‘নিশীথচিত্র'(৩০)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
____________
বিস্ময় রাগ সব মিলিয়ে থমথমে পরিবেশ। দীপ্তির সত্ত্বা পারলো না চুপ থাকতে।আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো
–“ভাইয়া রিপা কিভাবে?তুমি হয়তো ভুল শুনেছো কোথাও একটা। ”
দিহানের রাগ বাড়লো যেনো
–“আমি ভুল শুনেছি আর তুই ঠিক?”
দীপ্তি আটকে থাকা দমটুকু ছেড়ে বললো
–” ভাইয়া রিপার মাধ্যমে তনয় ভা ভা ভাইয়া আমার সাথে যোগাযোগ করতো। তনয় ভাইয়া সব হেল্প রিপার কাছ থেকে নিতো।আমি সবটা জানি।রিপার মধ্যে এরকম কিছু ছিলো না যা তুমি বলছো।”
দীপ্তির ভয় কাটছে না।দিহানকে ভুল বানিয়ে দিলে দিহান যদি আরও রেগে যায়?তবুও দীপ্তি দম নিয়ে আবার বললো
–” আর ভাইয়া রিপা তোমাকে পছন্দ করে।আর সেটা রিনি জেনে ফেলেছিলো।সে নিয়ে অনেক ঝামেলাও হয়েছে।রিপার সাথে আমার সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে গেছে অনেকটা ।”
দিহানের ঝটকা লাগলো।খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পেছনের দিকে তাকালো।রিনি ততক্ষণে হেটে অনেক দূর।আবার সামনের দিকে তাকালো।অসস্তি লাগছে। মাথা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় রাগের মাথায় রিনিকে বলা কথাটা নিউরনে আঘাত হানছে বারংবার।
_____________
মন চাইছে দৌড়ে রিনির কাছে যেতে কিন্তু কোথাও আবার বাধাও ঠেকছে।দিহান নিজেকে স্থির করলো।এপাশ ওপাশ পায়চারী করে নিজেকে নিজেই শান্ত হতে বলছে মনে মনে।
দিহান তনয়ের সামনে থামলো।কাধে হাত দিয়ে বললো
–“দীপ্তুর সাথে এভাবে কখনও দেখা করবি না।এভাবে একটা মানুষের চোখে পরলেও হুলুস্থুল কান্ড ঘটতে পারতো।ফোনে যোগাযোগ করিস ওর সাথে।আর যদি কখনও দেখা করার কথা ভাবিস তাহলে আমায় বলিস।আমি নিয়ে যাবো।আবার ভাবিস না তোদের মধ্যে হাটবো। তবুও আমায় না জানিয়ে আমার বোনকে একা কোথাও নিবি না।”
দিহান দীপ্তির দিকে তাকালো
–“দীপ্তু ওর সাথে কিন্তু আমার ছোট বেলা ঝামেলা ছিলো।যদি বলে আমাকে না জানিয়ে দেখা করার কথা তাহলে ওর ফোন ধরবি না।আর আমাকে বলবি।”
দীপ্তি না চাইতেও হেসে ফেললো।ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তনয়ের মুখে হালকা হাসির রেশ।দিহান তাড়াহুড়ো গলায় বললো
–“পাঁচ মিনিট পরে বাসায় দেখি জানো তোকে।”দিহান আর থামলো না। সোজা দৌড়।
তনয় দীপ্তি দিহানের দৌড় দেখছে হা করে।কিছুক্ষণ বাদে তনয় হালকা খুক খুক করে কাশলো
–“তোমার ভাই শান্তশিষ্ট হলেও পাগলাটে আছে।”
দীপ্তির হুস ফেরে।মানুষটার পাশে এখন সে নিতান্তই একা। দীপ্তির লজ্জা যেনো আষ্টেপৃষ্টে ধরলো তাকে।
_____________
ঘরে এসে দেখলো রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। দিহানের মন চাইলো দরজার সাথে মাথা টাক দিতে।থেমে না থেকে দৌড়ে ঘরের বাইরে থেকে দীপ্তির রুমের জানালায় এসে দাড়ালো। দিহানের বুক ধক করে উঠলো । রিনি অঝোরে কাদছে শুয়ে শুয়ে।শরীরের কাপনেই কান্নার পরিমাপ করতে পারছে দিহান।দিহানের অনুভূতি আরও তেতো তেতো হয়ে গেলো।
রিনিকে ডাকলো না আর।রুমে যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।মাথার উপর কষ্টময় চিন্তা নিয়ে হাত দুটি রাখলো। আর চোখ জোড়া ঝুলে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে নিবদ্ধ।
খট করে দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।মাথা জাগিয়ে দেখলো দীপ্তি এসেছে।দীপ্তিকে না ডাকতেই দীপ্তি দিহানের রুমেই এলো।থমথমে ভোতা মুখ নিয়ে।কি হয়েছে তা আর দিহানকে জিজ্ঞেস করতে হলো না।দীপ্তি খানিক অভিযোগ নিয়ে বললো
–” রিনিকে ওভাবে না বললেও পারতি ভাইয়া।আমারই খারাপ লেগেছে ও তো….”
দিহানের মন আরও নিস্তেজ হয়ে গেলো। কি একটা কাজ করে ফেললো সে!!!
দিহান কাদো সুরে ম্যান ম্যান করে বললো
–“দীপ্তি হেল্প কর প্লিজ।আমার পাগল পাগল লাগছে।”
দীপ্তি অমর্ষ স্বর টেনে বললো
–“লাগুক।লাগাই উচিত। আরও লাগুক, খুব লাগুক, বেশি লাগুক।লাগতে লাগতে রাস্তায় পাগল হয়ে দৌড় দে।আমার কি? আমি কোনো হেল্প টেল্পে নাই।”
বোনের কথায় দিহান হতাশ হলো।শক্ত গলায় বললো
–“সত্যিই পাগলামি করবো।দরজাটা একবার খুলে দে পারলে।”
দীপ্তি উঠলো। দরজার কাছে গিয়ে দুবার ডাকতেই দরজা খুলে গেলো।দরজার সামনে দিহানকে দেখে পুনরায় দরজা বন্ধ করতে গেলে দিহান আটকাতে দেয় না।প্রাণপণে ঠেলাঠেলি করেও দিহানের সাথে পেরে ওঠে না রিনি।দরজা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দেয় দিহান ।রিনি স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে।কিন্তু ইতোমধ্যেই পাশে থাকা নিজের ফোনটা দিহানের গায়ে ছুড়ে মারলো।দিহানের পেট বরাবর লাগলেও ফোনটা নিচে পরতে দিলো না হাত দিয়ে আটকে ধরলো।রিনি শব্দ করে পা ফেলে বিছানায় বসলো।দিহানও রিনির পাশে বসলো।হাতে হাত ঘষছে অনবরত নিজের।রিনি দিহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলেও পারলো না।শক্তিতে না পেরে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেদে উঠলো।শক্তিতে না পারাও এখন রিনির কাছে বেশ কষ্টের মনে হচ্ছে।বলতে ইচ্ছে হচ্ছে”সাধু সন্ন্যাসী আপনি খারাপ মেয়ের কাছে কেন এলেন?আপনিও খারাপ হয়ে যাবেন।”
রিনি বলেও ফেললো।দিহান তার উত্তর দিলো না।
–“আমি কিন্তু অনেক জোরে জড়িয়ে ধরতে পারি।দেখাবো?”
দিহানের গলায় কৌতুক।রিনির রাগ বারলো
–” এই দেখলেন আমার পাশে আসার সাথে সাথে আপনিও খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। চলে যান বলছি চলে যান।”
দিহান আবার রিনির কাছে আগায়।কানে কানে ফিস ফিস করে বলে
–“আমি মস্ত বড় খারাপ।আমাকে ভালো মনে হচ্ছে? সময় আসুক খারাপটা দেখিয়ে দেবো।হারে টু হারে।”এরপর আবার একসাথে বললো” হারে হারে বুঝলে”
রিনির রাগ আরও বাড়ে।হুট করে ফোন বেজে ওঠায় ফোন রিসিভ করে দিহান।ওপাশ থেকে ফিরোজের ভয়ার্তপূর্ণ কথায় আর বসে থাকতে পারলো না।দরজা খুলে বেড়িয়ে দীপ্তিকে বললো
–“দীপ্তি মিরা বার বার সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে। রিনিকে নিয়ে আয় তুই।”
_____________
রাত এগারোটা ছুই ছুই। দুঘন্টা আগেই ফিরোজ হাফসা ঘুমিয়ে গেছে।সারাদিনের ধকলে দুজন বড্ড ক্লান্ত ছিলো।দীপ্তি মিনিট পনেরো ধরে রিনিকে খোচাচ্ছে ছাদে যেতে মন চাইছে তার এমনটাই আবদার করছে।রিনি বিছানায় সুয়ে ফোন টিপছে আর বার বার নাকচ করে দিচ্ছে।
–“দীপ্তি আমার সত্যিই যেতে ইচ্ছে করছে না।”
–“রাতের আকাশ অনেক সুন্দর হয় রিনি।সব মন খারাপ উবে যাবে।চলোই না একবার।”
রিনি মহাবিরক্তি নিয়ে বললো
–“আকাশ দেখার এতো ইচ্ছা হলে জানালা দিয়েই দেখো।আমার সত্যিই যেতে ইচ্ছে করছে না দীপ্তি।”
দীপ্তি দম নিয়ে আরও মনোবল বাড়িয়ে নিলো।হাল ছাড়া যাবে না।দিহান তাকে হাতে পায়ে ধরে মিনতি করেছিলো যেন রিনিকে ছাদে নিয়ে আসে রাতে।পায়েই পরতে গেছিলো দিহান।দীপ্তি এক লাফে পেছনে সরে গেছিলো।
দীপ্তি রিনির হাত ধরেই টেনে চলতে লাগলো।রিনি ওড়নাটাও নিজের সাথে আনতে পারলো না।প্রয়োজনও অনুভব করলো না।দীপ্তির টেনে নিয়ে যাওয়ার গতিতেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে চলছে।
ছাদের পাশে দাড়ালো দীপ্তি, রিনি।রিনি প্রাণ ভরে নিশ্বাস টানলো।শীত প্রায় পরেই গেছে।ঘরের মধ্যে একদমই শীত লাগে না।কিন্তু ছাদে আসার পরে হালকা শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে। তবে সহ্য করা যাবে না এমন না।আকাশের তারা গুলো মিটমিট করে জ্বলছে।সবাই যেনো তমশার সাথে খোশগল্পে মত্ত।তমশা যতই গাঢ়ো ততই তারারা নিজেদের আলো বাড়িয়ে দিচ্ছে।রাতের মন খারাপ থাকাটা তারারা ঠিক মানতে পারছে না তাই ই তারা নিজের আলোতে আলোকিত করে তমশাকে একটু হলেও আলো উপহার দিচ্ছে।।রিনির আফসোস হলো।তার মান ভাঙাতে তারাটা কেন আসছে না? রাগ লাগলেও মনেও কোথাও একটা ধ্বনিত হয় যে “সে আসুক। এসে আমার সব কষ্ট মান অভিমান রাগ শুষে নিয়ে যাক।”
রিনি কাধে হাতের ছোয়া পেলো। প্রাণ ভরে আবার নিশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো
–“দীপ্তি তারা গুলো কি সুন্দর তাই না?
একটা পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠলো
–“হুম খুব সুন্দর।একদম আমার মতো ”
রিনি চমকালো।আশেপাশে তাকালো।কোথাও দীপ্তির ছায়া টুকুও নেই । এতো তালবাহানা করে
নিয়ে আসার মানে টা বুঝতে বাকি রইলো না।এই রাতে লোকটা মজা করছে!রিনি কাধ থেকে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিলো।
রিনি তেজি গলায় বললো
–“এখানে কেন আপনি? চলে যান বলছি।”
দিহান হিশ হিশ করে থামতে বললো।রিনিও থতমত খেয়ে থেমে গেলো।
–“এতো জোরে কথা বলছো কেন রিনি? এলাকার মানুষ আমাদের ছাদে চলে আসবে। চলো ওদিকটায় চলো আড়াল আছে”
দিহান রিনি আসবে নিজে থেকে সে ভরসায় থাকলো না।হাত ধরে টেনেই হাটা শুরু করলো।রিনি পা দমানো শুরু করলো সে কিছুতেই যাবে না।দিহান হায় হায় করে উঠলো
–“করছো কি তুমি? এই বরাবর আব্বা আম্মার রুম। ”
–“তাহলে তো আরও শব্দ করবো”
রিনিকে থামাতেই দিহান চকিতে বলে উঠলো
–“আল্লাহ রিনি তুমি জানতে আমি আসবো তাই না?”
–“কেন এমন মনে হলো আপনার?”
–“এই যে তুমি ওড়না পরে আসো নি।কয়মাস আগেই তো এটা তোমার সেরা অস্র ছিলো।আমায় হুশহীন লোক বানাতে চাইছো বুঝি?” দিহান ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বললো।
রিনির চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো।এই লোক কৌতুক করে তাকে লজ্জা দিলো নাকি সকালের মতো অপমান করলো?
আবছা নীলচে আলোয় দিহানের শয়তানি মার্কা হাসি দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দিহান রিনিকে টেনে বসিয়ে দিলো।নিজেও পাশে বসলো।
–“কাটা দিয়ে কাটা তুলতে হয় বুঝলে?
চলবে,’নিশীথচিত্র'(৩১)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে
_____________
রিনি কিছুক্ষণ ঝিম দিয়ে রইলো দুজনই। সব কিছুই কেমন বিষাদময়।আস্তে আস্তে গম্ভীর আওয়াজে বলতে আরম্ভ করলো রিনি।
–“প্রথমত, আমি জানতাম না আপনি ছাদে আছেন।আমাকে দীপ্তি জোর করে টেনে এনেছে তাই যেমন ছিলাম তেমনই এসেছি।দ্বিতীয়ত কি বলেন তো, দিহান ভাই,লজ্জা এমন একটা জিনিস যেটার মানুষের নিজস্ব চলাফেরায় বা পরিবেশ প্রচালনায় প্রকাশ পায় কিছুটা। যেমন ধরেন নায়িকারা সর্ট ড্রেস পরে, যতোটুকু তাদের লজ্জার সীমাবদ্ধতা সেটুকু ঢেকেই সর্ট ড্রেস পরে।তারও কিন্তু ওটাই লজ্জা।আর আমি আগে ঘরের বাইরে ভেতরে ওড়না ছাড়াই চলাফেরা করেছি।কারণ আমার পরিবেশ, বন্ধু বান্ধব বেশির ভাগ ওমন ছিলো।কিন্তু আপনার কাছে সেটা ছিলো সিরিয়াস ইস্যু। আমার কাছে কিন্তু একদমই দুধভাত।তাই ই আমি লজ্জা দিতাম আপনাকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে নিজের লজ্জাকে আজ যেখানে সীমাবদ্ধ করেছি সেটাই এখন আমার লজ্জা।হুট করে এখন বাইরে আমি ওড়না ছাড়া চলাফেরা করতে পারবো না।আর আপনার সাথেও চাইলেই আগের মতো করতে পারবো না।সময়ের ব্যবধানে আস্তে আস্তে অনেক কিছুই পাল্টেছে।সবই পাল্টায়।”
প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাড়ায় রিনি।মনযোগ দিয়ে শুনছিল দিহান।তার রিনি বড় হয়ে গেছে, বোঝার পরিপক্কতা এসেছে তবে পাগলামি যায় নি।সব ভালো লাগলেও রিনির উঠে যাওয়াটা ভালো লাগলো না।দ্রুত রিনির হাত টেনে ধরে। রিনি সরু চোখে তাকায়।দিহানের ভালো লাগে রিনির রাগটাও।
সুস্থ মেজাজে বলে
–“রিনি তুমি যেমন জটিল ব্যাপারটার একটা সহজ যুক্তি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে।তেমন আমার জটিলতারও সহজ কিছু স্বীকারোক্তি আছে।রিনি আমি একটু ভুল বুঝেছিলাম।শোভন সেদিন আমাকে বললো রিপার সাথে তনয়ের নাকি গলায় গলায় ভাব অন্য কোনো ছেলেকে নাকি পাত্তা দেয় না।এমন কথায় আমি ধরে নিয়েছিলান ওদের সম্পর্ক আছে।দীপ্তুকে আমি জানাতাম কিন্তু বিয়ের তোরজোরে খেয়ালই ছিলো না।সেদিন যখন ওদের কথা বলতে দেখলাম আর তুমি পাহারা দিচ্ছিলে দীপ্তুকে বাধা না দিয়ে।আমার রাগটা বেড়ে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছিলো হয়তো।আমার বোন প্রতারিত হচ্ছিল এমন টাই মনে হচ্ছিলো।তুমি যেমন খোলামেলা ভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করো, দ্বিধা নেই ভয় নেই। দূর থেকে দীপ্তিকে দেখেও তেমন মনে হয়েছিলো।ফেস এক্সট্রাকচার আমি ভালো লক্ষ্য করতে পারি নি দূর থেকে।তাই বলেছিলাম তোমার মতো বানাচ্ছো।আই সুয়্যার রিনি আমি এর বাইরে বাজে কোনো মিনিং করি নি।আর একটু আগে তোমায় শুধু লজ্জা দিতে চাচ্ছিলাম।আজ রাগারাগি না হলে তুমি এই কথাটায় কমলা লেবুর মতো হয়ে যেতা।কিন্তু পরিস্থিতির জন্য তোমার হয়তো রাগ বেড়েছে।সরি।”
দিহান একনাগাড়ে কথা গুলো বলে থামে।ঘন ঘন নিশ্বাস নেয়।আবার বলে”আমি কি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি রিনি?”
দিহানও উঠে দাড়ায়।একই প্রশ্ন আবার করে।রিনির বেশ গুরুগম্ভীর জবাব।
–“আপনি যা বললেন সবটাই হয়তো ঠিক।সহজেই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু আমি গ্রহণ করতে পারছি না দুহান ভাই। সরি।তনয় ভাইয়ার সামনে কথাটা শুনে আমার নিজেকে নর্দমার কীট সমতুল্য মনে হয়েছিলো।”
দিহান থমকে যায়।বিশ্রি অনুভূতি হয় বুকের পাজরে।অজান্তেই কি বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললো?নয়তো তার রিনি অভিমান, রাগ এসব ধরে থাকার মেয়ে?
রিনি দাড়ায় না।দ্রুত পা বাড়ায় দিহান কিছুক্ষণ ঝিম দিয়েই ছিলো।যতক্ষণে খেয়াল আসে রিনি অনেকটা এগিয়ে।দিহান দৌড় শুরু করে নিশব্দ পায়ে যতটা সম্ভব।এই রাতে আব্বা আম্মা উঠলে কেলেংকারী হবে।পেছন থেকে রিনিকে টেনে ধরে।রিনি ছাড়ানোর পায়তারা করলেও সম্ভব হয় না। কিন্তু দিহান ছাড়তে নারাজ।রিনির এই রাগ অভিমান তাকে বড্ড পোড়াচ্ছে।বড্ড বেশি। ধস্তাধস্তি করেই নিজের রুমে নিয়ে আসে।খোলা রুমে বসে বুঝাতে পারবে না।রুমে ঢুকে দরজাটা আটকে দেয়।
রিনি নিচু আওয়াজে বললো
–“দিহান ভাই হচ্ছেটা কি?”
দিহান বাচ্চাদের মতো মুখটা রিনির চোখে মিস হয় গেলো রুম পুরোপুরি অন্ধকার থাকার কারণে।
–“যদি তুমি আমায় মাফ করে দাও তাহলে ছেড়ে দেবো প্রমিস।”
রিনি হালছাড়া গলায় বলে
–“দিহান ভাই ছেড়ে দেন আমার এখন এসব কথা ভালো লাগছে না।আমি রাগ নেই ছেড়ে দেন।”
–“কষ্ট তো পেয়েছো?”
–“কষ্ট চাইলেই ভোলা যায় না দিহান ভাই।দাগ থেকেই যায়।”
–“আমি চাই না দাগ থাকুক।একদম চাই না।”
রিনি কিছু না বলে হাতের বাধন ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।রিনির জেদ বেড়ে যায়।ধস্তাধস্তি আরও শুরু হয়।আজ দিহানের শক্তিকে তার কাছে অসুরে শক্তি মনে হচ্ছে।হাত কোনোমতে ছাড়ানোর যো নেই।ক্ষুদ্র ধস্তাধস্তি যে বৃহৎ আকার ধারণ করবে তা কারোই জানা ছিলো না।দুজন নারী পুরুষ একান্তে থাকলে সেখানে তৃতীয়জন হয় শয়তান।হুট করে দুর্ঘটনার মতোই দুজনের সংস্পর্শ গভীর হয়ে যায়।হঠাৎ ঘটিত ব্যাপারে দুজনেই বেশ অপ্রতিভ হয়ে পরে।
___________
রাত তিনটা পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ। অত্যন্ত ক্লান্ত ব্যাথা জর্জরিত পায়ে রিনি রুমে প্রবেশ করে। দীপ্তি ভুশ ভুশ করে ঘুমাচ্ছে।বাথরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দেয় বার বার।রাগ, অভিমান,জেদ শূন্য মানুষ মনে হয় নিজেকে দেখে।কিন্তু বুকের মাঝে এখনও চিনচিনে ব্যাথা।কথাটা ভোলা সম্ভব হয় নি হয়তো।দাগ কখনও যায় না।তবে আজ খুশি হওয়া উচিত নাকি রাগ হওয়া উচিত জানে না রিনি।খুশি হবারও কারণ নেই রাগেরও কারণ পাচ্ছে না।দোষ কারোরই ছিলো না আর দিলে দুজনেরই সমান।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম ভর করে তার আঁখি পল্লবে।
অন্যপাশে দিহানের চোখে ঘুম নেই । তবে ভুল করার পর তা নিয়ে অনুশোচনা করেও লাভ নেই সে জানে।সে গোসল করে নামাজ পরে নেয়।আল্লাহর দরবারে চোখের জল ছেড়ে দেয়।সম্পর্কটা আরও জটিল হয়ে গেলো তাদের।সূর্য নিজের আলো ছড়ায় সময়ের সাথে।আলো দেখতে দেখতেই দিহানের চোখ লেগে আসে।
_____________
ঘুম থেকে উঠেই রিনির মনে পরে তার গোসল করা হয় নি। রাতে দিহান মাত্র একটা কথাই বলেছিলো “গোসল করে নিও।”এছাড়া একসাথে যতক্ষণ ছিলো আর কোনো কথা হয় নি তাদের মাঝে।আশে পাশে তাকাতেই দীপ্তিকে দেখলো কোনো একটা বই পরছে।রিনি উঠে বসে শরীর চলছে না যেন।দীপ্তির দিকে তাকিয়ে ভগ্ন আওয়াজে বলে
–“দীপ্তি আমি পুকুরে গোসল করবো।”
দীপ্তি চকিতে তাকায় কিছুটা ভাবুক দৃষ্টিতে বলে
–“বারোটাও বাজে নাই রিনি।ফ্রেস হও ভাত খাও তারপর না হয়।”
–“উহুঃ এখনই করবো ব্রাশও পুকুরেই করবো। ”
–“আচ্ছা তাহলে আমিও গোসল করবো চলো।”
আসলে আবদ্ধতায় রিনির আর মন টানছিলো না।বিস্তৃত জায়গায় নিশ্বাস নিতে চায়।
পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে আছে রিনি।মাঝে মাঝে দু একবার নাড়ছে পা। শরীর অবশ হয়ে আসছে।দীপ্তি সে দিব্যি পুকুরের এপার ওপার সাতরে বেরাচ্ছে।সাতার পারে না এমন ব্যক্তির সাতার শেখা দেখা যত মজা তাকে সাতরে দেখানোটাও ততই মজা।দীপ্তি সেই আনন্দই লুটছে।পেছন থেকে হঠাৎ রিনিকে ধাক্কা দিলো।শরীরে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো।ফাটিয়ে চিৎকার দিলো।উক্ত ব্যক্তিটি আবার তার হাত পাকড়াও করলো।রিনি পিটপিট করে চোখ খোলো।মেজাজ খারাপ, লজ্জা দুটো অনুভূতির সংমিশ্রণ খেলে গেলো শরীরে।
দিহানের মুখ দেখে মনে হলো সে ব্যাপক মজা পেয়েছে। রিনিকে পা দুলাতে দেখেই তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি চেপেছিলো। দিহান আবার ছেড়ে দিতে নিলেই রিনি পরে যেতে যেতে দিহান আবার ধরে।এক ভ্রু উচিয়ে বলে
–“আগে মন থেকে কষ্টের দাগ মুছে ফেলো।তাহলেই তোমার মুক্তি।”
তিনজনের মধ্যে দীপ্তি চরম মজা পাচ্ছে।পানির মধ্যে হেসে হেসে দুই ঢোক পানি ভুলে গিলেও ফেললো। নাকে মুখেও গেলো কিছু। কাশতে কাশতে ঘাটে এসে বসলো।
রিনির চেহারায় চিন্তার ছাপ।দিহান ফিসফিস করে ব্যথিত গলায় বললো
–“নিনিপাখি, মায়াবতী প্লিজ!আমি পুড়ছি।গন্ধ পাচ্ছো না? তোমার বুকের দাগ থুক্কু তোমার মনের দাগ আমায় পোড়াচ্ছে।বিলিভ।”
রিনি ডিম ডিম চোখ করে তাকিয়ে আছে।কি বলবে ভাষা নেই।তবে বেশ হাসি পাচ্ছে লজ্জার কারণে হাসতে পারছে না।প্রচুর হাসি দমিয়েও রাখতে পারছে না।ভেতর থেকে হাসির বেগে ঠোঁট উপচে হাসি বের হয়ে এলো।দিহান অন্যহাতটা নিজের বুকে রাখলো প্রশান্তিতে।
দিহানের খেয়াল নেই সে ওভাবেই ধরে অপলকে তাকিয়ে আছে।নারীর সৌন্দর্য্য আসলেই পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর বিষয়।
রিনি চোখ মুখ কুচকে বলে
–“আমার শরীরটা ভালো নেই।এভাবে ঝুলে থাকতে পারছি না। পায়ে ব্যাথা হচ্ছে।”
দিহান টেনে সোজা করে।যত্নমাখা কন্ঠে বলে
–“গোসল করবা না?”
–“করতেই তো আসলাম।কিন্তু ভয় করছে।ঘাটে শ্যাওলা অনেক যদি পিছলে যাই? “ঠোঁট উল্টায় রিনি।
আমি আছি আসো।দিহান পানিতে নেমে যায়।রিনি ওড়নাটা ভালো ভাবে বেধে নেয়।দিহানের হাত আগলেই এক ঘাট দুই ঘাট করে নামতে থাকে।
দিহান উপদেশ কন্ঠে বলে,
–” লিসেন রিনি,হাত দুটো ধরে শুধু পা নাড়াবে।ভয়ের কিছু নেই।আমি ছাড়বো না।”
রিনি নির্ভয়ে এগিয়ে যায়।সেটা বাইরের লুক কিন্তু ভেতরে খানিকটা ভীত সে।তবুও ভরসার জায়গাটা দৃঢ়।
দীপ্তির ঠোঁটে অদ্ভুত হাসির ঝিলিক।হয়তো ভাবছে এমন মোহনীয় মুহুর্ত তার কবে আসবে।সে নিজেও দিহান রিনির পাশে পাশে সাতার কাটবে বলে এগোয়।
দু তিন মিনিট পর রিনির পা চলছে না।দিনের বেলা শীত না লাগলেও এখন লাগছে।তবে এভাবে সাতার কাটার ইচ্ছে দমাতে পারছে না অদ্ভুত সুন্দর আনন্দ হচ্ছে।দীপ্তি উঠে যাচ্ছে দেখে দিহান বললো
–“দীপ্তি পানি গরম দিয়ে ওয়াসরুমে রেখে ডাক দিস তখন রিনি যাবে ।”
দিহান কথা বলতে বলতে দিহান একটু বেখেয়ালি হয়েছিলো তার দরুন রিনি পানি খেলো কিছু। দিহান দ্রুত ঘাটের কাছে নিয়ে এলো। কাশি থামলে রিনি আবার ধরলো সে সাতার কাটবে।
দিহান ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ে
–“এতো ধৈর্য কই পাও রিনি? যাও দীপ্তু এখনই ডাকবে।”
রিনি বায়না ধরে।দিহান শক্ত কণ্ঠে নাকচ করে।তা দেখে রিনি ঠোঁট উল্টায়।দিহানের হাসি পায় বেশ
সান্তনা দিয়ে বলে
–“কাল আবার সাতার কাটবে কেমন? আজ তুমি অসুস্থ।”
রিনি চোখ পিট পিট করে বলে
–“কাল অসুস্থ থাকবোনা?”
দিহানের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।বিস্ময় কাটিয়ে বলে
–“না থাকবে না।”
______________
সন্ধ্যা থেকেই বসে আড্ডা দেয়। আটটার পরে ফিরোজও এসে যোগ দেয়।খাওয়া দাওয়া হলে আবার বসে তিনজন। ফিরোজ হাফসার তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যাস।রুটিন মাফিক তারা ঘুমাতে চলে যায়।দিহান দীপ্তিকে একটা ফোন কিনে দেয় আর বলে তনয়েরটা যেনো গিফট হিসেবেই রেখে দেয়।এমন সারপ্রাইজে দীপ্তি সে কি আনন্দ!!!
দিহান বোনের দিকে তাকায় সে ফোন নিয়ে মস্ত ব্যস্ত।রিনির কাছেই বসা সে।রিনির পাশে আর একটু এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে
–“দীপ্তিকে কোনো দিন কোনো কিছু দিয়ে খুশি করতে পারি নি।ও এমন একটা বিহ্যাভ করতো যেনো এটা সাভাবিক।কিন্তু আজ ওর এতো খুশির কারণ জানো?”
রিনি বলে
–” হুম কিছুটা আন্দাজ করতে তো পারছিই।”
–“হুম ঠিক ওর জীবনে তনয় এসছে তাই ই এতো খুশি।জানো আমার মনে হয় সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ পৃথিবীতে এক টুকরো খাঁটি হাসি নিয়ে আসে আমাদের জন্য।সেই হাসি আমাদের সব থেকে তৃপ্তির হাসি হয়,মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় সেই হাসিতে।”দিহান থেমে আবার বলে “তবে বাবা মায়ের উর্ধে কিছুই না।তাদের সাথে একসাথে থাকি চাইলেই কাছে পাই বলে তাদের মর্ম তেমন টের পাই না আমরা।দূরে গেলে বোঝা যায় তারা কি! ”
দিহানের ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে রিনি মাথা এলিয়ে দেয় দিহানের কাধে।তাদের কারোরই সেদিকে খেয়াল নেই তেমন।হঠাৎ দীপ্তি বলে ওঠে
–“এই ভাইয়া রিনিরে তোর রুমে নিয়ে যা।আমার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে তোদের দেখে।”
দিহান তরাক করে সরে যায়।তাল সামলাতে না পেরে রিনি মাথা ধপাশ করে বিছানার পাশে লাগে।মাথা ডলতে ডলতে মাথা তোলে সে।দেখাদেখি দিহানও এগিয়ে মাথা ডলতে থাকে।এসবে দীপ্তির তুমুল বেগে হাসি পায়।হই হই করে হেসে ওঠে।
দিহান ধমক দেয় জোরেসোরে।মেয়েটার আক্কেল জ্ঞান দিন দিন কমছে।রিনির মাথার পাশ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।কম জোরে লাগে নি। এবার শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। ক্রিম লাগিয়ে টাগিয়ে একসাথ।
দীপ্তি মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছে দিহান রিনির উল্টো দিক ফিরে।তনয়ের দেয়া ফেসবুক জিমেইল পাসওয়ার্ড দিয়ে ফেসবুক লগ-ইনও করে ফেললো।তনয় নাকি আগে থেকেই দীপ্তির জন্য আইডি খুলে রেখেছিলো। দিহান না থাকলে রিনিকে এতোক্ষনে বলা হয়ে যেতো। তার এতো খুশি কখনও লাগে নি।
দিহান থেমে থেমে রিনির কপালে ফু দিচ্ছে।আর ব্যথিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে “ব্যাথা হচ্ছে?” রিনি না বললেও আবার জিজ্ঞেস করছে একই প্রশ্ন।রিনি অতিষ্ট হয়ে বলে
–“হলো কি আপনার বললাম তো লাগছে না তেমন আর।”
–“আমি জানি লাগছে আমার জন্যই হলো এমনটা ”
দিহানের অবস্থা দেখে রিনি ফিক করে হেসে দেয়।দিহান অনিমেষ চেয়ে রইলো রিনির মুখপানে।হুট করে তার বেশ লজ্জার কথা মনে পরলো।আর বসে থাকা যায় না।
চকিতে বলে
–“আমি যাই রিনি। ঘুমাও। ”
–“আমি আসি না প্লিজ।কিছু হবে না প্রমিজ।”
–“হতে হবেও না।ঘুমাও।”
রিনি কৌতুক করে বলে
–“আপনি ভয় পাচ্ছেন দিহান ভাই।”
দিহান অকপটে বলে
–“পুরুষরা কম লজ্জা পায় এসবে ভয় তো দূরের বিষয়। পেলে আরও লুটে নেয় আর তোমার বয়সের নারীর বুদ্ধির ধার কম হয়।”
চলবে,