প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -০৩

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০৩

সৌহার্দ্য তরীর কথা ভাবতেই বিরক্ত হলো। মেয়েটাকে সহ্য-ই হচ্ছে না। ফ্রেশ হয়ে ফোনটা একবার চেক করলো। অরুণী কোনো কল বা মেসেজ করেনি। করবেই-বা কেন? নিজে থেকেই তো কষ্ট দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো ওকে! নাহ! অরুণী ওর জীবনের সাথে মিশে গিয়েছে। মেয়েটাকে ভুলতে তো পারছেই না! আবার গ্রহন করার পথে হাজারো বাধা। উচিত-অনুচিত নিয়ে এক গভীর ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে গেল সৌহার্দ্য।

তরী দৌড়ে এসে ড্রয়িং রুমে মিসেস সুজাতার সামনে বসে হাপাতে লাগলো। সুজাতার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। সৌহার্দ্যের কথাগুলো তার ভেতরটায় অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যতই হোক, তিনি একজন মা। বাবারা নিজেদের শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখতে পারলেও মায়েরা পারে না। ছেলের শেষোক্ত কথাটা সুজাতার মনকে নাড়া দিয়েছে। বারবার কানে বাজছে কথাটা,

-“আমি ভালো নেই, মা! আমি ভালো নেই!”

কিন্তু অরুণীকে সৌহার্দ্য কখনো নিজের করে পেতে পারবে না। সেই পথ যে প্রথম থেকেই বন্ধ ছিল! সুজাতা চেয়েও এটা সৌহার্দ্যকে কখনো বলতে পারেননি। ভাবনার মাঝে তরীর দিকে নজর যেতেই সুজাতা ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন,

-“এখানে বসে আছো কেন? সৌহার্দ্য কিছু বলেছে তোমায়?”

তরী ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বললো। সৌহার্দ্যকে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। সুজাতা চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর তরীকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বললো,

-“এই ঘরে এখন থেকে তুমি থাকবে। আগে একজন ছিল। সে তো এখন আর নেই! জানি না আর ফিরবে কি না! তাই এখানে এখন থেকে তুমি থাকবে।”

তরী চারপাশে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

-“ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও। তোমায় নিয়ে বের হব আমি একটু পর।”

বলেই সুজাতা বেরিয়ে গেলেন। সৌহার্দ্য-ও এখনো কিছু খায়নি- ভেবে কিচেনে ছুটে গেলেন।

৬.
মিসেস সুজাতা সারাদিন তরীকে নিয়ে অনেক কিছু কেনাকাটা করলেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেনও। বিকেলবেলায় ভর্তি প্রস্তুতির জন্য একটা ভালো কোচিং-সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এডমিশন সিজন বলে কোচিং-এ এখন অনেক ভীড়। সুজাতা ফর্ম তুলে এনে তরীর হাতে দিয়ে বললেন,

-“এটা ফিল-আপ করে সামনের ওই রুমে গিয়ে জমা দিয়ে আসিস তো, মা! আমি এই সুযোগে এখানে বসে একটু জিরিয়ে নেই।”

তরী মাথা নাড়ালো। ফর্মটা ফিল-আপ করে সাথে দুটো পেপার ও ছবি এট্যাচ করে নিলো। কিন্তু জমা দিতে গিয়ে তরীর চক্ষু চড়কগাছ। এতো ভীড় কেন আজকে? ভীড় ঠেলে সামনে এগোলো তরী। এক মেয়ে কাউন্টারে বসা লোকটার সাথে সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছে। মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো তরী। রোগা-পাতলা বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে। টিশার্টের ওপর একটা নরমাল শার্ট পরায় ঘামে হাতের দিকটায় শার্টটা লেপ্টে আছে।

ঝগড়ার মাঝেই তরী ফর্মটা জমা দিলো। লোকটা বিরক্ত হয়ে তরীকে বললো,

-“এই ব্রাঞ্চে মেডিক্যালের জন্য আর সিট ফাঁকা নেই। সব সিট বুকড। তাই অন্য ব্রাঞ্চে ভর্তি হয়ে নিবেন।”

তরী মুখ কালো করে ফেললো। তার বাড়ি থেকে এখানে আসতে সুবিধা হবে। অন্য জায়গায় গেলে তো দূর হয়ে যায়! তরী মন খারাপ করলো। ফিরে যাওয়ার জন্য উল্টো ঘুরতেই পাশে থাকা ঝগড়াটে মেয়েটা ওর হাত চে’পে ধরে কাউন্টারের লোকটার দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো,

-“ও এখানেই ভর্তি হবে। আমার সাথে। আপনাদের সাথে না ভদ্রতা দেখাতে-ই নেই! আর আমিও ভদ্র নই। আমার যেটা চাই, সেটা আমি আদায় করে নিতে জানি।”

-“মহা মুশকিলে পড়লাম তো! আপনি কিন্তু একঘন্টা যাবৎ এখানে ঝামেলা করছেন। এখান থেকে যান এখন!”

-“যাব না! যাব না!! যাব না!!! ভর্তি কনফার্ম করেন আমাদের দুজনের। এক্ষুনি।”

তরী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে তো বেশ ডে’ঞ্জা’রা’স! বাকবিতন্ডায় লোকটা ব্যর্থ হলো। ভর্তি কনফার্ম করে বললো,

-“নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজটা করলাম!”

মেয়েটা মুখ ভেঙিয়ে বললো,

-“টাকা দিয়েই ভর্তি হবো। লাভ হয়েছে আপনাদের। আবার নিয়ম! হাহ!!”

বলেই তরীর হাত ধরেই আবার ভীড় থেকে বের হলো মেয়েটা। তরী এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মেয়েটা সেটা খেয়াল করে বললো,

-“ওভাবে তাকিয়ে থাকার মতো কিছু করিনি। লোকটা বললো আর তুমি চলে যাচ্ছিলে কেন? একবার বলতে অন্তত পারতে!”

তরী হাত নাড়িয়ে বোঝালো, সে কী-ই বা বলবে? কথা বলতে পারলে তো!

মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বললো,

-“এভাবে হাত নাচানাচি করছো কেন? মুখে বলতে পারো না?”

এমনি এমনি বললেও তরী আঘাত পেল কথাটা শুনে। মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কথা বলতে পারে না। মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তরীর মুখের দিকে। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কিনা কথা বলতে পারে না! অবিশ্বাস্য!

-“সিরিয়াসলি! তবুও তুমি এডমিশনের জন্য পড়ছো? বাহ্! কিন্তু এইচএসসি পরবর্তী পড়াশোনাতে কথা বলতে পারাটা জরুরি। ভাইবা, থিসিস, প্রজেক্ট, রিপোর্ট, প্রেজেন্টেশন এসবে মুখে বলে সব বোঝাতে হয়! তোমার এই কথা বলতে না পারাটা অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে সামনে। মনোবল ধরে রেখো নিজের!”

তরী মলিন হাসলো। তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে যে অসংখ্য বাধা ছিল! ভবিষ্যতে অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে, এটা ও আগে থেকেই নিশ্চিত। তবে তার জীবনের অপূর্ণতা ঘুচতে হলেও তাকে সামনে এগোতে হবে। প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তরীর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেয়েটি বললো,

-“বাই দ্য ওয়ে, আমি মধু। পুরো নাম মাধুর্য…. অব্ মানে মাধুর্যকে সবাই ছোট করে মধু বলে ডাকে আর কী!”

তরী হাসলো। ওর খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো, “মধু নামটা তো তোমার বৈশিষ্ট্যের সাথে একটুও মানানসই নয়! ধানিলঙ্কা দিলে মানাতো ভালো।” মনের কথা মনেই চেপে গেল সে। মধু তরীর হাত থেকে টোকেন-টা নিয়ে ওর নামটা দেখলো,

-“তরী!! নাইস নেইম। আচ্ছা, চলো! টাকা জমা দিয়ে আসি।”

দুজন দু’পা এগোতেই মধু হুট করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলের গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো। তরী মুখ হা করে তাকিয়ে আছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মধু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলেটাকে বললো,

-“মেয়ে দেখলেই বাজে নজরে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে? অনেকক্ষণ ধরে তোকে খেয়াল করছি! বি’শ্রী নজরে তাকিয়ে আছিস তো আছিস-ই। চোখ দুটো গে’লে দিতে পারলে শান্তি মিলতো আমার। আজকের জন্য কিছু বললাম না আর! চলি বস্!!”
মধু ফোসফাস করতে করতে বেরিয়ে গেল। তরী এখনো অবাক চোখে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন মেয়েও হয়! সে তো কখনো দেখেনি!!

৭.
সৌহার্দ্য সন্ধ্যার দিকে বাড়ি চলে এলো। আজ সারাদিন বেশ ধকল গিয়েছে। নিজেকে সারাদিন ব্যস্ত রেখেছে সে মূলত, যেন ঝামেলাগুলোর কথা মনে তেমন না আসে। কিন্তু দিনশেষে ঠিকই নিজের এ’লো’মে’লো জীবনটাকে নিয়ে আফসোস হয়। অরুণীর কথা মনে পড়েছে সারাদিন। কিন্তু নিজ থেকে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা সে করেনি। ভেবেই হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো সৌহার্দ্য।

বিছানায় বসতেই বেডসাইড টেবিলে চোখ গেল তার। অরুণীর ছবিটা নেই! অবাক হলো সৌহার্দ্য। ছবিটা তো সবসময় টেবিলেই থাকে! কোথায় গেল তাহলে? কেউ কি সরিয়েছে? কাল থেকে এই ঘরে শুধু তরী ছিল। তার মানে কি তরী-ই সরিয়েছে ছবিটা?

তরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে চুলে সিঁথি করছিল। হঠাৎ আয়নায় নিজের পেছনে দরজার সামনে সৌহার্দ্যের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলো সে। হাত থেকে চিরুনিটা পড়ে গেল।

সৌহার্দ্য তরীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ড্রেসিং-টেবিলের সাথে চে’পে ধর’লো। সৌহার্দ্যের রাগী দৃষ্টি দেখে তরী কাঁ’প’ছে। সৌহার্দ্য চিৎকার করে বললো,

-“তোমার সাহস কী করে হয় আমার জিনিস টাচ করার? হাও ডে’য়া’র ইউ? আমার জিনিসপত্র সরানো তো দূরে থাক, ছোঁয়ার-ও কোনো অধিকার নেই তোমার। কী ভেবেছো? কী ভেবেছো তুমি, হ্যা? তোমার এই রূপ দেখে আমি তোমায় নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দেব? নেভার!!! তোমার কোনো যোগ্যতাই নেই। আমি ঘাড়ে শুরু মাত্র একটা দায়িত্ব তুমি। কাগজে কলমে তৈরি হওয়া একটা দায়িত্ব তুমি শুধু। তোমার সাথে ভালো-মন্দ কোনো প্রকার আচরণ করার ইচ্ছে আমার নেই। সো, ডোন্ট এভার ডে’য়া’র টু ক্র’স ইয়র লিমিট।”

বলেই তরীকে ধাক্কা দিয়ে নিজে থেকে সরিয়ে দিলো সৌহার্দ্য। এই দুইদিনের মানসিক, ক্রো’ধা’কা’রে তরীর ওপর ঢেলে দিলো সে। কিন্তু বুঝতেই পারলো না, আজকের এই আচরণ কত বড় ভুল ছিল তার!

-চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here