দখিনা হাওয়া পর্ব -১১

#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[১১]

আজ শাপলা বেগম আমেরিকা চলে যাবেন। ওনার ছোটমেয়ে অনেক জোর করে এখন নিয়ে যাবে। শাপলা বেগম বলেছেন কয়েকমাস থেকেই চলে আসবেন। ওনার মেয়ে তাতেই হ্যাঁ করে দিয়েছে। তবে সে মাকে একবার নিতে পারলে আর দিচ্ছে না। তারা থাকতে মা কেন মামার বাড়ি পড়ে থাকবে। শাপলা বেগমের ছোটমেয়ে তৃষা গতকাল রাতেই মির্জা বাড়িতে এসেছে। এখন বিকাল চারটা। একটু পরে তারা রওয়ানা হবে। সন্ধ্যা ছয়টায় ফ্লাইট। সবাই ড্রয়িংরুমে বসে কথা-বার্তা বলছে। বিন্দু এককোণে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। আরাধ সবার সাথে কথাবলায় মগ্ন ছিল। হঠাৎ কথার মধ্যে একনজর বিন্দুর দিকে তাকালো। বিন্দু নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মোবাইলে গেম খেলছে। বিন্দুকে দেখতে এমুহূর্তে ছোট বাচ্চাদের মত লাগছে। এখন বিন্দুর মধ্যে বড় মানুষের কোনো লক্ষণ পাচ্ছে না আরাধ। বিন্দুর গেম খেলা শেষ হলে মোবাইলটা অফ করে সামনে তাকায়। সামনের সোফায় বসে আরাধ ওর দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তা দেখে বিন্দু নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়ে আরাধের দিকে তাকিয়ে ভ্রুঁ দ্বারা ইশারা করে। আরাধের এভাবে তাকিয়ে থাকার কারণ কি? আরাধ সম্বিত ফিরে পেয়ে থতমত খায়। নিজেকে শ’খানেক গালি দিয়ে বিন্দুর দিকে আবার তাকিয়ে ক্যাবলামার্কা একটা হাসি দেয়। সবার কুশল বিনিময় করে তৃষা আর শাপলা বেগম বের হন। সবাই সামনে আছে শাপলা বেগমের পিছন পিছন বিন্দুও আসে।

– আবার আসবেন ফুফু। আল্লাহ আপনার যাত্রা শুভ করুক।

শাপলা বেগম বিন্দুকে কটাক্ষ করে বলেন,

– আমার ভাইয়ের বাড়িতে আমি আসবোই। তার জন্য তোমার এত দাওয়াত করতে হবে না। নিজের চরকায় তেল দাও। এতেই তোমার লাভ। আমার মন পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে না তোমার। আমি তোমায় কখনোই পছন্দ করি নি আর কখনো করবোও না।

বিন্দু প্রথমে খানিকটা বিব্রতবোধ করে শাপলা বেগমের কথায়। সাথে খানিকটা অপমানিতও হয়। তারপর কি একটা ভেবে মুচকি হাসে। শাপলা বেগমের চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি বলে,

– আমি সবসময় একটা কথা ভাবি সাথে মেনে চলারও চেষ্টা করি। যেখানে তোমার সম্মান নেই, সেখানে যদি তুমি এক কদম বাড়িয়ে থাকো, তাহলে দুই কদম পিছিয়ে যাবে। যাতে তুমিতো না-ই তোমার অবচেতন মনটাও যেন কখনো সেখানে না পৌঁছাতে পারে। আর আমি জানি আপনি আমায় অপছন্দ করেন, তাই আপনার মন জয় করারও কোনো ইচ্ছাও নেই আমার। আর আপনি মানুষটাও এমন, যাকে আমার পার্সোনালি অপছন্দ।

শাপলা বেগম রোষানল দৃষ্টিতে তাকান বিন্দুর দিকে। বিন্দু ওনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য ঘরে ঢুকে গেল। সবাই বাহিরে আছে। বিন্দু রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। এই প্রথম কোনো গুরুজনের সাথে বিন্দু এমনভাবে কথা বললো। আজকে কেন যেন এসব বলে ফেললো বিন্দু। বিন্দুর খুব খারাপ লাগছে এখন। কেন যে এভাবে কথা বলতে গেল? শাপলা বেগম যেমনই হোক। গুরুজনের সাথে এমনভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি বিন্দুর। বিন্দু এসব ভাবতে ভাবতেই খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। শাপলা বেগম চলে যাচ্ছেন তাই সবাই ওনাকে এগিয়ে দিচ্ছে। আরাধ ওনাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। আরান গত দু’দিন ধরে বাড়ি নেই। ভার্সিটি থেকে সবাই ট্যুরে গেছে। বিন্দু যায় নি। বিয়ে হয়ে গেছে বলে নয়। বিন্দু কখনোই ট্যুরে যায় নি। কবির শেখ কখনো যেতে দেন নি। মেয়েদের নিয়ে খুব পজেসিভ উনি। বিন্দুও কখনো আক্ষেপ করেনি এ নিয়ে। তারও কেন যেন যেতে ইচ্ছা করেনি কখনো।
__________________

বিন্দু বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল রুমের মধ্যে। বাহির থেকে কেউ অনবরত দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। বিন্দুর কান সজাগ থাকলেও চোখ খুলতে পারছে না। অতিরিক্ত ঘুম এসে ধরা দিয়েছে তার চোখে। হঠাৎই দরজা ধাক্কানো বন্ধ হয়ে যায়। মিনিট পাঁচেক পর আবারও কেউ দরজা ধাক্কায়। কিছু বলছে যেন সাথে। বিন্দু অনেক কষ্টে উঠে গিয়ে দরজা খুলে।। দরজার ওপারে আরাধ দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু ঘুমঘুম চোখে আরাধকে পর্যবেক্ষণ করে। আরাধকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

– রুমে ঢুকবো না?

আরাধের কন্ঠ পেয়ে বিন্দু তাড়াতাড়ি করে জায়গা ছেড়ে দাঁড়ায়। মাথাটা দুইদিকে কিছুক্ষণ নাড়িয়ে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিছুটা সফলও হয়।

– কখন এলেন?

আরাধ মৃদু হেসে বিছানার ওপর গিয়ে বসে। ইশারা করে বিন্দুকে বসার জন্য। বিন্দু মুচকি হেসে আরাধের পাশে গিয়ে বসে।

– ঘুমাচ্ছিলে? আমার জন্য তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব হয়ে গেল কি?

বিন্দু মাথা নাড়িয়ে বলে,

– সমস্যা নেই। এখন ঘুমের রেশ কেঁটে গেছে। আচ্ছা ছাড়ুন ফুফুদের এয়ারফোর্টে কি ছেড়ে এসেছেন?

– সময় দেখেছেন ম্যাডাম? এতক্ষণে ফুফুরা আকাশে। তুমি ঘুমে ছিলে তাই সময় দেখোনি।

– হুম। আচ্ছা আপনি কিছু খাবেন? কিছু কি করে আনবো?

আরাধ মুচকি হেসে বলে,

– আনলে মন্দ হয় না।

বিন্দুও মুচকি হেসে বলে,

– তাহলে বলুন, কি বানিয়ে আনবো?

– তুমি যা চাও।

– যা চাই?

আরাধ মাথা নাড়ায়। বিন্দু মুচকি হেসে বলে,

– ভেবে বলছেনতো? যদি বিষ এনে দিই, তাহলে তা-ই খাবেন?

আরাধ বিন্দুকে একহাতে টেনে সামনে এনে বসায়। ঠোঁট দু’টো প্রসারিত করে বলে,

– আমি জানি তুমি আমাকে বিষ খাওয়াবে না। সে বিশ্বাস আমার তোমার ওপর আছে। আর যদি তাও বিষ খাওয়াতে চাও তাহলে যাও নিয়ে এসো বিষ। আমি অমৃত ভেবে খেয়ে নেবো।

বিন্দু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে আরাধের দিকে।

– হয়েছে আর ড্রামা করতে হবে না।

_____________

– বিন্দু এই হলো আমার বেস্টফ্রেন্ড অন্তর। ও এতদিন আউট অফ টাউন ছিল তাই বিয়ের সময় আসতে পারে নি। আজ তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। আর অন্তর এ হলো আমার ওয়াইফ মিসেস বিন্দু আরাধ মির্জা। পরিচিত হয়ে নে দু’জন।

অন্তর বিন্দুকে দেখে যতট অবাক হয়েছে বিন্দুও ঠিক ততটাই অবাক হয়েছে। এ সেই অন্তর যে বিন্দুর পিছনে দুই বছর ঘুরেছে। বিন্দু ওর পিকইতো আরাধের এফবির কভার পিকে দেখেছিল। বিন্দু কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমতাআমতা করে আরাধের দিকে একবার তাকিয়ে অন্তরের উদ্দেশ্যে বলে,

– আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন?

অন্তর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিন্দুর দিকে। সেও আমতাআমতা করে,

– ওয়ালাইকুমুসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি মানে আআপনি কেমন আছেন?

– জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

আরাধ মাঝখান থেকে বলে উঠে,

– কিরে, এতক্ষণতো খালি বিন্দুর সাথে দেখা করবি বলে উতলা হয়েছিলি। এখন ঠিক করে কথা বলছিস না কেন?

অন্তর মেকি হেসে বলে,

– কই? কথা বলছিতো। আচ্ছা আরাধ হঠাৎ করে মনে পড়লো আমার আজকে জরুরী একটা কাজে যেতে হবে। এতক্ষণ মাথায়-ই ছিল না। আসছি আমি। অন্যসময় এসে আড্ডা দিবো।

কথাগুলো বলে কোনোরকমে পালায় অন্তর। আরাধ আর বিন্দু গোলগোল চোখে অন্তরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।

– কেইসটা কি হলো? ও এমনভাবে পালালো কেন?

আরাধের প্রশ্ন শুনে বিন্দু কেঁশে উঠে। কাঁশতে কাঁশতে সোফায় গিয়ে বসে। আরাধকে ইশারা করে বসার জন্য। আরাধ গিয়ে বিন্দুর পাশে বসে।

– শুনবেন কেন এভাবে চলে গিয়েছেন উনি?

আরাধ অবাক হয়ে বলে,

– ও কেন চলে গেছো সেটা তুমি কিভাবে জানো?

বিন্দু আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ ঘটনা বলে আরাধকে। বিন্দুর কথা শেষ হতেই আরাধ হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,

– তুমি ওকে রিজেক্ট করলে কেন? কি খারাপ আছে ওর মধ্যে? বেচারাতো তোমায় বিয়ে করতে চাইছিল। এভাবে ওকে রিজেক্ট করার কারণটা কি?

– আপনাকেতো বললামই তখন আমি ছোট ছিলাম। এসব নিয়ে তখন কিছু ভাবিওনি। উনি এভাবে পিছন পিছন ঘুরতো বলে খুব ভয়ও পেতাম তখন।

আরাধ হাসতে হাসতে বলে,

– যা-ই বলো তুমি, বেচারা তোমায় দেখে কতটা ঘাবড়ে গেছে দেখেছো? যাকে ভালোবাসলো, বিয়ে করতে চাইলো। সে কিনা এখন তার বেস্টফ্রেন্ডের বউ। কতদিন যে ও আমার সামনে আসবে না সেটা ও-ই ভালো জানে। আজকে লজ্জা পেয়েছে খুব।

বিন্দুও আরাধের সাথে তাল মিলিয়ে হাসে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here