প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -২৫

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_২৫

সৌহার্দ্য হসপিটাল থেকে ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। কিন্তু তরী এখনো ফেরেনি। মেয়েটাকে দুই বার কল করেছে সে। তরী জানিয়েছে, সে জ্যামে আটকে আছে। ফিরতে দেরী হবে। সৌহার্দ্য ভেবে নিয়েছে, তরীকে আর এভাবে একা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার যোগাড় ওর!

তরীর কথা ভাবতে ভাবতেই সৌহার্দ্য নিজের ডায়েরিটা খুললো। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে মাঝামাঝি যেতেই সৌহার্দ্যের চোখ আটকে গেল। বেশ লম্বা একটা চুল ঠিক ডায়েরির মাঝে অবস্থান করছে। চুলটাকে হাতে নিয়ে ভালো করে পরখ করে সৌহার্দ্য মোটামুটি নিশ্চিত হলো যে, এটা তরীর-ই চুল! সৌহার্দ্য মনে মনে হাসলো। বিরবির করে বললো,

“আমার পার্সোনাল ডায়েরিও ঘাটাঘাটি করা শুরু করেছো তুমি, চাঁদ? তুমি কি জানো না? এই ডায়েরিটার মতো ডায়েরির মালিকেরও পুরোটা জুড়ে শুধু তুমিই আছো! কবে যে তোমাকে বুঝিয়ে উঠতে পারবো!”

সৌহার্দ্য কিছু লিখলো না আর আজকে। লাইটারটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

তরী ঘরে ঢুকলো প্রায় আরো আধাঘন্টা পর। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে পড়লো এসেই। টেবিল থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা নিয়ে পানি খেতেই সৌহার্দ্যের কথা মনে পড়লো। সৌহার্দ্যের তো আরো আগেই চলে আসার কথা! এখানে তার কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? বারান্দা থেকে সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধটা তরীর নাকে এসে লাগতেই নাকমুখ কুঁচকালো সে। সৌহার্দ্য যে এখানে কেন নেই, সেটা বোঝা হয়ে গেছে তার!

নাক দিয়ে বি*ষা*ক্ত ধোঁয়া গুলো বের করে পুনরায় সিগারেটটা ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরার আগেই সেটা কেউ হুট করে সৌহার্দ্যের হাত থেকে টেনে নিজের দখলে নিয়ে নিলো। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পাশে তাকালো সৌহার্দ্য। তরীর রাগী দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“কী হয়েছে? সিগারেটটা নিয়ে নিলে যে?”

“তো কী করবো? একজন ডাক্তার যে কখনো এসব খেতে পারে, সেটা আপনাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। আশ্চর্য!! এটাতে কী এমন আছে যে এটা ছাড়তেই পারছেন না?”

বলেই সেটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সৌহার্দ্য মলিন চোখে তাকিয়ে বললো,

‘ বি*ষ দিয়ে বি*ষ দূর করার মানে বোঝো? যখন মানুষের ভেতরটা বি*ষা*ক্ত*তায় ভরে যায়, তখন সেটা দূর করার সবচেয়ে সহজলভ্য উপকরণ হলো নিকোটিন। এই বি*ষা*ক্ত নিকোটিন মাঝে মাঝে অমৃতের মতো মনে হয়। বুঝলে?”

তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললো, “না, বুঝিনি। বোঝার চেষ্টাও করিনি, আর না আমার বোঝার কোনো ইচ্ছে আছে! আই হেইট স্মোকিং। সুতরাং, এরপর থেকে এটা আর ঠোঁটে স্পর্শ করাবেন না।”

“আরেহ্! এটা কি হুট করে ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি? কত বছরের অভ্যাস এটা আমার, জানো? সেই কলেজ লাইফ থেকে! একটু সময় তো লাগবেই! কিন্তু কথা দিচ্ছি ছেড়ে দেবো।”

তরী চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলো ঘরের ভেতরে। সৌহার্দ্যের এই বা*জে অভ্যাসের মূল কারণ তো সে নিজেই! তার অনুপস্থিতির দ’হ’ন সহ্য করার জন্যই তো সৌহার্দ্য এটাকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছে। সৌহার্দ্যের সাথে সবকিছু খুলে বলতে ইচ্ছে করে তরীর। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় না। সৌহার্দ্য ওকে এখনো সামনাসামনি নিজে থেকে ‘চাঁদ’ বলে একবারও সম্বোধন করেনি। সৌহার্দ্যের মনের ভেতর কী চলছে, বুঝতে পারছে না সে। কেন সৌহার্দ্য সবটা জেনে, বুঝে, আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েও সরাসরি সবকিছু প্রকাশ করছে না? তার মুখে ‘চাঁদ’ ডাকটা শোনার জন্য তরীর মন যে কী পরিমাণ অস্থির হয়ে আছে, সেটা সৌহার্দ্যকে কী করে বোঝাবে সে?

চাপা বিরক্তি ও হাহা*কার নিয়ে তরী ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে গেল। মিস্টার রায়হান ও দাদীর সঙ্গে আড্ডা দিলো অনেকক্ষণ। দাদী মজার ছলে বললেন,

“কী রে, নাতবৌ! তোর আমার আমার নাতির মধ্যে সব ঠিকঠাক চলতেছে তো?”

তরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বললো, “ঠিকঠাক মানে? বেঠিক থাকবে কেন? ”

“ঠিকঠাক চলুক, এটাই তো চাই! তোদের মইধ্যে তো প্রেম বিনিময় হয়েই গেল সেইদিন! তাহলে আর আমার ছেলে আর বউমাটারে অপেক্ষা করাইতেছিস ক্যান? ওরা যে বুড়ো হইয়া গেছে! পরে আরো দেরী হইলে নাতি-নাতনি সামলানোর সামর্থ্য-ই থাকবে না। তখন….”

মিস্টার রায়হান দাদীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

“আহ্! মা, থামো তো! মেয়েটা এখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ওকে পড়াশোনায় মন দিতে দাও। আমরা আর সৌহার্দ্য, কেউই চাই না তরীর পথচলায় বাধা দিতে। আর সৌহার্দ্য একজন ডাক্তার। এতো অবুঝ নয় ও। তাই এসব নিয়ে আর ঘেঁটো না।”

তরী এই ধরনের আলোচনায় প্রচন্ড অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আশে পাশে তাকাতেই হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে খানিকটা কেঁপে উঠল সে। রান্নাঘর থেকে সুজাতা বললেন,

“এতো রাতে কে এসেছে? বউমা, দরজাটা একটু খুলে দেখ তো কে এলো?”

তরী তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পা চালিয়ে মেইনডোরের কাছাকাছি গিয়ে দরজা খুলতেই মিস্টার আফনাদকে দেখতে পেল সে। খুশি মনে মুখে হাসি ফোটাতেই পাশে মোহনাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সেই হাসি গায়েব হয়ে গেল। অবাকতায় ছেয়ে গেল পুরো মুখশ্রী। ল মোহনা আজ এই সময়ে এখানে কেন? উনি তো তরীকে পছন্দ করেন না! তাহলে আজ দেখা করতে এসেছেন যে! ভাবনাগুলো তরীর মস্তিষ্কে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে বারবার।

তরা ভাবনায় বিভোর হওয়ার মাঝেই গালে কারো স্পর্শ অনুভব করলো। মোহনা ওর গালে হাত রেখেছেন, টলমলে দৃষ্টি তাক করে রেখেছেন তরীর মায়াবী মুখটাতে৷ তরী অবাক হয়ে বললো,

“কাঁদছো কেন, মা? কী হয়েছে?”

তরীর মুখে এ জীবনে প্রথম মা ডাক শুনে মোহনা ওকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখের পানিগুলো নির্দ্বিধায় ঝরতে দিয়ে বললেন,

“এই মা ডাকটা আগে শুনলে তোকে আমি দূরে ঠেলে রাখতে পারতাম না কোনো দিন। তোর সাথে যে আচরণ করেছি, তার কোনো ক্ষমা হয়না। তোর মুখে মা ডাক শোনার যোগ্য বলে মনে হচ্ছে না নিজেকে।”

“এসব কী বলছো তুমি, মা? আমি তো তোমার সংসারে বোঝা ছিলাম। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এমনই করতো। সমাজে এমনটাই হয়ে এসেছে। তবে সত্যিটা কী জানো? হোক সে নিজের সন্তান, বা সৎ, অথবা পালিত! সবাই কিন্তু র*ক্ত-মাং*সে তৈরি মানুষ। সবাইকে মন থেকে ভালোবাসতে না পারলেও ঘৃণা করা উচিত নয়।”

মোহনা চোখ মুছে বললেন, “আমি বুঝতে পারিনি তখন। কিন্তু কীভাবে যেন আজ আমার মন বদলে গেছে! তোর জায়গায় নিজের সন্তান বসিয়ে আমি অনুভব করেছি নিজের কৃতকর্ম কতটা অন্যায় ছিল! আজ আমি কিছু চাই না। শুধু বাকিটা জীবন তোর ভালো মা হয়ে থাকতে চাই।”

তরী মোহনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“ঠিক আছে। আজ থেকে তুমি আমার ভালো মা।”

মিস্টার আফনাদ তরীকে ও মোহনাকে বুকে আগলে নিয়ে বললেন, “আজ আমি অনেক খুশি। আমার মেয়ে আজ মা পেয়েছে।”

দূর থেকে তরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা সবাই লক্ষ্য করলো। সৌহার্দ্যের মুখে প্রসন্নের হাসির রেশ ফুটে উঠলো। মনে মনে বললো,

“তুমি তো সবাইকে পেয়ে যাচ্ছো, চাঁদ! তোমাকে যে আমি নিজের করে পেয়েও পেতে পারছি না! কবে হবে তুমি আমার একান্ত নিজের প্রিয়দর্শিনী? আরো অপেক্ষার প্রহর বাকি!”

৩৬.
“কী রে! সেই কখন থেকে খেয়াল করছি! একা একাই মিট মিট করে হাসছিস। কী হয়েছে আজ তোর?”

মধুর ডাকে তরী হকচকিয়ে গেল। চকিত চোখে তাকাতেই মধু ভ্রু নাচিয়ে বললো,

“কী? তোকে আমি চিনি না ভেবেছিস? তোর হাবভাব সব মুখস্থ আমার। বই সামনে নিয়ে বসে আছিস। কিন্তু মনযোগ কোথায় তোর?”

তরী আশেপাশে তাকালো। লাইব্রেরিতে সবাই বই পড়ায় ব্যস্ত। তরী ফিসফিস করে খুশি মনে বললো,

“আজকে আমি অনেক খুশি। শুধু হাসতে ইচ্ছে করছে এজন্য!”

মধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “এতো খুশির কারণ তো বললি না আমায়! আচ্ছা, চল। আর পড়াশোনা করে কাজ নেই। তোর মনে এতো আনন্দ কেন আজকে, সেটাই শুনি না-হয় এখন!”

তরী আর মধু লাইব্রেরি থেকে বের হলো। বিকেল হওয়ায় চারপাশে গুঞ্জন আর রমরমা পরিবেশের আমেজ। তরীও হাঁটতে হাঁটতে তার মায়ের কথা সবকিছু বললো মধুকে। মধু শুনে হাসলো। বললো,

“এজন্য এতো খুশি তুই? আসলে খুশি হওয়ারই কথা! মা জিনিসটা বোধহয় আল্লাহ পৃথিবীতে সবচেয়ে ভিন্ন ভাবে বানিয়ে পাঠিয়েছে, জানিস? পৃথিবীর কোনোকিছুর সাথে এটার তুলনা হয় না”

“তোমার মায়ের সাথে তোমার কথা হয় না?”

তরীর প্রশ্ন শুনে মধুর পা থেমে গেল। মলিন হেসে বললো,

“মা ভালোই আছে। খারাপ থাকার কোনো কারণ নেই। আচ্ছা, চল আজকে তোকে ফুচকা খাওয়াই! আমার প্রচুর খিদে পেয়েছে।”

তরীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতেই সামনে কারো সাথে ধাক্কা লাগলো মধুর। মধু পড়ে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নিলো। রাগী কন্ঠে বললো,

” আব্বে… কোন কানার বাচ্….”

প্রহরের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মধুর মুখ ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মুহুর্তেই আগের চেয়ে দ্বিগুণ রেগে সে প্রহরের দিকে আঙুল তাক করে বললো,

“তুই? তোকে কী বলেছিলাম আমি? বারণ করেছিলাম না আমার সামনে অপ্রয়োজনে আসতে? যত্তসব!”

প্রহর কিছু বলবে, তার আগেই সৌহার্দ্য সেখানে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলো। তরীর বাহু ধরে ক্লান্তি নিয়ে বললো,

“আমি বলেছিলাম না, চারটার পর তোমায় নিতে আসবো? এতো বার কল দিচ্ছি, ফোন ধরছো না কেন তুমি? খুঁজতে খুঁজতে ঘাম ঝরিয়ে ছেড়েছো আমার!”

বলেই সৌহার্দ্য পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছার জন্য হাত তুললো। সামনে তাকাতেই ওর চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। বিস্ময়ে নির্বাক, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু মধুর দিকে। মুহূর্ত গড়ালো। সৌহার্দ্যের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বের হলো,

“মধু! তুই? এখানে… এতো বছর পর!”

মধুর চোখের পানি গুলো বাধ মানলো না আর। তার খুব করে ইচ্ছে করলো সৌহার্দ্যের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে, খুব করে কাঁদতে, নাক টেনে টেনে মনে জমে থাকা অভিযোগ গুলো জানাতে। বলতে ইচ্ছে হলো,

“তোদের ছাড়া আমি ভালো নেই, ভাইয়া! তোদের আমি অনেক মিস করি!!”

কিন্তু মানুষ চাইলে সবকিছু করতে পারেনা, আর না পারে কিছু বলতে। কোনো একটা বাধা মধুকে আটকে দিলো। অশ্রুপূর্ণ চোখে প্রহর, তরী আর সৌহার্দ্যের মুখ একবার অবলোকন করলো সে। পরমুহূর্তেই তড়িৎ গতিতে পা ঘুরিয়ে চলে গেল সে। তরীর কী করা উচিত, সে বুঝে উঠতে পারলো না!

-#চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here