পথে হলো দেরি পর্ব ৭

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৭

,
,
ইরার মনটা খারাপ।কেমন উদাসীন লাগে তার।একধ্যানে বাইরের প্রকৃতি দেখে।
আকাশে উড়ন্ত পাখিদের দেখে।নিজের দুঃখগুলোও আকাশে উড়িয়ে দিতে মন চায়।
উড়ে উড়ে বহুদুর ভেসে যাক তারা।
কিন্তু তা কি আর সম্ভব?
বুক চিরে ভারী নিশ্বাস বের হয়।ভেতরটা হাহাকার করে খুব।কোন আপনজনের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে।
নিজের দুঃখগুলো কারো সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে।
ভেতরে জমে থাকা না বলা কষ্টগুলো কি অসহ্য যন্ত্রনা দেয়।ভারী হয়ে আটকে থাকে!
শাম্মিকেউ আজকাল কিছু বলেনা ইরা।
বলতে ইচ্ছে করেনা।
মুগ্ধর ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভয়ে থাকে সে।
না জানি শাম্মি বিষয়টাকে জানলে কিভাবে দেখবে?যদি ভুল বুঝে বসে ইরাকে?তখন?
আজ ভার্সিটি থেকে শাম্মি নিরবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।ইরাকেও সাথে যেতে হয়েছিলো।ইরা যেতে চায়নি।কেননা তাদের সাথে মুগ্ধ ছিলো।
কিন্তু শাম্মির জোরাজুরিতে অবশেষে বাধ্য হয়ে সাথে যেতে হয়েছিলো তার।
পার্কে একসাথে বসে যখন শাম্মি আর নিরব গল্প করছিলো তখন অন্যদিকে মুগ্ধ ইরাকে বিরক্ত করে মেরেছিলো।
কথায় কথায় হাত ধরার চেষ্টা করছিলো সে।
তাছাড়া উল্টো পাল্টা কথাবার্তা তো আছেই।
ইরা কোনমতে শাম্মিকে বুঝিয়ে চলে এসেছে সেখান থেকে।
এখনো ভাবলে তার কেমন গা ঘিনঘিন করছে।
অসস্থি হচ্ছে খুব।কতোটা খারাপ ছেলে!
ভাবনার মাঝেই ইরার কান্না পেলো।
এসব কথা বলার জন্য তার একজন আপনজনের খুব প্রয়োজন এই মুহুর্তে। যাকে মনের সব কথা বলা যায়।খুটিনাটি সব দুঃখ শেয়ার করা যায়।
নিজের ভাবনার উপর নিজেই হেসে ফেললো ইরা।
এমন মানুষ তার জিবনে কখনোই আসবেনা।
সে জানে।
ছাদের একপাশে কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগান তৈরী করেছে সে।
সেগুলোতে আজ পানি দেওয়া হয়নি।ভাবনা ফেলে ফুলগাছে পানি দিতে লাগলো।

শৌখিন নিয়মিত সিগারেট খায়না।মাঝেমধ্যে একটু আধটু খায়।
বিকেলের এইসময় ছাদে কেউ থাকবেনা এই ভাবনা নিয়ে ছাদে আসে সে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগুন নেয়।
দু আঙুলের মাঝে ধরে আরামসে এক টান দেয়।
পাশে কারো শব্দ পেয়ে তাকায়।ইরাকে দেখে তারাতাড়ি হাত থেকে সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে।
ছাদের কোনায় ইরাকে দেখে সেদিকে এগোয়।
বলে,

—গাছগুলো তুই লাগিয়েছিস?

ইরা হঠাৎ কারো গলা শুনে চমকায়।পেছন ফিরে দেখে শৌখিন দাড়িয়ে আছে।
দু’হাত তার প্যান্টের পকেটে ঢোকানো।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।
ইরা মৃদু গলায় বলে,

—হু।

শৌখিন ঘুরেঘুরে দেখে।
বেশ ভালো লাগে তার।বলে,

—এতোরকমের ফুলের গাছ আছে এখানে কিন্তু গোলাপের গাছ নেই কেনো?

—কারন ও গাছে কাটা থাকে।

—তাই বলে গোলাপের গাছই লাগাবিনা?কাটা থাকলেই বা কি?ফুলটা তো সুন্দর!

—আমার গোলাপ ফুল পছন্দ না।

–সেকি রে?গোলাপ পছন্দ না?বেশিরভাগ মেয়েই তো গোলাপ ফুল বলতে পাগল।গোলাপ দিয়েই তো তাদের রাগ ভাঙানো যায়।

ইরা চোখ ছোট করে।
শৌখিন সেদিকে দেখে গলা ঝারে।খুকখুক করে ওঠে।
মিতালীর গোলাপ পছন্দ। সেকথাই বলে ফেলতে গিয়েছিলো সে।কথায় কথায় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
মিতালি তো বলেও রেখেছে, বিয়ের পর এই বাড়িতে সে গোলাপের বাগান করবে।
চারিদিকে মো মো করবে সে ঘ্রান।
আরও নানা পরিকল্পনা আছে তাদের।
সে কথা ঘুরানোর জন্য বলে,

—না মানে গোলাপ তো আমারও খুব পছন্দ তাই বললাম।

ইরা জবাব দেয়না।সে গাছে পানি দেওয়ায় মন লাগায়।শৌখিনের পছন্দ আর তার পছন্দ মিলবে তার তো কোন মানে নেই।
শৌখিন আবার বলে,

—তুই ছোটবেলায় কতো দুষ্টু ছিলিস,আর এখন এমন গোমড়া হয়ে গেছিস কেনো?

—কারন কোনকিছুই আর আগের মতো নেই।

শৌখিন মুখ গম্ভীর করে।বলে,

–হুমম তা ঠিক।

সে আরও কিছু বলতে চায়।কিন্তু কথা খুজে পায়না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।ইরার কাজ করা দেখে।
উশখুশ করে বসে বসে।
কেন জানি তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু ইরা সেদিকে গুরুত্ব দেয়না।
নিজের মতো কাজ সেরে সে ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়।
শৌখিন সেদিকে তাকিয়ে দেখে।
তার নিজের কাজের উপর নিজেরই অবাক লাগে।
ফোন বের করে মিতালীকে কল করে।
ভাবে,হয়তো মিতালীর সাথে কথা বললে ভালো লাগবে তার।

💮💮💮💮

মায়ের সাথে বেশকিছুসময় কথা বলেছে শৌখিন।শাম্মির বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে।
হাতে মাত্র পনেরোটা দিন সময় পেয়েছে।এরমাঝে বিয়ের সব কাজ সারতে হবে।শৌখিনের ঘারে সব দায়িত্ব এসে পরেছে।
কোথায়,কিভাবে কি করবে সেসব বিষয়ে মায়ের আলোচনা করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেছে।
শাম্মির এনগেজমেন্টের সময় শৌখিন থাকতে পারেনি।মা অনেকবার বলেছিলো থাকতে কিন্তু সে তখন জেদ ধরে বসে ছিলো।ইরার সাথে বিয়ে দেওয়ার জেদ মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলো সে।

রুমে ফিরে সেন্টার টেবিল থেকে ফোন হাতে তুলে নিলো।
টুয়েন্টি মিসড কল উঠে আছে।শৌখিনের চিন্তা হলো খিব।মিতালী কখনো এতোবার কল করেনা।করলেও দু,একবার।
আজ এতোবার কল করলো তাও আবার এতো রাতে?কোন বিপদে পরেনি তো সে?
শৌখিন তড়িঘড়ি করে মিতালীর নাম্বারে ডায়াল করলো।
ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই এক নাগাড়ে অনর্গল বললো,

—তুমি ঠিক আছো মিতালী,কি হয়েছে তোমার?কোন সমস্যা হয়েছে?কি সমস্যা হয়েছে?কোথায় আছো এখন?

মিতালী গম্ভীর গলায় বললো,

—আমি ঠিক আছি।

শৌখিন একটু শান্ত হলো।মিতালীর গলার গম্ভীরতা উপলব্ধি করে বললো,

—মুড ওফ কেনো?

মিতালী এবার ফুসে উঠলো।
এতোক্ষণের নিরবতার পর রাগ উপচে পরলো তার।বললো,

—এতক্ষণ কই ছিলে তুমি?কতোবার কল করেছি দেখেছো?আর এখন বলছো মুড ওফ কেনো?

—সরি সরি।ফোনটা ঘরে ছিলো তো।
আমার সাথে ছিলোনা।

মিতালী কন্ঠ ঠিক করলো।বললো,

—এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?

–মায়ের রুমে।

—ওহ,তাহলে ঠিক আছে।
কন্ঠ একটু কোমল করে বললো,

—শাম্মির বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে শুনলাম।

—কে বলেছে রিফাত?

—হ্যা।

শৌখিন বললো,

—হ্যা,ডেট ঠিক হয়ে গেলো।
আর কটা দিন মাত্র হাতে সময় পেয়েছি বুঝলে?নিরব বেশকিছুদিন একটানা ছুটি পেয়েছে তাই এর মধ্যেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে।

—ভালোই তো।

—হ্যা।শাম্মির বিয়েটা দিলে নিশ্চিন্ত হতে পারবো।
তারপরেই মাকে তোমার কথা বলবো।

মিতালী হুট করে বলে ওঠে,

—কেনো শাম্মির বিয়ের পর ইরার কথা ভাববে না?ওর ও তো কেউ নেই।
তোমরা ওর বিয়ের কথা না ভাবলে কে ভাববে?

শৌখিন হঠাৎ কি বলবে বুঝতে পারলোনা।সে কখনো এ বিষয়ে ভেবে দেখেনি।ভাবার অবকাশ ও পায়নি।
ইরার সাথে বিয়ে হওয়া নিয়ে মায়ের সাথে এতোদিন মনোমালিন্য চলছিলো তার।
বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো সে যদিও এসব কথা মিতালি জানেনা,বাড়ির এ কয়জন ছাড়া কেউই জানেনা।সবাই জানে ইরার কেউ নেই বিধায় রেহেনা বেগম তাকে সাথে নিয়ে এসেছেন।

এরমাঝে ইরারও যে বিয়ে দিতে হবে,তার ও জিবন গুছিয়ে দিতে হবে এসব চিন্তা কখনো মাথায় আসেনি শৌখিনের।নিজের বউকে নিয়ে এরকম চিন্তা কারও মাথায় হয়তো আসেওনা।

শৌখিনের সাড়া না পেয়ে মিতালী আবার বলে,

–কি হলো?

—কিছুনা।

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।তুমুল বেগে বর্ষন হচ্ছে। এতোক্ষণ একটা চাপা গরম ঘর ছেয়ে গেছিলো।শৌখিন ফোন কানে নিয়ে বেলকনিতে এসে দাড়ায়।
অন্ধকারে বেলকনিতে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখে।
মিতালির সাথে এটাওটা কথা বলে।
মাঝেমাঝে হাসে।
হুট করে চোখ পরে নিচের বাগানের দিকে।
কেউ একজন দুহাত ছড়িয়ে বৃষ্টি বিলাশ করছে সেখানে।
অন্ধকারে চেহারাটা ঠিকমতো দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা।
শৌখিন চোখ তীক্ষ্ণ করলো।
খুব করে চেষ্টা করলো নিচের মানবীর চেহারা দেখার।
কিন্তু ব্যার্থ হলো।
বেলকনির আলো কিছুটা নিচের বাগানে পরে হালকা আলোকিত হয়ে আছে।
মেয়েটি উচ্ছাসিত হয়ে বৃষ্টি ছোয়ায় মত্ত।
এদিকওদিক লাফালাফি করছে খুব।
শৌখিন একদৃষ্টিতে সেদিকে দেখলো।
হঠাৎ মনে পড়লো,আরে এ বাড়িতে এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজবে কে?
বাইরের কেউ তো নয়।
এতোরাতে বাইরের কেই বা আসবে।
আর শাম্মি তো ঘুমিয়ে পরেছে।শৌখিন নিজে গিয়ে দেখেছে।
তাহলে নিচে মেয়েটা কে?ইরা?
শৌখিন মিতালিকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা রেখে রুম থেকে বোরুলো।
নিচে নামার আগেই ইরাকে দেখতে পেলো সে।

ভেজা গায়ে ইরা চারিদিকে সতর্কতার সাথে চোখ বুলাতে বুলাতে চুপিসারে ঘরে ঢুকছিলো।
তার বৃষ্টি খুব পছন্দ।
বৃষ্টি নামলে ভেজার জন্য মনটা আকুপাকু করে খুব।কিন্তু এতোরাতে বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে ফুপু সাফ মানা করে দিতো।
তাই চুপচুপি বেরিয়ে পরেছিলো ইরা।
কিন্তু রুমে ঢোকার পথে সামনে শৌখিনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পরলো সে।
চোখ বুজে বিরবির করলো মনে মনে।
আজ তার বোধহয় আর রক্ষে হবেনা।
এতোরাতে বৃষ্টিতে ভেজার অপরাধে নিশ্চয় শৌখিন এখন খুব বকবে তাকে।

শৌখিন কিছু বলতে চেয়েও পারলোনা।
ইরার দিকে নজর পরতেই থমকে গেলো সে।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার কড়া নজরে চোখ বুলিয়ে নিলো।
হার্টবিট হঠাৎ দ্রুতবেগে চলা শুরু করলো।
কানে খুব শো শো শব্দ হতে লাগলো।
ইরার ভেজা শরীরের ভাজে ভাজে চোখ বুলাতে গিয়ে নিজের উপর নিজেই বেশ কয়েকদফা অবাক হলো শৌখিন।
নিজেকে সামলানোর আপ্রান চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো সে।চোখ সরাতে চেয়েও পারলোনা।
নিজের ভেতরের এক সত্বা যেনো চিৎকার করে বলে উঠলো,
–ওকে দেখার পূর্ণ অধিকার আছে তোর।
শৌখিন বিরবির করে বললো,

—ইরা এতো সুন্দর? এতোটা?কই আগে তো কখনো দেখিনি?

ইরা শৌখিনের কথা বুঝতে না পারলেও বিরবির করা কিছু কানে আসায় চোখ মেলে তাকালো।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শৌখিনের দিকে তাকাতেই শৌখিনের সম্বিত ফিরলো।
নিজেকে বারংবার তিরস্কার করতে লাগলো সে।বোঝালো,
সে মিতালীকে ভালবাসে।শুধুমাত্র মিতালিকেই ভালবাসে।
অন্যকারোদিকে এভাবে তাকানোর অধিকার তার নেই।উচিত ও নয় তার।
ইরার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিজের প্রতি রাগান্বিত হয়ে কথা না বলেই উল্টো দিকে হাটা ধরলো সে।
,

,

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here