#নয়নতারা_২৩
#জেরিন_আক্তার_নিপা
নক্ষত্র সুযোগ খুঁজছে। নয়নকে এদিকে আসতে দেখলেই সে অ্যাক্টিং শুরু করে দিবে। যা আছে কপালে। দেখা যাক নয়ন তার জন্য কিছু ফিল করে কিনা। আর করলেও মুখে বলতে হবে ওকে।
নয়নকে এই বাড়িতে রান্না করতে হয় না। কাজের লোকেরাই সব কাজ করে। নয়ন শুধু নক্ষত্রর কাজগুলো করে রাখে। যেমন নক্ষত্রর কাপড় গুছিয়ে রাখা। ওর দরকারি জিনিসগুলো হাতের সামনে রাখা। তার ঘরটা আর ওয়ারড্রব আলমারি গুছিয়ে রাখা। ব্যস, তার কাজ এতটুকুই।
আজ নক্ষত্র এখনও বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। আজ কোথাও যাবে না নাকি? নয়ন ঘর গুছিয়ে বেরিয়ে এলো। তার চোখ নক্ষত্রকেই খুঁজছে।
—-ওই মেয়েটার সাথে গিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে নাকি? গায়ে পড়া শয়তান মেয়ে তো সারাক্ষণ উনার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে। উনিও তেমনই। সব পুরুষ মানুষ গুলোই এমন। না, সব না। বাবা, ইমন ভাইয়া ওরা কতো ভালো। ইমন ভাইয়া ঝিনুক আপুকে কতো ভালোবাসে। ঝিনুক আপুকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে ভুলেও তাকিয়ে দেখে না।’
নয়ন যা ভেবেছিল তা-ই হলো। নক্ষত্রকে সে ওই মেয়েটার সাথেই পেল। ওদের দু’জনকে একসাথে দেখে গা জ্বলে গেল নয়নের। মাথায় আগুন জ্বলছে তার। নয়ন নক্ষত্রকে কিছুই বলল না। কিড়মিড়ি খেয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দেখল। তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে আবার ঘরে চলে এলো।
নক্ষত্র বোকা হয়ে গেল। নয়ন ওকে আর রামিশাকে একসাথে দেখেও কিছু বলল না কেন? এভাবেই চলে গেল! আজব মেয়ে তো!
—-উনার ছোট বেলার বান্ধবী। ওদের মধ্যে প্রেম ভালোবাসাও থাকতে পারে। আমাকে তো বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে। ইচ্ছে করে করেনি। উনি মনে মনে হয়তো রামিশাকেই ভালোবাসে।’
নয়নের কান্না পাচ্ছে। সে অত বোকা কেন? কেন ওই লোকটার জন্য সে কষ্ট পায়। তাহলে কি ঝিনুক আপুর কথাই ঠিক। সে নক্ষত্রকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। একেই কি ভালোবাসা বলে? ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সাথে দেখলে কষ্ট হয়। অন্য কোন মেয়ের সাথে তাকে সহ্য করা যায় না। নয়ন বোকার মতো নক্ষত্রকে ভালোবেসে বসে আছে।
—-কেন উনাকে ভালোবাসতে গেলাম আমি? কেন? উনি কি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করবেন? বুঝবেন আমাকে? কখনো বুঝবেন না। বুঝলে আমার সামনে রামিশার সাথে এরকম গায়ে পড়ে হেসে মজা করতেন না।”
নয়ন কতক্ষণ কাঁদল। নক্ষত্র চলে আসতে পারে এই ভয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বসে কাঁদল।
নক্ষত্রর মা আজ বাড়িতেই থাকল। কোথাও বেরুলো না। রামিশা প্ল্যান করল আজ রাতে ডিনারটা বাইরে করবে। তার পক্ষ থেকে ট্রিট।
—-আমার দাদুর অসুস্থতার খবর পেয়ে আমি এসেছিলাম। মম, ড্যাড দাদুর কাছে। আমিও চলে যেতাম। কিন্তু ড্যাড ফোনে বলল দাদু এখন আগের থেকে অনেকটা ভালো। নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তাই আমি ডিসাইট করেছি কয়েকটা দিন এখানে থেকে তারপর দাদুকে দেখতে যাব। অনেকদিন পর এসেছি। ওখানে গেলে আর আসতে পারব না।”
—-ভালো করেছ বেবিডল। তোমাকে পেয়ে আমাদেরও অনেক ভালো লাগছে। আর কয়েকটা দিন থেকে যাও তুমি। আমাদের ভালো লাগবে।”
—-ওকে মাই সুইট আন্টি। দাদুর সুস্থতায় আজ আমি তোমাদের সবাইকে খাওয়াতে চাই। আজকের ডিনার আমার পক্ষ থেকে।”
—-ওয়াও গ্রেট। ”
—-নক্ষত্র আমাদের সাথে যাবে তো আন্টি?”
—-অফকোর্স যাবে।”
—-ওর বউ! নয়নতারাও কি যাবে?”
—-ওই মেয়েটাকে আবার এসবে টানছো কেন বেবিডল। ওকে আমার একদম পছন্দ না। ছেলেটা যে কী মনে করে ওই মেয়েকে বিয়ে করেছে গড জানে।”
—-আমি ওদের বলে দেখি। নক্ষত্র না গেলে আমাদেরও যাওয়া হবে না।”
—-তুমি এখনও নক্ষত্রর জন্য এতটা পাগল রামিশা। তাহলে ওকে বিয়ে করলে না কেন?”
রামিশা মুখ কালো করে বলল,
—-আমি কি একবারও না করেছিলাম আন্টি? তোমরা তো তোমার ছেলেকেই রাজি করাতে পারলে না।”
—-তুমি এখনো নক্ষত্রকে ভালোবাসো রামিশা?”
—-তোমার কাছে লুকাবো না আন্টি। হ্যাঁ বাসি। এখনও আমি নক্ষত্রকে আগের মতোই ভালোবাসি। এত বছরেও আমার মনে ওর জন্য ভালোবাসা এতটুকু কমেনি। অনেক ভালোবাসি আমি ওকে।”
—-ওই মেয়েটা নক্ষত্রকে ছেড়ে দিলে তুমি আমার ছেলেকে বিয়ে করবে?”
—-নয়নতারা নক্ষত্রকে ছাড়বে কেন?”
—-ছাড়বে। সেই ব্যবস্থা আমি করব। তুমি শুধু বলো ওই আপদ বিদায় হলে তুমি নক্ষত্রকে বিয়ে করবে।”
—-করবো আন্টি। নক্ষত্র এক বিয়ে করলে কেন, ও তিনটা বিয়ে করেও যদি আবার আমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলেও আমি ওকে বিয়ে করব।”
—-অহ রামিশা, মাই ডল। আমাকে বাঁচালে তুমি। নক্ষত্র ওই মেয়েকে ভালোবাসে না। ও শুধু জেদ করে বিয়েটা করেছে।”
নক্ষত্র নয়ন কেউই জানতে পারল না ওর মা আর রামিশা ওদের আড়ালে কী প্ল্যান করছে। নয়ন হয়তো কল্পনাও করতে পারছে না রামিশা তার ঘর ভাঙতে এবাড়িতে এসেছে। ওর হঠাৎ আগমন আগে থেকেই প্ল্যান করা। দাদুর অসুখের কথা শুনে আসেনি সে। তার দাদু সম্পূর্ণ সুস্থ। সে তো নক্ষত্রকে পেতে এসেছে।
—-নক্ষত্র শুধু আমার। আমার ওর বউ হবার কথা ছিল। আমার জায়গা আমি অন্য কাউকে নিতে দেব না। অত সহজে ওই নয়নকে নক্ষত্রর সাথে সংসার করতে দেব না আমি। নক্ষত্রর ভালোবাসা শুধু আমার জন্য। আমি ওর বউ হবো। নক্ষত্র শুধু রামিশার। নয়নতারার না।”
রামিশা ডিনারের কথাটা নক্ষত্রকে বলতে ওর ঘরে চলে এলো। নক্ষত্র এই সময় বাড়িতে থাকে না এটা রামিশা ভালো করেই জানে। সে নয়নের সাথেই কথা বলতে এসেছে।
—-নক্ষত্র কোথায় গেছে নয়নতারা? জানো তুমি।”
—-না।”
—-সেকি! তোমাকে বলে যায়নি। তুমি তো ওর বউ। ও কোথায় যায় না যায় তা তোমার জানা উচিত।”
—-বউ বলেই সিসি ক্যামেরা হয়ে উনার গতিবিধির উপর আমাকে নজর রাখতে হবে?”
—-তা না। আচ্ছা আমি ওকে কল করে জানিয়ে দেব। রাতে বাইরে ডিনার করতে যাব আমরা। তুমি যাবে তো?”
নয়ন কল্পনায় রামিশার চুল ধরে ঝুলে আছে। অনেক কষ্টে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার থেকে নিজেকে আটকে রেখেছ সে।
—-আমি যাব না।”
—- এ মা! যাবে না কেন? কত মজা হবে। নক্ষত্রও যাবে।”
—-যার ইচ্ছে হবে সে যাবে। আমার ইচ্ছে নেই। আমি যাব না।”
—-ওকে। না গেলে আর কী করার। একা তোমাকে বাসায় থাকতে হবে। একা থাকতে পারবে তুমি? ভয় পাবে না তো।”
—-না। আমি অত সহজে ভয় পাই না।”
‘অত সহজে ভয় পাই না আমি’ কথাটা বলাটা সহজ। কিন্তু ভয় না পাওয়া ততটাই কঠিন তার জন্য। একা বাড়িতে খুট করে একটা আওয়াজও তাকে ভয় পাইয়ে দিবে। কোন বিড়াল, বা সামান্য তেলাপোকা দেখলেও সে হার্টফেল করবে। ভূতের ভয় তো আছেই। নয়ন মনে মনে খুব করে চাইছে নক্ষত্র যেন তাকে একা রেখে না যায়। নক্ষত্র গেলেও তাকে জোর করে সাথে নিয়ে যাবে। সে যেতে না চাইলে বলবে, সরি রামিশা আমি তারাকে একা বাড়িতে রেখে যাব না। তোমরা যাও।
কিন্তু নক্ষত্র কি এমনটা বলবে? রামিশা তার ছোটবেলার বন্ধু। নয়নের জন্য কি ওকে ফিরিয়ে দিবে?
রামিশা নক্ষত্রকে এমন ভাবে চেপে ধরল যে নক্ষত্র মুখের উপর না করতে পারল না। সে যাবে বলে দিয়েছে। এখন নয়নকে রাজি করাতে হবে। ঘরে এসে নক্ষত্র আমতা আমতা করতে লাগল। কীভাবে বললে নয়ন না করবে না।
—-তারা আজ আমার সাথে ডিনারে যাবে?”
নয়ন তো জানেই ডিনারে রামিশা সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে। নক্ষত্র এখন রামিশার কথা তার সামনে বলছে না। নক্ষত্র জানে না রামিশা আগেই নয়নকে জানিয়ে গেছে।
থমথমে মুখে নয়ন না করে দিল। বলল,
—-না। বাইরের খাবার পছন্দ করি না আমি। বাইরের খাবার সহ্যও হয়না।”
এর পর আর নক্ষত্রর কী বলার থাকে। তারা যাবে না বলছে কিন্তু রামিশাকে সে অলরেডি কথা দিয়ে ফেলেছে। এখন না গেলে রামিশা কষ্ট পাবে। আবার গেলে নয়নতারা একা বাসায় থাকবে।
নক্ষত্র মহা দুটানায় পড়ে গেল। একদিকে বউ বেঁকে বসে আছে। তাকে মানাতে পারছে না। অন্য দিকে ফ্রেন্ডকে কথা দিয়ে ফেলেছে। এখন না যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নক্ষত্র যাবার আগ পর্যন্ত নয়নকে রাজি করানোর চেষ্টা করল। কিন্তু জেদি নয়ন শেষ পর্যন্ত তার জেদেই অটল থাকল।
বাধ্য হয়ে নক্ষত্রকে মা, রামিশার সাথে যেতে হয়েছে। বাড়ি থেকে বেরুবার পর থেকেই নয়নের জন্য চিন্তা হচ্ছে। একা কীভাবে থাকবে ও। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলেই তো নয়ন ভয়ে মরে যাবে। অন্ধকারে ভীষণ ভয় পায় সে। নক্ষত্র তাড়াহুড়ো করতে লাগল। কিন্তু রামিশা অন্য প্ল্যান করেই এসেছে। সে নক্ষত্রর মা’র কানে কানে বলল,
—-সুপাপ একটা প্ল্যান করে এসেছি আন্টি। ওই নয়নতারা এবার মজা বুঝবে। শুনেছি অন্ধকারে ভয় পায় ও। গাঁইয়া মেয়ে নাকি আবার ভূতে ভয় পায়। হাউ ফানি আন্টি। আজ ও বাসায় একা আছে। আমি যেই প্ল্যান করেছি তাতে আজ ওর পিণ্ডি চটকে যাবে। এভাবে নক্ষত্রকে না ছাড়ুক ভয় পেয়েই তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। হার্ট অ্যাটাকও করতে পারে বলা যায় না।”
নক্ষত্রর মা হাসল। ছেলে যাতে শুনতে না পারে তাই ফিসফিস করে বলল,
—-কী প্ল্যান করেছ বেবিডল? আমাকে বলা যাবে না।”
—-ওটা সারপ্রাইজ থাক আন্টি। বাসায় ফিরেই দেখতে পারবে। আ’ম শিওর তুমি ভীষণ এনজয় করবে।”
—-ও মাই সুইটি! এতদিন কেন দূরে ছিলে তুমি? আরও আগেই তুমি চলে এলে ওই মেয়ে আমার ছেলের বউ হতে পারত না। যাক, যা হবার হয়েছে। এখন আপদ বিদেয় হোক। তাতেই আমি শান্তি পাব।”
রামিশা শয়তানি হাসি হেসে মনে মনে বলল,
—-তোমাকে নিয়ে আসার আমারও ইচ্ছে ছিল না নয়নতারা। তুমি আমাদের সাথে এলে বরং আমার প্ল্যান বাতিল হতো। না এসে ভালোই করেছ তুমি। এবার বুঝবে মজা। আমার থেকে নক্ষত্রকে কেড়ে নেওয়ার জন্য কঠিন শাস্তি দেব তোমাকে। রামিশা তার শত্রুদের এত সহজে ছেড়ে দেয় না। তুমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার কথা মনে রাখবে। যেভাবেই হোক নক্ষত্রকে আমি তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবই। এটা নিজের কাছেই আমার প্রতিজ্ঞা। রামিশা সহজ চিজ না।”
চলবে____