নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব ৪

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
#পর্ব_4

৭.
সময় চলে যায় আপন গতিতে
জীবন চলে তারই ছন্দে
তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় অনেকগুলো দিন হয়তো মাস। সময় থেমে থাকে নি, মনীষীরা বলে গেছেন সময় নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত হয় আমরা কেউ তাকে আটকে রাখতে পারে না। জীবনও ঠিক তেমন সময়ে ছন্দে সেও চলে। কোন মোড়ে বা কোন বাকে কারও জন্য এতোটুকুও অপেক্ষা করে না। অপেক্ষা না করার নামই জীবন।

সেদিনের পর থেকে আর বিহঙ্গের সাথে কথা হয় নি আমার। এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়। অস্বাভাবিক তো ছিল সেদিনের সেই বিহঙ্গের চলে আসাটা। এই এক অস্বাভাবিক ঘটনার খেসারত দিতে হয়েছে আমাকে অনেকগুলো দিনের বিসর্জন দিয়ে। সাথে হয়তো কিছু চোখের পানিরও, আর রাত জাগা সেই নিঃসঙ্গ চোখ জোড়ার।
আজ কাল আর বিহঙ্গের কথা তেমন মনে পড়ে না। কথায় আছে সময় সব ঘা শুকিয়ে দেয়। হয়তো সময় আমার এই ঘা টাও শুকিয়ে দিয়েছে হয়তো না। হয়তো চাপা পরে গিয়েছে কিছু ছাইয়ের নিচে যেটাকে ফু দিলেও আবার তীব্র বেগে জ্বলে উঠবে।

আজ আবার সেই ঘা টাকে খুচিয়ে বড় করল বিহঙ্গ নিজেই। না সে না তার আসা একটা ম্যাসেজ। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা তার নামের একটা বার্তা।
ক্লাসে ছিলাম হঠাৎ টুং করে বেজে উঠল ফোনটা। স্যারের চোখ ফাকি দিয়ে যখন ফোনের স্ক্রিনের দিকে নজর দিলাম আমার হৃদ-স্পন্দন গুলো সেখানেই থেমে গেল। আজ এতোগুলো দিন পর আবারও বিহঙ্গের নামটা আমার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল। নিশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল আমার।

বাকী ক্লাসটুকু আর আমার করা হলো না। অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে বেরিয়ে আসলাম ক্লাস থেকে। মাঠ পেরিয়ে বড় গাছটান নিচে গিয়ে বসলাম। এখন আমার কিছু সময় একলা থাকতে খুব ইচ্ছা করছে। বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে গাছে হেলান দিয়ে বসলাম। আজ আবার বিহঙ্গ আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছে কিন্তু আজও আমার জন্য না সংযুক্তার জন্য।

আমার জন্য কেনই বা দিবে? আমি ওর কে? কেও না? হ্যা ওর জন্য আমার মনে কিছু অযাচিত আবেগ আছে হয়তো সেটা ভালবাসাতেও রূপান্তরিত হয়েছে কিন্তু বিহঙ্গের কাছে এর কোনও দাম নেয়। কোন দিন ছিলও না আর থাকবে কিভাবে এই আবেগের উৎপত্তি সম্পর্কে তো সে অজ্ঞাত। ও কোনদিও বুঝতে পারবে না একটা মেয়ে ওকে ভালবেসে একা একা কতো মিলিগ্রাম চোখের পানি ফেলেছে।
আর আমি কখনও ওকে আমার মনের মধ্যে লালন করা শত শত আবেগ অনুভুতির কথা বলতে পারব না। তাই আমার এই ভালবাসাটা সবার অগচরেই রয়ে যাবে

আজ প্রথমবার আমার সংযুক্তাকে বেশ হিংসা হল। বেশ তো আছে ও সভ্য ভাইয়ার সাথে। সভ্য ভাইয়া প্রচন্ড ভাল কেয়ারিং এবং লাভিং একজন মানুষ। সভ্য ভাইয়া সবসময় নিজের সবটা দিয়ে সংযুক্তাকে আগলে রাখে। কোন কিছুই আগে সভ্য ভাইয়াকে অতিক্রম না করে সংযুক্তাকে ছুতেও পারে না। তাদের দেখলে প্রাণটা জুরিয়ে যায়।
তবুও কখনও সংযুক্তার প্রেমিকের অভাব হয় নি। এতোটা ভালবাসার মতো একটা মানুষ ওর থাকা সত্ত্বেও ভার্সিটির অর্ধেক ছেলে সংযুক্তা বলতে ছিল অজ্ঞান। সংযুক্তাও সবার সাথে কিছুদিন মজা নিয়ে ছেড়ে দেয়। আসলে সুন্দরী মেয়েরা বুঝি এমনই হয়। আশেপাশে এতো ছেলে তার জন্য পাগল তাহলে তার মজা নেওয়াতে দোষের কি?
কিন্তু এতোদিন দিয়ে পরিপূর্ণ সংযুক্তার কাছেই কেন বিহঙ্গকে আসতে হলো। সংযুক্তার তো সব আছে , বিহঙ্গ না থাকলে তো ওর কোন কিছুই আসত যেত না। কিন্তু ওই একটা মানুষের অভাব যে আমি তীব্র ভাবে অনুভব করি। বারবার মনে হতে লাগল এতো পরিপূর্ণতা সংযুক্তাকে না দিয়ে কিছুটা তো আমাকেও দিতো পারত আল্লাহ্।

আমি ভার্সিটিতে শেষের সারির মেয়েদের মধ্যে পড়ি। পড়াশোনায় মোটামোটি ভাল বলে ক্যাম্পাসে পরিচিতি আছে না হলে সবার মধ্যে চোখে পড়ার মতো আমার কিছুই নেয়। এই নিয়ে এতোদিন কোন আফসোস ছিল না যেমন ছিলাম বেশ ছিলাম। কিন্তু আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে। বড্ড বেশী।

বার কয়েক স্ক্রিনে বিহঙ্গের ম্যাসেজটা দেখে ওকে রিপ্লে দেওয়ার মনস্থির করলাম। কিন্তু বলব কি সংযুক্তার কথা বেশী সময় বললেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এটা সংযুক্তাকে হিংসা করে নয় নিজের প্রিয় মানুষটার মুখে অন্য কারও নাম শুনে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ম্যাসেজ দিলাম,, বল।

ও ম্যাসেজের রিপ্লে না দিয়ে সরাসরি ফোন দিল। আবার সেই দম বন্ধ হওয়া অনুভুতি। জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে ফোনটা ধরে সালাম দিলাম। সালামের উত্তর দিয়েই বলল,
– আছো ! ক্লাস ছিল কি? আমি কি ডিস্টার্ব করলাম?

মনে মনে বললাম আমাকে শেষ করে দিয়ে এখন বলা হচ্ছে ডিস্টার্ব করলাম কি না। তবুও মুখে বললাম, ছিল তবে এখন নেয়।
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
– জানি কিন্তু সত্যি বলছি আমি তোমাকে কোন হেল্প করতে পারব না।
– আগে শোন তো
– শোনার কিছু নেয়। আমি জানি তুমি সংযুক্তার কথা বলবা কিন্তু সংযুক্তা সম্পর্কে যা বলার তা আমি সেদিনই বলে দিয়েছি। আর কিছুই বলার নেয় আর না করার।
– আচ্ছা তবুও একটা কথা ছিল।
– সংযুক্তার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।
– আর ইউ সিরিয়াস। তুমি না বলেছিলে হলেও হতে পারো।
– হ্যা বলেছিলাম। আর হচ্ছে এখন। খুব তাড়াতাড়ি ও অন্য কারও বউ হয়ে যাবে তাই বলছি ওকে নিয়ে আর কোন সপ্ন দেখা বন্ধ করে দাও ।
– আমি ওকে নিয়ে আর সপ্ন দেখি না। সপ্ন দেখা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি
– তাহলে কি চাইছ এখন? ফোন দিয়েছ কেন?
– শেষ একটা বার সংযুক্তার সাথে দেখা করতে চাই। একটু ব্যবস্থা করে দেবে?
– কত সময়ের জন্য?কোথায় দেখা করতে চাও? কোন হোটেলে নাকি? না মানে শেষ বারের মতো দেখা করতে চাও কেন?
– তুমি কি মিন করছ?
-ওটাই যেটা তুমি বুঝেছ।
– তুমি আমাকে নিয়ে এতো নিচু মনোভাব পোষণ কর হিমানী?

– একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনেও তুমি তার সাথে শেষ বারের মতো দেখা করতে চাও বিষয়টা ঠিক হজম হলো না তাই। এটা কি কোন স্বাভাবিক বিষয় বলে তোমার মনে হয় বিহঙ্গ?

– আমি এমন কিছু কখনও ভাবি নি। এমন কিছু করার হলে অনেক আগেই করে ফেলতে পারতাম হিমানী।
– আমি রাখছি।

বলেই ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। কেন যেন আর পারছিলাম না তাই ফোন বন্ধ করে সেখানে কতক্ষণ বসে থাকলাম। নিরবে কিছু পানি বেরিয়ে এলো চোখ দিয়ে। আমি তাদের বাধা দিলাম না। আমার সকল অভিযোগ সকল অভিমান এর মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে। যদি ভালবাসাটাকেও এভাবে বের করে দিতে পারতাম তাহলে কত ভাল হতো।

৮.
এর পরও বিহঙ্গ আমার সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রত্যেকবার আমি ওকে ইগনোর করে গেছি। আসলে আমার ভালবাসার মানুষটা এভাবে কষ্ট পাবে এটা আমি নিজে দেখতে পারব না। আসলে আমিও তো ওর মতো ভালবেসে হারিয়েছি তাই কতখানি কষ্ট হয় আমি জানি। এই সমপরিমান কষ্টে আমি ওকে দেখতে পারতাম না বলেই ইগনোর করতাম।

আমি চাইলেই ওকে সান্তনা দিতে পারতাম। হয়তো ওর জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারতাম কিন্তু আমি এই সব কিছুই করি নি। আসলে সংযুক্তাকে এতোটা সুখে দেখে আর বিহঙ্গের কথা ওকে বলতে পারি নি। ও সভ্য ভাইয়াকে প্রচন্ড ভালবাসে তাই উনাকে ছাড়ার কোন কারণই নেয়। আর বিহঙ্গ , আমারই ভালবাসার মানুষ অন্য একজনের জন্য কাঁদবে তার জন্য আমি কাধ এগিয়ে দিতে পারব না। সত্যি বলতে আমি ওতোটাও উদার নয় আর না মহামানবী।

তাই এই সবের মধ্যে বিহঙ্গকে ইগনোর করাটাই শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়েছিল। কষ্ট অনেকটাই হয়েছে কিন্তু যা আমার না তা নিয়ে সপ্ন দেখাও উচিত না। নিজের মনকে বারং বার বুঝিয়েছি। কিছু চোখের পানি ফেলেছি, কিছু সময় বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠেছে কিন্তু দিন শেষে সবার সামনে আমি হ্যাপি থাকার চেষ্টাটা চালিয়ে গেছি।

হয়তো শেষ বারের মতো ওর সাথে সংযুক্তার দেখা করানো যেত। আমি বললে সংযুক্তা রাজী হতো এই বিশ্বাস আমার ছিল কিন্তু ওই যে বললাম জীবনে সংযুক্তার কখনও প্রেমিকের অভাব হয় নি আর সবার সাথে ও কিছুদিন মজা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আমি বিহঙ্গকে এভাবে দেখতে পারতাম না। আর সংযুক্তা ওর সাথে মজা করে ওকে ছেড়ে দিলে ও আরও কষ্ট পেত সাথে ভালবাসার মানুষটার উপর থেকে ওর সমস্ত বিশ্বাস চলে যেত। হয়তো ঘৃণাও করত।সারা জীবন হয়তো আর কাউকে ভালই বাসতে পারত না।
কি দরকার এভাবে কষ্ট পাওয়ার বা ঘৃণা করার তার থেকে বরং দুর থেকে মনের মধ্যে ভালবাসাটা লালন করে বেঁচে থাকুক। এতে তো আর ঘৃণা কিংবা মন ভাঙ্গার বিষয়টা থাকবে না। দুর থেকেই ভালবেসে যাবে আমার মতো ,,,
হয়তো এই জন্যই সেদিন এমন কড়া কথাগুলো শুনিয়ে ছিলাম।

৯.
আজ সেই কাঙ্খিত দিন।
আজ সংযুক্তার গায়ে হলুদ আর কালকে বিয়ে। আমাদের প্রায় সব ফ্রেন্ডরাই এসেছে। আমিও এসেছে দুই দিন আগে। বিয়ে বাড়িতে মানুষে পরিপূর্ণ আর সংযুক্তা ওর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে বলে আংকেল আন্টি কোন কিছুরই কমতি রাখেন নি।

আমি একটু দুরে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছি। আমার এতো ভীড় ভাট্টা পছন্দ না। সংযুক্তার অনুরোধে শাড়ি পড়েছি আর কিছু সময় ওর পাশেও বসেছিলাম কিন্তু এখন ভীড় থেকে একটু দুরে নিজেকে সরিয়ে এনেছি। আম্মু ফোন করেছিল উনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর চুপচাপ বসে ছিলাম।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল আর ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল বিহঙ্গের নামটা। আমার হাতটা অনবরত কাপছে আজ আবার বিহঙ্গ কেন ফোন দিল! ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল সংযুক্তার বিয়ে কবে? কিন্তু কেন জানি আমি ওকে সেটা বলি নি। আসলে বলাটা যুক্তিসম্মত মনে হয় নি তাই বলি নি। তবে ও এখন কেন ফোন দিচ্ছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল আমি সস্তির নিশ্বাস ফেলাম। কিন্তু সাথে সাথেই আবার ফোনটা বেজে উঠল। কাপা কাপা হাতে আমি ফোনটা তুললাম। ফোনটা ধরতেই বিহঙ্গ হরবর করে বলে উঠল, হিমানী তুমি এখন কোথায় আছ?

আমি কাষ্ঠ কন্ঠে উত্তর দিলাম, কেন সেটা জেনে তোমার লাভ কি?

বিহঙ্গ কিছুটা সময় হাসল তবে শব্দ করে না। তবুও ওর হাসিটা আমি ফোনের এপাশ থেকে অনুভব করকে পারছি। কিছু সময় হেসে বলল, আমি জানি তুমি কোথায় আছ!
– কোথায়?
– তুমি সংযুক্তার বিয়েতে গেছ। এখন সংযুক্তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান চলে তাই না। আচ্ছা সংযুক্তাকে কি সেদিনের মতোই লাগছে হলুদ শাড়ি পরে।

আমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসল। প্রশ্ন করলাম, তুমি কিভাবো জানলে?

– সেটা তোমার না জানলেও চলবে। তুমি আমার একটা হেল্প করতে পারবা?

আবার হেল্প আমার হৃদয়টা ধুকধুক করতে লাগল। তবে মনে মনে স্থির করে নিয়েছি ও যাই বলুক আমি সরাসরি না করে দেব। এই মুহু্র্তে কোন হেল্পই আমি ওর করতে পারব না। কোন হেল্প না।

চলবে,,,,

জাকিয়া সুলতানা

{ বি দ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ }

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here