#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১০
তারানা আপা বাসা থেকে চলে গেলো। কোথায় গেলো কেউ জানি না। সুলতানা আপা তারানা আপার দেশের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন, কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আমি কৌশলে বাসা-দোকান আমার নামে লেখিয়ে নিলাম সালমানের কাছ থেকে। সপ্তাহ তিনের মধ্যেই মুনার বিয়ে হয়ে গেলো। এবার যেখানে বিয়ে হলো, সেখানেও জামাই আমেরিকা থাকে। ধূমধাম প্রচুর হয়েছিলো বিয়েতে। এখানেও মুনার জামাই বাড়ির লোকজনদের কাছে সুলতানা আপার পরিচয়টা গোপন রাখা হয়েছিলো তাদের কাছে। আমার ডেলিভারির ডেইট সামনের মাসের এগারো তারিখে। শরীর দিনকেদিন খারাপ হতে যাচ্ছে আমার।
সুলতানা আপাকে রোজ নিয়ম করে কান্না করতে দেখতাম। তারানা আপার জন্য হা হুতাশ করতো সবসময়। ভেতরে ভেতরে অনেক খোঁজ নেওয়া হয়েছে তার। তবে কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
সুলতানা আপা আমার সামনে বসে আমাকে বলতো,
“সামনে আরেকটা সত্যের মুখোমুখি তুই হবি। জানি না তখন তোর কী অবস্থা হবে।”
আমি জিজ্ঞেস করতাম,
“কী সত্য? কী অবস্থা হবে আমার?”
সুলতানা আপা নিশ্চুপ থেকে যেতো তখন কোনো জবাব দিতো না। মাথায় হাত রেখে বলতো,
“তোর সাথে খারাপ কিছু যাতে না হয়।”
এদিকে শাশুড়ি বাচ্চাদের কাঁথা বানাতে ব্যস্ত থাকতেন সারাক্ষণ। আদর যত্ন যেমন ছিলো তেমনই আছে, তবে আহেকার মতো গালাগাল আর সে করতো না। আমার বাচ্চা জন্মের আগেই সালমান ছেলে বাচ্চার পোশাক, দোলনা এসব এনে ঘর ভর্তি করে রাখতো।
মাঝেমধ্যে শাশুড়িকে কলে কান্না করতে দেখতাম আমি। কান্না কেনো করতো জানি না। একদিন সুলতানা আপা এসে বললো,
“খবর আছে একটা।”
“কী খবর?”
সুলতানা আপা তখনই তার মোবাইল থেকে কল রেকর্ডার অন করলো। অন করে বললো,
“চুপ করে শুনে যাবি শুধু। আজ মুনা আমেরিকা থেকে কল করেছিলো আম্মার সাথে কথা বলবে বলে। আমার মোবাইলে কল রেকর্ডার সবসময় অন থাকে। আমি কল রেকর্ডারে কথাগুলো শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। শোন তুই।”
কল রেকর্ডার চলতে শুরু করলো।
মুনা বললো,
“মা আমি এখানে কষ্টে আছে ভীষণ। কেউ কথা বলে না ভালোমতো। শাশুড়ি রোজ রোজ গায়ে হাত তুলে।”
মুনার কথা শুনে শাশুড়ি এপাশ থেকে বললেন,
“জামাই কিছু বলে না?”
“বলবে কীভাবে? গতকাল আমি তার কাছে নালিশ করেছিলাম তার মায়ের নামে, সে রাতে ঘুম থেকে বাসার সবাইকে তুলে সবার সামনে আমাকে অপমান করলো। বললো, আমি নাকি তার মায়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছি।”
“তারপর…”
এবার মুনা কান্না করে দিলো। কান্না করতে করতে বললো,
“শাশুড়ি তারপর ছেলের সামনে আমার গায়ে হাত তুললেন। ছেলেও তার সাথে যুক্ত হলো। সারাদিন শরীরের ব্যাথায় উঠে বসতে পারিনি মা….”
মুনা কান্না করতে লাগলো অঝোরে।
সুলতানা আপা রেকর্ড অফ করে দিলেন। আমি দেখলাম, সুলতানা আপার চোখের কোণে পানি জমে আছে। সুলতানা আপা মুখে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,
“অভিশাপ লেগেছে রে, তারানার অভিশাপ লেগেছে।”
আমার পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো এমন সময়। আমি চিৎকার করে উঠলাম। সুলতানা আপা উঠে গিয়ে শাশুড়িকে ডেকে আনলেন। সালমানকে কল দিলো সুলতানা আপা। সালমান এসে এম্বুলেন্স ডেকে আমাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো। সাথে সুলতানা আপা আর শাশুড়িও ছিলেন। এই পর্যন্তই আমার মনে ছিলো।
আমার জ্ঞান ফিরলো এর পরের দিন রাতে। আমি আইসিইউ তে এডমিট ছিলাম। আইসিইউ থেকে বের করে নিয়ে এসে রুমে রাখলো আমাকে। রুমে শাশুড়ি বসা ছিলেন। সুলতানা আপা কাছে আসলেন। জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। আমি নিজের শরীরটা পাতলা পাতলা অনুভব করলাম। সুলতানা আপা আমার মাথায় হাত রেখে বললো,
“তুই মা হয়েছি। আমি মা হয়েছি।”
শাশুড়ি পাশ কাটিয়ে বললো,
“তুই মেয়ে জন্ম দিয়েছিস। মেয়ে। তুই মেয়ের মা হয়েছিস। তোর পেটে মেয়ে আসলো কীভাবে?”
শাশুড়ি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ডাগর চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“রিপোর্ট বললো ছেলে তাহলে মেয়ে কীভাবে?”
আমি ফেলফেল চোখে তাকিয়ে থাকলাম সুলতানা আপা আর শাশুড়ির দিকে। সুলতানা আপা শাশুড়িকে বললো,
“বাচ্চা বাচ্চাই তো আম্মা। ছেলে আর মেয়ে যাই হোক, দোয়া করেন আল্লাহ মেয়েটাকে সুস্থ করে দিতে।”
আমি অবাক হলাম সুলতানা আপার কথায়। সুলতানা আপাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আমার বাচ্চা কোথায়?”
তারপর আমার বেডের চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম।
সুলতানা আপা বলার আগেই দরজা খুলে সালমান রুমে ঢুকলো। একটা অকথ্য গালি দিয়ে আমাকে বললো,
“কীরে মেয়ে পয়দা দিলি কেনো? আমি মেয়ে চেয়েছিলাম?”
আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। সালমান বললো
“তোর মেয়েটা আইসিইউ তে আছে। মরেযাক সে। আমি বাঁচতে দিবো না। আমার ঘরেও নিবো না। সে মরে যাক।”
ফেলফেল চোখে তাকিয়ে থাকলাম। অসার হয়ে গিয়েছে আমার পুরো শরীর। শাশুড়ি রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। শাশুড়ির সাথে সালমানও চলে গেলো রুম থেকে বের হয়ে। মুনা কল করলো সুলতানা আপার মোবাইলে। কল দিয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাইলো। আমি কল ধরলাম। অপাশ থেকে মুনা বললো,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও নুপুর ভাবি। আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি।”
মুনার কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে কান্না চলে আসলো। মুনা তারপর বললো,
“তারানা ভাবির খোঁজ পাওনি এখনও জানি। তার সাথে আমি অবিচার করেছি বেশি।”
আমি এবারও নির্বাক ছিলাম। মুনা বললো,
“সুলতানা ভাবীর চোখের সাথে চোখ মিলিয়ে আমি দাঁড়াতে পারবো না কখনো। সুলতানা ভাবী আমার সেই হাঁটা শেখার কাল দেখেছে। আমার মা না হয়েও মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে। আর সেই ভাবির গায়ে পর্যন্ত হাত তুলতে আমার গায়ে ধরলো না। ভাবিকে বলো, আমাকে যেনো ক্ষমা করে দেয়।”
আমি শুধু মুনার কথা শুনলাম। মুনা আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার ভাইজি কেমন আছে?”
আমার কান্না চলে আসলো কথাটা শুনে। আমার কান্না দেখে সুলতানা আপা আমার কান থেকে মোবাইল কেড়ে নিলেন। সুলতানা আপা মুনাকে বললেন,
“দোয়া করিস রে বোন। আমার মেয়েটা আইসিইউতে। অবস্থা ভালো না।”
মুনা আরও কিছুক্ষণ কথা বললো সুলতানা আপার সাথে। সুলতানা আপার চোখ দিয়ে দেখলাম কান্না ঝরছে। আমি অবাক হলাম। কল রাখার পর সুলতানা আপাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কাঁদছো কেনো?”
এমন সময় নার্স এসে বললো,
“আপনার মেয়ে আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছে। তাকে ডাক্তার আর এক ঘন্টার পর্যালোচনায় রাখবেন। আইসিইউ থেকে বের করা হয়েছে।”
সুলতানা আপা বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
আমার চোখ দিয়ে খুশির কান্না চলে আসলো। সুলতানা আপাকে আবার মুনার কথা জিজ্ঞেস করলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি কাঁদলে কেনো?”
সুলতানা আপা বললো,
“আমাদের মুনা ভালো নেই রে বোন”
“কী হয়েছে মুনার? অসুস্থ?”
সুলতানা আপার চোখ গড়িয়ে তখন কান্না বিছানায় এসে পড়লো। টপটপ করে কান্না ঝরছে তার চোখ দিয়ে। সুলতানা আপা বললো,
“বোন হারানোর যন্ত্রণা আমি বুঝি রে বোন। মুনা তো আমাদের বোন ই ছিলো।”
আমি অবাক হলাম।জিজ্ঞেস করলাম,
“বোন হারানোর যন্ত্রণা মানে?”
সুলতানা আপা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“মুনা আর বেশিদিন বাঁচবে না রে।”
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)