দখিনা হাওয়া পর্ব -১০

#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[১০]

আরাধের রুমটার ঠিক পশ্চিম পাশে একটা বারান্দা আছে। বিন্দু এই প্রথম বারান্দাটায় প্রবেশ করলো। আরাধ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্দু সন্তর্পণে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আরাধ তাকে রুমে কেন ডাকলো সেটাই তার মাথার অধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আরাধ বিন্দুর অস্তিত্ব টের পেয়ে পাশে বিন্দুর দিকে তাকায়। বিন্দু একটা খয়েরি রংয়ের শাড়ি পরে আছে।

– বলুন কি বলবেন?

আরাধ কিছুক্ষণ উশখুশ করে। বিন্দু আরাধের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়। মাথার কাপড়টাকে আরো একটু টেনে নেয়।

– তুমি না বিয়েটা করতে চাইছিলে না। তাহলে বিয়েটা করলে কেন?

কথাটা শোনামাত্র বিন্দুর চোখ ছলছল করে ওঠে। গলা খাঁকারি দিয়ে আরাধকে পিছনে রেখে দু’পা সামনে এগোয়।

– নিরুপায় ছিলাম আমি। হেরে গেলাম নিজের কাছে। যার সাথে আমার বিয়ে হবে সে অন্যকাউকে ভালোবাসে, তা জেনেও আমায় তাকেই বিয়ে কিরতে হলো। নিজেকে খুব অসহায় লাগে প্রতিটা মুহূর্তে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে না করার সাহস হয়নি। আপনি আমার বাবার বর্তমান অবস্থার কথা জানেন। আমিতো জানতাম যে আপনি বিয়েতে কখনো হ্যাঁ করবেন না। তাহলে আপনি রাজি হলেন কেন?

আরাধ বিন্দুর দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়। নিজের চুলে হাত ভুলায় কিছুক্ষণ। বিন্দুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,

– যাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়, তারা প্রথমে এক অপরকে চেনে না। ধীরেধীরে চিনতে শুরু করে, ভালোবাসতে শুরু করে। তবে আমার ক্ষেত্রে সময়টা একটু বেশি লাগবে। কারণ আমি অন্য একজনকে ভালোবাসিতো। কিন্তু আমি তোমায় ভালোবাসতে চাই, চিনতে চাই। সে সুযোগটা দেবে আমায়?

আরাধের কথা শুনে বিন্দু অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এসব কি বলছে আরাধ?

– আপনি এসব কি বলছেন? আপনিতো তানিয়াকে ভালোবাসেন তাহলে এসব বলার মানে কি? আমার জন্য আপনার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল?

– তুমি ভুল ভাবছো বিন্দু। তোমার জন্য আমার জীবনটা বরবাদ হয়নি, না হবে। আমি তোমাকে অনেকদিন থেকেই জানি। তুমি খুব, খুব ভালো একটা মেয়ে। বাবা তোমাকে আমার জন্য পছন্দ করেছে। তোমাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে আমার মধ্যে বাঁধা ছিল তানিয়া। এখন আর সে নেই।

– নেই মানে? আপনি এসব কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। দয়া করে, সব ক্লিয়ার করে বলুন আমায়।

আরাধ এবার বিন্দুর দিকে ফিরে তাকায়। হঠাৎ করে কান্না করে দেয়। বিন্দু এতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।

– আআপনি কান্না করছেন কেন? কি হয়েছে? থামুন আগে।

আরাধ কিছুক্ষণ পর নিজেকে শান্ত করে।

– আমি তানিয়াকে খুঁজে পেয়েছি বিন্দু।

অজানা আশঙ্কায় বিন্দুর বুক কেঁপে ওঠে। সেতো জানতো এসব হবে। কিন্তু এসবের জন্য নিজেকে তৈরি রাখেনি সে। কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,

– কোথায় সে এখন?

– তার শ্বশুরবাড়ি।

বিদ্রুপাত্মক হেসে জবাব দেয় আরাধ।

– মানে? আপনি কি আমাকে সবকিছু ক্লিয়ার করে বলবেন?

– ওকে। শোনো তাহলে, আমি আর আরান চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। তোমার বাবার যখন হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তখন। সকালবেলা একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম আমি। কিন্তু..কিছুদূর যাওয়ার পর দৃষ্টি যায় একটা কাপলের দিকে। তারা একে অপরের হাত ধরে হাঁটছে। সেখানকার মেয়েটাকে আমি চিনি। খুব ভালো করে চিনি। মেয়েটা হলো আমার প্রথম ভালোবাসা মানে তানিয়া। তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না ওদের ওই অবস্থায় দেখে আমার যেন নিঃশ্বাস আটকে আসছিল। আমি তানিয়ার সাথে কথা বলতে চাইলে ও আমায় অবাক করে আমাকে সম্পূর্ণ ইগ্নোর করে পাশ কাঁটিয়ে চলে যায়। আমি যেন সেখানেই বরফ হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর পিছন থেকে আমায় কেউ ডাক দেয়। পিছনে তাকিয়ে দেখি তানিয়া। এখন সে ছেলেটা নেই। আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করি, “এসব কি? আর ছেলেটা কে?” ও স্বাভাবিকভাবেই বলে,”আমার স্বামী। আমার বিয়ে হয়ে গেছে আরাধ।” জানো বিন্দু তখন মনে হয়েছিল আমি কথা বলতে ভুলে গেছি। ও বিয়ে করে নিয়েছে। যার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করলাম সে আমায় ধোঁকা দিল। মানতে পারছিলাম না কিছুতেই। ওকে জিজ্ঞেস করি, “আমায় ধোঁকা দিলে কেন?” ও জবাবে কি বলেছে জানো। “ফাইনাল ইয়ারের এক্সামের কিছুদিন আগে শুনি আমার বাবা আসিফের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আসিফের বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী। ওদের নিজস্ব ব্যবসা সেটা। আর আসিফই একমাত্র উত্তরাধিকারী। তুমিই বলো আসিফের জায়গায় তোমায় চুজ করি কি করে? হ্যাঁ মানছি, তোমাদের অনেক টাকা পয়সা আছে তবে আসিফদের টাকাপয়সার কাছে তোমাদের টাকাপয়সা কিছুই না।” বিন্দু তুমি ভাবতে পারছো কেমন ধোঁকাবাজ একটা মেয়েকে আমি ভালোবেসেছি।

– তারপর? তারপর আপনি কি বললেন?

আরাধ কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে বলে,

– তখন আমার মাথায় রাগ চেপে বসে। রাগের বশেই বলি “তুমি তাহলে টাকাপয়সাকে ভালোবাসো। আমার সাথে তাহলে এতদিন ভালোবাসার অভিনয় করে গেছিলে? যেই আমার চাইতে বড়লোক ছেলে দেখলে, তখনই তার গলায় ঝুলে পড়লে। বাহ, বাহ খুব ভালো। তবে তোমার মত কিন্তু সব মেয়ে হয় না। তুমি একটা ধোঁকাবাজ মেয়ে। তোমার মত একটা মেয়ের জন্য আমি আমার বাবাকে কষ্ট দিতে যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো তোমার সাথে দেখা হয়ে। ভালো থেকো তোমার বড়লোক স্বামীকে নিয়ে। ইনশাআল্লাহ আমিও ভালো থাকবো তাকে নিয়ে, যে আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে।

আরাধ কথাটুকু বলে আবারও কেঁদে দেয়। বিন্দু নিজের হাতটা বাড়িয়ে আরাধের পিঠে রাখে। খুব কাঁপছে বিন্দুর হাতটা। আরাধের পিঠে হাতটা রাখার সাথে সাথেই আরাধ বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। বিন্দু যেন এতে পাথর হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে আরাধ বলে,

– আমি ওকে ঠিক ভুলে যাবো, তাইনা বিন্দু? আমি ওকে মনে রাখতেও চাইনা। আমি তোমায় খুব ভালোবাসতে চাই। সময় লাগুক, তাও ভালোবাসতে চাই। আমায় দেবে সেই সুযোগ?

বিন্দু কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আরাধের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিন্দু।

– আমি জানি বিন্দু, আমার কথাগুলো তোমার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু ট্রাস্ট মি বিন্দু, আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসতে চাই। তোমার সুখ দুঃখের সঙ্গী হতে চাই। তোমার কি মনে হয়, তানিয়াকে আমি এখনো ভালোবাসলে আমি তোমায় বিয়ে করতাম? উঁহু! সেটা কখনোই হতো না। কারণ একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করে তাকে ধোঁকা দেবো, এমন মানুষ আমি নই। তানিয়া আমায় ধোঁকা দিয়েছে। ওর জন্য আমার মনে কোনোরূপ ফিলিংস রাখতে চাই না আমি। মোটকথা ওকে আমি মনেই রাখতে চাই না। জানি ওকে ভুলতে আমার খুব কষ্ট হবে। তবুও আমি চাই তুমি আমায় ওকে ভুলাতে সহায়তা করবে। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী বিন্দু। আমি তোমার সুখ দুঃখের সাথী হতে চাই। তুমি সবসময় আমার পাশে থাকবেতো?

বিন্দু কিছুক্ষণ ভেবে মাথাটা ওপরনিচ করে। আরাধ কান্নামাখা চোখে তৃপ্তির হাসি হাসে।

______________

বিন্দুর বিয়ে হয়েছে আজ তিনদিন হয়ে গেল। ভালোয় ভালোয় বৌ-ভাত কেঁটে গেছে। বিন্দু মন দিয়ে সংসার করার চেষ্টায় আছে। শাপলা বেগম ওকে যতই হেনস্তা করার চেষ্টা করুক না কেন, আরাধ ওর পাশে আছে। তাই কোনোকিছুই বিন্দুর খারাপ লাগে না। মা ঠিকই বলেছে, আরাধ পাশে থাকলে শাপলা বেগম আর কি করতে পারবেন? কথাটা ভেবে বিন্দু মুচকি হাসে। আরাধ অফিস থেকে ফিরেনি এখনো। আরানটাও বাসায় নেই। আলী আকবর মির্জা আর নয়না বেগম নিজেদের রুমে। শাপলা বেগমও ঘুমোচ্ছেন। এখন বিকেলবেলা। বিন্দু একা একা কি করবে তাই বসে বসে মোবাইলে গেইম খেলছে।

– কি করছেন ম্যাডাম?

বিন্দু গেইম খেলছে বলে সামনে তাকায়নি। সে জানে মানুষটা কে। বিন্দু মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বলে,

– গেইম খেলছি।

আরাধ বিন্দুকে ডিস্টার্ব না করে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে বিন্দু রুমে নেই। খানিকক্ষণ পর বিন্দু ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। আরাধ তা দেখে মুচকি হাসে। বিন্দু পুরো সংসারী হওয়ার চেষ্টায় আছে। আরাধ বাবার মুখে এখন তৃপ্তির হাসি দেখে। মেয়েটা পুরো সংসারটাকে কিছুদিনের মধ্যেই কেমন আপন ভেবে নিয়েছে। আরাধের ভাবনার মাঝেই বিন্দু ডাক দেয়।

– এই যে সাহেব, খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি।

বিন্দু খাবারগুলো টি-টেবিলের ওপর রেখে আরাধের দিকে তাকায়। আরাধ মুচকি হেসে এগিয়ে যায়।

– আসতে পারি?

আরাধ খাচ্ছিল আর বিন্দু চুপচাপ মোবাইল স্ক্রল করছিল। তার মধ্যেই আরানের কন্ঠ শোনা গেল।

– তুই আমার রুমে আসার জন্য আবার কবে থেকে পারমিশন নেওয়া শুরু করলি?

আরাধ ভ্রুঁ কুঁচকে আরানকে জিজ্ঞেস করে। আরান হেলে দুলে রুমে ঢুকে।

– এখন কি আর এটা তোর একার রুম, যে যখন ইচ্ছা করবে তখনই আসবো? এখনতো তুই আর একা না, ভাবিও আছে। অবশ্যই পারমিশন নিয়ে আসতে হবে।

বিন্দু চোখ কটমট করে তাকায় আরানের দিকে। আরান ক্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে বলে,

– এভাবে তাকাস কেন? আমি কি তোকে ভয় পাই? আর একটা কথা, এটা কিন্তু ঠিক না ভাবি। তুই ভাইয়াকে পেয়ে আমায় ভুলেই গেছিস। কোনো একটা সময় আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম, তোরতো দেখছি সেসব মনেই নেই। একজন ঠিকই বলেছে, মেয়েরা জামাই পাইলেই চলে, দুনিয়ার আর কিছু মনেই থাকে না।

বিন্দু একটা বই নিয়ে সেটাকে মুড়ে আরানকে দুই তিনটে বাড়ি দেয়। আরান মুখটাকে কিউট করে বলে,

– মারিস কেন ভাবি?

– এই এক সেকেন্ড! তুই ওকে ভাবি ডাকছিস আবার তুইও ডাকছিস। এসবের মানে কি?

আরাধের কথা শেষ হতেই আরান গর্বের সাথে বলে,

– বুঝতে পারোস নি দুলাভাই? ও একদিকে আমার বেস্টফ্রেন্ড তাই তুই করে বলছি আর আরেকদিকে আমার ভাবি তাই ভাবি করে বলছি।

– সব বুঝলাম কিন্তু তুই আমাকে দুলাভাই বললি কেন?

আরাধ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

– বিন্দু আমার বেস্টফ্রেন্ড প্লাস বোন। তো ফ্রেন্ডদের হাজবেন্টদের অবশ্যই দুলাভাই বলেই ডাকে! তাইনা?

আরানের কথা শেষে হতে তিনজন উচ্চস্বরে হেসে দেয়। হাসির মধ্যেই আরান আফসোস করে বলে,

– তুইতো বিয়ে করে নিলি। আমার কথাতো ভাবলিও না।

আরাধ ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

– কেন? তোর কথা কি ভাববো?

আরান আফসোসের সূরে বলে ওঠে,

– আমাদের মত ব্যাচেলরদের কষ্ট তুই কি করে বুঝবি? অফিস থেকে এসেছিস, তারপর তোর বউ তোর জন্য রুমেই খাবার নিয়ে এসেছে। আরাম করে খাচ্ছিস, বউয়ের সাথে সুখ দুঃখের গল্প করছিস। এই সুবিধাগুলো থেকেতো আমি বঞ্চিত হচ্ছি, তাই না?

আরাধ আর বিন্দু চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে থাকে আরানের দিকে।

– তার মানে কি আমার দেবরকে বিয়ে দিতে হবে? আমার জা আনতে হবে ঘরে? তাই কি?

– বুঝতেই যখন পেরেছিস, তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?

আরানের কথা শেষ হতেই আরাধ বলে,

– তাহলেতো তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে হচ্ছে।

আরান মাথা চুলকে ক্যাবলামার্কা হেসে বলে,

– তোর শালিকা থাকতে অন্য মেয়ে দেখার কি দরকার?

– এই একদম আমার শালিকার দিকে নজর দিবি না। তোর মত বাউণ্ডুলে ছেলের কাছে আমি ওকে বিয়ে দেবো না।

– এই, এই তুই একদম আমায় বাউণ্ডুলে বলবি না। আমি কি করেছি বাউণ্ডুলের মত? আমার মত ভালো ছেলে হারিকেন দিয়ে সাত গ্রাম খুঁজেও পাবি না। হুহ্!

বিন্দু গালে হাত দিয়ে দুই ভাইয়ের কান্ড দেখছে আর মুচকি হাসছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here