দখিনা হাওয়া পর্ব -০৭

#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[০৭]

বিশাল বড় বিল। পুরোটা জুড়ে সর্ষে ক্ষেত। চারদিকে হলুদের সমারহ। বসন্তকালে প্রকৃতি যেন নতুন করে সেজেছে। আর মাথার উপরের সূর্যটা যেন খিলখিলিয়ে হাসছে। কি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। প্রকৃতির সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। এখন বসন্তকাল হওয়ায় বিলে কাঁদা নেই। বিন্দু একটা খেতের আলে পা রেখেছে। দুইটা ক্ষেতের মাঝখানে একটা আল। সবগুলো আল খুব চিকন। আসলে আলগুলো চিকন হওয়ার কারণ হলো, যাদের ক্ষেত তারা এগুলোকে চিকন করে কাঁটে। আল যত চিকন করবে ততই ক্ষেতের জায়গা বাড়বে। সেখানে তারা আরো একটা লাইন ফসল বেশি ফলাতে পারবে। বিন্দু গ্রামে বড় হওয়ায় চিকন আল দিয়ে হাঁটতে তার কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। বিন্দু আর ফারিন গায়ে রোদ মেখে হেঁটে চলেছে এই সর্ষে ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। গ্রামে এসেছে বিন্দু আর ফারিন। এখানেই বিন্দুর খালার বাড়ি। এখানে তারা থাকার জন্য আসে নি। বিন্দুর খালাতো বোনের আজকে এঙ্গেজমেন্ট। এখন সে অনুষ্ঠানেই যাচ্ছে তারা। বিন্দুর বাবা আর মা আসতে পারেন নি। কারণ বিন্দুর মায়ের শরীরটা কিছুদিন যাবৎ ভালো যাচ্ছে না। তাই দু’বোনই আসল এখানে। আজকেই তারা চলে যাবে।

– আপু চল সর্ষে ক্ষেতের মাঝখানে গিয়ে সেলফি নিই। কি বলিস তুই?

বিন্দু হাঁটতে হাঁটতে বলল,

– রাখ তোর সেলফি। আগে খালামনির বাড়ি যাই। রিমিপুর এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠানটা আগে ভালোয় ভালোয় কাঁটুক। বাসায় যেতে হবেতো তাড়াতাড়ি।

– তুই এমন বিরস কেনরে আপু? আমার বোন হয়ে তুই এমন রসকষহীন কি করে হলি বলতো?

বিন্দু পিছনে ফিরে ফারিনের মাথায় একটা গাট্টা মারে।

– আমার এত রসকষের প্রয়োজন নেই বুঝেছিস?

– হুম বুঝেছি। আচ্ছা আপু আরান ভাইয়ার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?

বিন্দু বাঁকা চোখে ফারিনের দিকে তাকায়।

– কেনোরে? আরানের গার্লফ্রেন্ড দিয়ে তুই কি করবি?

ফারিন অধৈর্য হয়ে বলে,

– বল না আপু। বললে কি হয়। আর আমিতো এমনিই জিজ্ঞেস করছি। আমার আর কি?

– তোর যেহেতু কিছু না তাই তোর এসব জেনেও লাভ নেই।

– আপু। বল না।

– আগে বল তুই কি করবি?

– কিছু করবো না এমনি জাস্ট জিজ্ঞেস করছি।

– পারবো না বলতে। এবার তাড়াতাড়ি পা চালা। খালামনির বাড়ি গিয়ে আবার ঢাকায়ও ব্যাক করতে হবে।

ফারিন মুখটাকে ছোট করে রেখেছে। একটু বললে কি হত আপুর? শাঁকচুন্নি একটা। হুহ্।

______________

– ভাইয়া, তুই এত রাতে এখানে কি করছিস?

আরাধ পিছনে ফিরে আরানের দিকে তাকায়। ছাদে একা একা দাঁড়িয়ে ছিল। কোনো কিছু নিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন সে। তানিয়ার খোঁজ এখনো চালাচ্ছে কিন্তু কোনো খোঁজ পাচ্ছে না। বাবাকেও কিছু বলে উঠতে পারছে না মূলত সাহস পাচ্ছে না।

– কিরে কথা বলছিস না যে?

আরাধ মৃদু হেসে বলে,

– এমনিই রুমে ভালো লাগছিল না সেজন্য এখানে এসেছি। তুই এখানে কেন?

– এইতো আমি এমনি-ই আসলাম। আচ্ছা চল, দু’জন মিলে আড্ডা দিই।

আরান ছাদের রেলিং এর পাশ ঘেঁষে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আরাধও মৃদু হেসে আরানের মত তার পাশে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। আরাধকে চুপচাপ থাকতে দেখে আরান হালকা কেঁশে বলে,

– কিছু বলছিস না কেন?

– কি বলবো? তুই বল না। শুরু কর।

আরান রেলিংটাকে শক্ত করে ধরে বসে এবার। মুচকি হেসে বলে,

– বিন্দুকে তোর পার্সোনালি কেমন লাগে?

হঠাৎ এ প্রশ্ন করায় আরাধ হকচকিয়ে যায়।

– কেমন আবার লাগবে? ভালোই।

আরান মৃদু হেসে বলে,

– শুকনো মুখে ভালোটা শুনতে চাইনি। বিন্দুর সাথে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে। তাই কথা হলো ওকে তুই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবিতো। তোর পক্ষ থেকে কোনো না নেইতো?

শূন্যতে দৃষ্টি রেখে আরাধ কিয়ৎক্ষণ মৌন থাকে। এবার আশেপাশে তাকায়। রাত অনেক হওয়ায় চারদিকে অন্ধকার। দূর থেকে শুধু দুই একটা বিল্ডিং থেকে আলো দেখা হচ্ছে।

– বাবা বিয়ে নিয়ে আরো কিছু বলেছিল নাকি?

– আমার প্রশ্ন এটা ছিল না। আর বাবাকে আজকে দেখলাম, মায়ের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করছে। কিভাবে বিন্দুর বাবাকে রাজি করানো যায় সেসব ভাবছেন বাবা। বাবা এই বিয়েটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড। বাবার বড় স্বাদ বিন্দুকে তোর বউ করে আনবেন।

আরান ম্লান হেসে বললো,

– চল নিচে যাই। রাততো অনেক হলো ঘুম আসছে আমার। আয় তাড়াতাড়ি। চল।

আরাধ চলে যেতে নিলে আরান হাত ধরে আরাধকে আটকিয়ে দেয়।

– তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস ভাই? বল না কি হয়েছে? তুই কি বিন্দুকে পছন্দ করিস না?

– আব, না। সে রকম কিছুই না। আমার ঘুম পাচ্ছে চল।

আরাধ তাড়াতাড়ি করে ছাদ ত্যাগ করে। আরান এখনো আরাধের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

_____________________

– মমমা, বাবার কি হয়েছে? বাবা হসপিটালে কেন? ও মা বলো না বাবার কি হয়েছে?

বিন্দু মাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করে। আসমা বেগম মেয়েকে একহাতে ধরে কান্নামিশ্রিত গলায় বললেন,

– তোর বাবা সকালে খেয়েদেয়েই স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন প্রতিদিনের মত। কিন্তু দুপুরে স্কুল থেকে খবর আসে তোর বাবার অবস্থা নাকি খারাপ। তোর বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি খবরটা পাওয়া মাত্র হসপিটালে ছুটে আসি। এখানে এসে শুনি তোর বাবা স্ট্রোক করেছেন। একটু দেরি হলে তোর বাবাকে বাঁচানো যেত না।

কথাটা বলে আসমা বেগম শব্দ করে কেঁদে দেন। খবরটা শুনে বিন্দু যেন পাথর হয়ে গেছে। বিন্দুর মাথার উপরের ছাদ অর্থাৎ ওর বাবা আজ মৃত্যু শয্যায় এটা বিন্দু মানতে পারছে না।

– মা। বাবা কোথায়? চল বাবার কাছে যাই।

বিন্দু কোনোরকমে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে। পাশেই বেঞ্চিতে বসে বাচ্চাদের মত কাঁদছে ফারিন। বিন্দু বোনকে একহাতে আগলে নেয়। পা বাড়ায় বাবার কেবিনের দিকে।

_____________

– বাবা।

নিঃস্তব্দ রুমে বিন্দু বাবাকে ডেকে ওঠে। কবির শেখ দুর্বল দৃষ্টিতে বিন্দুর দিকে তাকান। বিন্দু দৌঁড়ে বাবার কাছে যায়। বাবার হাত ধরে বসে পড়ে।

– বাবা, তোমার এ কি অবস্থা! শরীরের একটুও যত্ন কেন নাও না তুমি?

কবির শেখ দুর্বল কন্ঠে বলেন,

– পাগলি মেয়ে আমার, দেখো বাবা একদম ঠিক আছি। পুরোপুরি সুস্থ।

বিন্দু অভিমানী কন্ঠে বলে,

– তুমি সুস্থ? তাহলে তুমি হাসপাতালে কেন শুনি?

কবির শেখ মৃদু হাসলেন। বা হাতের ইশারায় ছোট মেয়েকে ডাকলেন। ফারিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিল। ফারিন গুঁটিগুঁটি পায়ে এসে বাবার পাশে বসে। কবির শেখ মেয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে দেন। বাবার আহ্লাদ পেয়ে ফারিন এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়। কবির শেখ এই সেই বলে ফারিনকে বুঝান। এতে ফারিন কিছুটা শান্ত হয়।

– ফারিন মা, তুমি একটু বাহিরে তোমার মায়ের কাছে যাও তো। মাতো নিশ্চয়ই একা আছে বাইরে। তুমি সেখানে যাও। আমার বিন্দুর সাথে কথা একটু আছে।

ফারিন আচ্ছা বাবা বলে ভদ্র মেয়ের মত রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কবির শেখ এবার বড় মেয়ের দিকে তাকান। বিন্দু ওনার দিকেই তাকিয়ে আছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে বাবা তাকে কি বলতে চাইছে।

– আমি তোমায় কিছু বলতে চাই বিন্দু।

বিন্দু মুচকি হেসে বলে,

– হুম বাবা, বলো না কি বলবে।

– আমি চাই তুমি আরাধকে বিয়ে করো। আলী আকবর ভাইকে আমি এখনো কথা দিই নি। আমি বলেছি আমি তোমার সাথে কথা বলে ওনাকে জানাবো। আমি চাই বিন্দু তোমার মতামতটা যেন না-সূচক না হয়। আমি হ্যাঁ শুনতে চাই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here