পথে হলো দেরি পর্ব ৬

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৬

,
,
—দশটা যে বাজতে চললো,আর কতোসময় লাগবে তোর?

ইরার ডাক শুনে শাম্মি গলা উঁচিয়ে জবাব দেয়,

—আর দু’মিনিট।

ইরা বিরক্ত হয়।দু’মিনিট দু’মিনিট বলতে বলতে দু’ঘন্টা হয়ে গেছে তবু শাম্মির আসার কোন খবর নেই।
এদিকে ভার্সিটির টাইম হয়ে এলো।
সেই যে সাতসকালে সাজতে বসেছে শাম্মি আর ওঠার কোন নাম গন্ধও নেই।
ইরা বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে ওঠে।
ডাইনিং রুমের একপাশ থেকে আরেকপাশে পায়চারি করে।
শাম্মি হন্তদন্ত হয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।
বলে,

—চল চল।কতো বাজে রে?

–এইতো মাত্র নয়টা পন্ঞ্চাশ।

শাম্মির চোখ কপালে ওঠে।
সে তাড়াতাড়ি হাত ঘড়ির দিকে তাকায়।মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে।
বলে,

—বলিস কি?এতো কখন বাজলো?
আরো আগে একটু আমায় ডাকবিনা?

ইরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।বলে,

—ডাকিনি বলছিস?কতোবার ডেকেছি তোকে বলতো?

শাম্মি মিনমিন করে।
—হু ডেকেছিলি মনে হয়।

পাশকাটিয়ে শৌখিন যেতে যায়।
শাম্মি কে মুখ গোমড়া করে থাকতে দেখে আবার ফিরে আসে।
মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলে,

—এতো সেজেগুজে কোথায় চললি?

শাম্মি চমকায়, সাথে ইরাও চমকায়।
এতোদিন পর শৌখিনের এই স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে তারা খুশি হয়।শাম্মি মুখ ফুলায়।বলে,

—আমায় মারলি কেনো ভাইয়া।আর এতো কোথায় সেজেছি?সামান্য একটু মেকআপ করেছি মাত্র।

শৌখিন চোখ বড়বড় করে।
মৃদু চিৎকার করে।
—এটাই তোর সামান্য সাজ?এটা?

একটু ব্যঙ্গ করে বলে,

—তো একটু সামান্য সেজে যাচ্ছিস কোথায়?হুম?

শাম্মি আরও মুখ ফুলায়।গাল তার গুলুমুলু আকার ধারন করে।

মুখটা ভার করে বলে,

—ভার্সিটিতে।

–এই সময় ভার্সিটি যাচ্ছিস?কতো বাজে খেয়াল আছে?
কয়টায় ক্লাস তোদের?

—আজ দেরি হয়ে গেছেরে ভাইয়া।

রেহেনা বেগম রান্নাঘরে ছিলো।
রহিমার সাথে হাতেহাতে কাজ করছিলেন।
শৌখিন আর শাম্মির খুনসুটিময় কথা শুনে তিনি ড্রয়িং রুমে আসেন।
তার চোখ ছলছল করে।
কতোদিন ছেলেটার এমন রুপ দেখেননি তিনি।ইদানীং তো সবসময় মুখ ভার করে রাখতো সে।
এগিয়ে এসে তিনি বলেন,

—ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠলে তো আর দেরি হয়না।
বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে দেরি তো হবেই।

শৌখিন ও তালে তাল মেলায়।শাম্মিকে জ্বালানোর জন্য বলে,

—ঠিকই তো।সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারিস না?কদিন পর পরের বাড়ি যাবি তখনও কি এভাবে দেরি করে উঠবি নাকি?

শাম্মি এবার মুখটা কাঁদোকাঁদো বানায়।বলে,

—সবাই মিলে এভাবে আমার পিছন লেগেছো কেনো বলোতো?আমি কিন্তু তাহলে কোথাও যাবোনা।

শৌখিন এগিয়ে আসে।
হেসে শাম্মিকে টেনে বুকে আনে।
বলে,

—আরে আরে কাঁদছিস কেনো পাগলী।আমি তো তোর সাথে দুষ্টমি করছিলাম।

আবার একটু থেমে দুষ্টু হাসে।বলে,

—তাছাড়া এমনিতেই তোকে যা ভয়ংকর দেখাচ্ছে, কাদলে না জানি কেমন দেখাবে।

শাম্মি শৌখিনকে ছেড়ে হেসে ফেলে।হাত দিয়ে বাহুতে ঘুসি মারে।
বলে,

—কথা না বলে আমায় ভার্সিটিও তো দিয়ে আসতে পারিস।কতো দেরি হয়ে গেছে আজ।

শৌখিন হাতের ঘড়ির দিকে নজর দেয়।বলে,

—হুম আমিও ওই পথ দিয়েই যাবো।
চল তোদের পৌঁছে দেই।

শাম্মি একটু চমকে তাকায়।
—তোদের মানে?

—মানে তোর আর ইরার।কেনো ইরা যাবেনা আজ?
কিরে ইরা যাবিনা?

ইরা এতক্ষণ যাবত নিরব দর্শকের দাড়িয়ে ছিলো।শৌখিনের প্রশ্নে সে মাথা দুলায়।বলে,

—হু।

—তো চল।দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?

শাম্মি, ইরা দুজনেই শৌখিনের পিছু নেয়।

গাড়িতে উঠেই শাম্মি সুর তোলে সে আজ ভার্সিটি যাবেনা।
শৌখিন ভ্রু কুঁচকায়।
বলে,

—ভার্সিটি যাবিনা তো আমার সাথে কেনো আসতে গেলি?কতোটা পথ চলে এসেছি।এখন আবার বাড়ি ফিরে যাবো?

–বাড়িতো যাবোনা।

শৌখিন অবাক হয়ে বলে,
–তাহলে কোথায় যাবি?

শাম্মি আহ্লাদি সুর তোলে।
বলে,

—আজ তোর সাথে ঘুরবো ভাইয়া।কতোদিন একসাথে ঘুরিনি আমরা।

শৌখিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
একটু ভেবে বলে,

—আচ্ছা ঠিক আছে।

গাড়ি করে একটা পার্কে এসে থামে।
পাশে আইসক্রিম দেখে শাম্মি লাফায়।সে আইসক্রিম খাবে।
শৌখিন হেসে ফেলে ওর বাচ্চামো দেখে।
দুটো আইসক্রিম কিনে একটা শাম্মি ও একটা ইরার হাতে তুলে দেয়।
ইরা এতক্ষণ যাবত চুপচাপ লক্ষির মতো বসে ছিলো।
তবে আইসক্রিম পেয়ে সে লাফিয়ে ওঠে।
তার আইসক্রিম পছন্দ।
ইরার মুখে খাওয়ার সময় আইসক্রিম লেগে যায়।
গালেও লাগে।
দেখতে পুরো কিউট একটা বাচ্চা বাচ্চা লাগে।তবু সেদিকে তার কোন হুশ নেই।সে আইসক্রিম খেতে ব্যাস্ত।

শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসে।
ছোটবেলার মতো অভ্যাস ইরার এখনো আছে।
ছোটবেলা যখন ইরার বাবা মা বেচে ছিলো তখন প্রায়ই তাদের বাড়িতে যাওয়া আসা করতো শৌখিনরা।
ইরা তখন কিউট একটা পিচ্চি ছিলো।গুলুমুলু গাল ছিলো তার।
আইসক্রিম ছিলো খুবই পছন্দ। আইসক্রিম খেতে গেলেই গালে মুখে মাখিয়ে ফেলতো।
আর শৌখিন যত্ন করে মুছিয়ে দিতো।
কথাগুলো ভেবে আরেকদফা হেসে নিলো সে।

আনমনে পকেটে হাত দিয়ে টিস্যু বের করলো।ইরার মুখের সামনে টিস্যু নিয়ে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিলো।
আকস্মিক এমন ঘটনায় ইরা হতভম্ব হলো।মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো।
শাম্মিও কম অবাক হয়নি।সেও খাওয়া বাদ দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকালো শৌখিনের দিকে।
শৌখিনের আনমনা ভাব কাটলো নিমিষেই।
এতক্ষণ কি করছিলো ভাবতেই অসস্তি হতে লাগলো খুব।
নিজের দুর্বলতা ঢাকতে হুমকি ধামকি শুরু করলো।ধমকে বলে উঠলো,

—কিভাবে আইসক্রিম খেতে হয় তাও জানিস না?মুখে লেগে কেমন বিশ্রী দেখাচ্ছিলো।আশেপাশের মানুষ এসব দেখলে মানসম্মান তো আমারই যেতো নাকি?

,

🌸🌸🌸
,
—কেমন আছো আন্টি?

রেহেনা বেগম বসে ছিলেন।সারাদিন বাড়িতে তার অলস সময় কাটে।
বাড়ির কাজের জন্য রহিমা আছে।রেহেনা বেগমকে সেদিকে নজর দিতে হয়না।তবু মাঝেমাঝে একটু হাত লাগান।তবু সারাটাদিন প্রায় শুয়ে বসেই কাটে তার।
কথাটা কানে পৌছাতে সেদিকে ঘুরে তাকান।
মিতালিকে দেখে দাড়িয়ে পরেন।চোখেমুখে খুশি উপচে পরে।মেয়েটা আগে প্রায়,আসতো এ বাড়ি।রিফাতই নিয়ে আসতো।বাড়ির মেয়ের মতো মনে হয় তাকে।
খুব সহজে মিশে যেতে পারে।তবে দুবছর এমুখো হয়নি সে।

উৎফুল্ল হয়ে বলেন,

—আরে মিতালী যে?আয় আয়।এতোদিন পর আন্টির কথা মনে পরলো তোর?

মিতালী হেসে জড়িয়ে ধরে।বলে,

–কি করবো বলো?পড়াশোনার এতো চাপ।

—বাহানা বানাস না তো।
তো কি খবর তোর?

হাত ধরে টেনে পাশে বসান।
বলেন,
—কোথায় থাকিস এখন?

—চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে।
ওখানেই হোস্টেলে থাকি।

–ওহ,হ্যা রিফাতের কাছে শুনেছিলাম মনে হয়।
শৌখিনও তো চট্টগ্রাম থাকতো।
জানিস নাকি?

মিতালি মাথা নাড়ে।
সে জানে মানে কি?সে জানবে না তো আর কে জানবে?প্রায়ই দেখা করতো দুজনে।
কিন্তু সেকথা তো আর বলা যাবেনা।

বলে,

—এসব কথা বাদ দাও তো আন্টি। আগে বলো তুমি কেমন আছো?
শরীর নাকি আরো খারাপ হয়েছে শুনলাম?
শরীরের যত্ন ঠিকমতো নাওনা?

রেহেনা বেগম হেসে ওঠেন।বলেন,

–বাব্বাহ তুই তো একদম ইরার মতো কথা বলছিস।ইরাও আমাকে এমনভাবে বলে জানিস।
মেয়েটা আমার খুব খেয়াল রাখে।
ও না থাকলে আমি হয়তো আরো অসুস্থ হয়ে পরতাম।

–ইরা এখনো এ বাড়িতেই আছে?যায়নি?

রেহেনা বেগম চুপ থাকেন।
কথাটা তার কাছে ঠিক লাগেনা।

মিতালি সেদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝে।
ইরা মেয়েটাকে তার পছন্দ না।
যতোই মামাতো বোন হোক তবুও সে বাইরের মেয়ে।তারউপর আগুন সুন্দরী।
ভুল করেও যদি শৌখিনের চোখ সেদিকে পরে যায়?এক বাড়িতে থাকলে পরতেই
তো পারে।যতো যাই হোক ছেলে মানুষ।
মিতালি ভয় পায়।শৌখিনকে হারানোর ভয়।
সেই ভয়েই তার ভেতর এক হিংসাত্মক সত্ত্বা তৈরী হয়েছে।
সে রেহেনা বেগমকে শান্ত করতে বলে,

–না মানে কথাটা অন্যভাবে নিও না।যাস্ট এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।

রেহেনা বেগম কথাটা ঠিক শুনলেন না।তার চোখ গেলো দরজার দিকে।
সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,

—তোরা ভার্সিটি যাসনি?আর শৌখিন তুই ওদের সাথেই আবার ফিরলি যে?

শৌখিন দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে মায়ের কাছে এসে দাড়ায়।
পিছু পিছু আসে শাম্মি আর ইরা।
শৌখিন বলে,

—না মা, ওরা যায়নি।
শাম্মি মিতালিকে দেখে খুশি হয়।হেসে বলে,

—কেমন আছো আপু?

মিতালিও হাসে।তবে তা বাইরে।ভেতরে তার রাগ হয়।
ইরাকে শৌখিনের সাথে আসতে দেখে তার ভেতরটা জ্বলে ওঠে।
মেকি হাসি ফুটিয়ে বলে,

—ভালো, তুৃমি ভালো আছো?
কোথাও গিয়েছিলে নাকি?

—হ্যা,ভাইয়ার সাথে একটু ঘুরতে গেছিলাম।

—ইরাও গিয়েছিলো সাথে?

শৌখিন মিতালির কথার সুর বোঝে।তার আজ দেখা করার কথা ছিলো।কিন্তু যেতে পারেনি।শাম্মির আবদার মানতেই তো তাদের সাথে ঘুরে বেড়াতে হলো তাকে।এরমাঝে মিতালীর সাথে দেখা করার সুযোগই পায়নি।
শাম্মির হয়ে সে মিতালির কথার উত্তর দেয়।বলে,

—হ্যা।ইরাও গিয়েছিলো।

মিতালি কপাল কুঁচকে শৌখিনের দিকে তাকায়।শৌখিন চোখ দিয়ে ইশারা করে।একহাত তুলে কানে হাত দেয়।
সরি বলে।
মিতালি অন্যদিকে মুখ ঘুরায়।
সে রেগে আছে।

ব্যাপারটা সবার দৃষ্টির আড়ালে ঘটলেও ইরার চোখ এড়ায়না।
সে বেশ অবাক হয়।
শৌখিনের সাথে মিতালীর ইশারায় কি কথা থাকতে পারে?
তাদের মাঝে চলছেই বা কি?

,
,
,
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here