দ্বিরাগমন পর্ব ৭

#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৭

আমি ঠিক করলাম সুইসাইড করবো। এই জীবন আমার আর রাখার কোন ইচ্ছা নেই। প্রথমে বাবার উপর অভিমান হচ্ছিলো। বাবা আমাকে জেনে শুনেই টাকার কাছে লোভী হয়ে, সালমানের কাছে বিয়ে দিয়ে দেন। মাকেও আমি দোষ দিয়েছি। তারা আমার জীবন নিয়ে খেলেছেন। আজ যখন আমার বাবা মারা গেলন, যেই জন্মদাতা বাবা আমাকে বড় করে তুলেছেন, সেই বাবার শেষ দেখায় আমি যেতে পারলাম না। অথচ এমন যদি হতো, আমি দেশের বাইরে!
দেশের বাইরে হলেও তো মানুষ তার আপন জনদের মৃত্যুতে দেশে ছুটে চলে আসে। কিন্তু আমার বেলায়?

আমি ড্রয়ার খুললাম। ড্রয়ারের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা পুতুল। দেয়ালের দিকে তাকালাম, দেয়ালে ছেলে বাচ্চার ছবি। নিজের পেটে হাত দিলাম। আমার কোনো অধিকার নেই আরেকটা জীবন ধ্বংস করার। একটা বাড়ন্ত শিশুকে দুনিয়ার আলো দেখাবার আগেই মেরে ফেলার অধিকার খোদা আমাকে দেননি। তবে আমার কোন উপায় নেই। অনেক ভেবেচিন্তে সুইসাইড করাটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত হলো।
ড্রয়ার থেকে কলম বের করলাম। পেইজ খুঁজে পেলাম না। দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারের সাদা পাতা ছিড়লাম। এমন সময় সুলতানা আপা আমার রুমে চলে আসলো। আমার হাতে কলম আর ক্যালেন্ডারের ছেড়া কাগজ দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“এগুলো কী?”
আমি বললাম,
“ছবি আঁকবো বাবার। এজন্য হাতে নিয়েছি।”
সুলতানা আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। আমাকে বললো,
“মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, অনেক কষ্ট তোকে সহ্য করে নিতে হবে। এই পাষণ্ড সালমানের ঘরে আমাদের কোনো সুখ নেই রে বোন কোনো সুখ নেই। এখানে কেউ আমাদের আপন না।”
“আমার বাবা আর নেই গো আপা, আমার বাবা আর নেই।”
“কান্না করিস না বোন। আমি মা বাবা হারা মেয়ে। এতিম মেয়ে। আমার যাবার কোনো জায়গা নাই এই ধরাধামে। তোর তো মা এখনও বেঁচে আছেন রে। এখনও আছেন। আমার কে আছে রে?”
আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম সালমা আপাকে। সালমা আপাকে বললাম,
“তোমার বোন আছে। এইযে আমি। আমার থাকতে তোমার একা ভাবার কোনো দরকার নেই।”

সালমা আপা আমাকে ছাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“চোখ মুছে নে। সন্ধ্যায় মুনাকে দেখতে আসবে।”
“কে দেখতে আসবে?”
“পাত্রপক্ষ”
এমন সময় শাশুড়ি আমার রুমে আসলেন। চেঁচিয়ে বললেন,
“কান্না করা আর ন্যাকামি বন্ধ করে রেডি হও। লোক আসবে দেখতে মুনাকে। মুনার ভাবীকে এভাবে দেখলে লোকে মনে করবে আমরা ছেলের বউকে কষ্টে রেখেছি।
তারানা আপা দরজার বাইরে থেকে হঠাৎ এসে শাশুড়িকে বললো,
“সুখে রেখেছেন বউদের? আজ একটা মেয়ের বাবা মারা গেলো, কুসংস্কারের দোহাই দিয়ে মেয়েটাকে তার বাবার শেষ দেখা দেখতে দিলেন না?”

শাশুড়ি পায়ের জুতা পা বাড়িয়ে ছুড়ে মারলেন তারানা আপার দিকে। তারানা আপার গায়ে অবশ্য পরেনি। তারানা আপা বললো,
“মারো, আমাকে মেরে ফেলো। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখন মরে গিয়েই শান্তি পাই।”
শাশুড়ি তারানা আপার কথা শুনে তারানা আপাকে বললেন,
“মুখে বাড়ন্ত দেখছি। লাগাম লাগাও নাইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বিদায় করবো বাজা বউ। অলক্ষ্মী!”
“আমি অলক্ষ্মী?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অলক্ষ্মী।”
তারপর শাশুড়ি আমার দিকে ইশারা করে আমাকে বললেন,
“সন্ধ্যার পর যখন লোক মুনাকে দেখতে আসবে, তখন তুই বের হবি। এই অলক্ষ্মী দুইটা যেনো বের না হয়।”
তারানা আপা বললো,
“অলক্ষ্মী আমরা! বাহ। নিজেরও মেয়ে আছে আম্মা। আল্লাহ না করুক, বিয়ে দেয়ার পর যদি মেয়ে এমন কথা শুনে, আল্লাহর ভয় ডর নেই নিজের মনে? মুনাও তো মেয়ে হয়ে জন্মেছে!”

শাশুড়ি চেতে গেলেন। তারানা আপার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। মুখ থেকে বিরবির করে বলতে লাগলেন,
“অলক্ষ্মী, ছোটলোকের মেয়ে এইটাকে ঘরছাড়া করাই লাগবে…”
শাশুড়ি চলে গেলেন রুম থেকে। তারানা আপা আমার কাছে এসে বসলো। সুলতানা আপা তারানা আপাকে বললো,
“তারানা তুই এতো কথা বলিস কেনো? রোজ রোজ অপমানিত হতে ভালো লাগে তো? আমিতো এজন্য কোন কথাই বলি না।”
তারানা আপা সুলতানা আপাকে বললো,
“একটা মেয়ের বাবা মারা গিয়েছে আপা। পাষণ্ডরা তাকে তার বাবা দেখতে দেয়নি!”
সুলতানা আপা বললেন,
“এগুলো নিয়তি। ভাগ্য! বোন রে আমাদের কোনো দাম নেই।”

সুলতানা আপা আর তারানা আপা রুম থেকে চলে গেলো। আমিও একা হয়ে পড়লাম। যাবার আগে সুলতানা আপা এসি অন করে দিলো। বললো,
“এসি বন্ধ করিস না। তুই সারাক্ষণ বাসার ভেতরে থাকিস। এসি অফ করে রাখলে শরীর খারাপ করতে পারে।”
আমি হাসলাম। সুলতানা আপাকে বললাম,
“বাবার ঘরে এসি ছিলো না। ভালোবাসা ছিলো। এই ঘরে এসি আছে। ভালোবাসা নেই।”
“আমরা তোকে ভালোবাসি না? আমাদের জন্য তোর ভালোবাসা হয় না? আমরা তিনজনই তো তোর মতো ভালোবাসার কাঙ্গাল রে বোন।”

তারা চলে গেলো। রুমের দরজা লাগালাম। ইচ্ছআ করলো এসি অফ করে দিতে। তবে অফ করলাম না। আজ গরম ভীষণ।
রুমে কেউ নেই। একা একা। সুইসাইড করার এখন ই সময়। আমি ক্যালেন্ডারের পাতা আর কলম হাতে নিলাম। হাত কাঁপতে থাকলো। দুইটা চোখ আমার ঝাপসা হয়ে আসলো। এভাবে নিজেকে আর নিজের পেটের বাচ্চাকে আমি শেষ করে দিবো সেটা কল্পনাতেও ভাবিনি।

সেখানে লিখলাম,

“তারানা আপা ও সুলতানা আপা তোমরা দুজনের কাছেই আজ আমি লজ্জিত। তোমাদের ছেলে বাচ্চা আর দুনিয়ায় দিতে পারলাম না। তোমাদের ভালোবাসার মান রাখতে পারলাম না আজ। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও। পাষণ্ড স্বামীর ঘর করার থেকে না করাই ভালো মনে হলো। আমার বাবা মারা গেলো। অথচ আমি? বাসা থেকে বের হয়ে বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না। যখন বারান্দার ফাকে বাবার লাশবাহী খাটিয়াটা দেখলাম, তখন নিজেকে মনে হলো দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় প্রাণী। এই অসহায়ত্বের বুঝা নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। তবে অপরাধীর মতো মুখ লুকিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছি। যখন শুনলাম আমি মা হতে চলেছি, তখন নতুন করে একটা স্বপ্ন বুনতে চলেছিলাম নিজের ভেতর। তারপর যখন সালমানের, শাশুড়ির ছেলে বাচ্চা চাই ছেলে বাচ্চা চাই বলে আবদার শুনেই যাচ্ছিলাম তখন ভয় পেয়ে যাই। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া ছিলো, “আমার যাতে ছেলে বাচ্চা হয়”
আজ সেই আশাও পূর্ণ হতে চললো। ছেলে বাচ্চার মা হতে চলেছি আমি। তবুও সেই বাচ্চাটা সহ নিজে মরতে বসেছি। আমার এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। একমাত্র আমি নিজেই এর জন্য দায়ী। মাকে আর দেখা হলো না সাদা শাড়িতে কেমন লাগে। আমার ভাই দুইটার ভবিষ্যৎ কী আমার জানা নেই। সুলতানা আর তারানা আপা, তোমাদের ভালোবাসার কোনো মূল্য আমি দিতে পারিনি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও তোমরা। মুনার বিয়ে হবে শুনেছি। মেয়েটা সুখে থাকুক। তার উপর কোন ক্ষোভ আমার নেই। মেয়েরা স্বামীর ঘরটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনে থাকে নিজেদের মনের মধ্যে। মুনার সেই স্বপ্নটা পূরণ হোক। তার ভাইয়ের মতো কোনো ছেলে যাতে তার জীবনে না আসুক।আমাদের শাশুড়ির মতো শাশুড়ি যাতে তার কপালে না জুটুক এই দোয়া করি।
আমি চললাম চিরতরে….

তারপর ওড়না ফ্যানের মধ্যে প্যাচালাম। জীবনটাকে শেষ বারের মতো উপলব্ধি করতে চেষ্টা করলাম। খাটের সাইডে রাখা বক্সের উপর পানির গ্লাস ছিলো। এক গ্লাস দুধও রেখে গিয়েছে তারানা আপা। দুধ খেতে ইচ্ছে হলো। এক চুমুকে এক গ্লাস দুধ খেয়ে নিলাম জীবনে শেষবারের মতো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলাম আরেকবার। বারান্দার গ্লাস টেনে আমার বাবার টিনশেডের ভাড়া বাসার দিকে তাকালাম এক নজরে। বাসাটার সামনের টাঙানো তারে একটা সাদা শাড়ি ঝুলছে এখনও। শাড়িটা হয়তোবা আমার বিধবা মায়ের। বিধবার শাড়িতে মাকে কেমন লাগে সেইটা আর এই জন্মে দেখা হলো না…।

লেখা: Midhad Ahmed

(চলব)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here