দেশলাই – ৪র্থ পর্ব
সন্ধ্যায় রিকশা নিয়ে শাহী ঈদগাহ থেকে মেসে ফিরছিলাম।
তখনই মেসেঞ্জারে সুলতানার কল এলো। আমি ফোন রিসিভ করে বললাম।
– ‘কেমন আছো সুলতানা। তোমার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলে না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, সেখান থেকেই কথা বলছি। ও আমার পাশেই আছে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ তাই। কিন্তু আমার বেস্টু কখনও প্রেম করেনি। তাকে তোমার কথা সব বলেছি। তোমার ছবিও দেখেছে। বললো ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট দেবে। নাম ইন্তিশা আক্তার।’
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মানে এতো সহজে মেয়েটি রাজি হয়ে গেলে? নিজের উত্তেজনাকে প্রকাশ না করে বললাম, ‘আচ্ছা। থ্যাংক ইউ সুলতানা।’
একটু পরেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এলো। আমি একসেপ্ট করে নক দিলাম,
– ‘হাই।’
সে সালাম দিলো,
– ‘আসসালামু আলাইকুম।’
– ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
– ‘কেমন আছেন?’
– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?’
– ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ আপনার প্রফাইল ছবি দেখলাম। অনেক মিষ্টি আপনি। কিন্তু আমার থেকে অনেক বড় হবেন। তবুও বন্ধুত্ব করতে রাজি হলেন যে?’
সে জবাব দিলো৷ সেই জবাব থেকেই আমি সর্ববিষয়ে পুষ মেনে নিয়েছিলাম ওর কাছে। আমাদের সম্পর্ক পরিচালনার দায়িত্ব ওর ওপরেই চলে গিয়েছিল৷ আমাকে সে উল্টো প্রশ্ন করলো,
– ‘আমার বয়সে ছোট বলে কেন প্রত্যাখ্যান করবো? আপনি আমার বয়সে ছোট কিংবা আমি আপনার বয়সে বড় এখানে আমাদের দোষ কি? আমরা কি ইচ্ছা করে বড়-ছোট হয়ে দুনিয়ায় এসেছি?’
– ‘না, আমাদের কোনো দোষ নেই।’
– ‘আচ্ছা আপনার নাম্বার দেন। আমরা ফোনে কথা বলবো। আসলে কাল যখন সুলতানার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন ভয়েজ ভীষণ ভালো লেগেছিল।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে নাম্বার দিলাম। শরীর ঘেমে যাচ্ছিল। খানিক পরই ফোন বেজে উঠলো। আমি মেসের ছাদের চিলেকোঠায় গিয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে শান্ত, স্নিগ্ধ গলায় ইন্তিশা সালাম দিল।
আমি জবাব দিলাম, ‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন?’
– ‘নট আছেন। এখন থেকে আছো বলবে। ঠিকাছে?’
আমি ওর মিষ্টি ভয়েজে বিমোহিত হয়ে যাই৷ সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘হ্যাঁ তুমি কেমন আছো ইন্তিশা?’
– ‘ভালো, কারণ আমি অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়লেও এখনও মনের মতো কোনো ছেলে বন্ধু পাইনি। তোমাকে পেয়ে জানি না কেন অনেক ভালো লাগছে।’
বিশ্বাস কর ইলি। আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। ইন্তিশা আমাকে অল্প সময়ে এতো আপন করে নিয়েছে? আমি যেন তখনই ওর প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে শুরু করলাম৷
কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
-‘আমিও।’
সে ওপাশ থেকে ঝরনার কলকলে শব্দ তোলা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
-‘বিব্রতবোধ করছো কেন? আমরা না বন্ধু, আমাদের মধ্যখানে লজ্জা-শরম কিচ্ছু থাকবে না, ঠিকাছে?’
আমি মহানন্দে বললাম,
– ‘আচ্ছা।’
– ‘সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করবে তো, বলো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আচ্ছা এখনই সেল্ফি তুলে তোমার একটি ছবি পাঠাও। ফোন রাখছি।’
আমার কাছে সব স্বপ্ন লাগছিল। এতো দ্রুত সব হয়ে যাচ্ছে। চিলেকোঠা থেকে বের হয়ে নিজেকে সেল্ফি ক্যামেরায় দেখে চুল ঠিকঠাক করে ছবি তুলে পাঠালাম।
সে অনেকগুলো লাভ স্টিকার দিল। আমি মেসেজে বললাম, ‘তোমার ছবি দাও।’
ইন্তিশা ছবি পাঠালো। আমি দেখে পাগল হয়ে গেছি। এতো মায়াবী একটা মেয়ে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। ঘন কালো ভ্রু। চুল একপাশ দিয়ে রাখায় এক গাল প্রায় ঢেকে থাকে। তুলতুলে মুখ। দেখলেই আদর করার মতো ইচ্ছে জাগানো ঠোঁট।
এভাবে দ্রুত আমাদের সম্পর্ক এগোচ্ছিল। মাস দুয়েকের ভেতরে আমরা এতো বেশি আপন হয়ে গেছি যে এমন কোনো রসালাপ নেই যা আমাদের হয়নি। আমি প্রথমদিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ইন্তিশা অন্য মেয়েদের মতো রক্ষণশীল মনোভাবের না। অনেকটাই উদার। আমাদের ফোনে কথা বলতে বলতে প্রায় রাত দুই-তিনটা হয়ে যায়৷ সে কম্বলের নিচে ফোন নিয়ে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে কথা বলে। আমার কাছে মনে হয় পাশের বালিশে ইন্তিশা শুয়ে আছে। একদিন সে নিজ থেকেই বলল দেখা করতে। আমি বললাম তোমার ভার্সিটির সামনে আসি একদিন। সে দ্বিমত করে বলল, ‘না, এভাবে দেখা করা রিস্ক। তুমি সন্ধ্যায় আমাদের নীলগঞ্জ বাজারের রাস্তার পাশের শিমুল গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। কারণ আমি প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় টিউশনি করিয়ে এদিকে যাই। তারপর আছে আমাদের বাড়ির রাস্তা। দুইপাশে অনেক গাছগাছালি। সেদিকে কারও যাওয়া-আসা নেই। রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িও অনেক দূর।’
যেরকম বলেছিল আমি একদিন বিকেলে সিলেট থেকে বাসে উঠে চলে যাই। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে আমাদের দেখা হয়। ভয়ে বুক ধুকপুক করছিল। কিন্তু এদিকটা অনেক নির্জন। মেইন রোড থেকে তাদের বাড়ির রাস্তার দুইপাশে গাছগাছালি। বাড়ি থেকে কেউ এলেও বুঝা যাবে। ইন্তিশার ওড়না আলগা করে মাথায় দেয়া। গলা দেখা যাচ্ছে। মাথার বাম পাশের চুল খানিক কানে গুঁজে সেখান থেকে উল্টো করে সকল চুল গালের দিকে এনে বুকের ডানপাশে ফেলে রেখেছে। তুমুল আগ্রহী দু’টা চোখ। ঠোঁট নড়ছে ওর। আমরা ফোনেই একজন আরেকজনকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। ন্যাকামি চলবে না। যার যা ইচ্ছে তাই করবো। ইন্তিশা তাড়া দিয়ে বলল, ‘কেউ এসে যেতে পারে। আমি চলে যাবো।’
আমি চারদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তাহলে একটা চুমু খাই।’
সে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ঠোঁটে দীর্ঘ সময় নিয়ে চুমু খেতে লাগলো। আমার কাছে যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল সব। এই পৃথিবী যেন স্বর্গ হয়ে গেছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ওর নরম গরম শরীরে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সেও উম্মাদের মতো চুমু খাচ্ছে। তবুও সেদিন বিদায় নিয়ে আসতে হয়েছিল। কারণ রাস্তায় হঠাৎ কেউ দেখে ফেলতে পারে।
কিন্তু এই উষ্ণতা, ওম, সুখ আমরা ভুলতে পারছিলাম না৷ দু’জনই পাগল। রাতে ফোনালাপে আমরা সবই করতে লাগলাম।
সপ্তাহ দুয়েক পর সে বলল, ‘একদিন রাতে চলে আসো। সবাই যখন ঘুমোবে আমি তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে নেব। আবার ভোর হওয়ার আগে নীলগঞ্জ বাজারে চলে যাবে৷ কথাটি শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুরো একটা রাত ইন্তিশাকে আমি কাছে পাবো? আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ আসবো।’
আচ্ছা যাক, তুই তো বুঝতেই পারছিস ইলি। অনেক কিছুই বলে ফেলেছি৷ আর না বলাই ভালো। এভাবেই আমাদের সম্পর্ক হয়েছে এবং চলছে।
রাফসান ভাইয়ের প্রেমের শুরুর দিকের এই গল্পটি অতি সাধারণ। পরিণতি যদিও ভয়াবহ ছিল। তবুও আমার বুক ধুকপুক করে। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না।
‘আমি যাচ্ছি’ বলে ওর রুম থেকে ফুপুর ওখানে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। সকলের ডাকাডাকি উপেক্ষা করে রাতে ভাতও খাইনি। নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। গায়ে কেমন জ্বর জ্বর ভাব। পুরো রাত আমি আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছি৷ সত্যি বলতে রাফসান ভাইকে আমার কাছে বাজে লাগছিল। ইন্তিশা মেয়েটিকে নষ্টা ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। বাস্তবে এমন গায়েপড়া মেয়ে স্বভাবের মেয়ে থাকতে পারে তখনও আমি জানতাম না। রাফসান ভাই আমাকে সব না বললেও বুঝতে পেরেছি তাদের সম্পর্ক গভীরতার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে৷ সেদিন ভোরেই আমি বাড়িতে চলে এলাম। রাফসান ভাইকে এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। জানি না কেন যেন কাণ্ডজ্ঞানহীন, চরিত্রহীন জঘন্য মানুষ মনে হচ্ছিল তাকে৷ ইন্তিশার মতো নষ্টা মেয়ের প্রতি সে বুঁদ হয়ে আছে? যে মেয়ে জুনিয়র একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করে মজা নিচ্ছে। তাছাড়া পড়ালেখা রেখে রাফসান ভাই এমন নষ্ট প্রেমে মাতাল হয়ে গেল? এই তার শহরে মেসে গিয়ে পড়ালেখার নমুনা? আমি নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিলাম। অন্যকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই৷ নিজের এসএসসি পরীক্ষা সামনে৷ পড়ালেখা, কোচিং এগুলোতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। বান্ধবীদের সঙ্গে বেশি করে মিশতে লাগলাম। আড্ডায়, আনন্দে আমার পরীক্ষার প্রস্তুতি এগোতে থাকে।
রাফসান ভাই মেসেজ দিলে ‘হুম, হ্যাঁ, ওকে।’ এরকম রিপ্লাই দিয়ে এড়িয়ে যাই। মেস থেকে বকুল পুর এলে আমাদের বাড়িতে আসে। আমি পড়ার টেবিলে ব্যস্ত হয়ে থাকি। সেদিন এসে মাথায় ঘাট্টা মেরে বলল, ‘কিরে পড়ালেখায় বড়ো মনযোগী হয়েছিস মনে হচ্ছে।’
আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাই, গালে সুন্দর করে কাটছাঁট মেরে দাড়ি রেখেছে। চুল স্টেইট করা। বাম হাতে কালো ঘড়ি। পরনে পানপাতা রঙের গেঞ্জি। কালো ট্রাউজারের পকেটে বাম হাত গুঁজে রাখা। চোখ চিকচিক করছে। পেশি দেখে মনে হয় সদ্য জিম-টিম করাও ধরেছে। আগের থেকে আরও স্মার্ট, সুদর্শন লাগছে। আমার বুক শিরশির করে। আবার টেবিলের বইয়ে চোখ রেখে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার তো এসএসসি পরীক্ষা সামনে। পড়ালেখা তো করতেই হবে।’
কথাটি বলেই কোনো পাত্তা না দিয়ে স্বভাবসুলভ গুনগুন করে পড়া শুরু করলাম। এখন আর তাদের প্রেম কাহিনী শোনারও আগ্রহ দেখাই না৷ তবে মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। ওর বাবা নেই। এসএসসিতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। চাচারা টাকা খরচ করে মেসে দিয়ে পড়াচ্ছে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে সবার আশা এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে ভালো ভার্সিটিতে চান্স পাবে। কিন্তু ইন্তিশার মতো নষ্টা মেয়ের সবকিছু উজাড় করে দেওয়া প্রেম তার পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটাবে আমি নিশ্চিত৷
তাই আবার মাথা ঘুরিয়ে বললাম,
– ‘রাফসান ভাই একটা কথা বলবো।’
সে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আবার পেছন ফিরে বলল, ‘কি বলবি বল।’
আমি বিব্রতবোধ করছিলাম। তবুও বললাম,
– ‘আসলে আমি নিজেই তোমার থেকে ছোট রাফসান ভাই৷ আবার মেয়ে মানুষ। তবুও তোমার ব্যাপারগুলো আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তোমার বিশ্বাস ভেঙে বড় কাউকে বলে দিতেও পারছি না। আমার কাছে মনে হচ্ছে সরাসরি বলা দরকার। আসলে তুমি প্রেম করো ঠিকাছে, কিন্তু নিজের পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস হও। আরেকটি কথা, প্রেম অনেকেই করে। কিন্তু তোমার প্রেমিকা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। তোমরা খুব দ্রুত এগোচ্ছ। নিজেদের লাগাম রাখা উচিত। ছেলে হিসাবে তোমার বয়স কিন্তু এতটাও বেশি না৷ কিন্তু কাজ বড়দের হয়ে যাচ্ছে।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে শেষ দিকে আমার কেন জানি না কান্না পাচ্ছিল। আমি মাথা ঘুরিয়ে বইয়ে চোখ রাখলাম।
রাফসান ভাই আমার মাথায় ঘাট্টা দিয়ে বলল, ‘বাবা, তুইতো মাস্টারনি হয়ে গেছিস রে ইলি। কত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলিস৷ কিন্তু আমার প্রেমিকাকে তোর ভালো মনে হচ্ছে না কেন? হিংসা তাই না?’
দেশলাই – ৫ম পর্ব
আমি টেবিলে রাখা বইয়ের পাতায় চোখ বোলাচ্ছি। আদতেই কিছু পড়ছি না। রাগে শরীর কাঁপছে। তার নষ্টা প্রেমিকাকে আমার হিংসা লাগবে কেন? আমারই দোষ, অন্যের ভাবে লাভ। আমি এতো কথা বলতে গেলাম কেন? কোনো জবাব না দিয়ে গুনগুন করে পড়তে শুরু করলাম। রাফসান ভাই দুষ্টামি করে চেয়ারে ঝাঁকুনি দিচ্ছিল। আমি মুখ স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘আমি পড়ব। এখন যাও তো ভাই।’
– ‘আচ্ছা চলে যাব। তার আগে বল তুই আমাকে এড়িয়ে চলছিস ক্যান?’
আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম। তবুও পাক্কা অভিনেত্রীর মতো মুচকি হেঁসে জবাব বললাম, ‘কি যে বলো না। তোমাকে আমি এড়িয়ে চলবো কেন? আচ্ছা শোনো। তোমারে হাত ঘড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে।’
– ‘তাই না-কি? ঘড়িটি ইন্তিশা গিফট দিলো।’
– ‘ও আচ্ছা, দারুণ ঘড়ি।’
– ‘ঠিকাছে আমি যাচ্ছি৷ তুই পড়।’
রাফসান ভাই খুশি মনেই চলে গেল। আমি খানিক্ষণ বই বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। এভাবেই দিন কাটছে, রাত যাচ্ছে, মাস, বছর গেল। আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বের হয়। এ গ্রেড পাই। তখন আমার উঠতি বয়স। শরীরে, মননে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। রাফসান ভাইয়ের কাছেও আমি ধীরে ধীরে পুরোপুরি অচেনা হয়ে গেলাম। শৈশবের সম্পর্কের যে ধারাবাহিকতা ছিল সেটা বাধাপ্রাপ্ত হলো। এখন দেখা হলে কেবল ভদ্র বিধির বাক্যবিনিময় হয়। সাক্ষাতে কৃত্রিমতার ‘কেমন আছো’ ধরণের কথাবার্তা৷ রাফসান ভাইয়ের শহরে দিনকাল ভালো কাটছে। প্রেম করছে। উঠতি বয়সেই দেহ পাচ্ছে। মেসের নানান ধরনের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডাবাজি চলছে। মনের আকাশে রঙিন ফানুস উড়ছে। আমি বকুল পুর কলেজেই ইন্টারে ভর্তি হলাম। বান্ধবীরা তখন বলতো আমি খানিকটা মোটা হয়েছি। দেখতে না-কি বেশ লাগে। অবশ্য আমি অসুন্দর কোনো কালেই ছিলাম না। তবে এখন অন্য রকম সুন্দর। আঁটসাঁট পোশাকে বাঁধ না মানা নিটোল দেহ। গায়ের রঙে হলদেটে আভা। পোশাক ঠেলে নিজের জানান দিতে সদা ব্যস্ত আমার অসভ্য দু’টি স্তন। ইতোমধ্যে পুরুষ মানুষকে মোমের মতন গলিয়ে নিঃশেষ করে দেওয়ার সব রকম আয়োজন এই অসভ্য, দুষ্ট নারী শরীরের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার মামা-মামী এলেন ইংল্যান্ড থেকে। তাদের দু’জন ছেলে আছে। তারা দেশে আসতেই চায় না। বড় ছেলে ইংল্যান্ড বিয়ে করে আলাদা। পরিবারের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক নেই। ছোট ছেলের নাম হৃদ। তার এখনও বিয়ে হয়নি। আমার সমবয়সী। মামা-মামীকে দেখতে আমরা মৌলভীবাজার গেলাম। গ্রামের বাড়িতেই উঠেছেন। বহু বছর পর ভাই বোনের দেখা হওয়ায় আম্মু আর মামা গলা জড়িয়ে মরা কান্না দিলেন। মামার দাড়ি-চুল পেকে গেছে। মামী মোটা হয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার গায়ে বোরকা, মুখে নেকাব। সেগুলো খুলে হাতমুখ ধুয়ে এলাম। তখনই মামী আমাকে বিশেষভাবে খেয়াল করলেন মনে হয়। উঠে এসে আমাকে টেনে বুকে নিয়ে আম্মুকে বললেন, ‘কত ছোট দেখে গিয়েছিলাম। তোর মেয়েটা মিষ্টি হয়েছে রে রহিমা।’
আমাকে পাশে বসিয়ে পড়ালেখার খবর নিলেন। উনার আগ্রহী চোখের সামনে আমার ভীষণ লজ্জা করছিল। নানান কথাবার্তা হলো। মামাও নামাজ পরে এলেন। মামী খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘দেখো আমাদের রহিমার মেয়ে কত সুন্দর হয়েছে। এবার ইন্টারে পড়ে।’
মামা টুপি মাথা থেকে রাখতে রাখতে দুষ্টামি করে বললেন, ‘ছেলের বউ করবে না-কি?’
আম্মুও সুযোগ পেয়ে বললেন, ‘তা করবা ক্যান। বাইরের মেয়েকে ছেলের বউ করে দাগ খাও। বড় ছেলের বউ তো শুনছি জামাই নিয়ে আলগা হয়ে গেছে।’
সবাই হু হু করে হেঁসে উঠলো। আর আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েটা তো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।’
এই কথাটা আমার লজ্জার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। আচমকা আমি তাদের মাঝখান থেকে উঠে অন্য রুমে চলে গেলাম। আম্মু সকলের অগোচরে চোখ কঠিন করে আমাকে শাসাচ্ছিলেন। আমি উপেক্ষা করে চলে গেলাম। ধীরে ধীরে আমার কদর বাড়তে লাগল। মামী একের পর এক কল দিয়ে সবার সঙ্গে আমাকে কথা বলাচ্ছেন।
– ‘আমাদের রহিমার মেয়ে ইলির লগে কথা বলো। বাব্বাহ কি মিষ্টি হয়েছে না মেয়েটা। আর কত ভদ্র৷ বোরকা নেকাব পরে।’
বলেই মোবাইল বাড়িয়ে দেন। আমি কি কথা বলবো খোঁজে পাই না। লজ্জায় মরে যাই। সেটাও মামীর কাছে ভালো লাগে। মেয়েটির শরম-লজ্জা আছে। যার শরম বেশি সে নরম বেশি৷ নরম মেয়েরা বিনয়ী হয়।
দু’দিন পর শহর ঘুরে আমাকে নিয়ে শপিং করলেন। বাড়িতে এসে মামী নিজে আমাকে সাজগোজ করিয়ে বললেন, ‘মা তোমার হৃদ ভাইয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলবে কল দিচ্ছি।’
আমি অস্ফুটে বলি, ‘আমি কথা বলতে পারবো না মামী।’
আম্মু-আব্বু তখন চোখ দিয়ে শাসান। পুরো ব্যাপারটায় খুশিতে তাদের চোখমুখ ঝলমল করছে।
ফোনে কথা হয়। হৃদকে দেখতে বয়স খুব কমই মনে হলো। অনেক হালকা-পাতলা। এর আগে আমাদের কথা হয়নি। শুধু মামা-মামীর সঙ্গে আব্বু-আম্মুর কথা হতো।
তারা আমাদের বাড়িতেও বেড়াতে এলেন। কয়েকদিন থাকার পর যাবার আগের রাত আমাকে আংটি পরিয়ে দিলেন। মানে হৃদের সঙ্গে আমার বিয়ে দুই পরিবারের সম্মতি হয়ে গেছে। তবে বিয়ে এখনই যে হয়ে যাচ্ছে তা না। কেবল কথা পাকাপাকি হলো। আমার পড়ালেখা চলবে। হৃদও যখন বিয়ের করতে চাইবে তখনই তাকে দেশে নিয়ে আসবেন। আমার আব্বু-আম্মু প্রচন্ড খুশি। বিলেতি বর পাওয়া তো আর মুখের কথা না। ক’দিন পর আমাকেও লন্ডন নিয়ে যাবে। আমিও কি খুশি? সেটা ঠিক জানি না। তবে বিয়ে তো একদিন বসতেই হবে। এদিকে আমার আলাদা কোনো পছন্দও নেই৷ সুতরাং হৃদের মতো ইউরোপী বর প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নই আসে না৷ মামা-মামীরা সেবার আংটি পরিয়েই চলে গিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে আমাদের পরিবার অনেকটা মামাদের উপর নির্ভরশীল। আমার পড়ালেখা সহ পরিবারগত সকল বিপদ-আপদে তারা আর্থিক সহযোগিতা করেন। মামা-মামী মাস দুয়েক দেশে থাকার পর চলে গেলেন। আমাদের সঙ্গে রোজ যোগাযোগ হয়। হৃদের সঙ্গে আমাকে মাঝে মাঝে কথা বলান। যতদূর বুঝতে পারি হৃদ বিয়ে-টিয়ে নিয়ে এখনও কিছু ভাবেনি। তার বিয়ের বয়সও হয়নি৷ আমাদের কথা পাকাপাকি হলেও বছর কয়েক পর বিয়ে হবে বুঝাই যাচ্ছে।
আমি ইন্টার সেকেন্ডে ইয়ারে উঠেছি। বেশ যাচ্ছে দিনকাল। সহপাঠীদের সঙ্গে অনেক মিশেছি। ওরা প্রায় সবাই জমিয়ে প্রেম করছে। রেল লাইন ধরে আমরা বিকেলে হাটি। এদিকটা ছবির মতোন সুন্দর। দু’পাশে সারি সারি শিরিষ গাছ। নিচে সবুজ ঘাস। রেল লাইন ধরে কলেজের উত্তর দিকে একটু হেঁটে গেলে একটি ব্রিজ। তার নিচে চানাচুর আর ফুসকার দোকান বসে। ছেলে সহপাঠীদের সঙ্গে আমার সুন্দর পরিষ্কার আচরণ। সবাই জানে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে৷ তবে বান্ধবীদের প্রেমের সাঁকো হিসেবে ইতোমধ্যে খ্যাতিও অর্জন করেছি।
অনেকের মধ্যকার মান-অভিমান ভাঙানোর দায়িত্বও আমার উপর এসে পড়ে। সবকিছু আমি বেশ আনন্দের সহিত পালন করি। মাতব্বরিতে একটা মজা আছে।
একেকজন একেকদিন ফিসফিস করে শিশুর মতো এসে বলবে, ‘ইলি সোনা, বেস্টু আমার, প্লিজ আজকে কলেজ ছুটি হলে থাকবি। ওর সঙ্গে ব্রিজের নিচে ফুসকা খেতে যাবো।’
আমি মুচকি হেঁসে বলি, ‘আচ্ছা।’
কিন্তু ভালো করে জানি কেউ সেখানে কেবল ফুচকা খেতে যায় না। ব্রিজের বাম পাশে একটা অর্ধ তোলা পুরাতন শ্যাওলা পড়া দালান। মাঝখান দিয়ে একটা পিলার পড়ে আছে। সেখানে বসে কলেজের পুচকে ছেলেরা লুকিয়ে সিগারেট খায়৷ প্রেমিক মহলের কাছেও স্থানটি ইতোমধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে। কারণ চারদিকে দেয়াল তোলা। দরজার সামনে থেকে একজন নজর রাখলেই তারা চুমু-টুমু খেতে পারে। সেদিন বান্ধবী লিজার সঙ্গে গিয়েছিলাম। ওর প্রেমিক আমাদের কলেজ থেকে ইন্টার দিয়ে এখন সিলেট এমসিতে অনার্স পড়ছে৷ তাদের বেশ কয়েক বছরের প্রেম৷ যেই-সেই প্রেম না, জটিল প্রেম। ছেলেটি পাগলের মতো ভালোবাসে লিজাকে। কিছুদিন পর পর বাড়িতে চলে আসে। দেখতে শ্যামলা। মুখ ভর্তি ব্রণ। এই জুটির বিশেষত্ব হলো এরা দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদবে। তারপর একজন আরেকজনের চোখের পানি মুছে দিয়ে যাওয়ার সময় টুপ করে চুমু খেয়ে নেবে৷ আমার দায়িত্ব হলো প্রবেশ পথ থেকে খেয়াল রাখা কেউ আসছে কি-না। কেউ এদিকে এলে অতি মনযোগ দিয়ে ফুচকা খেতে হবে।
প্রেমের সাঁকো হিসেবে কাজ করতেও আনন্দ আছে।
এতোদিনে আমার সঙ্গে রাফসান ভাইয়ের কোনো যোগাযোগ নেই। তার পড়ালেখা, প্রেম কোনো কিছু জানি না। সে বাড়িতে এলেও যাই না। সেদিন রাতে আব্বু এসে বললেন রাফসান টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসেছে৷ কিন্তু ছেলেটার অবস্থা করুণ। শরীর-টরীর ভেঙে নাজেহাল অবস্থা। আমরা সবাই ভেবেছি হয়তো পড়ালেখায় এরকম হতে পারে। কিন্তু একদিন বিকেলে লিজাদের বাড়ি যাবার সময় তাকে খেলার মাঠে দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। এই মানুষটি কি রাফসান ভাই? ঠোঁট কালো, চোখের নিচ কালো, শুকিয়ে কাঠ, ফ্যাকাসে চেহারা। কি চলছে ওর জীবনে? একবার মনে হলো পড়ালেখার চাপ হয়তো। আবার মনে হলো তাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেব। কিন্তু শেষ আবধি আর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করলাম না।
এভাবেই দিন চলতে থাকে। আমারও পড়ার চাপ দিনকে দিন বাড়ছে। তাদের ব্যাচের ইন্টার পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট বের হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে রাফসান ভাই একাধিক বিষয়ে ফেইল। এবং সে মেস থেকে যখন বাড়িতে এলো তখন বদ্ধ উন্মাদ। হাত কাটে। রাত-বিরেতে চিল্লাচিল্লি করে। মেয়ে মানুষ নিয়ে নোংরা গালিগালাজ করে। আমরা সবাই তাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেলাম। দীর্ঘ দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় আমিও জানি না কি ঘটেছে যার জন্য তার এই অবনতি৷ এদিকে পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেইলও করে ফেললো। দীর্ঘ কয়েক বছর তার এভাবেই কাটছিল। সিগারেট খাওয়া। রোদ,বৃষ্টিতে ঘুরে বেড়ানো, পাগলামো, আত্মহত্যার চেষ্টা করা। এসব থেকে বহু কষ্টে সবাই তাকে বের করে খানিকটা স্বাভাবিক হওয়ার পর বিয়ে দেয়। কিন্তু বাসর রাতে বের হয়ে গিয়েছিল আজও ফিরে আসেনি৷
—-চলবে— ( বি:দ্র: এতক্ষণ ইলির কথা ছিল। এরপর লেখকের কথায় গল্প বলা হবে।)
লেখা: MD Jobrul Islam
–চলবে–
লেখা: MD Jobrul Islam