দ্বিরাগমন পর্ব ২

#দ্বিরাগমন
#পর্ব_২

অনিচ্ছা থাকার পরও সেদিন রাতে আমাকে পাশবিক ভাবে ভোগ করলো সালমান। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সালমান বাইরে চলে গেলো। আমার শাশুড়ি আমাকে ডেকে নিয়ে আসলেন তার রুমে। তারপর আমাকে বললেন,
“পা টিপে দে।”
একটা মেয়ের বিয়ের পরেরদিন একজন মানুষ কতটা অমানবিক হলে তাকে বলতে পারে যে, পা টিপে দিতে।
এদিকে সারারাত ঘুম হয়নি আমার। ঘুমের ঘুরে বারবার কেমন যেনো ঢলে পড়ছিলাম। শাশুড়ি তাগিদ দিচ্ছিলেন আমাকে এই বলে যে,
“বাপ মা কিছু খাওয়াইছেনা? এতো নিস্তেজ কেনো শরীর? হাতে জোর নাই?”
আমি কথা বলতে পারলাম না আর। অথচ রাতের পাশবিকতা আমাকে ভেতরে ভেতরব কুকড়ে খাচ্ছে মুখ ফুটে বলতেও পারছি না। শাশুড়ি এমন সময় ডাক দিলেন,
“বড় বউ, বড় বউ….”
বড় বউ আসলো। শাশুড়ি তাকে ধমকিয়ে বললেন,
“কয়টা বাজে এখন?”
“আটটা।”
“চা হয়েছে”
“হচ্ছে তো”
বড় বউয়ের এই কথা শুনে শাশুড়ি আমার সামনে আমার হাত থেকে পা সরিয়ে পা দিয়ে একটা লাত্তি মারলেন বড় বউয়ের উরুতে। তারপর বললেন,
“বেয়াদব। বাপ মা মরা মেয়ে। এখানে পড়ে আছিস কেনো? যা চলে তোর বাপের বাড়ি।”
বড় বউ কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“বিয়ে করে এসেছি চলে যাওয়ার জন্য?”
“খানকি তাইলে তুই বেয়াদবি করোস ক্যান?”
বড় বউ আর কথা বললো না। নিশ্চুপে রুম থেকে চলে গেলো। তারপর শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“দেখলি মুখের উপর কথা বললো সে।”
আমি কোন উত্তর দিলাম না শাশুড়ির কথায়। চোখে আমার ঘুম ধরে আছে। আনমতে পা টিপিয়েই যাচ্ছিলাম। হুট করে শাশুড়ি তার মুখ থেকে থুথুর দলা আমার মুখের উপর থু করে ছুড়ে মারলেন। তারপর হেসে হেসে বললেন,
“এভাবে বড় বউর মুখের উপর থু থু দিতাম। তুই সামনে তাই দেইনাই। তারপর তোকে জিজ্ঞেস করেছি, “দেখলি মুখের উপর কথা বললো সে” তুই কোন উত্তর দিলি না শুনে। দেমাগ দেখালি। এই নে তোর দেমাগ। কাল এসেছিস ঘরে নাহলে এখনই থাপ্পড় দিতাম দুইটা। ভাগ্য ভালো যে থু থু পর্যন্ত নেমে এসেছি আর নিচে নামিনাই। আমি মানুষ কেমন সেইটা বড় বউ আর মেঝো বউয়ের কাছে জিজ্ঞেস করে নিস। বুঝছিস?”

এবার আমি ভয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। শাশুড়ি তারপর মেঝো বউকে ডাক দিলেন।
“মেঝো বউ, এই মেঝো বউউউ…”
“জি আম্মা।”
“বাজার হয়েছে?”
“না আম্মা সবজিওয়ালা আসেনি এখনও”
“এই শুকরের বাচ্চা মুখের উপর কথা বললি কেনো? তোর বোন একটা দেমাগি ছিলো তুই আরেকটা। সেইটারে তো ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। রাস্তার কুকুররা খাচ্ছে ওইটাকে। কী মনে করেছিস আমি কোন খবর রাখি না?”

মেঝো বউয়ের চোখ থেকে টপাটপ পানি পড়তে লাগলো। আমার কেমন জানি খারাপ লাগা শুরু হলো। শাশুড়ি আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বললেন,
“পা টেপা বন্ধ করলি ক্যান? রাতে ভাত তো কম খাইলিনা। দেখলাম গপাগপ করে গিললি। তোর বাপের ঘরে তো দেখলাম ড্রামে চাউল তলানিতে। এখানে ভাত খাইয়াও শরীরে শক্তি আসেনাই?”

আমি কথা শুনে পা টিপতে লাগলাম। শাশুড়ি মেঝো বউকে বললেন,
“সালমান সকালে ভাত খেয়ে গিয়েছিলো?”
“না।”
“কেনো না? ভাত খায়নাই কেনো সে?”
“বলেছেন খাবেন না।”
“সে বলেছে খাবে না আর তুই ও ভাত দিলি না? আমার ছেলেটা সারাদিন না খেয়ে থাকবে?”

মেঝো বউ কোন জবাব দিলো না শাশুড়ি শেষে মেঝো বউকে বললেন,
” সবজিওয়ালা চলে আসবে। করোলা কিনে আনিস। তারপর ভাজি করিস। তিতা ছাড়িয়ে নিস।”
” জি আচ্ছা।”

মেঝো বউ চলে যাওয়ার পর শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“তোকে বিয়ে করিয়ে এনেছি কেনো জানিস?”
আমি কিছু বললাম না। শাশুড়ি আবার ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
“জানিস?”
এবার আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“জানি না।”
“আমার নাতি চাই। চার চারটা বউ এনেছি একটাও আমাকে নাতি দিতে পারলো না। মেঝো বউর একটা মেয়ে হয়েছিলো, সেইটা মরা জন্ম নিয়েছে। এখন আমার নাতি চাই ই চাই।”

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এরকম অনুভব আমার এর আগে কখনো হয়নি। শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“কীরে নুপুর? পারবি আমাকে নাতি দিতে?”
আমি নিশ্চুপ।
এবার শাশুড়ি বসা থেকে উঠে আমার হাত ঝাপটে ধরে আমাকে বললেন,
“কীরে পারবি তো? চুপ আছিস ক্যান খানকি”

আমি কান্না শুরু করে দিলাম। এমন সময় মেঝো বউ রুমে আসলো। শাশুড়িকে বললো,
“আম্মা আপনি একটু বুঝার চেষ্টা করেন। মেয়টা নতুন এসেছে মাত্র।”
শাশুড়ি মেঝো বউকে বললেন,
“তারানা নতুন ছিলি না?”

এই প্রথম শাশুড়ির মুখে মেঝো বউয়ের নাম শুনলাম। মেঝো বউয়ের নাম তারানা। তারপর শাশুড়ি বললেন,
“বড় বউ সুলতানা নতুন ছিলো না? তোর বোন নন্দিতা নতুন ছিলো না? জংশনপুরের মেয়ে বেলি নতুন ছিলো না? কই একটাও তো আমাকে নাতি দিতে পারলা না। আমার এই ঘর, এই সম্পত্তি, এতো টাকা পয়সা জহরত কে খাবে? কে দেখবে? ”

তারানা ভাবী চুপ করে থাকলো। তারপর শাশুড়ি তারানা ভাবীকে বললেব,
“চুপ কেনো মেঝো বউ? বাজা মেয়ে তোমরা। আমার ঘরে বাজাদের লাইন লেগেছে।”
তারপর শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোকে এবার নাতি দিতেই হবে নুপুর। দিতেই হবে। এই আমি বলে রাখলাম।”

তারানা ভাবীর হাতে রাখা ট্রে তে দুই কাপ চা রাখা ছিলো। শাশুড়ি তারানা ভাবীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই তারান দুই কাপ চা কে বলেছে? আমি দুই কাপ খাই?”
“না মানে, এক কাপ নুপুরের জন্য।”
শাশুড়ি এমন সময় বিছানা থেকে উঠে তারানা ভাবীর হাতে থাকা ট্রে টা ফেলে দিলেন নিচে। চায়ের কাপ নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গেলো। তারানা ভাবীকে গালে থাপ্পড় দিতে থাকলেন শাশুড়ি। পাশের রুম থেকে শব্দ শুনে সুলতানা ভাবী চলে আসলো। সুলতানা ভাবী রুমে ঢুকতেই শাশুড়ি বললেন
“মাতুব্বরি করতে আসবি তো বাপের বাড়ি চলে যাবি। কাজের জন্য রেখেছিলাম, এখন নতুন বউ চলে এসেছে। তোর আর দরকার নেই।”

সুলতানা ভাবী আর সামনে এগিয়ে আসলো না। সেদিন বেধড়ক মারলেন তারানা ভাবীকে। মারতে মারতে শাশুড়ি তারানা ভাবীকে বলতে থাকলেন
“নতুন মেয়ের জন্য এতো দরক ক্যান? চা তুই দিবি ক্যান তাকে? ওর হাত পা নাই?”

শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কীরে ফকিন্নির ঘরের মেয়ে, তোর হাত পা নাই?”
“আছে।”
“এই ফকিন্নির বাইচ্চা, মুখের উপর জবাব দিবি না।”

আমি ভেবে পেলাম না, জবাব দিলে উনি চিৎকার করেন। জবাব দিলেও বলেন মুখের উপর জবাব না। তারপর তারানা ভাবিকে ছেড়ে দিয়ে শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“যা ফ্লোরের কাচ পরিষ্কার করে আয়। আর আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসিস। আজ থেকে নিজের চা নিজে বানিয়ে খাবি। বাজা মেয়ে দুইটা থেকে দূরে দূরে থাকবি। কেমন?”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।
তারপর শাশুড়ি আবার বললেন,
“দুইটাই বাজা। ছায়া লাগাবি না তাদের। একটাও বাচ্চার সুখ দিতে পারলো না। একটাও আমার নাতি দিলো না। তারানা বাজা মেয়ে দিলো, তবে পোয়াতি ঘরেই মেয়ের মরা আসলো। অলক্ষ্মী। অভাগী। ”

আমি কথাগুলো শুনলাম নীরবে। ভেতর ভেতর ভয় পেতে শুরু করলাম আমি। কী করবো, কীভাবে করবো, এই ঘরে আমি কীভাবে থাকবো এসব আমাকে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছিলো।
দুপুরবেলা শাশুড়ি আমাকে, সুলতানা ভাবীকে আর তারানা ভাবীকে একসাথে ডাকলেন। তারানা ভাবীকে বললেন, তার তার আলমারি থেকে সবুজ কাতান বের করে আমাকে পরিয়ে দিতে। তারপর সাজিয়ে দিতে। দুপুরে আমার বাবা মায়েরা দেখতে আসবেন আমাকে।
শাশুড়ি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কয়জন আসবে তারা?”
মাথা নারিয়ে না সূচক উত্তর দিলাম, “আমার জানা নেই।”
শাশুড়ি বললেন,
“তোমার বাবা বলেছেন, তারা পনেরো জনের মতো আসবে।”
সুলতানা ভাবী শাশুড়িকে বললো,
“খাবারের ব্যবস্থা? ”
“আমি বেঁচে আছি তো? তোমাকে ভাবতে বলেছি? খাবার বাইরে থেকে আসবে। এগুলো নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। আর আমি সুলতানা ও তারানা দুজনকে বলে দিচ্ছি, নুপুরের পরিবারের লোকজনদের সাথে কোন প্রকারের খারাপ আচরণ প্রদর্শন যাতে না হয়।
তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী একসাথে মাথা নাড়লো। আমার ননদ আমার সামনে তার একটা গাউন নিয়ে এসে বললো,
“ভাবী এইটা গায়ে আটিয়ে দাও।”
তারানা ভাবী বললো,
“মুনা আমি দিচ্ছি। আমাকে দিয়ে দাও।”
শাশুড়ি রেগে গেলেন তখন। তারানা ভাবীকে বললেন
“মুনা কাকে বলেছে? তুই বাজাকে? নাকি নুপুরকে?'”
তারানা ভাবী নিশ্চুপ থেকে রইলো।

সেদিন দুপুরে আমার ফুফু, খালা চাচারা আমাদের বাসায় এলো। ফুফুরা আমার রুম ঘুরে দেখতে লাগলেন। খালা মাকে বললেন,
“নুপুরের ভাগ্য ভালো বলতেই হয়।”

সালমানের মধ্যে সেদিন অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পেলাম। সালমান সবার সাথে হেসেহেসে কথা বলছে। খাবার তুলে দিচ্ছে। ছোট ফুফুকে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমরা সব কাহিনী জানো?”
ফুফু হেসে হেসে বললো,
“জানি রে। তোর সতীনের ঘর হয়েছে। কী আর করবি বল? ভাগ্যতো মন্দ না। টাকা আছে, ঘর আছে। এটাই তো জীবন। আর কী চাই?”

আমি ফুফুর মুখ থেকে এই কথাটা শুনে মর্মাহত হলাম। সবাই সব জানে। অথচ আমিই জানতাম না। মাকে আমি রান্নাঘর লাগোয়া বারান্দায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আমার জীবন নষ্ট করে দিলে কেনো?”
মা সেদিন কান্নায় ভেঙ্গে গেলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“মারে, তোর বাবার কাছে জামাই টাকা পেতো এক লাখ। বাসা ভাড়া বাকি ছিলো চার মাসের। তোর বাবার নগদ টাকারও দরকার ছিলো। জামাই তোর বাবাকে নগদ তিন লাখ টাকা দিয়েছে। বাসা ভাড়া মাফ করে দিয়েছে। এও বলেছে, আমাদের আর বাসা ভাড়া দেওয়া লাগবে না। বিনিময়ে তোকে চেয়েছে রে মা! আমরা অনেক লোভী বাবা-মা। তোর জীবনটা এভাবেই শেষ করে দিলাম। আমাকে পারলে তুই ক্ষমা করিস রে। আমাকে ক্ষমা করিস!”

আমি কান্না শুরু করে দিলাম। মাকে বললাম
“আমি না তোমার মেয়ে? আমাকে না পেটে ধরেছিলে তুমি?”
মা তখন নিশ্চুপ ছিলো। পেছনে তারানা ভাবী কখন এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আমরা খেয়াল করিনি। তারানা ভাবী আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“বোন রে, টাকার জোরে আমার আপন বোনকেও পাষণ্ড বিয়ে করেছে। তারপর বাচ্চা হয়নি বলে ছেড়ে দিয়েছে। তুই এইটা ভাবিস না যে তুই সতীনের ঘরে এসেছিস। আমরা দুইজন তোর বোন হই। আপন বোন। আমাদের দুঃখের কমতি নেই রে। আমাদের দুঃখগুলা এক।”
আমি তারানা ভাবীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম।

লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here