তোলপাড় পর্ব ২৫

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৫
_________
অরূণীর মুখ থেকে স্যার সম্বোধন শুনে রুদ্র বোধ হয় বিব্রত হলো খানিক। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটলো।অরূণীর তীব্র অস্বচ্ছন্দ্য লাগছে ।কিছুক্ষণ পর রুদ্ররও মনে হতে লাগলো অরূণীর এমন আচরণে ওঁর’ও অস্বস্তি হচ্ছে।এই অস্বস্তিকর পরিবেশ এড়াতে রুদ্র অরূণীর দিকে তাকিয়ে চটজলদি সহজ গলায় বলল, “আচ্ছা,আচ্ছা কী যেন পড়াচ্ছিলাম?”
অরূণী স্বাভাবিক গলায় বলল, “পদার্থ বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন।”
রুদ্র বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে নিচু স্বরে বলে, “ব্যক্তিগত একটা রাগ বা জিদের বশে ফোন’টা ভেঙে ফেলেছিলাম।আর বাসাটাও পরিবর্তন করেছি কিছু সমস্যার কারণে। নতুন বাসায় সবকিছু গুছিয়ে তার পরের দিন রাজশাহী চলে গিয়েছিলাম।”
রুদ্র কথা বলার ফাঁকে তাকালো একবার অরূণীর দিকে।অরূণীর মুখাবয়ব বলছে রুদ্রের কথার দিকে ওঁর খেয়াল নেই। রুদ্র আবার বলল, “মানুষের ব্যক্তিগত কিছু দুঃখ, কষ্ট থাকে না?আমারও তেমন কিছু দুঃখ আছে।আগের সব গুলো সিমই অফ।আর আমি মানছি রেস্টুরেন্টে বসে তোমার হাত ধরা’টা অন্যায় হয়েছিলো।আমি তার জন্য দুঃখিত।”
অরূণী কঠিন গলায় বলল, “অন্যায়টা কী শখের বশেই করেছিলেন?”
রুদ্র উত্তর দিলো না।অরূণীও বোধ হয় উত্তরের অপেক্ষা করলো না। রুদ্র অনেকক্ষণ পর বলল, “আমি ওই ঘটনাটার জন্য অনুতপ্ত।”
অরূণীর প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে।পড়া শেষে অরূণী বলল, “আপনার কাছে পড়া আমার জন্য অস্বস্তিকর বিষয়। কিন্তু বাসার কাউকে এটা বলতে পারবো না।অন্য কোনো মিথ্যে বললেও তারা সায় দিবে না। এর পিছনে অবশ্য আমার দোষ আছে। আপনি কোনো এক অজুহাতে আমায় পড়াতে আসা বাদ দিয়ে দেন।”
কথাটা বলে রুদ্রের দিকে আর তাকালো না অরূণী। রুদ্রের জন্য এতসব হাস্যকর পাগলামি করেও কোনো লাভ হয় নি তাতে অরূণীর কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু রেস্টুরেন্টে বসে অমন আচরণ করে অরূণীর আবেগ,অনুভূতি নিয়ে মজা নিয়েছে?এই ব্যাপার’টাই অরূণীর মনে তীব্র রাগ কিংবা অভিমানের সৃষ্টি করেছে। অরূণী সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার সময়‌ সেলিনা আহমেদের গলা কানে আসলো।
– “রুদ্র,প্রতিদিন এখানে নাস্তা করবে বুঝলে?এত অস্বস্তি বোধ করার কী আছে?”
অরূণী তাকায় সেদিকে।বুঝা গেল রুদ্র খেতে চাচ্ছে না। সেলিনা আহমেদের জোরাজুরির কবলে পড়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা রুদ্রের।অরূণী একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।মনের ভিতর ছটফট করছে অরূণীর। চুপচাপ রুমে বসে থাকে। রুদ্র যতক্ষণ এ বাসায় থাকবে ততক্ষণ অরূণীর এই ছটফটানি কমবে না। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অস্থির লাগছে‌‌। রুদ্রের মুখোমুখি হতে চায় না আর অরূণী।খাবার রুম থেকে সেলিনা আহমেদ ডাকে।অরূণীর সাড়া না পেয়ে বেজায় বিরক্তি নিয়ে অরূণীর রুমের দিকে আসে। রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে বলে, “কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোকে।”
অরূণীর অমনোযোগী ভাব, “আম্মা পরে খাবো।”
রুদ্র যাওয়ার পর রুম থেকে বের হলো অরূণী।বুকের ভিতর নিদারূণ এক কষ্ট হচ্ছে ক্রমশ।কোথায়ও যেন শূন্যতা,চাপা কষ্ট,প্রখর অভিমান সবটা মিলিয়ে ঔদাসিন্যতার গ্রাস করছে অরূণী’কে।
_____________
কার্তিক কর্মকারের বাসা ছাড়ার পর রুদ্র আর কিরণ ভিন্ন ভিন্ন মেসে উঠেছে। কিরণের দুই চাচাতো ভাই থাকে তাঁদের সাথে উঠেছে কিরণ।সকালে অরূণীর আচরণে খুব বিচলিত হয়েছে রুদ্র। সাথে অনুতপ্তও হচ্ছে।অরূণীর হাত ধরা’টা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।একজন মানুষকে এভাবে অবজ্ঞা করে কেমন যেন অপরাধ বোধ হতে লাগলো রুদ্রর।অরূণীর পরিবর্তনও কম-বেশি ভাবাচ্ছে রুদ্র’কে। সন্ধ্যার পর রুদ্র কিরণ’কে ফোন দিয়ে বলল, “আমার বাসার দিকে আয়,আড্ডা দিই না অনেকদিন।”
কিরণও সাথে সাথে রুদ্রের বাসায় গিয়ে হাজির।‌ চাচাতো ভাইদের সাথে কিরণের ভালো বনাবনি হচ্ছে না সেই নিয়ে আক্ষেপ করলো কিরণ। রুদ্র বলল, “আমারও এখানে তেমন ভালো লাগছে না।ছেড়ে দিবো ভাবছি।”
একটু থেমে রুদ্র হেসে আবার বলল, “তোর সাথে বনাবনি হবে কীভাবে?সবাইকে কী রুদ্র ভাবিস যে তোর সাথে বনাবনি করে থাকবে?”
বলেই আরো শব্দ করে হেসে ওঠে রুদ্র।কিরণ মুহূর্তের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।বলে, “আসলেই দোস্ত। আর আমার জীবনের প্রিয় মানুষদের তালিকায় তোর নামটা আগে রে।”
কিছুক্ষণ পর কিরণ আবার বলল, “বাসায় ভালো লাগছে না চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি‌।আদিল,সজল ওঁদের ফোন দিয়ে আসতে বলি।”
– “বল।তবে একটা কথা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কিরণ।”
কিরণ আগ্রহী চোখে কথা’টা শোনার জন্য তাকায়, “কী কথা?”
রুদ্রের গলায় কৌতুক, “বিয়ের পর তোর বউয়ের সাথে তোর নিত্য মারামারি লাগবে। মারাত্মক মারামারি।”
কিরণের মুখে বিরক্তি। রুদ্র বাসার গেট থেকে বের হওয়ার পর বলে, “আজ অরূণী’কে পড়াতে গিয়েছিলাম।”
কিরণ যেন ভুল কিছু শুনেছে। নিশ্চিত হতে প্রশ্ন করে, “কী বললি?”
– “অরূণী’কে পড়াতে গিয়েছিলাম। আত্মীয়-স্বজনের বাসায় টিউশনি অস্বস্তিকর ব্যাপার। কিন্তু সাহেদ আহমেদের মুখের উপর না বলি কী করে?”
কিরণের চমকানো দৃষ্টি। আবছা অন্ধকারে অস্পষ্ট ভাবে বুঝা গেল কিরণের চেহারায় তীব্র বিস্ময়। কিছুক্ষণ পর রোমাঞ্চিত হয়ে বলে, “হাউ রোমান্টিক দোস্ত!এত রোমান্টিক ব্যাপার। উফ্!”
রুদ্র কিরণের এসব কথা উপেক্ষা করে গাঢ় গলায় বলল, “আমার ওইদিনের ঘটনাটা আসলে ঠিক হয় নি।অরূণী কষ্ট পেয়েছে।”
– “অরূণী মেয়েটার ধৈর্য আছে বটে।নয়ত এত উপেক্ষার পরও কীভাবে নির্লিপ্ত ভাবে এতসব পাগলামি করে যাচ্ছে? দোস্ত বলি কী প্রেম’টা করে ফেল।”
রুদ্র হালকা গলায় বলল, “ধুর।”
কিরণ একটু বিরক্ত নিয়ে বলল, “ধুর কী? আসলে তোর প্রবলেম’টা কী? অরূণীর গায়ের রং ফর্সা না,এটা?”
– “পাগলের মত কথা বলিস না তো কিরণ।অরূণীর চোখ গুলো কী সুন্দর!ড্যাপড্যাপে। কাঁধ অবধি চুল গুলো ভালোই লাগে। ওঁর গায়ের রংটা একদম পারফেক্ট।আমার মনে হয় ফর্সা হলে ও’কে ভালো লাগতো না, যত’টা এখন লাগে। ওঁর কথাবার্তা, চঞ্চলতা সবই আকর্ষণীয়।”
রুদ্র একটু থেমে বলল, “অরূণীর ঠোঁট দু’টো সুচিত্রা সেনের মতো।”
কিরণ হেসে ওঠলো।হাসির ধকলে শরীর কাঁপছে কিরণের।হাসতে হাসতে বলে, “ওরে শালা তলে তলে এত দূর! ঠোঁট,চোখ,চুল সবই খেয়াল করিস।”
কিরণ আবার সমান তালে হাসছে। রুদ্র খানিক বিরক্ত হয়ে বলল, “এত হাসির কী হলো তোর?আরে ভাই একটা মানুষ দেখতে কেমন এটা বলাও কী দোষ?”
কিরণ হাসি পুরোপুরি থামিয়ে বলল, “না দোস্ত দোষ না! তুই কিন্তু অরূণীর প্রেমে পড়ে গেছিস। প্রেমে যে পড়েছিস এটা তুই নিজেও বুঝতে পারছিস না।”
– “প্রেমে ট্রেমে কিছুতেই পড়ি নি। আপাতত একটা ঝামেলায় পড়েছি।”
– “কী ঝামেলা?”
– “লাবণ্য।”
লাবণ্যর কথা শুনতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কিরণের।বলল, “লাবণ্য,কী?”
– “লাবণ্য প্রতিনিয়ত ফোন,ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে।দেখা করতে চায়।”
– “তোর ফোন নম্বর আবার কোথায় পেলো?”
– “আদিল হয়ত জোগাড় করে দিয়েছে।এছাড়া আর কে দিবে?”
কিরণ অনেকক্ষণ চুপ থাকলো।খেপাটে গলায় বলল, “লাবণ্য একটা অসভ্য মেয়ে লোক।ওঁর সাথে তুই দেখা করবি?তোর সাথে এই ব্যাপারে কিছু বলতে আমার সত্যি বিরক্ত লাগছে।এসব আমার কাছে বলিস না।”
কিরণ একটু থেমে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে আবার বলল, “তোর কী বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাচ্ছে দিন দিন?”
লাবণ্যের প্রসঙ্গে আসার পর অরূণীর বিষয়’টা চাপা পড়লো।এর ভিতর আদিল,সজল আসে।অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলে। লাবন্যে কিংবা অরূণী কারো বিষয়ই নিয়েই কথা হয় নি আর।
__________
অরূণী অন্ধকারে চোখ দু’টো মেলে শুয়ে আছে। রুদ্র’কে নিয়ে ভাবতে না চাইলেও অবাধ্য ভাবনা-চিন্তা গুলো জেঁকে ধরে আছে অরূণী’কে।কষ্ট হচ্ছে অরূণীর, বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।সকাল বেলা সাহেদ আহমেদের ডাকে ঘুম ভাঙে অরূণীর। একদিন পর পর রুদ্র পড়াতে আসবে।তাই আজ আসে নি‌। নাস্তার টেবিলে বসে অরূণী সংকোচ আর ভয় নিয়ে সাহেদ আহমেদের উদ্দেশ্যে বলে, “আব্বা রুদ্র ভাইয়ের কাছে পড়তে ভালো লাগছে না‌।নতুন কোনো টিচার—”
গর্জে ওঠে সাহেদ আহমেদ, “থাপ্পড় দিয়ে দাঁত সব ফেলে দিবো বদমাশ মেয়ে।”
অরূণী আর কিছু না বলে চুপচাপ খাবার গিলে।সাহেদ আহমেদ কতক্ষণ রাগে বিড়বিড় করলো।তারপর আবার বলে ওঠল, “এবার যদি কোনো ধরণের ফাজলামি করিস অরূণী খারাপ হবে।”
অরূণী মুখ ভার করে খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। আর কিছু বলার সাহস পেলো না।
কলেজ থেকে ফেরার পথে বাস স্ট্যান্ডে দেখা হলো রুদ্রের সাথে। রুদ্র অরূণী’কে দেখে নি। রুদ্রর কানের কাছে ফোন।মুখে হাসি।অরূণীর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠল। রুদ্র কে সর্বপ্রথম এখানেই দেখেছিলো অরূণী।কানের কাছে মোবাইল ছিলো,মুখে হাসি। একটা গেঁজ দাঁত অরূণীর দৃষ্টি থামিয়ে দিয়েছিলো। কার সাথে এভাবে কথা বলছে রুদ্র? নিজেকে এবার নির্বোধ মনে হচ্ছে অরূণীর।অরূণী কখনো জানার চেষ্টাও করে নি রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না? রুদ্র শুধু একবার বলেছিলো ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে চলে গেছে। হতে পারে মানুষ’টা আবার ফিরে এসেছে। নয়ত নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে। এরকম অনেক কিছু হতে পারে। বাস স্ট্যান্ড থেকে কয়েক পা এগিয়ে রুদ্র একটা শপিং মলের কাছে সামনে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর রুদ্রের সামনে একটা রিক্সা এসে থামলো। লাবণ্য রিক্সা থেকে নেমে মৃদু হাসলো রুদ্রের দিকে তাকিয়ে। অরূণীও দুই জনের দিকে তাকালো বার কয়েক।অরূণীর বুকের ভিতর’টা ভারী হয়ে আসছে।দ্রুত হেঁটে চলে যায় সেখান থেকে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here