#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#পর্ব_2
৪.
আমি সংযুক্তারর কথা কারও সামনে বলতে পারছিলাম না। আর নিজের মধ্যে রাখতেও পারছিলাম না। আমি আগে থেকেই একটু মেয়ে বিদ্বেষী টাইপের ছেলে। ভার্সিটির এই সময়ে এসে প্রত্যেক ছেলে মেয়ে প্রেম করলেও আমার এসব ন্যাকামি লাগত। পড়াশোনা ছাড়া আর বিশেষ কোন দিকে আমার আগ্রহ কোন দিনই আসে নি। এগুলো আমার কাছে ওয়েস্ট অফ টাইম ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। এই যে আজ আমি এখানে এসেছি তাতে আমার ইমপর্টেন্ট ক্লাসগুলো মিস হয়ে গেল। একসময় এটাই ন্যাকামি লাগল তবে আজ আর কেন যেন লাগে না।
আমার বন্ধুরা বলত, এতো দিন তো পড়াশোনা করলি এখন ভার্সিটি শেষের দিকে এখন একটা প্রেম কর। মামা প্রেমটা জীবনের একটা ইমপর্টেন্ট পার্ট পরে এটা মিস করবা। এখনও সময় আছে আর তোর জন্য তো ভার্সিটির অর্ধেক মেয়ে পাগল। আর হবে না কেন দেখতে সুপুরুষ সাথে ভার্সিটি টপার। এতোদিন তো এসবসব অর্জন করলি এখন একটু চিল কর।
আমি তাদের কথায় কপাল কুচকে তাকাতাম তারা যা বোঝার বুঝে যেত আর কিছু বলত না। প্রচন্ড বিরক্তর বিষয় লাগত আমার কাছে এটা।
সেই আমি কিনা একটা মেয়েকে এক দেখাতেই,, কেউ শুনলে মান সম্মান কিছু থাকত না। মান সম্মানের ভয়ে আমি কারও সামনে কিছু বলতে পারলাম না। সারা রাত আমার ঘুম হলো না। প্রায় সারা রাত বসে বসে সিগারেট খেলাম। সারা রাতে কতোগুলো যে সিগারেট শেষ করেছি তার হিসেব আমার নেয়।
যে আমি বিয়ে থেকে পালাই পালাই করছিলাম সে আমি পরের দিন বিয়ে নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলাম যেন আমার নিজের ভাইয়ের বিয়ে। সকাল থেকেই যেন সব কাজে আমি নতুন উদ্দীপনা খুজে পাচ্ছিলাম। আমার পার্সোনালিটি ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দিল সেই একরাতের দেখা মেয়েটা যাকে কি না আমি চিনি না নাম পর্যন্ত জানি না।
শুধু জানতাম আমি তার ওই কাজল কালো চোখে নিজেকে হারিয়েছি। তার কপালের টিপে আমি হারিয়েছি, হারিয়েছি তার ওই কাচের চুড়ির রিনি ঝিনি শব্দেও। নাম না জানা ওই মায়াপরীতে আমি আমার পুরো সত্ত্বা হারিয়েছি। চোখ বন্ধ করলে সেই মেয়েকে দেখতাম। ভার্সিটিতে হাজারও সুন্দরীদের মাঝে আমি কখনও হারায় নি। ঝাউতলায় কিংবা পুকুর পাড়ে যখন কোন সুন্দরী রমনী তার একগুচ্ছ ভালবাসার ভেলা আমার সামনে এনে রাখত আমার মন চায়তো সেটা মাড়িয়ে চলে যায়।
আশেপাশে তো কম সুন্দরী ছিল না কিন্তু তাদের কারও রুপ আমাকে থমকে দাড়াতে বাধ্য করে নি যেমনটা করেছিল সেই সন্ধ্যের মেয়েটা। মনে হচ্ছিল যেন আমার সবটা ভেঙ্গেচুরে নিয়ে চলে গেছে সে। আমি বুঝলাম এটা কোন মায়া বা মোহ নয় হয়তো ভালবেসে ফেলেছি আমি তাকে।
পরের দিন বিয়ে বাড়িতে গেলাম কিন্তু মেয়েটার দেখা পাচ্ছিলাম না। বুকের মধ্যে যেন চিনচিনে ব্যথা করছিল। বন্ধুরা হয়তো কিছু আন্দাজ করেছিল তার রেশ ধরে আমাকে ক্ষেপাতে আরম্ভ করল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমার তাতে কিছুই মনে হলো না। বরং এক ধরনের ভাল লাগা খুঁজে পেলাম। এতোদিনের জমানো সব আত্মসম্মান যে আমার এ নিমিসে নিঃশেষ হয়ে গেল তাতেও আমার কিছু আসে যায় না।
বিয়ে বাড়ির ভীড়ে আমি আবারও মেয়েটাকে হাড়ালাম। যখন দেখলাম তখন মেয়েটা প্রচন্ড ব্যস্ত। এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে কাজ করে চলেছে। প্রচন্ড ইগো কিংবা আত্ম-সম্মান যেটার জন্য হোক আমি ওর সাথে কথা বলতে পারলাম না। তবে দুর থেকে শুধু তার নাম টুকু শুনলাম। কেই একজন তাকে নাম নিয়ে ডাকছে। সংযুক্তা।
সেই নামটুকুই ছিল সব। তার বেশী কিছুই জানতে পারি নি আমি। জানার চেষ্টাও করা হলো না আর আমার। বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরতেই মায়ের কল আসল বাবা অসুস্থ। মা একা সামাল দিতে পারছে না আমি যেন আসি। সেই রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। পিছনে ফেলে আসলাম হয়তো অনেক কিছু কিংবা কোন কিছুই না।
– তাহলে তুমি জানলে কি করে সংযুক্তা আমার ভার্সিটিতে পড়ে।
বিহঙ্গের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলাম। এতোক্ষন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ওর গল্প শুনছিলাম। গল্পটা বলার সময় সেকেন্ডে সেকেন্ডে ওর চোখের ভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছিল। কখনও চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তো কখনও চকচকে আবার কখনও যেন উদাসী। ও গল্পটা এমনভাবে বর্ণনা করল যেন আমার চোখের সামনে সবটা ঘটছে। আমি চোখ বুজলেই যেন দৃশ্য গুলো আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে।
বিহঙ্গ চোখ নামিয়ে এক মনে কি যেন ভাবছে। ওর চোখের সামনে সিল্কি চুলগুলো এসে ছড়িয়ে আছে। আমার অবাধ্য মনটা চাইছে ওর কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলি,
– এই ছেলে ছেলেদের চুল এতো সিল্কি হয় নাকি। চুল তো মেয়েদের সিল্কি হয়। এমন যদি সব ছেলেদের চুল হয় তাহলে তো মেয়েদের তো মুখ লুকিয়ে কাঁদার জায়গা থাকবে না।
কিন্তু পরে মনে হলো কই আর কারও চুল তো এমন দেখি নি। ও আলাদা একদম রুপকথার রাজ্য থেকে উঠে আসা রাজপুত্র। সিল্কি চুল, ঘন কালো চোখের পাপড়ি, গাড় নীল চোখের মণি, হালকা গোলাপী ঠোঁট দুটো, বলিষ্ঠ মাংসপেশী সবই যেন একেবারে পারফেক্টলি এ্যারেন্জড। ওর হাতের নখগুলো পর্যন্ত সুসজ্জিত ।
আর আমি কোথায়? শ্যামলা মেয়েরা শুধু কবি সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাসের পাতায় যায়গা পায় কোন রাজকুমারের মনে নয়। ও তো সত্যি সংযুক্তার মতো মেয়েকে ডিজার্ভ করে। সংযুক্ত সুন্দরী স্মার্ট, দেখলেই একটা গ্লামারাস ব্যাপার আসে। আমি কোন দিক দিয়েই সংযুক্তার সাথে তুলনায় যেতে পারি না।
নাহ্ ভাবনা গুলো বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। নিজের ভাবনাগুলোর বাধ দিতে আমি পাশের টেবিলের দিকে তাকালাম। সেখানে একজোড়া কপোত কপোতী বসে আছে। ছেলেটা টেবিলে থাকা ফুলটা নিয়ে মেয়েটাকে দিচ্ছে। হয়তো কিছু বলছেও ঠোঁট নড়ছে তার। ওদের দিক থেকে আমি চোখ সরিয়ে নিজেদের টেবিলে তাকালাম। এই রেস্টুরেন্টের প্রত্যেক টেবিলে একটা করে ফুলদানী আছে আর তাতে রাখা আছে তাজা লাল গোলাপ। এমনিতে আমার লাল গোলাপ মোটেও পছন্দ না। কিন্তু পাশের টেবিলের ওই কপোত কপোতীকে দেখে আমারও ইচ্ছা হলো এই ফুলটা নিয়ে বিহঙ্গকে দেয়।
নিজের ভাবনাগুলোতে বাধ দিতে পাশের টিবিলের দিকে তাকিয়েছিলাম তবে সেখান থেকে আরও উদ্ভট ভাবনার উদয় হলো। নাহ্ আর কোন দিকে তাকাব না। সোজা নিচের দিকে মুখ করে চোখদুটো চেপে ধরলাম। আর কোন উদ্ভট ভাবনা মনে আনা যাবে না। কিছুতেই না। অন্ততঃ এই ছেলেকে নিয়ে তো নয়।
বিহঙ্গ কিছুটা সময় কি যেন ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল।
৫.
বাসায় এসে দেখলাম বাবার ডাইরিয়া হয়েছে। অনেক বেশী দুর্বল হয়ে গেছিলেন তিনি। বেশ কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হবে। সেই কয়েকদিন আমার বেশ দৌড়াদৌড়ি হল। আমার বড় ভাই চাকুরির সুবাদে শহরের বাইরে থাকে। বাসায় শুধু মা আর বড় ভাবী। তাই এই কয়েকদিন আমাকে বাড়ি এবং হাসপাতাল দুটোই একা হাতে সামলাতে হলো। বাবা একজন উকিল। এই কয়েকদিন তার অনেকগুলো এপয়েন্টমেন্ট ছিল। বাবার অসুস্থতায় এই সবও আমাকে সামলাতে হল। সবসময় সব কিছু থেকে দুরে থাকা ছেলেটা হঠাৎ করে এতো দ্বায়িত্বে যেন একেবারে হাপিয়ে উঠেছিলাম ।
এই কয়েকদিনের এতো দৌড়াদৌড়িতে আমার মেয়েটার কথা একবারও মনে পড়ল না। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতেই আমি আবার ভার্সিটি যেতে শুরু করলাম। আর তার সাথে আমার ঘাড় থেকে অনেকগুলো দ্বায়িত্ব কমে গেল। আর তখন থেকেই আবার মনে মধ্যে সেই মেয়েটা জেকে বসল। বাকীরা সবাই বিয়ে থেকে ফিরে এসেছে এতোদিনে । কিন্তু সেই সংযুক্তার কোন ঠিকানা বা ফোন নাম্বার আমি পেলাম না। আর পাওয়ার কোন উপায়ও আমি চোখের সামনে দেখলাম না।
হঠাৎ একদিন মনে হল ওর নামটা দিয়ে ফেসবুকে সার্চ দেয়। এমনিতে আমি ফেসবুকে খুব একটা এক্টিভ না। সংযুক্তা নামে সার্চ দিতে প্রায় হাজার খানেক আই ডি আসল। আমি খুব ধৈর্য সহকারে প্রত্যেকটা আইডির প্রফাইল পিকচার চেক করে আমার সংযুক্তার আইডি খুজে পেলাম। ভাগ্যিস আইডি তার নিজের ছবি দেওয়া ছিল তাই চিনতে পেরেছিলাম।
ওকে ম্যাসেন্জারে নক দিলাম। কিন্তু মেয়েটা বেশ স্মার্ট। বারবার দক্ষতার সাথে আমাকে ইগনোর করে গেল। ওর এটিটিউড দেখে মনে মনে খানিকটা হাসলাম । মনে হচ্ছিল বলি, আমাকে এতো এটিটিউড দেখিও না মেয়ে আমার সব এটিটিউড তোমার সাথে সাথেই চলে গেছে। এখন এক নিঃস্ব আমি পড়ে আছি। আমাকে এসে পূর্ণ কর তুমি।
কাউকে বিষয়টা বলা খুব জরুরী মনে করছিলাম। কারন মনের মধ্যে এটা পুষে রাখতে রাখতে আমার দম বন্ধ হবার জোগার হচ্ছিল। ভাবীকে বলা যাবে না কারণ ভাবীকে বললে সরাসরি মাকে বলে দেবে। অবশেষে আমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ফ্রেন্ড ইবনীহাকে বললাম। আমার দৃড় বিশ্বাস ছিল ও আমাকে একটা উপায় বলে দেবে হলোও তাই। ওর থেকেই জানতে পারলাম তুমি আর সংযুক্তা একই ভার্সিটিতে পড়। সংযুক্তার ভার্সিটির নাম ওর প্রোফাইল থেকে জেনেছিলাম। ইবনীহার থেকে তোমার ফোন নাম্বার নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম এই অজানা উদ্দেশ্যে।
বিহঙ্গ তার আধা আধুরা গল্প শেষ করে আমার দিকে তাকাল। আর প্রায় সাথে সাথেই তারস্বরে আমার ফোনটা বেজে উঠল। টেবিলের উপর ফোনটা হালকা কেপে কেপে বেজে চলেছে। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে আছে সংযুক্তার নামটা। তার নিচে কিছুদিন আগে তোলা সংযুক্তার একটা ফ্যাবুলাস ছবি। ঠোঁট বাকা সেই হাসি দেখে আমিই ক্রাস খেয়েছিলাম। বিহঙ্গ দৃষ্টি আমার ফোনের স্ক্রিনে নিবন্ধ। ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল সেই মন ভুলানো হাসিটাও।
চলবে,,,
জাকিয়া সুলতানা
।