পথে হলো দেরি পর্ব ৫

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৫

,
,
খোলা হাওয়ায় ইরা চুল খুলে দেয়।মুক্ত হয়ে এদিকওদিক দোল খায় চুলগুলো।
বাতাসে মিষ্টি ঘ্রান ভাসে।
এতক্ষণ যাবত মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা মনখারাপ গুলো ছুটে পালায়।
চুপটি করে বসে মাঠে ঘুরে বেড়ানো ছেলেমেয়েকে দেখে ইরা।
ভার্সিটিতে এসেও মন ভালো হচ্ছিল না তার।
শৌখিনের বলা সকালের কথাগুলো বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
ভেতরটা ছটফট করছিলো খুব।
বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে শৌখিন তাকে।
কিন্তু সে কোথায় যাবে?
এসব ভেবে কোন ক্লাসেও মন বসাতে পারেনি ইরা।
তাইতো ভার্সিটির পাশে এই বটগাছের নিচে ঘাসের উপর বসেছে সে।
এখানে বসে মনটা কিছুটা ভাল লাগছে এখন।
শাম্মি ক্লাস করছে।
সে আসেনি ইরার সাথে।ইরাই জোর করেনি।
তার নিজের ক্লাস করতে মন চাইছে না বলে যে শাম্মিরও চাইবেনা তা তো আর না।

এসব ভাবতে ভাবতেই কেউ পেছন থেকে বলে ওঠে,

—ইরা পাখি একা একা করো কি?

ইরা চমকে ওঠে। হঠাৎ কথা বলায় ভয় পেয়েছে সে।কিন্তু কথাটা কর্নগোচর হতেই ভ্রু কুঁচকে আসে তার।
মেজাজটা ফট করে গরম হয়ে যায়।
পেছন ফিরে রাগী চোখে তাকায়।
দেখে মুগ্ধ ।
তাদের ক্লাসমেট।প্লে বয় টাইপের ছেলে।
ভার্সিটির জুনিয়র,সিনিয়র কোন মেয়েকেই ছাড়েনা,সবার সাথেই ফ্লাট করে বেড়ায়।
ইরার সাথে হয়তো একটু বেশিই করে।
ইরাকে দেখলেই বাজে বাজে কথা বলে।কথার ছলে গায় হাত দিতে চায়।আর চোখ দিয়ে তো গিলে খায়।কেমন বিশ্রীভাবে তাকায়!
ইরা ভেবে পায়না এমন বদ ছেলের এমন সুন্দর নাম কি করে হয়?এই ছেলের নাম হওয়া উচিৎ ছিলো গুন্ডা গুন্ডা ধরনের।মুগ্ধ নামে তাকে একেবারেই মানায় না।

ইরার রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হাসে।তবে তার হাসি মোটেও মুগ্ধকর লাগেনা ইরার কাছে।
বরং বিরক্তিকর লাগে।
মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলে,

—ইরা পাখি রেগে আছে কেনো?

ইরা ধমকে ওঠে,

—আপনাকে না কতোবার বলেছি আমায় এসব উল্টোপাল্টা নামে ডাকবেননা।

মুগ্ধ ইনোসেন্ট মুখ বানায়।

—উল্টোপাল্টা নামে কখন ডাকলাম?
ওহ ইরা পাখি নামটা তোমার পছন্দ নয়?আগে বলবা তো।

ইরার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসে।
মাথা ঝুকিয়ে বলে,

—তাহলে বেয়াইন বলে ডাকবো?

ইরা আবার ধমকে ওঠে।
—এসব করে কি মজা পান আপনি?কেনো জালাতে আসেন আমায়?
প্লিজ চলে যান এখান থেকে,প্লিজ। আমাকে একা থাকতে দিন।

শাম্মি ততক্ষণে তাদের কাছে এসে হাজির হয়।
মুগ্ধর কথা না শুনলেও ইরার কথা সে ঠিকই শোনে।
অবাক হয়ে বলে,

—ওর সাথে তুই এভাবে কথা বলছিস কেনো ইরা?

ইরা চুপ করে যায়।শাম্মির সামনে মুগ্ধর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে চায়না সে।

মুগ্ধ শাম্মিকে দেখে এগিয়ে আসে।মুখটা করুন করে।বলে,

—দেখেছো ভাবি,তোমার বোন আমার সাথে কেমন করে।আমি বেয়াই হিসেবে নাহয় একটু ফাজলামিই করি।

শাম্মি সেদিকে দেখে ইরাকে বলে,

—সত্যিতো ইরা,তুই এমন ব্যবহার করিস কেনো বলতো?

ইরা জোরে নিশ্বাস ফেলে।
সে কারনটা শাম্মি কে বলতে পারবেনা।বললেও শাম্মি হয়তো বিশ্বাস করবেনা।
মুগ্ধর ভাই নিরবের সাথে শাম্মির বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।এন্গেজমেইন্ট ও হয়ে গেছে।
এরমাঝে এসব কথা বলা মানে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরানো।
ইরা সেটা করতে পারবেনা।
ইরা মুগ্ধর দিকে তাকায়।
বলে,

—সরি, ভুল হয়ে গেছে।

,

——–

রাতে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয় শৌখিনের।
মিতালীর সাথে ঘুরাঘুরি করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে তার।
রাতে খাওয়ার ইচ্ছেটাও নেই।মাঝে মাঝেই এমন ইচ্ছে হয়।
চট্টগ্রাম থাকাকালীন এই বাজে অভ্যাসটা তৈরী হয়েছে।
তৈরী হবেইনা কেনো,সেখানে তো আর মা ছিলোনা।যে জোর করে খাওয়াবে।
না খেতে চাইলে পছন্দের খাবার তৈরী করে দেবে।
শৌখিন সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠে।
নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়।
জামা কাপড় বদলে টিশার্ট আর ট্রাইজার পরে।
মায়ের সাথে দেখা করার কথা মনে ওঠে।
আসার পর থেকে মায়ের সাথে সে ভালভাবে কথা বলেনি।
মা নিশ্চিয় কষ্ট পেয়েছে।
কিন্তু কি করবে?ইরার জন্যই তো এমন করতে হচ্ছে তাকে।
ইরার কথা মনে পরতেই কপাল কুচকে এলো তার।
মেয়েটার কথা ভাবতে ইচ্ছে করেনা।
সহ্যও করতে ইচ্ছে করেনা।কিন্তু কিছুদিন আগেও মেয়েটার জন্য মায়া হতো খুব।
মেয়েটার মায়াবী মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হতো তার জন্য।
ইরার জিবনের ঘটে যাওয়া দুঃখের ঘটনা শুনলে কার না খারাপ লাগবে।
শৌখিনেরও লাগতো।
কিন্তু বিয়েটা হবার পর থেকেই ইরাকে সহ্য হয়না একদম।
মনে হয় সে শৌখিন আর মিতালীর মাঝে এসে দাড়িয়েছে।মিতালীকে তার থেকে দুরে সরিয়ে দেবে সে।

ভাবনা চিন্তা ফেলে মায়ের রুমে যায় শৌখিন।
রুমে ঢোকার আগে দরজায় টোকা দেয়।
ভেতর থেকে রেহেনা বেগম বলেন,

—শৌখিন?আয়,ভেতরে আয়।

শৌখিন হালকা করে দরজা ভেজিয়ে আসে।
রেহেনা বেগম খাটে আধশোয়া হয়ে আছেন।শৌখিন একটা চেয়ার টেনে মায়ের সামনে বসে।
আমতাআমতা করে।
সে আসলে কি বলবে বুঝতে পারেনা।
কি বলতে এসেছে তাও জানেনা।

রেহেনা বেগমই বলেন,

—কিছু বলবি?

শৌখিন কথা বলার সুযোগ পায়।মৃদু গলায় বলে,

—তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো মা?

রেহেনা বেগম সেকথার উত্তর দেননা।তিনি রাগ করবেন কি?তার ছেলেই তো তার উপর উল্টো রাগ করেছে,সেকথা তো তিনি জানেন।
ইরার সাথে বিয়ের পর থেকেই শৌখিনের তার মায়ের উপর যতো রাগ।তাছাড়া আগে তো শৌখিন এমন ছিলোনা।মাকে কষ্ট দেওয়ার কথা,মুখের উপর কথা বলার কথা ভাবতেও পারতোনা।

রেহেনা বেগম বলেন,

—ইরা মেয়েটা খারাপ না মোটেও।ও খুব ভালো মেয়ে।

শৌখিন বলে,
—আমি জানি।

—তাহলে সমস্যা কোথায়?

শৌখিন মাথা নিচু করে।সমস্যা কোথায় সে বলতে পারবেনা।মিতালীর কথা এখনি কাউকে জানাতে চায়না সে।
বলে,

—আমি জানিনা।তবে ইরাকে আমি বউ হিসেবে মানতে পারছিনা আর কখনো পারবোওনা।

—তাহলে ও যাবে কোথায় সেটা তো ভাববি?

শৌখিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
সত্যি ইরার যাওয়ার কোন জায়গা নেই সেটা সে জানে।
কিছুক্ষণ ভেবে বলে,

—ও ওর ফুপুর বাসায় তো থাকতেই পারে।
তোমার ভাস্তি হিসেবে।
আমার বউর পরিচয়ে কিন্তু নয়।

রেহেনা বেগম আশার আলো দেখেন।এতোদিন ইরার এ বাড়িতে থাকা নিয়েই ঝামেলা করছিলো শৌখিন।ইরা থাকলে সে থাকবেনা বলছিলো।
কিন্তু এখন একটু তো উন্নতি হয়েছে।
বউয়ের পরিচয় না দিক তবু এ বাড়িতে থাকতে তো বলছে।
আস্তে আস্তে না হয় আরও ভালো হবে।
তাছাড়া ইরাকে তিনি চেনেন।
মেয়েটার মধ্যে জাদু আছে।
তার মায়ায় আটকে ফেলার মতো জাদু।
কেউ ইরাকে কাছ থেকে চিনলে,জানলে তাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারেনা।
শৌখিনও পারবেনা।

তিনি বলেন,

—আচ্ছা ঠিক আছে।ও তোর বউ এই পরিচয়ে নয় বরং আমার ভাইয়ের মেয়ে এই পরিচয়ে এখানে থাকবে।

—তাহলে কাগজপত্র রেডি করি?

রেহেনা বেগম অবাক হন

—কিসের কাগজপত্র?

শৌখিন বলে ওঠে,

—কিসের আবার?ডিভোর্সের।

রেহেনা বেগম কিছুটা আঁতকে ওঠেন। এরকম কথা তিনি শৌখিনের মুখে আশা করেননি।
ভেবেছিলেন এভাবেই চলতে চলতে একসময় সম্পর্কটা ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু ডিভোর্স?
বলেন,

—ডিভোর্স কেনো?

—বারে,সম্পর্কটার যেহেতু কোন মানেই নেই তাহলে শুধু শুধু বয়ে বেড়ানোর কি দরকার?

রেহেনা বেগম পরিস্থিতি সামাল দিতে চান।
শৌখিন আর ইরার দুজন দুজনকে বুঝতে সময় দরকার তার।
বলেন,

—আমাদের বাড়ির কয়েকজন ছাড়া তো কেউ জানেনা তোদের বিয়ের কথাটা।তো এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?
সময় আসুক,আস্তে ধীরে যা হবার হবে।

শৌখিন আস্বস্ত হয়।তার মন এখন ফুরফুরে হয় বেশ।
এতোকালের বয়ে বেড়ানো চিন্তা এতো সহজে মাথা থেকে নেমে যাবে তা ভাবতে পারেনি।তাছাড়া মা ও যে এভাবে সবকিছু মেনে নেবে তা মনেও হয়নি কখনো।
শৌখিন খুশি মনে মায়ের হাত ধরে।
কৃতজ্ঞতা সূচক হাসি হাসে।
বলে,

—ঘুমিয়ে পরো মা।
আমি আসি।

—আচ্ছা।

রুম থেকে বেরোনোর পথে বারান্দায় এক ছায়ামানবীকে দেখে থমকে দাড়ায় শৌখিন।
মেয়েটা যে ইরা সে বুঝতে পারে।
তবে ইরাকে দেখে রাগ হয়না তার।শৌখিন ভেবে রেখেছে,
মেয়েটাকে এখন থেকে বোন হিসেবে মনে করবে সে।শাম্মি আর ইরাকে এক নজরে দেখবে।
তাহলে ইরার প্রতি রাগটাও থাকবেনা।

ইরা শৌখিনকে দেখে একপাশে সরে দাড়ায়।
অন্ধকার বিধায় তার মুখটা চোখে পরেনি শৌখিনের।নয়তো ঠিক ইরার চোখের পানি দেখে নিতো সে।
শৌখিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়।
শৌখিন পিছু ডাকে।

—ইরা,শোন।

ইরা থমকে দাড়ায়।তার ভয় হয়।আবার না জানি কি বলে বসে শৌখিন।

শৌখিন মৃদু গলায় বলে,

—তোর সাথে সকালে খারাপ ব্যবহার করার জন্য সরি।

ইরা চমকে তাকায়।কানে আঙুল দিয়ে কান খোঁচায়। ভাবে নির্ঘাত কানে সমস্যা হয়েছে তার।
নয়তো এমন আবোলতাবোল কথা শুনবে কেনো?

ইরাকে কথা বলতে না দেখে শৌখিন আবার বলে,

—কথা বলছিস না কেনো?

ইরা আমতাআমতা করে।
গলা আটকে এসেছে তার।কোনমতে মিনমিন করে বলে,

—কি বলবো?

কথা বলার সময় তার গলা কাপে।
শৌখিন বোঝে ইরা তাকে ভয় পাচ্ছে।
তার নিজেরই খারাপ লাগে।
মেয়েটার সাথে এতোটা খারাপ ব্যবহার করা উচিৎ হয়নি তার।কিন্তু কি করবে?
ওকে দেখলেই তো রাগ হতো।আর রাগলে কি কারো মাথা ঠিক থাকে?

সে কন্ঠ আরও কোমল করে।বলে,

—তোকে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবি।

ইরা মাথা নাড়ে।
সেদিকে তাকায়না শৌখিন। সে নিজের মতোই বলে,

—আমাদের বিয়েটা তো এক্সসিডেন্টলি হয়েছে বল?এই বিয়েটা আমার কাছে যেমন বোঝা তেমন তোর কাছেও তো তাইনা?

ইরা কথা বলেনা।
এটা ঠিক যে বিয়েটা এক্সসিডেন্টলি হয়েছে তবুও তার কাছে মোটেও বোঝা না।

শৌখিন তাড়া দেয়।

—কিরে বল?

—হু।

শৌখিন আবার শুরু করে।বলে,

—তাহলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা বয়ে বেড়ানোর কি কোন মানে আছে?
তোর আর আমার সম্পর্কটায় এতো তিক্ততা কেনো থাকবে?
আমার আর শাম্মির মধ্যে কি এমন আছে?
তুইও তো আমার কাছে শাম্মির মতোই।
আমার বোন তুই।বড় মামার মেয়ে।
তাহলে?এতো সুন্দর সম্পর্কের মাঝে ঝামেলা কেনো আনবো শুধুশুধু?

ইরার মাথায় হাত যায় আপনাআপনি।
কোথায় শাম্মি আর কোথায় সে?লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো?
বউকে কেউ বোন বানায়?

শৌখিন বলে ওঠে,

—কিরে শুনছিস?

ইরা বলে,

—হু।

–তো আমরা ওসব বিয়ে-টিয়ের কথা আর মনে রাখবোনা বুঝলি?তুই শুধুমাত্র আমার মামার মেয়ে আর আমি তোর ফুপুর ছেলে।
ঠিকআছে?

ইরা ঘাড় কাত করে।

শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
বলে,

—গুড গার্ল।
আচ্ছা মনে থাকে যেনো।

কথাটা বলেই সে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।ইরা সেদিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
নিজের ভাগ্যের উপর আজ বড্ড হাসি পায় তার।

,
,
,

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here