তোলপাড় পর্ব ২৮

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৮
______________
কিরণ রুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময় নিয়ে। কিছু মুহূর্ত পর বলল, “রুদ্র তুই ঠিক আছিস তো?”
রুদ্র কিরণের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। কিরণ ফের চমকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে তুই অরূণীর জন্য পটুয়াখালী যাবি?”
কিরণের মুখাবয়ব দেখে বুঝা যাচ্ছে ব্যাপার’টা বিশ্বাস করতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে তার। রুদ্রর স্বাভাবিক গলা “এত অবাক হচ্ছিস কেন? একদম এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া অরূণীর ঠিক হলো?”
কিরণের বিস্ময় ভাব’টা কিছু সময় বাদে কেটে যাওয়ার পর বিদ্রুপ করে বলে, “আমি আগেই বলেছিলাম তুই অরূণীর প্রেমে পড়ে গেছিস।সময় থাকতে প্রেম’টা করে ফেল।তখন শুধু তোর অঙ্গ জুড়ে ভাবের আগুন।মেয়েটা বেশী পাগলামি করেছিলো বলে পাত্তাই দিস নি।এখন এত—”
রুদ্র কিরণ’কে থামিয়ে দিয়ে নাক মুখ কুঁচকায়, “উফ্!থাম তো তুই।”
কিরণ থামে। রুদ্র কিছুক্ষণ পর অস্থির গলায় আবার বলল, “আমি কী বুঝেছি অরূণী এত রাগ করবে?আমার অভ্যাসে জড়িয়ে গেছে ও।এ কয়দিন ধরে আমি শুধু কিছু একটার অভাব বোধ করেছি।”
কিরণ রুদ্র’কে উপহাস করে হাসলো। রুদ্র ধমক দিয়ে ওঠে, “বন্ধ কর তোর দাঁত কেলানি।”
কিরণের ধারণা সঠিক হওয়ায় কিরণ সগৌরবে বলে, “আমি অনেক বার বলেছি অরূণীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিস তুই। মেয়েটার সাথে বেশী বাড়াবাড়ি করেছিস তুই।”
রুদ্র স্থির ভঙ্গিতে খাটের উপর বসলো, “এখন ওসব বাদ দে।”
কিরণ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল, “এসব আমি জানি না।আমি এসবে নেই।”
– “কিরণ ভাব নিস না তো।চল পটুয়াখালী। এখন চল।”
কিরণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “রুদ্র তুই পাগল হয়েছিস?সত্যি যাবি পটুয়াখালী?”
রুদ্র চড়া মেজাজ নিয়ে বলে, “তোর সাথে আমি ইয়ার্কি মারছি?”
রুদ্রর ভাব ভঙ্গিমা দেখে কিরণ বুঝতে পারলো বিষয়’টা সিরিয়াস।কিরণও সিরিয়াস হয়ে বলল, “সময়ের কাজ সময়ে না করলে যা হয় আর কি!”
কিরণ একটু থেমে ব্যঙ্গ স্বরে আবার বলে, “গিয়ে কী বলবি অরূণী’কে? ভালোবাসার কথা বলবি? এত ভাব নিয়েছিস এখন লজ্জা করবে না?”
রুদ্র অধৈর্য হয়ে কিরণের এত প্রশ্নে, “কিরণ থামবি তুই?”
কিরণ সহজ গলায় বলল, “হ্যাঁ আমার তো থামা উচিত। আচ্ছা থামলাম।”
রুদ্র অস্ফুট স্বরে তীব্র রাগে বিড়বিড় করে “অরূণী’কে সামনে পাইলে দুই’টা চড় দিবো। ফাজিল মেয়ে।মাথা ভরা গোবর।”
কিরণ আবার বিদ্রুপ ভাব নিয়ে তাকায় রুদ্রের দিকে। তারপর রুদ্র’কে উদ্দেশ্য করে বলে, “আচ্ছা পটুয়াখালী গেলেই কী হবে?অরূণী তো ওঁর মামার বাসায়।তুই ওখানে যাবি কীভাবে? পটুয়াখালী কীভাবে যায় তাও তো জানিস না।আর বাসায় ঠিকানাও জানিস না।”
রুদ্র খাটে হেলান দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তোর এসব নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। ভাইয়ার কাছ থেকে বাসার ঠিকানা নিয়েছি। আর পটুয়াখালী যাওয়ার জন্য গুগল তো আছেই। এই যুগেও কীভাবে পটুয়াখালী যাবি সেই চিন্তা করিস?”
– “ও হ্যাঁ গুগল তো আছেই। তানভীর ভাই জানে এসব?তুই ঠিকানা কেন জিজ্ঞেস করছিস জানতে চায় নি?”
– “মাথা খারাপ এসব ভাইয়া’কে বলবো?অন্য এক প্রসঙ্গে জেনে নিয়েছি। এগুলো কী বলেছি না-কি?”
কিরণ চিন্তান্বিত হয়ে জানতে চায়, “তো তুই অরূণীর মামার বাসায় কীভাবে যাবি?বুঝতেছি না কিছু।”
রুদ্র সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ’টা ফেলে উঠে বসলো।বলে, “ভাইয়া’কে বলেছি পটুয়াখালীতে এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো।এই প্রসঙ্গে ভাইয়া বললো তাঁর চাচা শ্বশুরও পটুয়াখালীতে থাকে। আমিও ঠিকানা’টা জিজ্ঞেস করে নিলাম।আমি তো জানি পটুয়াখালীর কথা বললেই ভাইয়া তাঁর চাচা শ্বশুরের কথা বলবে।
আমরা দরকার হলে পটুয়াখালী গিয়ে একদিন হোটেলে থাকবো। তারপর ভাইয়ার শ্বশুরের বাসার কাছে বা অফিসের কাছে যাবো। তাঁদের বাসার সবাই আমায় চিনে।অমায়িক মানুষ বুঝলি? একবার তাঁদের সাথে দেখা হলে ছাড়তেই চাইবে না। তাঁদের বাসার যে কারো সামনে পড়তে হবে।মানে ব্যাপার’টা এমন হতে হবে যে আমরা হঠাৎ করেই তাঁদের সামনে পড়েছি।
আর যদি এসবে কাজ না হয় তাহলে ভাইয়া কে বলবো একটা সমস্যা হয়ে গেছে।থাকার জায়গা লাগবে দুই দিনের জন্য।তখন ভাইয়া ই তাঁর চাচা শ্বশুর’কে বলবে।”
কিরণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে।অবাক গলায় বিড়বিড় করে বলল, “এত পরিকল্পনা! কিন্তু লঞ্চ তো সন্ধ্যায়‌। তুই এখন কীভাবে যাবি?আর ঢাকা থেকে পটুয়াখালী গাড়িতে যাওয়া ভোগান্তির ব্যাপার। লঞ্চে শান্তিতে যাওয়া যাবে।”
রুদ্র কিরণের কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ লঞ্চেই যাবো।”
কিরণ কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে, “আচ্ছা অরূণী তো কয়দিন পর এসেই পড়বে।না গেলে হয় না?এমন তো না যে অরূণী পটুয়াখালী থেকে যাবে।আর তোর হঠাৎ করে এত উপচে পড়া প্রেম আসলো কোত্থেকে?”
– “মাঝে মাঝে পাগলামি করতে ভালো লাগে। প্রেম তো হঠাৎ ই হয়।”
কিরণ আবার দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে, “দোস্ত তোর মাথা ঠিক আছে?কি সব পাগলামি করছিস?”
রুদ্র গাঢ় গলায় বলে, “আমি ঠিক আছি। রওয়ানা দে।সন্ধ্যায় যাবো।”
কিরণ আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। রুদ্র শুধু ভাবছে অরূণী ও’কে দেখে কত’টা অবাক হবে। কেমন প্রতিক্রিয়া করবে অরূণী?এসব ভাবতে ভাবতে অপূর্ব পুলকে বার বার রোমাঞ্চিত হতে থাকে রুদ্রর বুকের ভিতর’টা। রুদ্র খাটের আধশোয়া অবস্থায় চোখ বুঁজে আছে। অরূণীর সমস্ত পাগলামি গুলো নতুন করে ভাবছে। রুদ্রর ঠোঁটের কোণে আপনাআপনি হাসি ফুটে। রুদ্রর শুধু মনে হচ্ছে আসলেই অরূণী অদ্ভুত।
_______________
চারটার দিকে কিরণ আসে। কাঁধে ছোট খাটো একটা ব্যাগ ঝুলানো। এসেই রুদ্র’কে তাড়া দিয়ে বলল, “এখনো রেডি হোস নি?পাগলামি করতে যাবো পটুয়াখালী।এডভেঞ্চার।”
বলেই হাসলো কিরণ। রুদ্র জিজ্ঞেস করলো, “এত তাড়াতাড়ি বের হবো?”
– “সদরঘাট যেতে সময় লাগবে না?রাস্তায় জ্যাম থাকলে তো লঞ্চ মিস। আগে আগে যাওয়াই ভালো।আমি একবার বরিশাল গিয়েছিলাম।এসব ব্যাপারে ধারণা আছে বুঝলি?”
রুদ্র তাড়াহুড়ো করে রওয়ানা দেয়।কিরণের দিকে তাকিয়ে অজ্ঞাত এক শঙ্কা নিয়ে বলে, “আল্লাহ ই জানে কপালে কি আছে।”
কিরণ হালকা গলায় বলল, “খুব বেশি হলে মার আছে কপালে।এর বেশী আর কী? পাগলামি করতে যাচ্ছি। একটু মার তো খাওয়াই যায়।”
– “কে মার দিবে?কীসের জন্য মার দিবে? আবোল তাবোল বকিস না তো।”
রুদ্র আর কিরণ বাসা থেকে বের হয়। সদরঘাটের উদ্দেশ্যে গাড়ি নেয়। কিরণ বলে, “দোস্ত অরূণী তোকে দেখে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।আর যদি কোনো রকম হার্টে সমস্যা থাকে তাহলে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবে।”
রুদ্র হাসলো কিরণে কথা শুনে।সন্ধ্যার দিকে লঞ্চ ছাড়লো। কিরণ কিছু’টা শঙ্কিত হয়ে বলল, “আমরা গিয়ে থাকবো কোথায় বল তো?”
রুদ্র বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, “কিরণ তুই কী ছোট বাচ্চা? হারিয়ে যাবি?”
– “হারিয়ে গেলে আমার গার্লফ্রেন্ড আমায় গালাগালি করবে তো।”
কিরণের কণ্ঠে হালকা কৌতুক।হো হো করে হেসে ওঠলো।

রুদ্র লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। নদীর কোনো কূলকিনারা নেই।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌কি অদ্ভুত সুন্দর একটা পরিবেশ! শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। রুদ্র এই মোহময় পরিবেশে মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছে। চারদিকে মানুষের শোরগোল।
রুদ্র নিবিষ্ট হয়ে অরূণীর কথা ভাবছে।অরূণীর ফোন’টা এখনো বন্ধ। রুদ্র বিরক্ততে নাক মুখ কুঁচকে ফেলে। রুদ্র ফোনের দিক থেকে মুখ না তুলেই কিরণের উদ্দেশ্যে বলল, “কিরণ,ভাইয়ার কাছে ফোন দিয়ে বলি যে পটুয়াখালী যাচ্ছি।থাকার জায়গা দরকার।এটাই ভালো হবে। ওসব ঝামেলা হয়ে যায়।”
কিরণ নীলার সাথে কথা বলছে ফোনে।কানের কাছ থেকে ফোন’টা সরিয়ে বলল, “তোর ইচ্ছে।”
কিরণ কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে গেল আবার। রুদ্র তানভীর’কে ফোন দিয়ে বলল। তানভীর বলল, “আচ্ছা আমি তোকে একটু পর ফোন দিচ্ছি।” তানভীর কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিয়ে হেসে বলল, “নিম্মির চাচায় লোক পাঠাবে লঞ্চঘাট তোদের নিতে।খুব আন্তরিক মানুষ।”
রুদ্র স্বস্তি পেলো। তানভীর আবার জিজ্ঞেস করলো, “তুই তো বললি তোর বন্ধুর বাসায় যাবি। হঠাৎ কী হলো?”
– “একটু ঝামেলা হয়েছে।”
রুদ্র ফোন রাখে। সকালের দিকে লঞ্চ পটুয়াখালী পৌঁছে।অরূণীর মামা বাসার কাজের লোক পাঠিয়েছে লঞ্চঘাট কিরণ আর রুদ্র’কে নেওয়ার জন্য।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here