দীপ্ত গোধূলি পর্ব -৩৭+৩৮

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৩৯

তুলি ডায়েরি দেখবে বলে গোধূলির সাথেই ওদের বাসায় চলে এসেছে।গোধূলিদের বাসায় তুলির সেই ছোট্টবেলা থেকেই যাতায়াত।সবাই ওকে গোধূলির মতোই আদর করে।গোধূলি আর তুলি বাসায় এসে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নেয়।তারপর সবার সাথেই লাঞ্চটা করে নেয়।লাঞ্চ শেষ করে তুলি সবার আগে চলে আসে।খাটের ঠিক মাঝখানটায় বসে ছটফট করছে আর উঁকিঝুঁকি মারছে।কারণ গোধূলি এখনো আসে নি।গোধূলি আসতে দেরি হচ্ছে বলে ডাক দিতে যাবে ঠিক তখনই দেখতে পেলো গোধূলি বেখেয়ালি মনে হেঁটে হেঁটে আসছে।তুলি চোখ রাঙিয়ে বলে,

– নিচ থেকে আসতে এত সময় লাগে?

…….

– নে এবার ডায়েরিটা বের কর!

……..

গোধূলি নিজের মতো করে এসে তুলির পাশে বসেছে ঠিকই কিন্তু কিছু ভাবছে।তুলি যে ওকে কিছু বলছে সেটা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না।তুলি গোধূলিকে হাত ধরে একটু ঝাকি দিয়ে বলে,

– আরে এই গোধূলি!কোথায় হারিয়ে গেলি।

– হুম!

– হুম কি?

– কি?

– তোকে যে বললাম ডায়েরিটা বের করতে তুই শুনিস নি?

তুলির কথায় গোধূলি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,

– কখন বললি?

– লে!এ আমি কাকে কি বলছি।এ তো দেখছি বরের শোকে পুরাই দেবদাসীনী হয়ে গেছে!

– তুলি!

– আচ্ছা এখন তো শুনলি!যা এবার গিয়ে নিয়ে আয়।

যাচ্ছি! বলে গোধূলি তখনও বসেই রয়েছে।কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।তার সেটা তুলি দেখে খুব রেগে যায়।তাই একটু উচ্চস্বরেই বলল,

– ওমা গোধূলি,এখনো বসে রইলি যে!

– আসলে আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না।

– কি?

– সকালে যখন আমি ভার্সিটিতে গেলাম তখন আমার সাথে কারোর দেখা হয় নি।শুধু আম্মু আর ছোটদাভাই ছাড়া।

– তো?

– এখন তো সবার সাথেই আমার দেখা হলো।কেউ তো কিছু বলে নি।মানে বকা তো দেয়ই নি বরং তাঁদের ব্যবহার দেখে মনে হলো কাল কিছু হয়ই নি!

– তা ভালোই তো হয়েছে।বেঁচে গেলি তুই!তা না হলে কাল যা করেছিস তুই বাবা!আমার পাপা হলে আমাকে বাসাতেই ঢুকতে দিতো না।যাকগে যা হয়েছে ভালো হয়েছে।এখন যা মেরি দোস্ত ডায়েরিটা বের করে আন।

– এই নে।

– ওয়াও!খুব সুন্দর তো ডায়েরিটা!

তুলি ডায়েরিটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল।হঠাৎ করেই ডায়েরির ভেতর দেখে কাগজের মতো কিছু একটা নিচে পড়লো।গোধূলি নিচ থেকে ওটা তুলে মুখের সামনে ধরতেই ওর চোখ ছানাবড়া!গোধূলিকে হা করে থাকতে দেখে তুলি গোধূলির হাত থেকে নিয়ে দেখে ওটা একটা ছবি!কোনো এক পড়ন্ত বিকেল গড়িয়ে গোধূলি লগ্নে তোলা।খোলা চুলে কোনো কিশোরী ছাদের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।ছবিটা পিছন থেকে তোলা।তুলি চিনতে না পেরে গোধূলি জিজ্ঞাস করে,

– এটা কার ছবি রে গোধূলি?

– আমার!

– হোয়াইট?তোর ছবি?এটা দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক আগের ছবি।বয়স আর কত হবে মেবি এগারো-বারো !

– হুম।

– তাহলে তোর ছবি এই ডায়েরিতে এলো কি করে?

– আমিও তো সেটাই ভাবছি।

তুলি গোধূলির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,

– গোধূলি কি ব্যাপার হুম?তলে তলে কি চলছে?

তুলির কথায় গোধূলি কপালে কুঁচকে বলে,

– মানে?

তুলি ভ্রু নাচিয়ে বলে,

– লাভ কেইস মনে হচ্ছে!

গোধূলি একটু রাগান্বিত স্বরে বলল,

– হোয়াইট!কি যা-তা বলছিস।

– ওকে রিল্যাক্স!এত হাইপার হোস না!আমি তোর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি তাতে বুঝলাম তোর এনগেজমেন্টটা পারিবারিক ভাবে হয়েছে।কিন্তু তুই জানতি না যে তোর এনগেজমেন্ট হবে ইনফ্যাক্ট তুই এটাও জানতি না তোর বর কে!

– হ্যাঁ তো?

– তো তুই যদি এই ছবিটা না দিয়ে থাকিস তাহলে তোর ছবি এই ডায়েরিতে এলো কি করে?

– সিরিয়াসলি তুলি!তোর মনে হয় এই ছবিটা আমি উনাকে দিয়েছি!আমি কেন কাউকে আমার ছবি দিতে যাবে।আমি এইভাবে ছবি তুলিই নি কখনো।ইনফ্যাক্ট আমি এটাও জানি না কে এই ছবিটা তুলেছে।আর এটা উনার কাছে কি করেই বা গেল।

– সেটা তো ডায়েরিটা খুললেই বুঝতে পারবো।

– তো খোল!

– দোস্ত!

– কি?

– আমার না কেমন আনইজি লাগছে।এটা নিশ্চয় ভাইয়ার পার্সোনাল ডায়েরি!আমার খোলাটা কি ঠিক হবে?

– কারো পার্সোনাল ডায়েরি কেউ আমাকে দিতে যাবে কেন?তুই খোলে দেখ!

– আরে গবেট!কোনো বর কি তার উডবি ওয়াইফকে তার নার্সারির ডায়েরি দিবে!অবশ্যই এটাতে স্পেশাল কিছু আগে বলেই তোকে দিয়েছে।নাহ দোস্ত তুইয়েই খোল!

– আরে আমি বলছি তো তোকে!তুই খোল।

– না ডায়েরিটা বরং তুইয়েই পড়িস!আমার যতোটুকু মনে হচ্ছে এর ভেতর থেকে যেহেতু তোর ছবি পাওয়া গেছে সো ডেফিনেটলি তোকে নিয়েই কিছু লেখা থাকব!

– এত জোর গলায় বলছিস!তুই যেমনটা ভাবছিস সেটা তো নাও হতে পারে।

– দেখিস তুই।

– দেখছি হু!

গোধূলি মুখ ভেংচি কাটে।

– মিলিয়ে নে আমার কথাটা।পরে যদি আমার কথাই সত্যি হয় নাহ তখন দেখবি আমি কি করি হুম!আরে দোস্ত এটা কি?

তুলি ডায়েরিটার কভারের উপর দেখে গোল্ডেন কালার দিয়ে খুবই নিখুঁত ভাবে কিছু একটা লেখা।তুলি এক্সাইটমেন্টে একদম খেয়ালই করে নি যে ডায়েরির কভারে কিছু লেখা রয়েছে।তুলি প্রথমে ভেবেছিল ওটা হয়তো কোনো কারুকাজ হবে।কিন্তু খেয়াল করে দেখার পর বুঝতে পারছে ওটা কোনো কারুকাজ নয়!তুলি লেখাটা বুঝতে না পেরে গোধূলিকে দেখিয়ে বলে,

– গোধূলি দেখ তো এখানে কি লেখা।

– তুই আবার এর লেখা নিয়ে পড়লি কেন?

– আহা!তুই দেখ না কি লেখা আছে।আমি ঠিক ধরতে পারছি না।

গোধূলি ডায়েরিটা হাতে নিয়ে একটু দেখে তারপর বলে,

– চড়াই…..

গোধূলি ওর পুরো কথা শেষ করতে পারলো না।তুলির ফোনে কল আসায় গোধূলি থেমে যায়।তুলি কলটা রিসিভ করে কথা শেষ করে বলে,

– গোধূলি!

– হুম।

– আম্মু কল দিয়েছিল।

– তো?

– বলল আমাকে এক্ষুনি বাসায় যেতে হবে।

– আর্জেন্ট?

– হুম।

– সরি ইয়ার!

– তো এতে সরি বলার কি আছে।

– তোকে সময় দিতে পারলাম না বলে!আজ যাই অন্যদিন এসে তোকে সময় দেবো কেমন।

– আচ্ছা,সাবধানে যাস!

– ওকে,বাই।

তুলি তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে যায়।তুলির আর ডায়েরি পড়া হলো না!গোধূলির খুব নার্ভাসনেস কাজ করছে।ও ঠিক বুঝতে পারছে না কি করবে।ডায়েরিতে ওর কোন প্রশ্নের কোন উত্তরের সম্মুখীন হবে।ডায়েরির কভারে চড়াইপাখি নামটা পড়ে বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে।যদিও নামটার সাথে ও পরিচিত না।তবুও ওর কেমন যেন ফিল হচ্ছে।অবশেষে নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলো যে,হয়তো ডায়েরির কভারে এমনিতেই এইরকম একটা নাম দেওয়া হয়েছে।
সাত পাঁচ না ভেবে ডায়েরির প্রথম পেইজ খুলতেই থমকে যায় গোধূলি।কারণ প্রথম পেইজটাতে স্কেচ করা একটা মেয়ের ছবি!ছবিটার নিচে ঠিক ডানপাশে ছোট্ট করে লেখা চড়াইপাখি!তবে গোধূলির ছবি বা নাম নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।সমস্যা হলো তো স্কেচ করা ছবির মেয়েটাকে নিয়ে!কারণ স্কেচ করা ছবিটা আর কারো না স্বয়ং গোধূলির।যেটা গোধূলিকে বেশ অবাক করে।গোধূলি এখন ঠিক বুঝতে পারছে এটা স্টল থেকে কিনে আনা সাধারণ কোনো ডায়েরি নয়!আর ডায়েরির কভারে চড়াইপাখি নামটাও এমনি এমনি নয়!এই ডায়েরিটা স্পেশাল ভাবেই তৈরি করা হয়েছে।গোধূলি আর কিছু না ভেবে ডায়েরিটা পড়া শুরু করে।

– জানিস চড়াইপাখি,সেদিন রাস্তায় প্রথম তোর হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম সেদিন কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিল।নেশালো সেই হাসি বার বার আমার কানে বাজছিলো।চোখ বন্ধ করলেই সেই হাসির ঝংকার তীরের মতো এসে আমার বুকে ঠেকত!যত বারই সেই হাসির আওয়াজ অনুভব করতাম ততবারই নিজেকে উন্মাদ বলে মনে হতো।আমার অদেখা সেই চড়াইপাখিকে না দেখেই তার নাম দিয়েছিলাম চড়াইপাখি!কি করতাম বল?দিবা নিশী সে যে আমার মাথায় চড়াও হয়ে বসে থাকতো!তার সাথে নামটা বেশ মানিয়েছে তাই না রে?সারাক্ষণ মাথায় চড়ে থাকতো অথচ কোথায় যে উড়াল দিলো খুঁজেই পাচ্ছিলাম না।তাই তো এই নামটা দিয়েছি!আচ্ছা চড়াইপাখি নামটা কি তোর পছন্দ হিয়েছে?নামটা শুনে কি তোর রাগ হচ্ছে?হলে হোক!তাতে আমার কিছু আসে যায় না!

ডায়েরির প্রথম পাতার এই কয়েকটি লাইন পড়েই গোধূলির গলা শুকিয়ে আসছে।আশ্চর্য হয়ে ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে আছে।বুকের ভেতর ধুকপুকানিটা রীতিমতো বেড়েই চলেছে।আবার রাগ যে হচ্ছে না সেটাও নয়।গোধূলি রাগে গজগজ করতে করতে বিড়বিড় করে বলছে,

– উনার চড়াইপাখির গল্প পড়তে কি এই ডায়েরি উনি আমাকে দিয়ে গেছেন?তাই যদি হবে ডায়েরিতে আমার ছবি কত্তথেকে এলো?আর আমার স্কেচই বা কেন আঁকা?এই চড়াই পাখিটাই বা কে?কে সে যাকে উনি আবার তুই বলে সম্মোধন করছেন!

গোধূলির মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি বাইতে শুরু করে দিয়েছে।কিছুই ওর বোধগম্য হলো না।গোধূলির মনের ভেতর তপ্ত হাওয়া বইছে!অশান্ত মনকে শান্ত করতে গোধূলি আবার পড়ায় মন দেয়।

– হা হা হা….! অবাক হচ্ছিস?হ্যাঁ অবাক তো হওয়াই কথা!ওকে রিল্যাক্স,শান্ত হো।আমি সবটা এক্সপ্লেইন করছি।

– লন্ডন থেকে ফিরে আমরা তোদের বাসার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম তখনই ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে যাই।জ্যাম ছাড়ছে না বলে আমি গাড়ির জানালা খুলে বাহিরটা দেখে আবার যখন ভেতরে বসতে যাবো ঠিক তখনই কারো খিলখিল করে হাসার শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম।তবে পরে যখন আবার জানালা খুললাম তাকে দেখবো বলে ততক্ষণে ট্রাফিক জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে।খুব মন খারাপ হয়েছিল তখন। কিন্তু আম্মু বলল,আমরা যদি মন থেকে কিছু চাই তাহলে সৃষ্টিকর্তা সেটা আমাদের দেন।তো আমিও হয়তো আমার চড়াইপাখিকে মন থেকে চেয়েছিলাম বলেই হয়তো তাকে খুঁজে পেয়েছিলাম!

“আমার ডায়েরির পাতায় আর জীবনের অপূর্ণতার খাতায় প্রাপ্তির নাম তুই!আমার চড়াইপাখি”

চলবে…..#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৪০

আজকের জন্য এতটুকুই থাক!যতটুকু পড়েছে তাতেই ওর মাথা বিগড়ে যাচ্ছে।কিছুই মাথায় ঢুকছে না।গোধূলি ডায়েরিটা রেখে দেয়।

– গোধূলি!

গোধূলি ডায়েরিটা রেখে আলমারির দরজাটা বন্ধ করে পেছন ফিরে বললো,

– কখন এলে লাজুবু?

– মাত্রই আসলাম।সকালে বাসায় চলে গিয়েছিলাম।রাতে নানু একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।অনেকটা সময় চলে গেছে তোর সাথে দেখা করা নি।তাই নানুকে দেখে সোজা তোর কাছে চলে এসেছি।

– ওহ!নানু এখন কেমন আছেন?

– ভালো!

– তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?আসো ওইদিকে গিয়ে বসি।

গোধূলি এগিয়ে গিয়ে লাজুকের হাত ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে গেলো।লাজুককে দোলনাটায় বসিয়ে দিয়ে ও ব্যালকনির রেলিংটায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়ালো।দুজনের মধ্যকার নিরবতা ভেঙে লাজুক বললো,

– শুনলাম আজ ভার্সিটিতে গিয়েছিলি?

গোধূলি একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে বললো,

– হ্যাঁ।

– গোধূলি!

– হুম!

– দীপ্ত তো চলে গেছে!

– তো?

– তোর কষ্ট হচ্ছে না!

– মানে?

লাজুক বুঝতে পারছে কালকের ঘটনা নিয়ে গোধূলি কোনো কিছু বলতে চায় না।তাই লাজুক বললো,

– না কিছু না!

…….

– এয়ারপোর্টে চলে যাওয়ার আগে দীপ্ত রির্সোটেও গিয়েছিল।বলে গেছে কবে ফিরবে সঠিক সময়টা ওউ জানে না!

……..

– তোকে কিছু বলে গেছে? মানে কবে ফিরবে টিরবে!

গোধূলিকে নীরব থাকতে দেখে লাজুক আড়চোখে গোধূলির দিক তাকিয়ে বললো,

– তবে অবশ্য আমাদের এটা বলে গেছে যে,পাঁচ দিনেও কাজ শেষ হতে পারে আবার পাঁচ বছরো লাগতে পারে!

– আমাকে কেন কারো জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে?আর আমি অপেক্ষা করবোই বা কেন?কিসের টানে আমাকে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে?শুধু ওই একটা আংটি বদল করেছি বলে?কিন্তু সেটাও তো আমি নিজের ইচ্ছেয় করি নি!আচ্ছা আমার নিজের ইচ্ছেটাকেই কি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ?নাকি এই অনুচিত কাজটা আমার করা উচিত হবে না।আরে আমি অনুচিত কেন বলছি!বরং জোর করাটা অনুচিত। কিন্তু আমাকে তো কেউ জোর করে নি।তাহলে?আমার কি মানিয়ে নেওয়া প্রয়োজন?তাহলে চড়াইপাখির কি হবে? উনার জীবনে যদি কারো অস্তিত্ব থেকেই থাকে তাহলে তার জীবনের সাথে আমাকে কেন জড়ালেন?

কথাগুলো মনে মনে আওড়ালো গোধূলি।কথা গুলো ভাবতেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও গোধূলির মনে অভিমানের পাহাড় জমে যাচ্ছে।ও নিজেও জানে না আদৌ ওর এই অভিমান করাটা উচিৎ কিনা!অভিমানের পাহাড় আরো ভারী হওয়ার আগেই গোধূলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– নিচে চলো লাজুবু!

লাজুক একটু আশ্চর্য হলো।ওর কথা শেষ হওয়ার পর গোধূলি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল।
“নিচে চলো লাজুবু” এই কথাটা বলতে এতটা সময় নিতে হলো?তবে গোধূলির চোখ মুখ দেখে লাজুক বুঝতে পেরেছে ও কিছু বলতে চায় না।তাই লাজুকও আর কথা না বাড়িয়ে গোধূলিকে নিয়ে নিচে চলে যায়।

______________

আদিবার বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে গেছে তাই বাড়িতে এখন অনেক কাজ।সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।গোধূলিও বোনের বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পাড় করছে।বিয়ের দিন যতো কাছে চলে আসছে বিয়ের কাজের মাত্রাও ততই বেড়ে চলেছে।বিয়ে উপলক্ষে এতো আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে দীপ্তকে সবাই খুব মিস করছে।বিয়েতে সবাই উপস্থিত থাকবে অথচ দীপ্ত থাকবে না!এটা ঠিক মেনে নিতে পারছেন না আহসান সাহেব।তাই আহসান সাহেব দীপ্তকে আসার জন্য বলেছিলেন!কিন্তু দীপ্ত বলে দিয়েছে ও এখন আসতে পারবে না!বাকি আছে আর দুইদিন।দুইদিন পরেই আদিবার বিয়ে।

– আজ মেহেন্দি কাল হলুদ আর পরশু বিয়ে!বুবু তোমার ফিলিংস কেমন গো?

আদিবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে গোধূলি।আদিবা গোধূলির মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলো।গোধূলির বাচ্চাসুলভ কথায় আঁতকে উঠে আদিবা!একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

– বাড়ির সবাইকে ছেড়ে অন্য একটা পরিবারে সারা জীবনের জন্য চলে যেতে হবে তার জন্য মনটা শক্তকে করছি!

– সাজি!

– হুম।

– আমি তো কখনো তোদেরকে ছাড়া থাকি নি।তাহলে
ওই বাড়িতে আমি তোদেরকে ছাড়া কিভাবে থাকবো?

কথাটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো আদিবা।।গোধূলি মাথা উপরে তুলে আদিবার দিকে তাঁকিয়ে দেখে আদিবার চোখে পানি টলমল করছে।যেকোনো সময় কেঁদে ফেলতে পারে।গোধূলি উঠে বসে আদিবাকে জড়িয়ে ধরে।আদিবাও গোধূলিকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদেই দেয়।বোনের কান্না দেখে গোধূলিও কাঁদছে।এইদিকে এই দুই বোনের কান্না দেখে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জাকিয়া বেগমও কাঁদছে।শিখা বেগম জাকিয়া বেগমকে ডাকতে এসে দেখেন উনি কাঁদছেন।পরে উনাকে আদিবা আর গোধূলি কাছে নিয়ে যান তখন আদিবা ওর মাকেও একহাতে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে।অনেকক্ষণ হলো বড় জা আর মেজো জা কে নিচে দেখতে না পেয়ে তাঁদের খুঁজে জ্যোতি বেগমও আদিবার ঘরে এসে উপস্থিত হন।আদিবা গোধূলির কান্না দেখে তিনিও সেই কান্নায় যোগ দেন।এখন এই পাঁচ জনের কান্নার আওয়াজ মোটামুটি সারা বাড়িতে ছড়িয়ে গেছে।বর্তমানে বাড়ির সবার অবস্থান এখন আদিবার রুমে!তাঁদের কান্নাকাটি দেখে কেউই আর শক্ত থাকতে পারলো না!অতএব একে একে সবাই যোগ দিলো!
রংবেরঙের আলোক সজ্জায় সাজানো হয়েছে পুরো বাড়িটা।আদিবার বিয়ের অনুষ্ঠান সহ যাবতীয় কাজ বাড়িতেই করা হবে।তাই বাড়ির এই রূপ দেওয়া হয়েছে।যথা সময়ে আদিবার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়।বিদায় বেলায় গোধূলি আদিবাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল।ওর কান্না দেখে উপস্থিত গেস্টরা অব্দি কান্না করতে বাধ্য হয়েছিল।

সময় বেঁয়ে চলেছে আপন মহিমায়।বনি,বহ্নি আদিবা আর রায়ানের বিয়ের পর দিনেই চলে গেছে।আদিবার বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেছে।দ্বিরাগমন করতে এসে তিন দিন থেকে আজই চলে গেছে।কাল থেকে গোধূলি প্রথম সেমিস্টার এক্সাম।রাত জেগে ওকে পড়তে হচ্ছে। ওর অসুস্থ হওয়া তারপর এনগেজমেন্ট আবার এনগেজমেন্টের পর বিয়ে!এইসবের চক্করে ও পড়াশোনায় একদম সময় দিয়ে পারে নি।এখন আবার আদিবা রায়ান দ্বিরাগমন করতে এসেছিল ওদেরকেও সময় দিতে হয়েছে।গোধূলি ওর বাকি পড়ারা শেষ করে শুয়ে পড়ে।ঘুম ভাঙে এলার্ম শুনে।তড়িঘড়ি করে উঠে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে।আহান ওকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়েই চলে যায়।

গোধূলির পরিক্ষা চলা কালীন রোজ আহান এসে ওকে দিয়ে গেছে আর ইহান এসে নিয়ে যেতো।কিন্তু আজকে গোধূলি একাই এসেছে।আজ ওদের এক্সাম শেষ হবে।তুলি আর গোধূলির সিট অনেক দূরে দূরে পড়েছে।প্রত্যেক দিন ওদের দেখা হয় নি।আজকে তুলির এক্সাম আগেই শেষ হয়ে গেছে আর যেহেতু আজকেই এক্সাম শেষ তাই ও বেড়িয়ে এসে গোধূলির জন্য অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষণ পরে গোধূলিও চলে আসে।তুলির কাছে এসে বললো,

– এক্সাম কেমন হয়েছে তোর?

– ভালোই।তোর?

– মোটামুটি!বেশি ভালো না।আমি তো পড়াশোনা করার তো সময়ই পাই নি।

– ব্যাপার না!সামনের সেমিস্টারে ভালো করবি তাহলেই হবে।

– রেজাল্ট খারাপ হলে ভালো লাগে বল?

– হুম তা তো ঠিকই।

দুজনেই হাটতে হাটতে কথা বলছে।

– গোধূলি ডায়েরিটা পরেছিলি?

দাঁড়িয়ে যায় গোধূলি।নানান ব্যস্ততায় ডায়েরির কথাটা ওর মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো।গত কয়দিনে একবারও ডায়েরিটার কথা মনেও পড়ে নি ওর।তুলি বলাতে ওর মনে পড়লো!

– কি হলো দাঁড়িয়ে গেলি কেন?

– দোস্ত তোর সাথে পড়ে কথা বলবো কেমন।

– এ……

তুলি কিছু বলতে চাইছিল।কিন্তু গোধূলি ওর কথাটা শেষ করেই ছুট লাগায়।তুলি বোকার মতো দাঁড়িয়ে গোধূলির যাওয়াটা দেখলো।তারপর তুলিও ওর বাসায় চলে যায়।

আর এইদিকে গোধূলি বাসায় এসে জামা কাপড় চেঞ্জ না করেই ডায়েরিটা নিয়ে সোজা ব্যালকনিতে গিয়ে বসে।ডায়েরির ভাজে রাখা ফিতেটা সড়িয়ে ওইদিনের সমাপ্ত করা জায়গা থেকে আবার পড়তে শুরু করে,

– চড়াইপাখি এইভাবে হাসিস না!তোর এই হাসির কারণে কেউ একজন যে বার বার ঘায়েল হয় সেই খবর কি তুই রাখিস?নিজেকে কন্ট্রোল করতে বড্ড কষ্ট হয় রে!বাড়ির সামনে থাকা কৃষ্ণচূড়া গুলো বোধহয় আজ তোকে হিংসেই করছিলো!কমলা রঙের চুড়িদারে আজ নিজেকে সাজিয়েছিলি না?তাঁদের কম কৃষ্ণচূড়া ফুল আজ তোকে মনে হচ্ছিলো!শহরের সবচেয়ে বড় কৃষ্ণচূড়াটা মনে হয় আজই ফুটেছিল!কানে গুজা ওই কৃষ্ণচূড়ার উপর আমার কিন্তু বড্ড রাগ হয়েছে বলে দিলাম!এর মাশুল কিন্তু চড়াইপাখিকে দিতে হবে।তা এত হাসির কারণ কি ছিলো শুনি?

গোধূলি শক্ত হয়ে বসে আছে।ডায়েরির পাতায় তারিখটা উল্লেখ করাই আছে।তারিখ দেখে গোধূলির চোখের সামনে সবটা যেন ভাসছিল।ডায়েরির পাতায় কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে আবার পড়া শুরু করে,

– চড়াইপাখি,আজ আমার বার্থ ডে।তোর থেকে উপহার স্বরূপ আমি তোর ওই উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া পেয়ে চাই! চড়াইপাখি আর ইউ রেড়ি ফর ডু ইট?আসছি আমি!

গোধূলি গলা শুকিয়ে আসছে।এখানে তারিখ উল্লেখ তবে এই তারিখের কোনো ঘটনা ওর মনে পড়ছে না।

– এই চড়াইপাখি কি অন্যকেউ?

কথাটা বিড়বিড় করে বলে গোধূলি।বুকের ভেতরটা ধুকধুক করছে।কাঁপা কাঁপা হাতে পরের পৃষ্ঠাটা উল্টে পড়তে শুরু করে,

– কোনো এক বর্ষার দিনে একগুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোর সাথে!একটা বার ভাব তো কি রোমান্টিক একটা সিন হবে তখন।ইশশ!আমার তো ভাবতেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।তবেও আজকেও কিন্তু গিয়েছিলাম!কিন্তু নানা শ্বশুরের দৌড়ানি খেয়ে কোনো রকমে প্রান নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।বুইড়া এতো কদম দিয়ে কি করবে রে?বউকে কি কদম ফুল দিয়ে কদমরানী বানিয়ে কদম গাছে বসিয়ে রাখবে!

ফিক করে হেসে দেয় গোধূলি।তখন দীপ্তের অবস্থা কি হয়েছিল ভেবেই খুব হাসি পাচ্ছে ওর।হাসি সংবরণ করে আবার পড়ায় মন দেয় গোধূলি।

– নানু বাড়ি এত দিন থাকতে হয়?এতটা রাস্তা যেতে আমার কি কষ্ট হয় না!যদিও চড়াইপাখির জন্য আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতেও প্রস্তুত!কালকে চুপচাপ লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে বাড়ি চলে আসবি ঠিক আছে!

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে গোধূলি।মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,

– নানু বাড়িতে যে কত ভালো লাগে সেটা আপনার মতো এলিয়েন কোনোদিন বুঝবে না হু!

গোধূলি আরো এক মুখ ভেংচি দিয়ে পড়া শুরু করে,

– গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছিস বলে কি মাথা কিনে নিয়েছিস হুম!তাও ছেলেদের থেকে একশো হাত দূরে থাকবি!আর ওই মিহির দানাকে বলিস ওর ওই যে ফ্রেন্ড কি যেন নাম!ও হ্যাঁ মনে পড়েছে নীল।ওই নীল যেন চড়াইপাখির আশেপাশে ঘুরঘুর না করে।আমি যদি আরেকদিন দেখি তাহলে ওই নীল কিন্তু আর নীল থাকবে না!তখন নাম আর চেহারা দুটোই লাল হয়ে যাবে!

বিস্মিত হয়ে গিয়েছে গোধূলি!অস্ফুটস্বরে বললো,

– মিহির কি এই চড়াইপাখিকে চিনতো?নীলকে তো একদিন কেউ প্রচুর মেরেছিল ঠিকই।কিন্তু ওকে জিজ্ঞাস করার পর বলেছিল ও নাকি বাইকে এক্সিডেন্ট করেছে।আর ওই ঘটনার পর থেকে নিজের ইচ্ছায় নীল কোনো দিন আমার সামনে আসে নি।বরং আমি যদি ওকে ডাকতাম বা কথা বলতে চাইতাম তখন নীল এড়িয়ে চলে যেতো।

এখন গোধূলি খুব আশ্চর্য হয়ে ভাবছে, এটা কি সত্যিই কোনো কাকতালীয় ঘটনা নাকি দুটোর কোনো যোগসূত্র রয়েছে?

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here