প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -০২

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-০২

সৌহার্দ্য অরুণীকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। তরী, অরুণী আর পরিবার- সবকিছু নিয়ে ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে। তাই অরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“অরুণী, একটা কথা বলবো! কিছু মনে করবে না তো!”

অরুণী ভ্রু কুঁচকে হেসে ফেললো। বললো,

-“তুমি আবার কবে থেকে আমার সাথে এতো ফর্মালিটি মেইনটেইন করা শুরু করলে, সৌহার্দ্য? যা খুশি বলো!”

-“ব্যাস, এটাই বলার ছিল যে, এভাবে হুটহাট আমাকে আর জড়িয়ে ধরো না আর আমার চেম্বারে সময়ে-অসময়ে এভাবে এসো না।”

বলেই অন্য দিকে ঘুরে তাকালো সৌহার্দ্য। এ কথায় অরুণীর প্রতিক্রিয়া দেখার সাহস তার নেই। অরুণী কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দিকে। ছয় বছরের সম্পর্কে এই প্রথম সৌহার্দ্য এই ধরনের কথা বললো। দূরে ঠেলে দিলো। মনে মনে প্রচুর কষ্ট পেল সে। কান্নারা এসে চোখে ভীড় করতেই কিছু না বলে চলে গেল সৌহার্দ্যের সামনে থেকে। সাথে নিয়ে গেল পাহাড়সম অভিমান।

অরুণীকে কষ্ট দিয়ে সৌহার্দ্যের-ও খারাপ লাগলো। বুকের ভেতর একটা অন্যরকমের চাপা ব্যথা অনুভব করলো। তবুও নিজেদের মধ্যে এই দূরত্ব সৃষ্টি করাটা দরকার ছিল। দেখা যাক, দূরত্বটা সহ্যসীমা অতিক্রম করে কি না!

৩.
বিয়ের প্রথম রাত, অথচ বর আসার কোনো নাম নেই। বিছানার মধ্যখান-টায় বসে আছে তরী। সৌহার্দ্য এখনো বাসায় আসেনি। ঘড়ির কাঁটা এগারোটার কাছাকাছি। অনেকক্ষণ যাবৎ একভাবে বসে থেকে পা ধরে গেছে তরীর। কিন্তু ভয়ে নড়েচড়ে বসতেও দ্বিধাবোধ করছে সে।

মিসেস সুজাতা নিজের ঘরের জানালা দিয়ে পার্কিং এরিয়ায় নজর বুলালেন। সৌহার্দ্যের গাড়ি এখনো আসেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি সৌহার্দ্যের ঘরে, তরীর কাছে গেলেন।

-“গহনা, শাড়ি এসব চেঞ্জ করে এসো। এভাবে আর কতক্ষণ!”

বলেই মিসেস সুজাতা তরীর হাতে একটা সুতি শাড়ি ধরিয়ে দিলেন। শাড়ির দিকে তাকিয়ে তরী মুখ কালো করে ফেললো। মিসেস সুজাতা তরীর হাবভাব বুঝতে না পেরে হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন,

-“কী হয়েছে? মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছো কেন?”

তরী শাড়ির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। সে শাড়ি পরবে না। ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলো যে, সে শাড়ি পরতে পারে না। মিসেস সুজাতা হেসে বললেন,

-“আচ্ছা, শাড়ি পরতে না পারলে আমি শিখিয়ে দিবো। কালকে তোমার জন্য কিছু শপিং করে আনবো। আজকের মতো ম্যানেজ করে নিতে হবে।”

বিয়ের সাজ ক্লিন করিয়ে মিসেস সুজাতা তরীকে শাড়িটা পরিয়ে দিলো। চুলের খোপাটা খুলতেই দীর্ঘ কালো চুলগুলো কোমড় অতিক্রম করে হাঁটুর কাছাকাছি ঠেকলো। মিসেস সুজাতা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তরীর শুভ্র-সুন্দর, স্নিগ্ধ মুখের দিকে। এই মেয়ে যে সবটা মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর! শুধু বাকশক্তি-টা থাকলে এই মেয়ে সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ হতো। কিন্তু সবটা পরিপূর্ণভাবে দিয়ে সৃষ্টিকর্তা হয়তো কাউকে পৃথিবীতে পাঠান না! এটাই হয়তো তার প্রমাণ।

রাতে মিস্টার রায়হান আর মিসেস সুজাতার সাথে এক টেবিলে বসেই ডিনার করলো তরী। খাওয়ার সময় তরীকে অনেক কথা বললেন তারা। এই বাড়ির নিয়মকানুন, সৌহার্দ্যের পছন্দ-অপছন্দ সহ অনেক কিছু জানতে পারলো তরী। উত্তরে তরী শুধু মাথা নাড়ালো। মিস্টার রায়হান হেসে বললেন,

-“বউ মা, আমরা কিন্তু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ পারি না তেমন একটা। তবে তোমার সাথে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে শিখে ফেলবো, কী বলো?”

তরী মলিন হেসে মাথা নাড়ালো। মিস্টার রায়হান পুনরায় বললেন,

-“তোমার বাবার কাছ থেকে জেনেছি, তুমি এইচএসসি কমপ্লিট করেছো গত বছর। এক বছর যাবৎ তোমার পড়াশোনা বন্ধ তোমার সৎমায়ের কারনে। তুমি কোথাও ভর্তি হতে পারোনি। তুমি কি পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চাও।”

তরী দ্রুতগতিতে মাথা নাড়ালো। তার যে নিজেকে নিয়ে মনের কোণে অনেক অনেক স্বপ্ন সাজানো। সেগুলো বাস্তবায়ন করতেই হবে তাকে। মিসেস সুজাতা হাসলেন। বললেন,

-“আমরাও চাই সেটা। তোমার মধ্যে আমি নিজের মেয়েকে খুঁজে পাই, জানো! মেয়ে না থাকাটা কতটুকু কষ্টের, আমি জানি না। কিন্তু যাদের মেয়ে থেকেও নেই, তাদের কষ্টটা বলে বোঝানোর মতো নয়।”

সুজাতার চোখে পানি জমে এসেছে। তরী বেশ অবাক হলো। “মেয়ে থেকেও নেই”- মানে কী? মিস্টার রায়হান বিরক্ত হলেন। থমথমে গলায় বললেন,

-“আহ, সুজাতা! একটা কাজের কথার মাঝে এসব কথা টেনে না আনলে তোমার চলছিল না? ওসব কথা বাদ দাও, বউ মা। তুমি আমাকে এটা বলো যে, তুমি কোথায় ভর্তি হতে চাও? কোন কোন জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা দেবে?”

তরীর নড়েচড়ে বসলো। হাত নাড়িয়ে ইশারায় কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করলো। মিস্টার রায়হান কিছুই বুঝতে পারলেন না। দুজনের দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো তরী। কী মনে হতেই সুজাতা আচমকা বলে উঠলেন,

-“ডাক্তার?”

তরীর মুখে হাসি খেলে গেল। এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিল সে এতক্ষণ। মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই মিস্টার রায়হান বললেন,

-“কিন্তু তরী, তুমি কি এটা জানো যে সৌহার্দ্য-ও ডাক্তার। ডাক্তার তো তোমাকে হতেই হবে! সৌহার্দ্যের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করতে হবে তোমায়। ওর মন জিততে হলে ওর থেকে ভালো কিছু অর্জন করতে হবে তোমাকে।”

তরী চিন্তিত হলো। এ যে আরেক নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে গেল সে! তরী পারবে তো সবার আশার মান রাখতে! পারতে যে তাকে হবেই। সুজাতা তরীর দিকে তাকিয়ে ভাবনায় মশগুল হলেন। নাহ! এই মেয়েটা অসাধারণ-ই।

৪.
সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরলো খুব ভোরের দিকে। সূর্যের আলোও তখন ভালো করে ফোটেনি। বাড়িতে প্রবেশ করে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই মিসেস সুজাতা পেছন থেকে ডাক দিলেন।

-“সৌহার্দ্য! সারা রাত বাসায় ফিরলে না। রাতে কিছু খেয়েছিলে?”

সৌহার্দ্য মায়ের দিকে ঘুরে তাকালো। চশমা ভেদ করে ওর লাল লাল চোখ দুটো নজরে ঠেকলো সুজাতার। তিনি ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললেন,

-“সারারাত কি ঘুমাওনি?”

-“সার্জন মানুষদের অনেক রাত-ই নির্ঘুম কাটে, মা! আর শান্তির ঘুমের দিন হয়তো আমার ভাগ্য থেকে মুছেই গেছে!”

সৌহার্দ্যের কন্ঠে তা’চ্ছি’ল্য’তা স্পষ্ট। সুজাতা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,

-“দেখো সৌহার্দ্য, যা হয়েছে……… ”

-“প্লিজ, মা! স্টপ ইট। আমার এখন এই ব্যাপারে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। প্রচুর ক্লান্ত আমি নিজেকে নিয়ে, নিজের কাজকে নিয়ে, ইভেন ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়েও!”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে কথাগুলো বললো। আবারও প্রস্থান করার মুহুর্তে সুজাতা বললেন,

-“অরুণী… অরুণীকে সবটা জানিয়েছো? নাকি সাহস হয়ে ওঠেনি এখনো?”

সৌহার্দ্য নীরব রইলো। কী করবে, কী বলবে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সে। সিদ্ধান্তহীনতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেও এমন মা’রা’ত্ম’ক পরিস্থিতিতে পড়ে না কেউ, যেটাতে সে পড়েছে। বুক ভর্তি নিঃশ্বাস নিয়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। চোখ দুটো ছলছল করছে তার। কম্পিত কণ্ঠে বললো,

-“আমার দেওয়া কথা-ই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, মা। সেদিন তোমাদের কাছে করা প্রতিশ্রুতির কাছে হেরে যেতে হয়েছে আমায়। নয়তো তোমাদের কথা রাখতে এই বিয়ে আমি কিছুতেই করতাম না। আর অরুণীর কথা বলছো? কী বলবো আমি অরুণীকে? এটাই বলবো যে, ওর আর আমার ছয় বছরের সাজানো স্বপ্ন ভাগ্য এক চালেই ধ্বং*স করে দিয়েছে? কীভাবে বলবো আমি? আমি ভালো নেই, মা! আমি একটুও ভালো নেই!!”

চোখে আঙুল ঘষতে ঘষতে সৌহার্দ্য নিজের ঘরে চলে গেল। মিসেস সুজাতা সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু।

৫.
ঘরে প্রবেশ করেই সৌহার্দ্য নিজের এপ্রোন, স্টেথোস্কোপ আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র টেবিলে রাখলো। পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল, তরী বিছানায় ঘুমাচ্ছে এখনো। উল্টোদিকে ঘুরে শুয়ে থাকায় তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মুহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল সৌহার্দ্যের। কিন্তু কিছু না বলে আলমারি থেকে কাপড় বের করতে লাগল।

টুকটাক শব্দে তরীর ঘুম ভেঙে গেল। হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসতেই দেখলো, সৌহার্দ্য ওর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তরী ভয় পেল। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। সৌহার্দ্য খেয়াল করলো, তরীর সুতি শাড়ির আঁচলটা পেছন বেয়ে ফ্লোর ছুঁয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আর তার সাথে তরীর ঢেউ খেলানো ঘন চুলগুলো হাওয়ায় পিঠময় দুলতে লাগলো।

তরী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকালো। ঠোঁট ভেঙে কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে বললো,

-“অদ্ভুত মেয়ে!”

-চলবে…

(সকলের মন্তব্য প্রত্যাশিত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here