নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব ৩

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#পর্ব_3

৬.
আমার হাতটা বারবার কেপে উঠছে। বিহঙ্গ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওর ঠোঁটে সেই হাসিটাও বিদ্যমান। আমার ভয় করছে আমি ফোন কেটে দেওয়ার পর বিহঙ্গকে কি বলব? এক আজানা ব্যথায় বুকটা চিনচিন করছে। বিহঙ্গ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

-কি ব্যাপার হিমানী ফোনটা ধরছ না কেন?

আমি কোন রকমে মাথাটা ঝাকিয়ে ফোনটা তুলালম। ফোনের ওপাশে সংযুক্তার মুখে একরাস হাসি। সালাম দেওয়ার পরই বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল,

– কিরে তুই এমন হুট করে কোথায় চলে গেলি? আজকেও তোকে ফ্রি পাওয়া যাবে না? কত আগে থেকে তোকে আজকের কথা বলে রেখেছিলাম।

– আচ্ছা
– আচ্ছা মানে কি তুই কি আসছিস? দেখ এখন না করবি না।
– ফোনটা রাখ তাহলে না আসতে পারব। কোথায় যেতে হবে ইনবক্স করে দে।
– তুই কোথায় আছিস বল তোকে পিক করে নিচ্ছি।
– আজ তো তোমার মনে ব্যাপক আনন্দ মনে হচ্ছে।
– হুম।ছাড় তো বল কোথায় আছিস?
– কিরে লজ্জা পাচ্ছিস নাকি?
– হিমানী ?
– আমাকে পিক করতে হবে না। একটু দুরে আছি, তুই বল কোথায় আসতে হবে!
– আচ্ছা তাহলে ইনবক্স করে দিচ্ছি। ওই তাততারি আসবি কিন্তু।
– হ্যা তা তো অবশ্যই কথা দিয়েছি যে।
– আচ্ছা আল্লাহ্ হাফেজ।
– আল্লাহ্ হাফেজ।

আমি ফোনটা রেখে নিজের ডান হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরলাম। বিহঙ্গের দিকে তাকাতে পারছি না। কি বলব তাকে আমি?

– কি হয়েছে হিমানী? এনিথিং রং?

আমি মুখ তুলে বিহঙ্গের দিকে তাকালাম। ও সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করলাম আমি। মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করলাম আর মনে মনে ভাবছি আল্লাহ্ এই কোন উভয় সংকটের সামনে আমাকে এনে দাড় করালেন। বিহঙ্গ আবার বলল,

-আচ্ছা তুমি সংযুক্তাকে আমার কথা বললা না কেন?
ওর সাথে কি দেখা না করেই চলে যাব? এতোদুর এসেও আর একটি বার দেখা হবে না!

আমি নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে দ্রুত বললাম, বিহঙ্গ তুমি যেটা বলছ তা সম্ভব নয়।

– কেন?
– সংযুক্তা!
– সংযুক্তা কি বল?
– সংযুক্তা এনগেজড।
– হোয়াট?
– হ্যা

বিহঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটা ঢোক গিলে বলল, কখন?
– দুই বছর আগে।

বিহঙ্গ সামনে থাকা বোতলটা কাপা কাপা হাতে ধরল। এলোমেলো ভাবে বোতলটা খুলে কয়েক বার পানি খেল। কিন্তু যেন ওর তষ্ণাই মিটছে না। বেশ কয়েকবার পানি খেয়ে সামনে থাকা টিস্যু হোল্ডার থেকে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে মুখে বুলাল। আবারও পানি খেতে নিলে আমি বোতল ধরে আটকালাম।
ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি খুব বেশী দেরী করে ফেলেছি হিমানী ?

ওর চোখগুলো কেমন যেন ধুসর বর্ণ ধারণ করেছে বৃষ্টি নামার আগে যেমন আকাশটা ধুসর বর্ণ ধারণ করে তেমনটা। ঠোঁটটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ও বারবার জিব বের করে ভিজানোর চেষ্টা করছে । হাতগুলো কেপে চলেছে অনবরত। আমার ইচ্ছা করছিল ওর পাশে বসে ওর হাত ধরে বলতে এতো ভেঙ্গে পড়ো না প্লিজ আমি তো আছি।
কিন্তু এই সান্তনার কোন প্রয়োজন ওর নেয় কারন আমার থাকা না থাকায় ওর কোন ইফেক্ট আদও পড়ে না।

আমি ওয়াসরুমটা দেখিয়ে দিয়ে কাতর কন্ঠে বললাম, প্লিজ একটু ফ্রেস হয়ে আসুন। আপনাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

বিহঙ্গ এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল ওয়াসরুমের দিকে। আমি সেখানেই ঠায় বসে আছি। ফোনটা আবারও বাজছে। সংযুক্তার ফোন। কি করব বুঝতে ছি না?
আজ সংযুক্তার জীবনের ইমপর্টেন্ট দিনগুলোর মধ্যে একটি। সভ্য ভাইয়া, সংযুক্তার ফিয়ন্সে। এনগেজমেন্টের পর পরই তিনি উড়াল দিয়েছিলেন দুর দেশে। প্রায় দুই বছর পর দেশে এসেছেন তিনি। সংযুক্তার থেকে শুনেছি এবারই নাকি তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে সভ্য ভাইয়া।

আজ তিনিও সংযুক্তার সাথে দেখা করতে বরিশাল এসেছেন। সংযুক্তা আগে থেকেই বলেছিল সেই সময়টা যেন আমি ওর পাশে থাকি। আজ কোন ক্লাস নেয় সকাল থেকেই ওকেই সময় দেওয়ার কথা ছিল আমার। ফোনটা বেজেই যাচ্ছে, আমি আবার ফোনটা তুললাম। ফোন ধরেই সংযুক্তা বেশ রেগে বলল,

– তুই কোথায় আছিস বলতো? কোন কি সমস্যায় পড়েছিস?
– আরে না। সভ্য ভাইয়া কি চলে এসেছে?
– অলমোস্ট। আমার প্রচুর নার্ভাস লাগছে। বুঝছিস না কেন।
– নার্ভাস লাগার কি আছে। দুই বছর থেকে প্রত্যেক দিন কথা হয় তোদের। তার আগে আংকেলের ফ্রেন্ডের ছেলে হিসেবে অনেক দিনই তোদের বাসায় এসেছে। এমন নয় যে প্রথম সব কিছু । তাহলে নার্ভাস লাগে কেন?

– আসলে এনগেজমেন্টের পর ওর সাথে আর সামনাসামনি কখনও দেখা হয় নি। এটায় প্রথম। তাই নার্ভাসটা বেশী লাগছে। তুই বুঝবি না কারন তুই প্রেম করিস না।
– হয়তো।
– হয়তো তয়তো কিছু না তোকে আমার পাশে চাই ব্যাস।
– আচ্ছা বলেছি না তোর এই সময়ে আমাকে তোর পাশে পাবি মানে পাবি। দেখবি সভ্য ভাইয়া আসার আগে আমি এসে হাজির হব।
– প্রমিস তো।
– পাক্কা প্রমিস
– তুই কি কিছু লুকাচ্ছিস আমার থেকে? তোর ভয়েস এমন কেন শোনাচ্ছে?
– কেমন?
– জানি না তবে অন্য রকম।
– কিছুই না। আসলে তুই নার্ভাস তাই এমন মনে হচ্ছে।
– আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয় না।
– আসছি। আল্লাহ্ হাফেজ
– আল্লাহ্ হাফেজ

সভ্য ভাইয়া আসায় মেয়েটা বড্ড বেশী এক্সসাইটেড। খুব ভালোবাসে ও সভ্য ভাইয়াকে। সভ্য ভাইয়ার জন্য কমতো পাগলামী করতে দেখলাম না ওকে। একবার ঝগড়া হয়েছিল বলে দশটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলেছিল। পরে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে শেষ রক্ষা। তারপর থেকে সভ্য ভাইয়া আর ঝগড়া করে না ওর সাথে ও যা বলে তাই শোনে। বলা তো যায় না যে মেয়ে আবার না কিছু ঘটিয়ে ফেলে।

ফোনটা রেখে পাশে তাকিয়ে দেখলাম বিহঙ্গ ফিরে আসছে। এসে ধপাস করে বসে পড়ল চেয়ারে। আরও একবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যি বলছ তো হিমানী? সংযুক্তা,,,,

– হ্যা তুমি যা শুনেছ তা ঠিক। সভ্য ভাইয়া, সংযুক্তার ফিয়ন্সে। ভাইয়া সংযুক্তার বাবার বন্ধুর ছেলে। সংযুক্তা আগে থেকেই পছন্দ করত ভাইয়াকে বলতে গেলে প্রায় ছোট বেলা থেকেই । ভাইয়াও হয়তো করত কিন্তু কেউ কাউকে কখনও বলে নি।

প্রায় দুই বছর আগে ভাইয়ার জাপানে একটা স্কলারশিপ আসে। কিন্তু আন্টি ভাইয়াকে একা যেতে দিতে চায় নি। ওনার ধারণা ছিল সভ্য ভাইয়া ওখানে গিয়ে কোন সাদা চামরার মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলবে আর কোন দিন দেশে আসবে না। তাই উনি চায়ছিলেন উনাকে বিয়ে দিয়ে তারপর পাঠাতে।

কিন্তু সভ্য ভাইয়া বিয়ে করে এতোটা দুর যেতে রাজী ছিল না। সংযুক্তার কথা বাসায় বলায় সবাই রাজী হয়ে যায়। কিন্তু সভ্য ভাইয়া চায় নি বলে তখন সংযুক্তার সাথে তার শুধু এনগেজমেন্ট করে রাখা হয়েছিল। তারপর তারা দুই বছর চুটিয়ে প্রেম করে। ভাইয়া এক সপ্তাহ হল দেশে এসেছে বিয়ে করতে। খুব তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হবে। আর সংযুক্তাও সভ্য ভাইয়ার সাথে খুব হ্যাপি।

কোন রকমে দম বন্ধ করে কথাগুলো বলে ফেললাম। তারপর বিহঙ্গের দিকে তাকালাম। ও এখনও বিধস্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়েটার খাবার দিয়ে গেছে অনেক আগে। ও কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখটা নামিয়ে বলল, ও আচ্ছা।

ওর কন্ঠটাও প্রচন্ড ক্লান্ত শোনাচ্ছে। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই টপিক চেন্জ করার জন্য বললাম, খাবার অনেক আগে দিয়ে গেছে। ঠান্ডা হয়ে গেছে হয়তো। তুমি তো সকালে খাও নি, খেয়ে নাও।

বিহঙ্গ আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল তারপর বলল, তুমি কি করে জানলে আমি খায় নি।

– জানি না। মনে হল তাই বললাম। যাই হোক তুমি খাও। আর সরি আমি তোমাকে আর সময় দিতে পারছি না। আমার এগারোটায় ক্লাস। এখন সাড়ে দশটা বাজে আমাকে যেতে হবে।

বিহঙ্গ খাবারটা নাড়াচাড়া করছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খাবে না?
– নাহ্ আমার খিদে নেয়। আমি আসি নয়তো দেরী হয়ে যাবে।

ও একটা হাসি দিয়ে বলল, আচ্ছা।

ওর হাসিটা আমার বুকে গিয়ে লাগল। দ্রুত সেখান থেকে উঠে পালিয়ে আসতে চাইলাম আমি। কিছুটা এসে পিছনে তাকাতে দেখলাম ও এখন খাবারটা নাড়া চাড়া করছে আর কি যেন ভেবে চলেছে। মুখে ঝুলে আছে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। হয়তো সংযুক্তার কথা ভাবছে। আমার চোখ দিকে টুপ করে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল যেটাকে আমি এতোটা সময় আটকে রেখেছিলাম। দ্রুত বেড়িয়ে এলাম রেস্টুরেন্ট থেকে। আমার এই চোখের পানি কিছুতেই ওকে দেখানো যাবে না কিছুতেই না।

চলবে,,,,

জাকিয়া সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here