#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৪
তরী ব’জ্রা’হ’ত হলো যেন! মূ*র্তির মতো তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের চলে যাওয়ার দিকে। এতো কথা কেন শোনালো ওকে? সে তো জানামতে সৌহার্দ্যের কোনো জিনিসে হাত দেয়নি!
সৌহার্দ্য রাগান্বিত-ভাবেই নিজের ঘরে চলে এলো। রাগে ঘামছে সে। কপালের ঘাম মুছে সামনে তাকাতেই দেখলো, মিসেস সুজাতা তার ঘরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে অরুণীর সেই ছবিটা। সৌহার্দ্য অবাক হলো। সে কিছু বলার আগেই সুজাতা বললেন,
-“না জেনে, না বুঝে, হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার শিক্ষা আমি তোমায় দেইনি, সৌহার্দ্য। কিন্তু তুমি বরাবরই এই ভুলটা করো। কী বুঝে তুমি তরীকে এতো গুলো কথা শুনিয়ে এসেছো, আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু তোমার ধারণাটা ভুল।”
সৌহার্দ্য বির*ক্ত হলো। মন ও ম’স্তি’ষ্কে’র দ্বন্দ্বে মাথা ঠিক মতো কাজ করছে না তার। তাই বললো,
-“মা, তুমি আবার কবে থেকে এতো পেচি*য়ে-ঘু*চিয়ে কথা বলা শুরু করলে বলো তো! আর তুমি বেশ ভালো করেই জানো, অরুণীর এই ছবিটা আমার কাছে কী? ঐ মেয়েটার সা’হ’স কী করে হয় এটা এখান থেকে সরানোর?”
-“ছবিটা তরী সরায়নি, সৌহার্দ্য! ইন ফ্যাক্ট, ও ছবিটাতে হাত-ই দেয়নি। ছবিটা আজ বিকেলে আমি সরিয়েছিলাম। তোমার বিয়ে হয়েছে, এটা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করো। আর বাকি রইলো অরুণীর কথা! ওকে নিয়ে সিদ্ধান্ত তুমিই নিবে যখন তুমি সবটা জানতে পারবে। এখনো অনেক কিছু অজানা তোমার, সৌহার্দ্য। অনেক কিছু।
বলেই সুজাতা ফ্রেম থেকে ছবিটা বের করে সাথে নিয়ে চলে গেলেন। ছবিহীন ফ্রেমটার দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য নিজের মায়ের বলা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো।
৮.
দুটো টিউশন শেষ করে কোচিং-এ ক্লাস করতে এসেছে মধু। ক্লাসে ঢুকে চারপাশে চোখ বুলিয়ে একদম পেছনে গিয়ে তরীর পাশে বসলো সে। দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলো।
তরী মনযোগ দিয়ে পড়া বুঝলো, দরকারী জিনিসগুলো নোটও করে নিলো। মধুর দিকে তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটার পড়ায় একদম মনযোগ নেই। গালে হাত দিয়ে পড়া না শুনে অন্য কিছু ভাবছে সে। কোনো কিছু নোটও করছে না।
ক্লাস শেষে মধু তরীর খাতার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বললো,
-“আ’রি'”ব্বা’স!!! এতো কিছু পড়িয়েছে আজকে!”
তরী মাথা নাড়িয়ে ইশারায় বললো,
-“তুমি খাতায় কিছু লেখোনি কেনো?”
মধু নাক-মুখ কুঁ*চ*কে বললো,
-“আরে, ধু”র! পড়াশোনা আমার দ্বারা হবে না কখনো, বুঝলি? কোথাও চান্সও হবে না আমার! পড়াশোনার চেয়ে বোরিং চি”জ এই দুনিয়ায় দ্বিতীয়টা আছে বলে আমার মনে হয় না।”
তরী মধুর ব্যা”ঙ্গা”ত্ম”ক কথা শুনে হাসলো। বাসা কাছে বলে একা একাই যাওয়া-আসা করে সে। কাঁধে ব্যাগটা ঝু*লি*য়ে বেরিয়ে গেল মধুও।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়। স্কুটার স্টার্ট দিয়ে তৃতীয় টিউশনের উদ্দেশ্যে যাবে মধু এখন। যেতে আধঘন্টার মতো লাগবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো মধু। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জ”ন্মা”নো সত্বেও আজ এই বয়সে তাকে এতো ব্যস্ততার মাঝে কাটাতে হয়। মধ্যবিত্তের মতো হিসেব করে পদক্ষেপ ফেলতে হয়। ভাবতে ভাবতে স্কুটার স্টার্ট দিলো সে।
ভেতরের দিকের রাস্তা বলতে গেলে ফাঁকা-ই। তাই স্পিড খানিকটা বাড়িয়ে দিলো মধু। আর এতেই ম’হা’বি’প’দে পড়ে গেল সে। একটা গাড়ির সাথে মুখোমুখি সং*ঘ*র্ষ হলো তার। স্কুটারসহ ছি’ট’কে পড়লো সে মাঝরাস্তায়।
ব্য”থা”য় আ’র্ত’না’দ করছে মধু। বাঁ হাত যে ভে”ঙে গেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এটাই বোধ হয় গাড়ির ভেতরে থাকা সেই লোক। রাগী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁ’তে দাঁ*ত চে*পে মধু বললো,
-“গাড়ি চালাতে পারেন না, গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন কেন? আজব পাবলিক মা”ই”রি!”
-“হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ স্যায়?”
মধু কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁ’ড়া’তে খোঁ’ড়া’তে বললো,
-“ইংরে’জ বংশো’দ্ভূ’ত রাজা*কা*র নাকি! কোন পা’গ’ল-ছা’গ’লে’র খ’প্প’রে পড়লাম!! ধুর!! আর রাতে চোখে কেউ সানগ্লাস পরে। আপনার এই কালো চশমার জন্য আজকে আমার বারোটা বাজলো! আবার এখানে এসে…”
ছেলেটা বিরক্ত হলো। রেগে বললো,
-“এই যে, মিস! ইউ আর গেটিং মি রঙ্, ওকে? আমার গাড়ি আপনাকে ধা’ক্কা দেয়নি। যেই গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছে, সেটা অলরেডি এখান থেকে পালিয়ে গেছে।”
মধু ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো,
-“সত্যি? ”
-“বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। তবে সত্যি এটাই! আমি তো চপনাকে হেল্প করতে এসেছিলাম! আর আপনি আমাকেই গা*লা*গা*লি করা শুরু করে দিলেন!”
মধু চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
-“লাগবে না আপনার হেল্প। আমার স্কুটারটা ঐ সামনের গ্যারেজে একটু রেখে দিয়েন পারলে। আমি একটা রিকশা দিয়ে সামনের ক্লিনিকে যাচ্ছি।”
বলেই মধু বিরবির করে বলতে লাগলো,
-“আমায় মা/রা/র চেষ্টা করেছিস! একবার হাতের কাছে পাই! মে*রে’ প*ঙ্গু’ যদি না বানিয়েছি একেকটাকে! তাহলে আমার নামও মাধুর্য না।”
পেছন থেকে ছেলেটাও বিরবির করে বললো,
-“অ*ভ*দ্র মেয়ে একটা! একবার থ্যাংকসও বললো না!!”
৯.
পেরিয়ে গেছে একটা সপ্তাহেরও বেশি সময়। অথচ সৌহার্দ্য অরুণীর সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি। বাধ্য হয়ে অরুণী সৌহার্দ্যকে কল দিলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ বলছে।
টলমলে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে অরুণী সিদ্ধান্ত নিলো, সে সৌহার্দ্যের চেম্বারে-ই যাবে। চোখ মুছে কোনোরকমে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল
বাড়ি থেকে। অরুণীর বাবা মেয়েকে পেছন থেকে ডেকে বললো,
-“কোথায় যাচ্ছিস?”
-“সৌহার্দ্যের চেম্বারে।”
অরুণীর বাবা আর কিছু বললেন না। মেয়েকে আটকালেন-ও না। অরুণী চলে গেল। অরুণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অরুণীর বাবা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। মনে মনে বললেন,
-“মিস্টার রায়হান! তোমায় একবার ধ্বং”*স করে আমার তৃপ্তি মেটেনি। তাই দ্বিতীয়বার তোমার জীবন নিয়ে খেলতে নামছি আমি।”
অরুণী সৌহার্দ্যের চেম্বারে গিয়ে সৌহার্দ্যকে পেল না। পিয়নকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
-“স্যারের তো আজকে সার্জারী আছে। ওটিতে আছেন উনি। ইদানীং স্যার প্রচুর ব্যস্ত থাকেন।”
অরুণী চেম্বারে ঘন্টা খানেক বসে রইলো। আজ সৌহার্দ্যের সাথে দেখা না করে যাবে না সে। সৌহার্দ্য এলো আরো দুই ঘন্টা পর। চেম্বারে ঢুকতেই অরুণীকে দেখে বুকের ভেতর অদ্ভুত ক’ম্প’ন অনুভব করলো সে। অরুণীকে দেখেও তেমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। এপ্রোন খুলতে খুলতে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
-“হঠাৎ! এখানে এলে যে?”
অরুণী এমন কথা মোটেও আশা করেনি। এতে বছরের সম্পর্কে তাদের নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান কম হয়নি। সবসময়ই সৌহার্দ্য অরুণীর রাগ ভা’ঙ্গি’য়ে বুকে জ’ড়ি’য়ে ধরত। আর আজ! আজ এইভাবে কথা বলছে সৌহার্দ্য!
-“এতো স্বাভাবিক তুমি? সবটা এতোই সহজ তোমার কাছে? কেন করছো আমার সাথে এরকম? আমি কোনো অপরাধ করেছি? কী হয়েছে তোমার?”
সৌহার্দ্য নীরব রইলো। কী বলবে, কীভাবে বলবে, বুঝতে পারছে না সে। অরুণী ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
-“একটা সপ্তাহ চলে গেছে, সৌহার্দ্য। আর তুমি আমার কোনো খোঁজ-ই নাওনি। তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারছি না আমি। কেন এভাবে মে*রে ফেলতে চাইছো আমায়? শ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আমার! বলো, কী অপরাধ আমার?”
সৌহার্দ্য অরুণীর কান্নামাখা মুখশ্রীর দিকে তাকালো। পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে মেয়েটার। নিজের বুকও ভার হয়ে এলো সৌহার্দ্যের। কান্না আঁটকে কোনো মতে বললো,
-“তোমার অপরাধ একটাই। তুমি আমায় ভালোবেসেছ।”
অরুণীর কান্না থেমে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে সে বললো,
-“কীহ্?”
সৌহার্দ্যের অশ্রুপূর্ণ লালাভ চোখ দুটো চশমার বাহির থেকেই দেখতে পাচ্ছে অরুণী।
-“আমরা প্রেমে পড়তে পারি, একে-অপরকে ভালোবাসতে পারি, অরুণী। কিন্তু তোমায় এটা মেনে নিতে হবে যে, উই আর নট মেইড ফর ইচ আদার।”
এ কথা শুনে অরুণী আরো বেশি বি’ভ্রা’ন্ত হয়ে গেল। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সৌহার্দ্যের কলার চেপে ধরলো সে। রাগী কন্ঠে বললো,
-“এসব কী বলছো তুমি? পা”গ”ল হয়ে গেছো? তুমি কেন আমার হবে না? আর আমার না হলে আমায় ভালোবেসেছিলে কেন? এখন এসব কথা কেন বলছো তুমি?”
সৌহার্দ্য কলার থেকে অরুণীর হাত সরিয়ে নিলো। শান্ত গলায় বললো,
-“লিসেন, অরুণী! তুমিই আমায় আগে ভালোবেসেছ। এখন ওসব কথা টেনো না।”
-“তাহলে? আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়ার কারণ কী?”
সৌহার্দ্য লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললো,
-“আমি অনেক ভেবেছি, অরুণী। বাবা-মাকে বাদ দিয়ে তোমায় বেছে নিতে পারছি না আমি। এক সন্তানকে অলরেডি হারিয়েছেন আমার মা। আমাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। তাই পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তরীকে ছাড়তে পারবো না আমি। তোমায় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে আমি আমার মা-বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যেটা সব সন্তানরা-ই তাদের মা-বাবার কাছে করে। সেটা ভঙ্গ করা অসম্ভব আমার জন্য।”
-“তরী? তরী কে?”
সৌহার্দ্য নীরব রইলো কিছুক্ষণ। তরীর পরিচয়টা প্রকাশ করতে বুক কাঁপছে ওর। জীবনে এই প্রথম সত্য প্রকাশে ভয় পাচ্ছে সে। তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“আমার স্ত্রী। বিয়ে করেছি আমি ওকে। স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। যেদিন তুমি আমার চেম্বারে লাস্ট এসেছিলে, তার কিছু মুহুর্ত আগে।”
-চলবে…
()