব কারো কারো কাছে পাগলামি কিংবা বয়সের খামখেয়ালি।”
এই টুকু লিখে আর কিছু মাথায় আসে না। ছন্নছাড়া অবস্থা। কয়েকদিন পর এক দুপুরে অরূণী বাসার উদ্দেশ্যে ফিরছিলো। হঠাৎ এক দোকানের ভিতর থেকে ডাক আসে, “অরূণী‌।”
অরূণী চারপাশে তাকায়। কোত্থেকে ডাক’টা এসেছে বুঝতে পারলো না। হঠাৎ একটা দোকানের ভিতর থেকে রুদ্র বের হলো। অরূণীর বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কেঁপে ওঠলো শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা।অরূণীর ভিতর থেকে কান্না উপচে উঠছে যেন, ঠোঁট বেঁকে আসছে চাপানো কান্নার বেগে। রুদ্র হাসি মুখে বলল, “কেমন আছো তুমি?”
অরূণীর সকল কাঠিন্য ভাব বরফের মত গলে যেত লাগলো।লুকানো রাগ, অভিমান গুলোও কর্পূরের ন্যায় উবে যেতে লাগলো। রুদ্র’কে উপেক্ষা করার সকল প্রতিজ্ঞা নড়বড়ে হয়ে যেতে লাগলো।অরূণী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। চোখ ততক্ষণে জলে ছাপিয়ে গেল। কথা বলতে গেলেই গলায় কান্না আত্মপ্রকাশ করলো।এই কান্না থামানোর নিছক চেষ্টা করলো না। চারদিকের মানুষ বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। অরূণীর সেদিকে খেয়াল নেই। রুদ্র হতভম্ব হয়ে গেল। চারপাশে অস্থির চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “আরে কী হয়েছে?”
একটু থেমে আবার বলল, “অরূণী কান্না থামাও।”
অরূণী সবকিছু অবজ্ঞা করে যাচ্ছে। হঠাৎ কি হলো রুদ্র ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।অরূণী আচমকা আক্রমনের মত রুদ্র’কে জড়িয়ে ধরলো।পাবলিক প্লেস, চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। পৃথিবীর সমস্ত হতভম্বতা রুদ্রের ওপর ভর করলো।নির্বুদ্ধি, বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেল।

1 COMMENT

  1. অনেক ভালো হয়েছে দিদি গল্পটা গল্পটা কি পর্ব 20 তেই শেষ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here