তোলপাড় পর্ব ৪

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪
_________
নীড়া প্রশ্ন করল, “আমজাদ স্যার যদি জেনে যায় এসব?”
অরূণী তাচ্ছিল্য করে বলল, “নির্বোধ মানুষের মত কথা বলিস না তো নীড়া। আমজাদ স্যার আমার কথা জানবে কীভাবে?”
অরূণীর ঠোঁটের কোণ প্রদেশে সূক্ষ্ম হাসি। চেহারায় সানন্দ ভাব’টা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রুদ্র ওঁর ফোন নম্বর বন্ধ পেয়ে প্রথমে স্কুলে যাবে। স্কুলে এই নামে কাউকে না পেয়ে বিস্মিত হয়ে যাবে। তারপর শেষে উপায় না পেয়ে আমজাদ স্যারের বাসায় গিয়ে সাথি’কে খোঁজ করবে। আমজাদ স্যার রুদ্রর দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে। এসব আগাম ভবিষ্যৎ ভাবতে ভাবতে অরূণী পুলকিত হয়ে ওঠছে।
রাকা ভাবাবিষ্ট গলায় বলল, “অরূণী আর যাই বলিস রুদ্র’কে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাওয়া যায়। ওয়েটারের সাথে যখন কথা বলছিল তখন একটু হেসেছিল। আহা কি দারুন হাসি! একটা গেঁজ দাঁত আছে।‌ আমার বলতে ইচ্ছে করছিল ভাইয়া আবার একটু হাসেন।”
রাকা কথা’টা বলা শেষে অরূণীর দিকে তাকিয়ে দেখল অরূণীর আরক্ত দৃষ্টি ওঁর দিকে। ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মত মুখের অভিব্যক্তি। এক্ষুনি যেন রাকার গর্দান দেহ থেকে আলাদা করে ফেলবে।
– “রুদ্রর দিকে যদি ফের তাকাস খুব খারাপ হবে।”
অরূণীর প্রতিক্রিয়া দেখে নীড়া অবাক হয়ে গেল।এত সিরিয়াস রুদ্রর ব্যাপারে? নীড়া মজা ভেবেছিল।বলল, “তোরা সবাই এমন ভাবে রুদ্র রুদ্র ডাকছিস মনে হয় উনি আমাদের সমবয়সী কেউ। কম হলেও তিন-চার বছরের সিনিয়র।আর অরূণী তুই বোকার মত রুদ্রর ব্যাপারে এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন?কারো ওপর ক্রাশ খেলেই এত পাগলামি করতে হবে? গিয়ে দেখ ওই ছেলের কম হলেও পাঁচ’টা গার্লফ্রেন্ড আছে।”
অরূণী চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, “বোকার মত সিরিয়াস হচ্ছি মানে? রুদ্র’কে ভালো লেগেছে প্রথম দেখাতে। আস্তে আস্তে ভালোবেসে ফেলেছি। সিরিয়াস ভালোবাসা। ক্রাশ তো কত ছেলের উপরই খেয়েছি। ক্রাশের জন্য এত পাগলামি করার মত বোকা আমি না। আমি রুদ্রর প্রেমে পড়ে গেছি, প্রেম মানেই পাগলামি। তোরা দেখিস রুদ্রর সাথে আমার প্রেম, বিয়ে সব হবে।”
অরূণীর সিরিয়াসনেস দেখে ওঁরা যথারীতি হাঁ হয়ে রইল। অরূণী ওঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোন, আমি রুদ্র ডাকবো। আর তোরা রুদ্র ভাই ডাকবি। একটায়ও কু নজর দিবি না রুদ্রের দিকে।”
তাইতি কষাটে গলায় বলল, “অরূনী অনেক পাগলামি হয়েছে। এবার বাদ দে। সূর্য ভাই একবার জানলে তোর অবস্থা খারাপ হবে।”
– “পাগলামি মানে?কি পাগলামি করেছি? একটা ছেলে যদি একটা মেয়ে’কে প্রেমের প্রস্তাব দিতে পারে। একটা মেয়ে কেন পারবে না? আর সূর্য দাদা কিভাবে জানবে?”
রাকা বলল, “কি বললি অরূণী? তুই প্রেমের প্রস্তাব দিবি? আর ইয়্যু ওকে অরূণী?”
অরূণী উত্তরে বলল, “কথায় কথায় ইংরেজি ফুটাইস না। আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। দেখবি কয়দিন পর রুদ্রের সাথে পালিয়ে গেছি। আমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে। নাম রাখবো সিজুকা। ডোরেমনের সেই সিজুকা।”
নীড়া হতচেতন হয়ে বলল, “অরূণী তুই বাসায় যা। গিয়ে মাথায় এক ঘন্টা বরফ দিয়ে রাখ। তারপর টানা সতেরো ঘন্টা ঘুমাবি। ঘুম থেকে ওঠে গোসল দিবি। গোসল দিয়ে পেট পুরে তোর পছন্দের খাবার গুলো খাবি। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবি যে এমন পাগলামি কি করা উচিত?”
অরূণী কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলে গেল। রুদ্রের সাথে দেখা হয়েছে। এত কাছ থেকে দেখেছে!রুদ্রের গলার স্বর সুস্রাব্য ধ্বনির মতো অরূণীর কর্ণকুহরে বার বার বাজছে।অরূণীর মনের আনন্দ দিগ্বিদিক মাতিয়ে তুলছে। সেই সাথে রুদ্র আমজাদ স্যারের বাসায় গিয়ে সাথি’কে খুঁজলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সে নিয়ে উৎকণ্ঠা। এত উত্তেজনা,উৎকণ্ঠায় অরূণী নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।
________
রুদ্র আকন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ফিজিক্স নিয়ে অনার্স করছে। অনার্স তৃতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট। দেখতে সুদর্শন, বিশেষ করে রুদ্রের হাসি। হাসলে একটা গেঁজ দাঁত দেখা যায়। গেঁজ দাঁত’টাই যেন হাসি সুন্দর হওয়ার রহস্য।অরণী’কে টাকা ধার দিয়ে সন্দিহান মনে বাসায় গেল রুদ্র। অরূণীর কথা-বার্তায় অদ্ভুত এক ভাব ফুটে ওঠে। এই অদ্ভুত ভাব’টা যে কাউকেই প্রথম প্রথম ভীষণ ভাবায়।
রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় ফিরে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে পাবজি খেলছে রুদ্র। কিরণ কোথা থেকে যেন এসে ধপ করে বিছানায় বসল।
– “রুদ্র তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।‌‌‌‌‌‌আরে ভাই কি যে ইন্টারেস্টিং কথা! আমি ভুলেই গিয়েছি বলতে।”
রুদ্র পাবজি খেলায় মগ্ন। কিরণের কথা রুদ্রের কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। কিরণ বিরক্ত হয়ে বলল, “ফালতু একটা খেলা পেয়েছে। আরে শালা ইন্টারেস্টিং কথা।”
রুদ্র মোবাইলের দিকে তাকিয়েই অমনোযোগী ভাবে বলল, “পরে শুনবো।”
এখন যদি ভূমিকম্প হয়ে বিল্ডিং ধ্বসে পড়ে তবুও রুদ্রর মনোযোগ পাওয়া যাবে না।কিরণ ব্যর্থ চেষ্টা না করে নিজের কাজে মন‌ দিলো।
রাতে ঘুমানোর আগে রুদ্র কিরণ’কে বলল, “কি যেন বলতে চেয়েছিস বিকালে?”
– “কিছু না,ঘুমাবো এখন। বিরক্ত করিস না।”
– “আরে আমি তো তখন পাবজি খেলছি। পাবজি খেলার সময় ডিস্টার্ব করা গুনাহ। এখন বল কি ইন্টারেস্টিং কথা?”
– “আমিও এখন ঘুমাবো। ঘুমে ডিস্টার্ব করাও গুনাহ।”
– “মেয়ে মানুষের মত কথা পেঁচানোর স্বভাব তোর আর গেল না।”
কিরণ গায়ের পাতলা কাঁথা’টা ফেলে শোয়া থেকে ওঠে বসে। সিথানের বালিশ’টা খাটের সাথে লাগিয়ে হেলান দিয়ে রুমের লাইট’টা অন করল। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “আরে লাইট জ্বালিয়েছিস কেন? একদম উঠে বসে লাইট জ্বালিয়ে কথা বলতে হবে?”
– “আরো দোস্ত ইন্টারেস্টিং কথা! আন্ধারে বলে মজা পাবো না।”
রুদ্র এত ইন্টারেস্টিং কথা শুনতে অধীর চোখে তাকালো। কিরণ বলল, “তুই রাজশাহী যাওয়ার কয়দিন পর এক মেয়ে আসে। আমি সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছি এমন সময় ডোর বেল বাজে। আমি ভেবেছি নিচের তলার সিফাত ওঁরা এসেছে। দরজা খুলে দেখি এক মেয়ে দাঁড়ানো। আমার কোমরে কোন রকম তোয়ালে পেঁচানো ছিলো। আমি দ্রুত রুমে এসে ট্রাউজার আর টি- শার্ট পরে আবার দরজার কাছে যাই। মেয়ে’টা তোকে খোঁজ করল।”
রুদ্র খানিক অবাক হয়ে বলল, “আমায় খোঁজ করেছে?আমার পরিচিত কেউ?”
– “তোর পরিচিত কিনা আমি বলবো কিভাবে?এসে বলে মেয়ে’টা নাকি তোর গার্লফ্রেন্ড। তোর সাথে শারীরিক-মানসিক সম্পর্ক। আরে ভাই কি চটপট কথা বলে!”
রুদ্র এই পর্যায়ে জোরেসোরে ধাক্কা খেল যেন। অত্যাশ্চর্য হয়ে বলল, “শারীরিক- মানসিক সম্পর্ক!”
– “আরে পুরো’টা শোন। তারপর বলে, “ভাইয়া আমি মিথ্যে বলেছি। রুদ্র’কে আমার খুব দরকার। উনার ফোন নম্বর’টা দিন প্লীজ।” এমন ভাবে অনুরোধ করা শুরু করল,আমি ফোন নম্বর দিয়ে দিলাম। তোর ফোন যেদিন হারিয়ে গেছে ওইদিনই দিয়েছি ফোন নম্বর। তাই বোধ হয় ফোনে পায়নি। ওই সিম তুলেছিস?”
রুদ্র চিন্তাযুক্ত গলায় বলল, “না তুলেনি সিম। কিন্তু মেয়ে’টা আমায় খুঁজতে একদম বাসায় চলে এসেছে?কি অদ্ভুত ব্যাপার। আর কি সব আজগুবি কথা বার্তা বলেছে! মেয়েটার নাম জানিস?”
– “না,না নাম বলে নি বোধ হয়।আমি ফোন নম্বর দেওয়ার পর আমায় বলল, “ভাইয়া আপনি আমার কি যে উপকার করেছেন! আপনায় জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। আপনি মেয়ে হলে শুধু জড়িয়ে ধরতাম না ,চুমুও খেতাম।”
শেষ কথা টুকু বলে হাসতে লাগলো কিরণ। রুদ্রও হাসছে। কিন্তু রুদ্রের মাথায় একটা চিন্তা বিরাজ করছে, “মেয়ে’টা কে?” এই চিন্তার কারণে হাসি বেশি সময় স্থায়িত্ব লাভ করল না।রুদ্র ঠোঁট কামড়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “আমি কি মেয়ে’টা কে চিনি?”
– “আমি আগে কখনো দেখিনি। তুই চিনিস কি-না বলবো কীভাবে? মেয়ে’টা শ্যাম বর্ণের। সিল্কি চুল কাঁধ বরাবর। শ্যামলা হলেও দেখতে ভালো লাগে। উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবে,স্লীম।”
মেয়েটার চেহেরার বর্ণনা শুনে রুদ্রের কল্পনায় রেস্টুরেন্টের সেই চারুর কথা মনে পড়ে গেল। রুদ্র মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
– “কিরণ আমার খুব খটকা লাগছে। তুই যেরকম বললি না, ঠিক সেরকম একটা মেয়ে আজ রেস্টুরেন্টে বসে আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে।”
সব’টা শুনে কিরণও খানিক চিন্তিত হয়ে গেল।বলল, “ফোন দে তো ওই মেয়ের নম্বরে।”
– “আরে ধুর! এত রাতে ফোন দিবো?কাল সকালে দিবো।”
– “তোর টাকা কবে ফেরত দিবে বলেছে?”
– “কাল।”
– “একটা মেয়ে টাকা ধার চাইলো আর তুই দিয়ে দিলি?সেই মেয়েই কি এই মেয়ে?”
রুদ্র বেশ বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো, “আরে ভাই এমন অনুনয় বিনয় শুরু করেছে! আমি বলবো কীভাবে এই মেয়ে সেই মেয়ে কিনা?আমার তো মনে হয় এই মেয়েই সেই মেয়ে। কিন্তু শিওর হবো কীভাবে?”
রুদ্র একটু থেমে আবার বলল, “আর ওই মেয়ে’টা একদম রুম পর্যন্ত এসে পড়লো কিভাবে?সঞ্জিতা কর্মকার দেখেনি?”
কিরণ নিরুদ্বেগ ভাবে বলল, “কি জানি।”
লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল রুদ্র। রাত হয়েছে বেশ! অন্ধকারে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি অন্ধকারে মিশে রয়েছে। রুদ্র চোখ বুঁজে। রেস্টুরেন্টের মেয়ে’টার ব্যাপার’টা ভাবাচ্ছে রুদ্র’কে। রুদ্র ভাবনা-চিন্তা মাথা থেকে দূর করে ঘুমিয়ে যায়।
_________
আজকে সকালে কোচিং থাকার তাড়নায় তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় অরূণীর। চোখ না খুলেই বালিশের পাশে রাখা ফোন’টা খুঁজতে থাকে। ফোন পেয়ে গেলে ফোনের স্ক্রিনের দিকে নিভু নিভু চোখে তাকায়। এখনো টাইম হয়নি। আরো এক ঘন্টা ঘুমানো যাবে। হঠাৎ রুদ্রর কথা মনে পড়ায় উত্তেজনায় ঘুম চলে যায়। চোখ বুঁজে শুয়ে থাকলেও ঘুম হয়না। রুদ্র’কে নিয়ে মনগড়া প্রেমময় কিংবা রোমাঞ্চকর চিন্তা-ভাবনায় ছেয়ে যায় অরূণীর মনের দিগদিগন্ত। কিন্তু এই রোমাঞ্চকর কল্পনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। রুমের বাইরে থেকে লম্বা সুরে ডাক আসে, “অরূণী।”
সাহেদ আহমেদের গলা। অরূণী হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়ে।এত শিক্ষা সচেতন বাপ’কে নিয়ে অরূণী মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। দ্রুত হেঁটে সাহেদ আহমেদের কাছে যায়।নিচু স্বরে বলে, “আব্বা আরো আধা ঘন্টা ঘুমানো যেতো।”
সাহেদ আহমেদ গম্ভীর মুখে বলল, “তোর পড়তে বসতে হবে না সকালে? সকালে ব্রেন ফ্রেশ থাকে,পড়া ভালো হয়! দুপুরে যে পড়া এক ঘন্টায় হয় না, সকালে সে পড়া বিশ মিনিটে হয়ে যায়।”
অরূণী মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে রুমে গিয়ে পড়তে বসে। রুদ্রর কলের অপেক্ষায় বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে। এখনো ফোন দিচ্ছে না কেন টাকার জন্য?রুদ্রের ফোন নম্বর’টা পেলেই সিম’টা বন্ধ করে রাখবে।
অরূণী কোচিং-এ যায় ।নাহিদ স্যার রসায়ন বুঝাচ্ছে।অরূণী পিছনের সিটে বসে আছে।খেয়াল নেই সেদিকে। নাহিদ স্যার কর্মমুখী রসায়ন বুঝাচ্ছে, অরূণী প্রেম রসায়নে ব্যস্ত। হঠাৎ অরূণীর ফোন বেজে ওঠে। ক্লাসের সবাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কার ফোন বেজেছে? নাহিদ স্যারের কোচিং-এ ফোন নিয়ে আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে প্রায় সবাই ই ফোন নিয়ে আসে। সাইলেন্ট কিংবা অফ করে রাখে। অরূণীর ফোন সাইলেন্ট করতে খেয়াল ছিলো না। নাহিদ স্যার হুংকার দিয়ে বলল, “অরূণী দাঁড়াও।”
অরূণী দাঁড়ায়। নাহিদ স্যার অরূণীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “ফোন এনেছো কেন?”
অরূণীর চেহেরা বিষণ্ণ প্রকৃতির হয়ে গেল। শোকার্ত গলায় বলল, “স্যার আমার খালা খুব অসুস্থ। খালার জন্য ‘ও-নেগেটিভ’ রক্ত দরকার।এই গ্রুপের রক্ত পাওয়া কঠিন। কোথায়ও পাচ্ছে না। আমি একটা ফেসবুক গ্রুপে রক্তের জন্য পোস্ট দিয়েছি। সেখানে আমার ফোন নম্বর দিয়েছি।আমি কোচিং-এ আসার একটু আগে একজন ফোন দিয়ে বলল রক্ত দেওয়ার মানুষ পেয়েছে। তাঁরা কিছুক্ষণ পরে আমার সাথে যোগাযোগ করবে। তাই ফোন এনেছি। আমি কখনো ফোন নিয়ে আসি না। জিজ্ঞেস করে দেখুন সবার কাছে।”
তাইতি তাকিয়ে আছে অরূণীর মুখের দিকে। অরূণীর কোনো খালা-ই নেই।বেদনায় অরূণীর গলা ছলছল।এমন ব্যথাতুর মুখে বলা কথার বিপরীতে নাহিদ স্যার শক্ত গলায় কিছু বলতে পারলো না। নাহিদ স্যার বরাবরই পরোপকারী মানুষ। অন্যের বিপদে মন-প্রাণ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাহিদ স্যার স্নেহপূর্ণ গলায় বলল, “যাও যাও। রুমের বাইরে গিয়ে কথা বলে এসো।”
অরূণী ফোন নিয়ে রুমের বাইরে এসে ঠোঁটে দুষ্টুমির এক চিলতে হাসি ফোটায়। রুদ্রের ফোন নম্বরে ডায়েল করে। একটু কথা বলেই না হয় সিম’টা অফ করবে। অরূণী দুই বার ফোন দেওয়ার পর ফোন তুলে ওপাশ থেকে। শুরুতেই বলে, “টাকা কখন দিবে?কোথায় বসে দিবে?”
অরূণীর কাছে রুদ্রের গলার স্বর শ্রুতিমধুর লাগলো। অরূণী এই স্বরে মুগ্ধ, এই স্বরে বিভোর! এই কণ্ঠ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে চায় সারা জীবন।অরূণী যেন মত্ত হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, “কত টাকা যেন ধার নিয়েছি?”
রুদ্র অবাক, “এই মেয়ে ফাজলামি করছ?”
অরূণী রুদ্রের গলা শোনার জন্য আরো কিছুক্ষণ উল্টাপাল্টা বকতে থাকে। তারপর সিম অফ করে রাখে। খুঁজুক রুদ্র! স্কুলে, আমজাদ স্যারের বাসায় সবখানে খুঁজুক!
_______
অরূণী ফোন রাখার রুদ্র হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল।কিরণ বসে বসে ফিজিক্সের অংক কষছিলো। রুদ্রের চেহেরার অভিব্যক্তি দেখে বলল, “কিরে কি হলো? রেস্টুরেন্টের এই মেয়েই কি সেই মেয়ে?যে বাসায় এসেছিলো।”
রুদ্র রাগ দেখিয়ে বলে, “আরে রাখ তোর এই মেয়ে সেই মেয়ে! রেস্টুরেন্টের সেই মেয়ে টাকা চাইতেই কিসব উল্টাপাল্টা বলল!”
কিরণ হেসে ওঠে।বিদ্রুপ করে বলে, “দিয়েছে মেরে তোর টাকা।”
– “আমার টাকা মেরে খাওয়া এত সহজ? দরকার হলে সেনা মোতায়েন করব। ওই মেয়ে’কে খুঁজে বের করবোই।”
কিরণ কৌতুকের ছলে বলল, “সেনা মোতায়েন করার কি দরকার?মেয়ের ঠিকানা তো জানিস’ই। প্রথমে স্কুলে খোঁজ নে। পেয়ে গেলে তো ভালোই। স্কুলে না পেলে সোজা বাসায়।”
রুদ্রর কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ উত্তর আসে না। অনেকক্ষণ পর চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, “হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে।কত ফাজিল।”
– “আমার মনে হয় এই মেয়েই সেই মেয়ে। কোথায়ও কোনো গণ্ডগোল আছে।”
রুদ্র উত্তর দিলো না।ভার্সিটি’তে যাওয়ার পথে অরূণী যে স্কুলের ঠিকানা দিয়েছে সে স্কুলে যায় রুদ্র। অনেক খোঁজাখুঁজি করে। চারু নামের কেউ নেই। সাথি নামে অনেকজন আছে কিন্তু রুদ্র যাকে খুঁজছে সে না। রাগে রুদ্রের গা জ্বলে যাচ্ছে। রুদ্রের এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে টাকা কোনো বিষয় না কিন্তু মেয়ে’টাকে খুঁজে করতেই হবে।
বিকালে ছাদে ক্যারম খেলার সময় কিরণ অরূণীর প্রসঙ্গ’টা তোলে। কার্তিক কর্মকারের বাসার দোতলায় থাকে সৌমিক। রুদ্র আর কিরণের এক ব্যাচ জুনিয়র। কিন্তু সম্পর্ক খুব ভালো। সব’টা শুনে সৌমিক হাসতে হাসতে বলল, “রুদ্র ভাই আজকাল এত দিল দরদী হয়ে গেছেন! আপনার মত মানুষ’কে বোকা বানায়! সাধারণ কোন মেয়ে না। দারুন বুদ্ধিমতি বটে।”
এমন তামাশা রুদ্রের বিরক্ত লাগছে।ক্যারম বোর্ড ঘষতে ঘষতে বলল, “মেয়ে’টা এমন ভাবে অনুনয়-বিনয় করেছে!” খেলা শেষে রুমে গিয়ে রুদ্র চোখ লাল করে তাকায় কিরণের দিকে। চোয়াল শক্ত করে বলল, “জুনিয়র পোলাপানের মধ্যে তুই ওসব কথা তুলে দিয়েছিস।আমাদের মান-সম্মান খুব বেড়েছে না?”
রুদ্র রাগে অনার্থক বিড়বিড় করতে করতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। বন্ধ ল্যাপটপ’টা অন করে। কিরণ কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, “লাবন্য ফোন-টোন দেয়?”
রুদ্রের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে ল্যাপটপ’টা কিরণের মুখে ছুঁড়ে মারবে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে রুদ্র।পরক্ষণে রাগ সংযত করে বলে, “না রে।”
– “মিস করিস না দোস্ত?”
– “ওই যে একটা কথা আছে না, যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয় না তখন মায়া কাটাতে শিখতে হয়।”
রুদ্র কিরণের পরবর্তী কথার আর জবাব দিলো না। ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো।
________
দুই-তিন দিন হয়ে গেল।অরূণী এবার নিজেই চিন্তায় পড়ে গেল। রুদ্র কি যায় নি আমজাদ স্যারের বাসায়? রুদ্রের সাথে কিভাবে প্রেম করবে? আদৌ কি সম্ভব সেটা?অরূণীর মনে হচ্ছে ও রুদ্র’কে সত্যি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। অদ্ভুত বাড়াবাড়ি রকমের সে ভালোবাসা। ভালোবাসা তো সকল নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে। কখন কিভাবে ভালোবাসা নামক মহাপ্রলয়ে মানুষ নিজেকে হারিয়ে ফেলে তা সে নিজেও জানে না। রুদ্রর যদি অরূণী’কে ভালো না বাসে, অরূণী কষ্ট পাবে। ভীষণ কষ্ট, অসহ্য রকমের কষ্ট।
অরূণী ছাদে বসে ছিলো। হঠাৎ পায়েস খেতে ইচ্ছে করল। ছাদ থেকে নেমে রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে ডাকল, “শামীমা আপা, শামীমা আপা।”
শামীমা রান্না ঘর থেকে উঁচু গলায় বলে, “কি হইছে অরূণী?”
অরূণী রান্না ঘরের দরজার সামনে গিয়ে বলল, “আমার জন্য পায়েস রান্না করবে। ভাত ভাত করে। কড়া মিষ্টি দিবে,আর দুধ দিয়ে একদম ক্ষীর ক্ষীর করে ফেলবে।”
– “এহনি রান্না করা লাগবে?”
– “তোমার কাজ থাকলে পড়ে রান্না করো।আমার তো এখন খেতে ইচ্ছে করছে।”
শামীমা মাথা ঝাঁকায়। অরূণী রুমের দিকে যেতে লাগলো। হঠাৎ কি যেন মনে পড়ায় আবার রান্না ঘরে আসলো। শামীমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। অরূণী বলে, “আপা তোমার ছেলে সুস্থ হয়েছে? বললা না যে টাইফয়েড জ্বর হয়েছে?”
শামীমা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শামীমার প্রতি অরুণীর এই সহানুভূতি শামীমার মনে প্রশান্তি ঢেলে দেয় যেন। শামীমা বিমর্ষতাপূর্ণ গলায় বলে, “না সুস্থ হয় নাই। ডাক্তার অনেক টাকার ঔষাধ দিছে। খাওয়াইতে পারি নাই।”
– “বাসায় যাওয়ার সময় আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেয়ো।”
কথা’টা বলে অরূণী শামীমার দিকে আর তাকালো না। তাকালেই শামীমা অস্বস্তি’তে পড়বে। অরূণীর কাছে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে শামীমা’কে ভালো লাগে ভীষণ। ধীর-স্থির,স্বল্পভাষী শামীমা সব সময় মৃদু হেসে কথা বলে। কেমন মায়া মায়া একটা ভাব।
.
রুদ্র বিকালের দিকে অরূণীর দেওয়া ঠিকানা’টা দেখে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে রুদ্রর। কিরণ’কে জিজ্ঞেস করে, “যাবি? চল।”
– “এত ইন্টারেস্টিং ঘটনা আমি মিস করতে চাই না‌। যাবো না মানে?”
– “কোন দিক থেকে তোর কাছে এটা ইন্টারেস্টিং?আমার টাকা মেরে দিয়েছে সেটা তোর কাছে ইন্টারেস্টিং! তুই শালা বন্ধু নামে কলঙ্ক।”
কিরণ হাসে।অরূণীর দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী যায়। দুই তলা একটা বিল্ডিং। রুদ্র উপরের দিকে তাকায়। টাকা নিতে শেষ অবধি বাসা পর্যন্ত আসতে হলো! কিরণ থেমে যায় হঠাৎ। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত যা তুই। আমার কেন জানি ভয় করছে।”
– “তোর ভয় করছে মানে?তোর কেন ভয় করবে? ইন্টারেস্টিং ঘটনা দেখতে এসেছিস তো! এখন ভয় করছে কেন?”
রুদ্রর জোরাজুরি’তে কিরণও যায়। রুদ্র খুব ভয়ংকর মেজাজ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।যেন অরূণী’কে পাইলে দুই-চার ঘা লাগিয়ে দিবে। কয়েকবার কলিং বেল বাজায়। কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙা আমজাদ হোসেন দরজার সামনে দাঁড়ানো। কাঁচা ঘুম ভাঙার ফলে মেজাজ খিটখিটে। রুদ্র আপাদমস্তক এক নজর তাকালো আমজাদ হোসেনের দিকে। পরনে লুঙ্গি,উদাম গাত্র। বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে। রুদ্র জিজ্ঞেস করল, “সাথি আছে?আপনি কি সাথির ভাই?”
হঠাৎ কি হলো রুদ্র ঠিক বুঝতে পারলো না। আমজাদ হোসেন চিৎকার করে বলল, “শালারপুত দাঁড়া।”
কিরণ দৌড় দিলো।কিরণের দৌড় দেখে রুদ্রও দৌড়াতে লাগলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here