দহন পর্ব ১৫

#দহন
#পর্ব_১৫
#লেখা_মিম

-” শিমুল অনেক তো রাত হলো। এতরাতে তোমার সাথে একা খালিঘরে থাকাটা ঠিক হবে না। ব্যাপারটা বাজে দেখাবে। অনিমটাও তো আসছে না। তোমাকে একা রেখে যাওয়ার সাহও পাচ্ছি না।”
-” আপনি চলে যান। আমি একা থাকতে পারবো। আমার অসুবিধা হবে না।”
-” কেঁদে কেঁদে নিজের যা হাল করেছো তোমাকে এরপর একা ঘরে রেখে যাওয়াটা একদমই সেইফ না। এক কাজ করি তোমার বাসায় ফোন করে বলি কাউকে এখানে চলে আসতে।”
-” না মুহিব ভাই। এত রাতে ওদের ডেকে এনে এসব শোনানোর প্রয়োজন নেই।”
-” লুকিয়ে রাখতে পারবে কতদিন?”
-” জানি না।”
শিমুল মুহিব দুজনই অনিমের অপেক্ষায় বসেই আছে। পৌনে এগারোটার দিকে বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। মুহিব দৌঁড়ে যেয়ে গেইটটা খুলে দিলো। এই মূহূর্তে মুহিব নিজের চোখে যা দেখছে এরপর আর তার গলা থেকে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। ড্রইং রুমের সোফায় বসেই গেটের বাহিরটা দেখতে পাচ্ছে শিমুল। কি দেখছে সে এটা? শেষ পর্যন্ত অনিম এটা করতে পারলো? সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শিমুল। মুহিব অনিমকে বললো,
-” এই মেয়েকে তুই বাসায় নিয়ে আসছিস কেনো?”
মুহিবকে গেট থেকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে একহাতে নীলা আর অন্য হাতে নীলার লাগেজ নিয়ে ঢুকছে অনিম।
-” নীলা তুমি বামদিকের রুমটাতে যেয়ে বসো।”
-” এই তোকে আমি কি জিজ্ঞেস করছি? উত্তর দেস না কেনো?”
-” কি উত্তর দিবো?”
-” নীলা এই বাসায় কেনো?”
-” তো আর কোথায় যাবে? আমার বউ তো আমার বাসাতেই থাকবে তাইনা?”
-” বউ মানে? অনিম কি বলছো তুমি? এই অনিম…….. নীলাকে বউ বলছো কেনো?”
-” ওকে বিয়ে করেছি তাই বউ বলছি।”
-” মিথ্যা….. মিথ্যা কথা বলছো তুমি। আমি থাকতে ওকে কেনো বিয়ে করবে তুমি?”
-” ওকে আমি ভালোবাসি তাই। আজ যা ঘটেছে এরপর আমার নীলা আবার সুইসাইড এটেম্পট নিতো। আমি আর কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। তাই ওকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছি। এখন সিদ্ধান্ত তোমার শিমুল। তুমি এখানে চাইলে থাকতে পারো। তোমার সব খরচ আমি দিবো অসুবিধা নেই। কিন্তু দয়া করে আমার উপর কোনো অধিকার খাটাতে আসবে না।”
মুহিব অনিমের শার্টের কলার চেপে ধরেছে।
-” কি করেছিস তুই এটা? শিমুল থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়েকে কিভাবে বিয়ে করলি তুই? শিমুলকে কি তুই মেরে ফেলতে চাচ্ছিস অনিম?”
-” ওকে আমি মারতে চাইনা। আমি নিলাকে বাঁচাতে চাই। শিমুল যথেষ্ট শক্ত মনের মেয়ে। ও মরতে যাবে কেনো?”
-” শিমুল তোকে কতটা ভালোবাসে সেটার কোনো আন্দাজ আছে তোর? এটা কি করলি রে অনিম? মেয়েটা এখন কি নিয়ে বাঁচবে?”
-” দুনিয়াতে বহু ডিভোর্সি ছেলে আছে। ওর জন্য কোথাও ছেলের অভাব পড়বে না।”
-” আর ও যে কষ্টটা পাচ্ছে সেটা?”
-” ওটা সাময়িক। কিছুদিন পরই ঠিক হয়ে যাবে। আমিও তো নীলার শূন্যতায় এই সাড়ে চার বছর ভুগেছি। কই আমি তো মরিনি।”
বিগত পনেরো মিনিট যাবৎ ওরা দুজন বাক বিতন্ডা করেই যাচ্ছে। নীলা এসেই নিজের লাগেজটা নিয়ে অনিমের দেখানো রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। শিমুল এই ঝগড়ার মাঝেই কখন এখান থেকে নিজের রুমে যেয়ে দরজা আটকেছে সে খবর মুহিব বা অনিম কারোরই জানা নেই। তারা ঝগড়া করতে এতটাই ব্যস্ত ছিলো যে চোখের সামনে থেকে একটা মেয়ে সরে গেছে সেটা তাদের নজরেই পড়েনি। পুরো পনেরো মিনিট পর ঝগড়ার মাঝেই হুট করে মুহিবের খেয়ালহলো শিমুলের কথা। শিমুল কোথায়? এখানেই তো দাঁড়িয়েছিলো সে। মুহিব ঘরের দিকে চোখ ঘুরাতেই লক্ষ্যকরলো শিমুলের রুমের গেইট ভেতর থেকে লক করা। দরজা লক দেখামাত্রই মুহিবের কলিজায় কামড় লেগে উঠলো। দৌড়ে সে শিমুলের দরজার কাছে গিয়ে শিমুলকে জোরে জোরে ডাকছে কিন্তু তার কোনো সাড়া শব্দ মিলছে না। এতক্ষন অনিম ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে মুহিবের দরজা ধাক্কানো দেখছিলো। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরও শিমুলের কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় এতক্ষনে অনিমের টনক নড়লো। এবার সেও এসে মুহিবের সাথে শিমুলকে ডাকা শুরু করেছে।
-” অনিম দরজা ভাঙতে হবে।”
প্রায় বিশমিনিট আপ্রান চেষ্টা করার পর দরজা ভেঙেছে ওরা। মুহিব এতদিন ধরে যা সন্দেহ করছিলো তাই ই ঘটিয়েছে শিমুল। দু’হাতের রগ কেটে খাটের কাছের ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সে। সাদা টাইলসের ফ্লোরটা লাল হয়ে গেছে শিমুলের রক্তে। রক্তগুলো গড়িয়ে খাটের নিচের দিকে এগোচ্ছে। মুহিব দৌঁড়ে শিমুলের কানের নিচের রগটা চেক করে দেখলো। রুম থেকে দৌড়ে বের হতে হতে অনিমকে বললো,
-” ও বেঁচে আছে এখনও। আমি গাড়ি বের করছি। তুই শিমুলকে নিচে নামা।”
মুহিব পার্কিং এড়িয়া থেকে গাড়ি বের করে দাঁড়িয়ে আছে শিমুলের জন্য। দশ মিনিট পর অনিম শিমুলকে কোলে করে বেড়িয়ে আসলো। অনিমের আকাশি রঙের শার্টটাও ভিজে গেছে শিমুলের রক্তে। এত রক্ত দেখে মুহিবের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শিমুল বাঁচবে তো? গাড়ির পিছনের সিটে শিমুলকে শুইয়ে সামনের সিটে এসে বসলো অনিম।
-” কি রে তুই এখানে বসেছিস কেনো? শিমুলের পাশে যেয়ে বস।”
-” না আমি এখানেই ঠিকাছি। তুই শিগগির গাড়ি স্টার্ট কর।”
অনিমের আচরনে ব্যাপক অবাক হচ্ছে মুহিব। ওর মধ্যে তেমন কোনো চিন্তাই দেখা যাচ্ছে না। এত নিষ্ঠুর কবে থেকে হলো অনিম? মুহিব আর কথা বাড়ালো না। এই মূহূর্তে কথা না বাড়িয়ে শিমুলকে হসপিটাল নেয়াটা জরুরি।

শিমুলের দুই ভাই আর ছোট ভাবী এসেছে হসপিটালে। বড় বোন, দুলাভাই রাস্তায় আছে। যেকোনো মূহূর্তে তারা এসে পৌঁছুবে। মুহিব তাদের ফোন করে আসতে বলেছে। তাদেরকে খোলাসা করে সব জানিয়েছে সে। বর্তমানে এখানে বেশ থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। বৃষ্টি O.T. বাহিরের সোফায় বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। মুহিব সিঁড়ির পাশের জানালায় মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে নীরবে কাঁদছে যাতে ওর চোখের পানিটা কেউ দেখতে না পায়। ওর ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি এই মুহূর্তে শিমুলের দুহাত ধরে বলতে, ” আমাকে মাফ করে দাও শিমুল। আমি জানতাম না অনিম এমন করবে। সত্যিই জানতাম না আমি। খুব বিশ্বাস করে আমি তোমাকে অনিমের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ও আমার বিশ্বাসটা রাখেনি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ও। আমি সত্যি বলছি শিমুল। মাফ করে দাও।”
আগুনে পুড়ে যাচ্ছে মুহিবের ভেতরটা। আফসোসের আগুন….. ওর এই যন্ত্রনাটা কেউ বুঝতে পারছে না, কেউ দেখতে পারছে না। তার যন্ত্রনাটা সে নিজে এবং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব না। শিমুলের বোন নদী এসেছে। নদীর গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ মুছে ঘাড় ঘুরালো মুহিব। বৃষ্টি নদীকে প্রতিটা লাইন বিছিয়ে বিছিয়ে বলছে যা সে মুহিবের কাছ থেকে শুনেছে। নদী বেশ শক্ত মনের মানুষ। তার চোখ থেকে সচরাচর পানি বের হয়না। হাজার কষ্টেও তার চোখে কেউ পানি দেখতে পায়না। অন্যসব দিনের মতো আজও সে বেশ শক্ত মন মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। আদরের ছোট বোনের এই অবস্থা দেখে তো তার এতক্ষনে কান্নাকাটি করার কথা। আহাজারী করে না হোক দু’এক ফোঁটা পানি তো চোখ থেকে পড়ার কথাই ছিলো। কিন্তু তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে সে বলছে,
-” চামার টা কোথায় এখন?”
-” বলতে পারিনা আপা।”( মুকুল)
-” মুহিব তুমি কিছু জানো?”
-” না আপা। ওকে এসব জিজ্ঞেস করিনি।”
-” তুমি কি এসব আগে থেকে জানতে?”
-” সন্দেহ হয়েছিলো কয়েকবার। নিজের চোখে একবার দেখেছি, অন্যান্য বন্ধুরাও দেখেছে। ওকে জিজ্ঞেস করেছি কয়েকবার। স্বীকার করেনি। এটা নিয়ে ছোটখাটো দ্বন্দও হয়েছে আমাদের মধ্যে। এমনকি শিমুলও আমাকে বলেছিলো অনিমের আচার আচরন নাকি বদলে গেছে।”
-” কই শিমুল তো আমাকে কিছু জানায়নি। গতকাল সকালেও ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। বৃষ্টি তুমি কি কিছু জানো? তোমাকে কিছু বলেছে ও?”
-” না আপা। ওর সাথে তো আমার প্রতিদিনই কথা হয়। সপ্তাহে দুতিনদিন আমাদের দেখাও হয়। ও তো আমাকে বা বড় ভাবীকে কিছুই বলেনি।”
-” আপা, আমাদের বোনটা একাই কষ্টটাকে হজম করেছে এতদিন।”(সৈকত)
-” কে বলেছে ওকে হজম করতে? হজম করেছে কেনো ও? অনিমকে সরাসরি জিজ্ঞাস করলো না কেনো এই ব্যাপারে?”
-” আপা, ও অনিমকে জিজ্ঞেস করেছিলো। কিন্তু অনিম মুখ খুলেনি। কথা এড়িয়ে গেছে।”(মুহিব)
-” শিমুল নিশ্চয়ই অনিমকে মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করেছে। আমি তো চিনি আমার বোনকে। এসব কথা মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলে সারাজীবনেও উত্তর পাবে না। ওর উচিত ছিলো অনিমকে ছাঁই দিয়ে আটকানো যাতে সে পিঁছলে যেতে না পারে। ওর যখন সন্দেহ হচ্ছিলো তখন ও অনিমের মোবাইল চেক করলেই তো পারতো। তাহলে তো শুরুতেই সব গোমড় ফাঁস হয়ে যেতো। তা না করে বসে বসে তামাশা দেখেছে। কি অবস্থা এখন ওর?”
-” এখনও ক্রিটিক্যাল।”
-” আব্বা কি জানে এসব?”
-” না আব্বাকে শিমুলের কথা কিছুই জানাইনি। আব্বাকে বলেছি বৃষ্টির ছোট বোন অসুস্থ। তাকে দেখতে হসপিটাল যাচ্ছি।”
-” তোর বউ কোথায়?”
-” আফসানাকে আব্বার কাছে রেখে আসছি।”
-” মামলা করার ব্যবস্থা কর অনিমের বিরুদ্ধে আর যত তাড়াতাড়ি পারিস ডিভোর্স লেটার রেডি কর। চামাড়টাকে এবার জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো।”
O.T থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এসে বললো,
-” পেশেন্টের আরও দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। আমাদের স্টকে দুই ব্যাগ ছিলো দুটোই পেশেন্টকে অলরেডি দিয়ে দিয়েছি। আমাদের স্টকে আর নেই। আপনাদের মধ্যে কেউ ও পসিটিভ থাকলে আমার সাথে আসুন।”
শিমুলের দুই ভাইয়েরই ব্লাড গ্রুপ ও পসিটিভ। তারা দুজনই নার্সের পিছন পিছন গেলো। মুহিবের মোবাইলে ফোন এসেছে। ফোনটা মুহিবের বাবা করেছেন। বেশ খানিকটা দূরে যেয়ে ফোনটা রিসিভ করলো মুহিব।
-” কি রে? এত রাত হয়ে গেছে কোথায় তুই? তোর আম্মা তো তোর জন্য চিন্তা করছে।”
মুহিব তার বাবার আওয়াজটা শোনা মাত্রই ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করলো। কোনোভাবেই সে এই কান্নাটা আটকাতে পারেনি। কান্নার বেগটা দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে তার। হতে পারে সে এতক্ষন একজন মানুষ খুঁজছিলো যার কাছে সে একটু মন খুলে কাঁদতে পারবে, তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলবে শিমুলের কিচ্ছু হবে না। দুদিন বাদেই মেয়েটা একদম সুস্থ হয়ে উঠবে। ছেলের কান্না শুনে চমকে উঠলেন মুহিবের বাবা। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ছেলের কি হয়েছে জানার জন্য।
-” কি হয়েছে বাবা? কথা বলিস না কেনো? কাঁদছিস কেনো তুই?”
-” আব্বা শিমুল……”
-” হ্যাঁ শিমুল.? কি হয়েছে ওর?’
-” শিমুল হসপিটালে। আমি যা ভয় পেয়েছিলাম তাইই হয়েছে। ও সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছিলো।”
-” বেঁচে আছে তো?”
-” আছে। তবে কতক্ষন থাকবে জানি না। ডক্টররা এখনও সঠিক করে কিছু বলতে পারছে না।।”
-” বাবা তুই কোন হসপিটালে? আমি কি আসবো বাবা?”
-” -” আব্বা আমি আর পারছিনা। আমার কারনে মেয়েটা…..”
-” ওর কিচ্ছু হবেনা। আল্লাহকে ডাক। আমি আসছি তোর কাছে। একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here