দহন পর্ব ৩

#দহন
#পর্ব_৩
#লেখা_মিম

অনিম কয়েকবার সোফা ছেড়ে উঠেছে শিমুলের কাছে যাবে বলে। প্রতিবারই আবার যেয়ে বসে পড়ে। এভাবে ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে। না অনিম শিমুলের কাছে যাচ্ছে না শিমুলের অনিমের কাছে যাচ্ছে। কলিংবেলের আওয়াজ শোনা গেলো। অনিম উঠে যেয়ে গেইটটা খুলে দেখলো শিমুলের বোন, দুলাভাই আর দুই ভাবী এসেছে। তাদের গলার আওয়াজ পেয়ে শিমুল বেরিয়ে এলো। আফসানা বললো,
-” শুধু নদী আপা আর দুলাভাইয়ের আসার কথা ছিলো। তুই চলে আসছিস কথাটা মনে হতেই খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই আমরা দুজনও আপা দুলাভাইয়ের সাথে চলে আসছি তোকে দেখতে। তোদের সাথে রাতে একসাথে খাবো। এরপর যাবো।”
-” খুব ভালো করেছো।”
-” এই শিমুল, ভেতরে চল তোর সাথে ইম্পর্টেন্ট কথা আছে আমাদের।”
বৃষ্টি শিমুলের হাত ধরে টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে এলো। ওদের পেছন পেছন নদী আর আফসানাও এলো।
-” কি হয়েছে ভাবী?”
-” ঘরে ঢুকে যা বুঝলাম অনিম টিভি দেখছিলো। তোকে দেখলাম তুই বেডরুম থেকে বের হয়েছিস। তারমানে তোরা দুজন আলাদা ছিলি।”
-” হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমিও লক্ষ্য করেছি। কাহিনী কি রে? তোরা আলাদা বসে ছিলি কেন?” (নদী)
-” কাহিনী তেমন কিছুই না। আমি আমার কাপড় গোছাচ্ছিলাম আর অনিম বসে টিভি দেখছিলো। তাই আমি বেডরুমে ছিলাম আর ও ড্রইংরুমে।”
-” কাপড় গোছাচ্ছিলি মানে? কিসের কাপড় গোছাচ্ছিলি তুই? তোর সব কাপড় তো আমি সুন্দর করে ভাঁজ করে লাগেজে ভরেই দিয়েছি। এখানে আবার গোছানোর কি হলো?” (আফসানা)
-” কি রে তুই এমন কাঁচুমাচু খাচ্ছিস কেন? আমরা কি জিজ্ঞেস করছি উত্তর দে?”(নদী)
-” সত্যি কথা বলবো?”
-” তো কি মিথ্যা কথা শোনার জন্য বসে আছি নাকি?”
-” আপা আমার না খুব লজ্জা লাগছিলো। তাই সেখান থেকে উঠে রুমে এসে বসে আছি।”
-” ইশশশ…. ঢঙ…… লজ্জা লাগছিলো…..। এত লজ্জা পাস কোথায় তুই?”(নদী)
-” এই মেয়ে এগুলা কি বলিস তুই? অনিম তোর বিয়ে করা হাজবেন্ড। ওর কাছে তোর কিসের লজ্জা?”(আফসানা)
-” আর অনিম টাও কি? শিমুল নাহয় লজ্জা পাচ্ছিলো বুঝলাম। অনিমও কি লজ্জা পাচ্ছিলো? ও শিমুলের কাছে আসলেই তো হতো।”(বৃষ্টি)
-” শোন বৃষ্টি, অনিম হচ্ছে আমার হাজবেন্ডের মতো গাধা। তুই জানিস তোদের দুলাভাই বিয়ের একসপ্তাহ পর আমার হাত নিজে থেকে ধরেছিলো।”(নদী)
-” বলো কি আপা? দুলাভাই যদি এক সপ্তাহ পর তোমার হাত ধরে তাহলে বাকি কাজ করেছে কবে?”(আফসানা)
-” আর বলিস না….. লোকটা পুরো একমাস সময় লাগিয়েছিলো। এর মাঝে আমি তার কাছে যাওয়ার ট্রাই করেছি কয়েকবার। কিন্তু তাকে দেখতাম সে লজ্জায় শেষ হয়ে যেতো। অনিমটা বোধহয় আমার হাজবেন্ডের মতই নিরামিষ।”
-” না আপা অনিম বোধহয় ততটাও নিরামিষ না। ও আমাকে সন্ধ্যার পর শাড়ি আর বেলী ফুলের মালা হাতে দিয়ে বললো রাতে এগুলো পরতে।”
-” রাতের কথা বাদ দে। এতক্ষন তোরা কেনো আলাদা বসেছিলি? নতুন বিয়ে হয়ছে তোদের। এখন তো সারাদিন একজন আরেকজনের সাথে আঠার মতো আটকে থাকবি। তা না করে দুজন দুই রুমে বসে আছিস। এতবড় হয়েছিস এখনও কি আমদের সব কথা তোকে ভেঙেচুরে বুঝাতে হবে নাকি?”(নদী)
-” আমরা এখানে আসার আগে রাস্তায় কত শত গবেষনা করলাম তোদের দুজনকে নিয়ে। ভেবেছিলাম অনিমের গালে লিপস্টিকের দাগ দেখতে পাবো, রুমের ফ্লোরে তোর হাতের চুড়িগুলো এলোমেলো হয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখবো, আরও কত কি!!! অথচ এসে দেখলাম কিছুই না। শিমুল শোন, বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলে কিন্তু সারাদিনে একবারও জড়িয়ে ধরার সুযোগটাও পাবি না। অতএব যা রোমান্স টোমান্স করার করে নে।”(আফসানা)
-” আচ্ছা, তোমরা শোনো রাত নয়টা বেজে যাচ্ছে। জলদি খাওয়া শেষ করে আমরা কেটে পড়ি। এমনিতেই পুরো সন্ধ্যা ওরা নষ্ট করেছে। আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। (বৃষ্টি)
ওরা সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে খাচ্ছে। বৃষ্টি বারবার সবাইকে বলছে,
-” জলদি খাওয়া শেষ করো।”
ওকে বারবার এই কথা বলতে শুনে অনিম জিজ্ঞেস করলো,
-” এত তাড়াহুড়া করছেন কেনো ভাবী? সবে তো নয়টা বাজে। আস্তেধীরে খাওয়া-দাওয়া করেন। ঘন্টা দেড়-দুয়েক পর নাহয় যাবেন।”
-” তাড়াহুড়ো কেনো করছি সেটা কি সত্যিই বুঝতে পারছো না নাকি বুঝেও না বুঝার ভান ধরছো?”
-” না ভাবী আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না।”
-” তুমি আস্ত একটা গাধা তাই তুমি বুঝতে পারছো না।”
খাওয়া শেষে সবাই চলে গেছে। খাওয়ার পর পাঁচ মিনিটও বসেনি। চলে আসার সময় শিমুলের বড় ভাবী তাকে বলে এসেছে আগামী এক সপ্তাহ রান্না বান্নার দরকার নেই। রান্না করে আফসানা শিমুলের বাসায় পাঠিয়ে দিবে। শিমুল রান্নাঘরে প্লেট ধোয়ার জন্য যাচ্ছিলো। সে সময় অনিম শিমুলের হাত ধরে বললো,
-” রান্নাঘরের কাজ করতে হবে না। কাল সকালে বুয়া এসে এগুলো করবে। তুমি যাও শাড়ি পরো। শাড়িটা খুব শখ করে কিনেছি তোমার জন্য।”
শিমুল কিছু না বলে রুমে চলে এলো রেডি হতে। আজ সে অনিমের জন্য সাজবে। অনিমের পছন্দ অনুযায়ী সাজবে। এর আগেও সে অনিমের জন্য সেজেছে। তবে আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। আজ ওদের বাসর রাত। শিমুলের শাড়ি পরা শেষ। খুব বেশি সাজে নি। চোখে খানিকটা মোটা করেকাজল লাগিয়েছে। জাম রঙা জামদানী শাড়ি দিয়েছে অনিম তাকে। সেটার সাথে মিলিয়ে কানে ছোট একজোড়া ঝুমকা পরেছে সে। । চুলের খোপায় বেলি ফুলের মালাটা আটকানোর সময় সে ভাবছে অনিমের কথা। অনিম যখন তাকে দেখবে তখন অনিমের প্রতিক্রিয়া কেন হবে। অনিম আজ তাকে কাছে টেনে নিবে। অনেক বেশি কাছে। কেমন হবে তখনকার অনুভুতি গুলো? এসব কথা ভাবতেই শিমুলের ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠছে। অনিমের জন্য তৈরী হওয়া শেষ। নিজের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো শিমুল। সে রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে ড্রইং রুমের লাইট অফ। বাহিরের সাদা সোডিয়াম লাইটের আলোতে ঘরটাতে আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে। অনিম জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে শিমুল তাকে ডাকলো,
-” অনিম….”
-” হুম….”
পিছন ফিরে তাকালো অনিম। সে শিমুলের দিকে এগিয়ে এসে শিমুলকে কোলে তুলে নিলো।

অনিম শিমুলকে বারান্দায় এনে বসালো। শিমুলের মুখোমুখি চেয়ার টেনে এনে অনিম বসলো। তার একহাত শিমুলের হাতে আর অন্য হাতটা শিমুলের গালে রেখে বললো,
-” শাড়িটা কেনার সময় যেমন ভেবেছিলাম তারচেয়ে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে।”
-” ঘরের লাইট তো নিভিয়ে রেখেছো তারউপর বারান্দায়ও কোনো লাইট নেই। আমাকে তো ঠিক করে দেখাই যাচ্ছে না। না দেখে বলে ফেললে আমাকে তোমার কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে?”
-” কে বলেছে আমি তোমাকে দেখিনি। তোমাকে তো আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। এই যে আমার শিমুল আমার সামনে বসে আছে। আমার মনমতো সে আজ সেজেছে। শোনো শিমুল, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেটা আবছা আলোতেই ভালোভাবে ফুটে উঠে । আবছা আলোয় ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে অদ্ভুদ রকমের মায়া কাজ করে। আবছা আলোয় তোমাকে কতটা মায়াবী দেখাচ্ছে তুমি জানো? তোমার মায়াবী মুখটা মনের ভেতরটাতে গভীর আঁচড় কেটে যাচ্ছে।”
শিমুল চুপচাপ অনিমের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে। অনিমের কথার মাঝে সে আজ যাদু খুঁজে পাচ্ছে। অনিমের চোখে, কথা বলার ভঙ্গির মাঝে একটা অন্যরকম আকর্ষন, কামনা খুঁজে পাচ্ছে। এমন আকর্ষন তো কখনো শিমুল অনিমের চোখে দেখতে পায়নি। তবে আজ হঠাৎ কেন? আজ ওদের বাসর রাত তাই? হতে পারে বিয়ের রাতে স্বামীদের চোখের ভাষা এমনই হয়।
অনিম শিমুলের হাতটা টেনে এনে তার বুকের বাম পাশটাতে রাখলো।
-” হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারছো শিমুল?”
-হুম।”
-” এতদিন হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক ছিলো। কিছুক্ষন আগে থেকে হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। কেন জানো?”
-” কেন?”
-” তোমার মায়াভরা মুখটা দেখে।”
-” আমার মুখটা কি আজ প্রথম মায়াবী দেখাচ্ছে?”
-” নাহ্। তুমি সবসময়ই মায়াবতী ছিলে। তবে আজ একটু বেশীই দেখাচ্ছে ।”
-“…………………”
-” শিমুল……”
-” হুমম..”
-” আমার কাছে আসবে? আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার খোপার বেলী ফুলের ঘ্রান নিতে চাই।”
শিমুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অনিম তাকে কাছে টেনে পায়ের উপর বসালো। শিমুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাতাল হয়ে তার খোপার বেলী ফুলের ঘ্রান নিচ্ছে। নিজেকে এই মুহূর্তে অনিমের নেশাগ্রস্থ মনে হচ্ছে। অনিম শিমুলের ঘাড়ে চুমু খেতেই শিমুল কেঁপে উঠে অনিমের দুহাত চেপে ধরলো। ঘাড়ের উপর অনিমের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছে সে। চোখ দুটো খুব শক্ত করে বুঁজে রেখেছে শিমুল। তার অনুভুতি ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। অনিম শিমুলের কানের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে বললো,
-” আজ আমি তোমাকে পুরোপুরিভাবে আমার করে পেতে চাই। সে অধিকারটা কি আজ তুমি আমাকে দিবে?”
শিমুল কোনো কথা বলছে না। তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না। তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনিমের চেয়ে আরও অনেক বেশি।
-” শিমুল, তুমি কথার উত্তর টা দিচ্ছো না যে? আমি কি অন্যায় আবদার ধরেছি তোমার কাছে?”
-” ……………..”
-“তুমি না চাইলে আমি আর এগোবো না। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিচ্ছু হবে না। খুব সম্ভবত আবদারটা বেশিই করে ফেলেছি। স্যরি শিমুল।”
শিমুল ঘাড় ঘুরিয়ে অনিমের দিকে তাকালো। শিমুল বুঝতে পারছেনা সব কথা কি অনিমকে তার ভেঙেচুরে বুঝাতে হবে? শিমুল তো অনিমকে একবার না করেনি। তাহলে কেনো অনিম উল্টা টা বুঝছে? অবশেষে শিমুল মুখ খুলে কিছু একটা বলতে যাবে অনিম ওকে থামিয়ে ফের বলতে লাগলো,
-” শিমুল আমি বুঝতে পারছি তোমার ব্যাপারটা। হুট করেই এতটা গভীরে যাওয়াটা তোমাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে। আমি তো কখনো তোমাকে এতটা কাছে টানিনি। অতএব, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। গভীরে যাওয়ার সময় অনেক পড়ে আছে। এত তাড়াহুড়োর কিচ্ছু নেই। চলো ভেতরে যাই। বিছানায় বসে সারারাত গল্প করবো আর তোমাকে দেখবো। শিমুলের মোটামোটি মেজাজ খারাপ হলো অনিমের উপর। এত বেশি বুঝে কেন সে? অনিম শিমুলের হাত ধরে বেডরুমের দিকে এগোতেই শিমুল অনিমকে হেঁচকা টানে ওর কাছে নিয়ে এলো। অনিমের ঘাড়ে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটজোড়া দিয়ে অনিমের ঠোঁট দুটো স্পর্শ করলো। অনিম শিমুলের কোমড়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। কিছুক্ষন পর অনিম মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-” তাহলে কি তুমি রাজি?”
-” তুমি সত্যিই একটা গাধা। নিজে থেকে কিছুই বুঝো না। সব কথা তোমাকে মুখে বলে দিতে হয়।”

সকালে মোবাইলের ভাইব্রেশনের কাঁপাকাপিতে শিমুলের ঘুম ভেঙে গেলো। নিজেকে সে আবিষ্কার করলো অনিমের বুকে। অনিম তাকে দুহাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। শিমুলের চুলগেলো অনিমের মুখ গলায় ছড়িয়ে আছে। পুরো বিছানায় শিমুলের খোপার বেলিফুলগুলোর পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চুলের ক্লিপ, শাড়ি সব এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, ফ্লোরে। গতরাতের কথা মনে পড়তেই শিমুলের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here