নীলচে রঙের ভালোবাসা পর্ব ১

১.
বেশ কিছুক্ষন থেকে ফোনটা টানা বেজে চলেছে। বিন্দু পরিমাণও বিরতি দিচ্ছে না। যে ফোন দিচ্ছে সে যে অনেকটা উতলা হয়ে ফোন করছে তা বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই সময় আমার ফোনটা ধরতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। টানা সাত দিন ক্লাস, ল্যাব, প্রাকটিক্যাল, রিপোর্ট লিখা, প্রজেক্ট ওয়ার্ক করে আমি একটু সময়ের জন্য ঘুমাতে পারি নি। কাল সন্ধ্যায় এসে সেই যে ঘুমিয়েছি আর জাগনা পায় নি। গত কিছু দিনের ক্লান্তিটা একেবারে পেয়ে বসেছে আমাকে। ভয় হচ্ছে আবার কোন অসুখ না বাধিয়ে ফেলি, কিছুদিন পরই সেমিস্টার ফাইনাল। এই ভার্সিটির টিচাররা নিজেদের কি মনে করে কে জানে! সারা সেমিস্টার হেলে দুলে ক্লাস করিয়ে তাদের টনক নড়ে পরীক্ষার আগে। তখন প্রত্যেকে শুরু করে তাদের পায়তারা আর বলির পাঠা হয় আমাদের মতো নিরহ স্টুডেন্টরা।

এই সব ভাবতে ভাবতে ফোনটা হাতে নিলাম। ঘুমটা এখনও ভালভাবে কাটে নি, চোখদুটো যেন বন্ধ হয়ে আসছে বারবার। প্রায় সতেরটা মতো কল এসেছে। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ লাগছে। কোন ম্যানারস নেই নাকি। যতই প্রয়োজন হোক এতোবার কোন মানুষকে কল করা কোন ম্যানারসের মধ্যে পড়ে না। তার উপর আবার আননোন নাম্বার। কল ব্যাক করাক যেটুকু ইচ্ছে ছিল সেটুকুও আর অবশিষ্ট থাকল না। ফোনটা রেখে আবার ঘুমাতে যাব এমন সময় আবার ফোনটা বেজে উঠল। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরলাম। “আসসালামুআলাইকুম ” বলতেই ওপাশের মানুষটা সালামের উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ না করে হরবর করে বলে উঠল,

– এতোক্ষন থেকে ফোন দিচ্ছি। তুমি কি ব্যস্ত আছ? একটু দেখা করতে পারবা ?

বেশ কিছুক্ষন তাকে সালাম এবং সালামের উত্তর দেবার উপর লেকচার দিব মনে করলাম কিন্তু পরমুহুর্তে নিজেই মত পরিবর্তন করলাম। তবে ওপাশে কে সেটা জানি না। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে, তবুও বিনয়ের সাথে আবারও সালাম দিয়ে বললাম, কে বলছেন আপনি?

এবার মনে হচ্ছে তার অশান্ত মনটা একটু শান্ত হয়েছে। একটু সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে সালামের উত্তর দিল। এবার আমার মনটা ভাল হয়ে গেল আসলে যতোটা ম্যানারলেস ভেবেছিলাম ততোটা সে নয়। হয়তো সে আমার সালাম শোনে নি কিংবা অনেকটা সময় ফোন না ধরায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। সালামের উত্তর দেবার পর নিজে থেকেই বলল, আমি বিহঙ্গ।

নামটা শোনার পর আমার মনটা বড্ড বেশী অশান্ত হয়ে উঠল। এই নামের সাথে যে আমার একটা অতীত জড়িয়ে আছে। সেই বিভীষিকাময় অতীতটা আবারও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করল। অতীতের সেই ছবিগুলো একটার পর একটা চোখে ভাসতে শুরু করল। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। মনে মনে একটা ভীষন জেরে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কোন রকমে নিজে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। এতো সময় ওপাশের মানুষটা কি বলেছে তার একটা কথাও আমার কান দিয়ে ঢুকে নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কোন বিহঙ্গ?

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এতো সময় আমার কথা শোনো নি? আচ্ছা আমি বিহঙ্গ আহসান। চিনেছ?

কোন মতে গলা দিয়ে শব্দ বের করার চেষ্টা করলাম তবুও হুম এর বেশী কিছু বের হল না। কিন্তু অপর পাশ থেকে উনি আবারও বলে চলেছে, চিনতে পেরেছে? আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবে? আমি তোমার ক্যাম্পাসের বাইরে দাড়িয়ে আছি একটু আসতে পারবে?

‘আসছি’ বলেই লাইনটা কেটে দিলাম। ফোনের ঘড়িতে দেখলাম সকাল ছয়টা বাজে। আমি যতোদুর জানি বিহঙ্গ ঢাকায় কোন ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। তবে এতো সকালে বরিশাল ও কীভাবে এলো? আর আমার সাথে তার কি প্রয়োজন? আমার সাথে দেখা করার জন্য কি সে সুদুর ঢাকা থেকে বরিশাল এসেছে এতো সকালের এই শীতে কাপতে কাপতে?

মুহু্র্তের মধ্যে মনটা ভাল হয়ে গেল। ঠোটের কোনে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সেই হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেই রেডী হয়ে নিলাম। আজ অনেকদিন পর কেন যেন সাজতে মন চাইলো। বরিশালে আমার ঘোরার কোন জায়গা নেই, আসলে সাথে ঘোরার মতো কোন মানুষ নেই। তাই ক্যাম্পাস থেকে হোস্টেল আর হোস্টেল থেকে ক্যাম্পাস এটুকুই আমার বিচরন। তাই সাজগোজ কিংবা নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করার কোন আগ্রহ নিজের মধ্যে কখনও পায় না আমি। কিন্তু সেই আমার আজ নিজেকে নতুন করে সাজাতে মন চাইল। কিন্তু সময় না থাকায় ইচ্ছেটাকে মনের মধ্যেই বেধে দিয়ে বেড়িয়ে আসলাম হোস্টেল থেকে।

২.
সংযুক্তাকে আমি প্রথম দেখি একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। আমার বন্ধুর বড় ভায়ের বিয়ে ছিল। ও ছিল মেয়ে পক্ষের, বউয়ের কেউ হয়তো ছিল। বিয়েতে যাওয়ার আমার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু সব বন্ধুরা মিলে যাচ্ছিল আর আমাকে জোর করেছিল বলে যাওয়া। বিয়ে বাড়িতে গিয়েও আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। আসলে অপরিচিত মানুষদের মধ্যে আমার বেশ অসস্থি হয়।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা বর বউয়ের একসাথে করেছিল। কমিউনিটি সেন্টারের বিশাল বড় লনে আমি একা বসে ছিলাম। ভিতরে সবাই মজা করছিল, আমাকে বার বার ডাকছিল কিন্তু যায় নি। হঠাৎ এক হলুদিয়া পরীতে আমার চোখ দুটো আটকে যায়। পড়নে তার হলুদ আর নীল মিশেলে একটা শাড়ি, কোমড় সমান চুলগুলো ছড়িয়ে রয়েছে পুরো পিঠ জুরে, হাতে রিন ঝিন করে বাজছে হলুদ আর নীল মিশেলের কাচের চুড়িগুলো। পাতলা ফিনফিনে ঠোটেও ছেড়ে আছে লাল রয়ের ছোয়া, ঠোটগুলো নেড়ে নেড়ে কথা বলছে সে। মেয়েটা আমার থেকে কিছু দুরে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। হয়তো ভেতরের এতো শব্দের জন্য বেড়িয়ে এসেছে।

মনে মনে ভাবলাম মেয়েটা কি অামাদের কেউ। মানে আমি যে বিয়ে এটেন্ড করতে এসেছি সেও কি সেই বিয়েতেই এসেছে। মনে করার চেষ্টা করলাম এই কমিউনিটি সেন্টারে আজ আর কোন অনুষ্ঠান নেয়। পুরোটা আমার বন্ধুর বাবা ভাড়া করেছে দুই পরিবার উপস্থিত হবে বলে। তাই এখানে সবাই একই বিয়েতে এসেছে।

ততক্ষণে মেয়েটা কথা বলে ভিতরে চলে গেছে। আমি মেয়েটার পিছু পিছু ভিতরে ঢুকলাম। কিন্তু এতো মানুষের মধ্যে তাকে খুজে পাওয়া সহজ নয়। আর না জানি তার নাম না জানি পরিচয়। শুধু চোখের দেখা দিয়ে তো কাউকে বলতেও পারব না। একবার পুরো হলটা চোখ বুলিয়ে এক কোনায় গিয়ে বসে পড়লাম।

হঠাৎ স্টেজের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ও কনের সাথে কি যেন বলছে হেসে হেসে। ফোনটা বের করে একটা ছবি তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু এতো মানুষের মধ্যে সেটা সম্ভব হল না। কিন্তু মনে মনে একটা সান্তনা পেলাম যে আরও দুটো দিন আছে ঠিক মেয়েটাকে খুজে পেয়ে যাব। এই আশায় সেদিনের মতো সেন্টার ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম আমি।

– হিমানী তুমি শুনছ তো?

৩.
আমি যখন দৌড়ে হোস্টেল থেকে বেড়িয়ে ক্যাম্পাসের গেটে আসলাম দেখলাম বিহঙ্গ দাড়োয়ানের সাথে বসে গল্প করছে। আমার মনটা আরও ভাল হয়ে গেল। ঠোটের কোনের হাসিটা আরও প্রসস্থ হয়ে পুরো মুখে ছড়িয়ে গেল। দুর থেকে দেখেও ওকে আমার চিনতে এতোটুকু ভুল হয় নি। ছেলেটা এমনই সবার সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারে। ওর কোন অহংকার নেয় সবার সাথে অনায়েসে ভাব জমাতে তার কোন জুড়ি নেয়।

আমরা কেউ কখনও ভাবিও না যে এভাবে দাড়োয়ানের সাথে বসে চা খেতে খেতে গল্প করার কথা। খুব বেশী হলে ঢুকা এবং বের হওয়ার সময় দাড়োয়ান চাচাকে একটা সালাম দেওয়া হয়। কিন্তু কখনও সে কেমন আছে তার পরিবার কেমন আছে এসব জিজ্ঞেস করার সময় আমাদের হয় না কিন্তু বিহঙ্গ যেন তার পরিবারে পরিণত হয়ে গেছে এটুকু সময়ে। বেশ জমিয়ে হেসে হেসে আড্ডা দিচ্ছে দাড়োয়ান চাচার সাথে।

আমাকে দুরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ও দাড়িয়ে হেসে আমার দিকে তাকাল। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। পাশে দাড়াতে বলল, একটু বসে কথা বললে ভাল হতো?

আমি কোন কথা না বলে ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম। ক্যাম্পাস থেকে একটু দুরে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। এখানে সচরাচর আমাদের ক্যাম্পাসের কেউ আসে না একটু দুরে বলে। কখনও কোন ছেলের সাথে বাইরে যায় নি যেটুকু যাওয়া হয় তাও রুমমেটদের সাথে। তাই একটা ছেলের সাথে বসে কথা বলতে আমার বেশ অসস্থি হওয়ার কথা।আবার যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে তো কথায় নেয় তাই এমন লোকচক্ষুর আড়ালে আসা।

রেস্টুরেন্টটা প্রায় খালি আছে। এতো সকালে এখনও কেউ হয়তো বাড়ি থেকে বের হয় নি। আমরা কোনের একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। খাবার অডার করে ওর দিকে ফিরে বললাম, বলো এখন কি প্রয়োজন?

কথাটা বলে আমার চোখগুলো নিচু করে ফেললাম, গালগুলো লজ্জায় গরম হওয়া শুরু করেছে। আমি ওর কথা শোনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি মনে মনে। জানি না ও কি বলবে তবে মনে ক্ষীন আশা নিয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

ও অনেকটা সময় নিয়ে ওর শ্রেয়শীর কথা শুরু করল। তবে সেটা আমি নয় সংযুক্তা।ও সংযুক্তাকে ভালবাসে তাহলে আমার কাছে কি? প্রচন্ড মেজাজ খারাপ লাগছিল তবুও চুপচাপ ওর সামনে বসে থাকলাম। কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কথা বলার সময় ওর মুখটা বারবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আমার বেশ ভাল লাগছে। বলুক না অন্য কারও কথা তাতে কি কিছুটা সময় তো আমার সামনে বসে আছে। এটাই কম কিসে?

চলবে,,,,

#নীলচে_রঙের_ভালবাসা
জাকিয়া সুলতানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here