#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|৪র্থ পর্ব |
টানা ছিয়ানব্বুই ঘন্টা পর কাজ থেকে মুক্তি পেলো রাদ। বাবার অফিসের সিও পদ নেবার পর অফিসের কাজকর্ম বুঝে নিতেই এত সময় লেগে গিয়েছে। এই ছিয়ানব্বুই ঘন্টায় শুধু রাতে দুই থেকে চার ঘন্টা ঘুমিয়েছে আর বাকি সময়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। রাদ কাজের মধ্যে এতই ব্যস্ত ছিলো যে বাহিরের কিছুই মনে ছিলো না এমনকি তুবার কথাও।
অফিসে নিজের কেবিনে কার্যরত অবস্থায় রাদ। হাতের বন্ধনীর দ্রুত চলাচলে’ই বলে দিচ্ছে সে কতটা ব্যস্ত। আকস্মিক কারোর কথায় কাজে ব্যাঘাত ঘটে। দরজার দিকে তাকিয়ে রাদের মুখে হাসিফুটে উঠে। হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে এসে লোকটিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলল,
– কেমন আছিস মাই জান?
রাদের কথায় মানুষটা মলিন হেসে উওর দিলো,
– কীভাবে ভালো থাকি রে! আমার ভালো থাকার মানুষটা যে অচিন পথে পাড়ি জমিয়েছে। রাদ, ভাই আমার। তাঁকে এনে দে না? আমি প্রমিজ করছি তোর কাছ থেকে আর কিচ্ছুটি চাইবো না।
– আর কিছুদিন অপেক্ষা কর। তোর মানুষ তোর কাছেই থাকবে।
রাদের কথায় লোকটি এবার রাগান্বিত হলো। রাদের কাছ থেকে এক হাত দূরে গিয়ে চিল্লিয়ে বলতে লাগল,
– কীভাবে অপেক্ষা করব। সে তো চারদিন আগে বিলেতে চলে গিয়েছে। শেষ ভরসা তুই ছিলি। তুই
ও আমাকে ধোঁকা দিলি।
– মানে আমিতো তাকে,,,,,
– থাক আর বলতে হবে না। আমি নিজে এয়ারপোর্টে তাকে ঢুকতে দেখেছি। শত অনুনয় করেও তার মন গলাতে পারিনি। অনেক লেকচার দিয়েছিলি সেদিন তাকে আমাকে এনে দিবি। কিন্তু সে কই রাদ? আমার যে তাঁকে বড্ড প্রয়োজন।
লোকটির কথা শুনে রাদ ঘামতে শুরু করল। এতবড়ো ভুল রাদের দ্বারা হয়েছে ভাবতে পারছে না।
রাদ কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে বলল,
– তোর তাঁকে আমি এনে দিবো প্রমিজ। আপাতত আমার যেতে হবে। ভালো থাকিস।
রাদ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। গাড়ির চাবি নিয়ে রওনা হলো আপন উদ্দেশ্যে।
———
নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছি দরজার পানে। আমার কাছে মনে হচ্ছে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে একবার হলেও আমার সাদা বিলাইয়ের দেখা পাবো। সাদা বিলাই আসলে শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করব, কেন আমাকে বিয়ে করে এমন শাস্তি দিচ্ছে। যেই অপরাধেই শাস্তি হোক না কেন আমার মৃত্যুর পর সে যেন মাকে দেখে রাখে এই কথা বলে যাবো।
আমার ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে রাদ প্রবেশ করল। আজ রাদের মুখে মাক্স নেই হয়তো মনের ভুলে ফেলে রেখে এসেছে। কিন্তু আমি রাদের চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না। রাদ আমার কাছে এসে আমার গালে হালকাভাবে নিজের হাত ছুঁয়ে দিলো। তা দেখে আবেশে চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে রাদের গালে হাত দিয়ে বললাম,
– মাকে দেখে রেখো সাদা বিলাই।
এদিকে তুবার অবস্থা দেখে রাদ বিচলিত হয়ে পড়ে। তুবার গালে হালকা চাপড় দিয়েও কোন কাজ হচ্ছে না দেখে রাদ তুবার পালস চেক করল। খুবই ধীরে পালস চলাচল দেখে রাদের মনে সন্দেহ জাগলো। তুবার পাশ থেকে উঠে ফ্রিজ খুলে দেখল যে , রাদ যে খাবার তুবার জন্য রেখে গিয়েছিল তা আগের মতোই আছে। তারমানে তুবা এই চারদিন না খেয়ে আছে। রাদ আর এক মুহূর্তও দেরি করল না তুবাকে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
সেলাইন চলছে ধীরগতিতে। একটা সেলাইন শেষে আরেকটা দেয়া হচ্ছে তুবাকে। তুবার শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেকটা কমে গিয়েছিল এই নিয়ে ডাক্তাররা রাদকে অনেক বকাবকি করেছে। কিন্তু রাদের সেদিকের কোন খেয়াল নেই। রাদ একমনে কি যেন চিন্তা করছে। কেবিনে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে তুবা। না খেয়ে থাকার কারনে চেহারা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। চঞ্চল আঁখিদ্বয় আজ নিস্তব্ধ হয়ে আছে। দুষ্টু-মিষ্টি বলা ঐ কন্ঠস্বর আজ নিরব হয় আছে। রাদ আর কিছুই ভাবতে পারছে না। মাথা অসম্ভব যন্ত্রণা করছে। নিজের চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে সোফায় বসে মাথা এলিয়ে দিলো।
লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি পরিধান করে হাসিমুখে এগিয়ে যাচ্ছি। আশেপাশে পরিচিত মুখ। আম্মুকে দেখা যাচ্ছে হিন্দি সিরিয়ালের দুঃখি মায়েদের মত চোখের পানা আঁচল দিয়ে মুছে নিচ্ছে আর কান্নামাখা হাসি হাসছে। মা আমার সাথে থেকে থেকে দুষ্টুর মা হয়ে গিয়েছে। মাকে দেখে ড্রামাকুইনের মায়ের থেকে কম লাগছে না।
ঘোড়ার গাড়ি চড়ে রাজপুত্র আসছে আমাকে নিয়ে যেতে। আমি হাসিমুখে আমার রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমার স্বপ্নের রাজপুত্র কাছে আসাতেই আমার মুখ চুপসে গেল। কেননা আমার রাজপুত্রের মুখে কালো মাক্স পরা যা দেখে খুবই বিরক্ত আমি। মাক্স পরা দেখে আমার মনে পড়ে গেল যে আমি বিবাহিত। এক সাদা বিলাই আমাকে জোর করে বিয়ে করেছে। না আমি দ্বিতীয় বিয়ে করব না এই ভেবে চোখ বন্ধ করে রইলাম।
আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। হাত নাড়াচাড়া করতে খেয়াল হলো কোন কিছুর সাথে আটকে আছে; হাতের দিকে লক্ষ্য করে দেখি সেলাইন চলছে। তারমানে আমি এখন আমার বন্ধুর বাড়ি মানে হাসপাতালে। আর এতক্ষণ ভুলভাল যা ছিলো সব স্বপ্ন। আমি যেমন উদ্ভট আমার স্বপ্নও তেমন উদ্ভট।
খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, লাল অধরযুগল, চোখ তো মাশাআল্লাহ। আমার সাদা বিলাই তো সুবহানআল্লাহ। এত সুন্দর সাদা বিলাই আমার বর ভাবতেই আনন্দ লাগছে। সাদা বিলাইটাকে দেখে একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে,
” খায়রুল লো তোর বিলাইয়ের মত চোখ,
খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে লাগছে হেব্বি বড়োলোক।
ও জামাই গোওওও,,,,,
আমার সাদা ভুত। সেদিন চান্দের মত চেহারা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে কিন্তু আজ কই যাবা চান্দু! আমিতো দেখেই ফেলছি হি হি হি।
বরাবরই হাসপাতাল আমার প্রিয় জায়গা। যদি কেউ স্ট্যাম্প মেরে বলে দেয় তুবার জন্য হাসপাতাল ফ্রি তাহলে তো আমি মহা খুশি। হাসপাতালে ছোট-বড়ো, জোয়ান-বুড়া সব বয়সের মানুষ থাকে। এজন্যই আরো বেশি ভালো লাগে। তাঁদের সাথে মিশতে, দুষ্টুমি করতে ভালো লাগে। আর বছরের বেশির ভাগ সময় কাঁটাতে হয় আমার হাসপাতালে। তাই তো সুইচ, সেলাইন কিছুই ভয় পাই না।
সেলাইনের পাইপে আঁকিবুঁকি করছি এমন সময় সাদা বিলাইয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
– এখন কেমন লাগছে আয়মান?
সাদা বিলাইয়ের মুখে আয়মান বলে সম্বোধন শুনে আমার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। এই প্রথম সাদা বিলাই নরম স্বরে কথা বলল আমার সাথে। সাদা বিলাই আমার কাছে এসে আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নীচু কন্ঠস্বরে আমাকে বলছে,
– কিছু খাবে? ক্ষুধা লেগেছে?
সাদা বিলাইয়ের কথায় তিনদিন না খেয়ে থাকার কথা মনে পড়ে গেল। অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি বেটা মুচকি হাসছে; যা দেখে আমি ফিদা। তবুও কিছু বললাম না।
– সত্যিই কিছু খাবে না?
এবার আমার অভিমান আরো গাঢ় হলো। মুখ ফুলিয়ে বললাম,
– আপনি এই দুইদিন আসেননি কেন? আমার কথা কি ভুলে গিয়েছিলেন? আমার খুব কষ্ট হয়েছে। এখন যদি খেতে হয় তো এক শর্তে খাবো।
রাদ বিনা বাক্যে আমার কথার প্রত্যুওরে বলল,
– কি শর্ত?
– পারাম সুন্দরী গানে নাচতে হবে।
আমার কথা শুনে রাদের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। রাদ হয়তো মনে মনে ভাবছে,” এই মেয়ে মানুষ নাকি এলিয়েন!” যাই’ই ভাবুক না কেন! আমার রাগ ভাঙ্গতে হলে এই স্টাইলে ভাঙ্গাতে হবে। রাদ রাগান্বিত চোখে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
– তুমি কি পাগল? নাকি এলিয়েন! তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এই তুমি না অসুস্থ! এই অসুস্থ অবস্থায় এমন উদ্ভট কথা কোথায় থেকে পাও শুনি? আর রইল নাচের কথা! আমি কখনোই নাচবো না। আর এমন ফালতু গানে তো একদমই না।
– তাহলে ঠিক আছে। আমি আপনার সাথে কথা বলব না। আর আমাকে রাগ দেখাচ্ছেন তো! আমি কিন্তু আপনার চেহারা দেখে ফেলেছি। সবাইকে বলে দিবো আপনি খুব সুন্দর।
রাদ এবার নিজের মাথার চুল ধরে টানছে। আমার দিকে একবার আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আমার উদ্দেশ্যে নরম কন্ঠস্বরে বলল,
– দেখো আয়মান, তুমি এখন অসুস্থ। তোমার এখন বিশ্রাম এবং কিছু খাওয়ার প্রয়োজন। তোমার খাওয়া শেষ হোক তারপর দেখা যাবে।
– সত্যি নাচবেন তো সাদা বিলাই?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমার অভিমান শেষ। এখন আমার জন্য ঝটপট দুইটা বার্গার, দুইটা স্যান্ডউইচ, একটা হটডগ, পিজ্জা নিয়ে আসুন।
আমার কথা শুনে রাদ আবার আমাকে ধমক দিলেন।
-এত জিনিস তুমি খাবে? এই অবস্থায় ফাস্টফুড খাওয়া ঠিক হবে না তুমি বরঞ্চ কিছু ফল আর জুস খাও।
রাদের কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– আমি খাবো না, খাবো না, খাবো না বলে দিলাম।
আমি আমার কথায়ে অটল। রাদ আমার জিদের সাথে পেরে উঠলো না। অগত্যা রেগে গজগজ করের হনহনিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর আমি বড়ো একটা হাসি উপহার দিলাম। কারণ রাদকে জ্বালাতে আমার খুবই ভালো লাগে।
চারদিন পর খাবার খাচ্ছি। খাবার খাচ্ছি বলতে ভুল হবে খাবারের ওপর হামলে পড়েছি। একবার বার্গারে কামড় দিচ্ছি তো একবার পিজ্জায়। আমাকে দেখে এখন মনে হচ্ছে বাহিরের দেশের ফুড ব্লগাররা যেভাবে বিনা আওয়াজে গাপুস গুপুস খায় ঠিক তেমন। আমার সামনে বসে বসে আমার খাবারের ভিডিও করছে সাদা বিলাই। তাতে আমার কি! আগে খাওয়া তারপর অন্য কিছু।
————-
বাসায় এসেছি এক ঘন্টা হয়েছে। এর মধ্যে একটা এক লিটারের কোকাকোলার বোতল সাবাড় করে ফেলেছি। আমার খাওয়া দেখে রাদ শুধু খুক খুক কাশে অবশ্য রাদকে অনেকবার বলেছি কোক খাওয়ার জন্য; সে বরাবরই উত্তর দিয়েছে,
– তোমার মত খাদক আমি! আজ যা খেয়েছ তার বদহজম যেনো না হয় তারজন্য কোক কিনে দিয়েছি। এখন খাও আর আমাকে উদ্ধার করো।
তাদের কথায় আমি শুধু হাসি। জীবনের খাবার খাওয়াটা খুবই প্রয়োজন। তা রাদের মত সাদা বিলাই কীভাবে বুঝবে।
আজ খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘরে ঢুকেছি। রাদ আর আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। এমনকি আমার ঘরের দরজা লক করেনি।
রাত বিছানায় বসে ফোনে কি যেন করছে। আমি এখন সুস্থ, শরীরের যেহেতু এনার্জি আছে তাই ধপ করে রাজের পাশে বসে রাদের গলায় ঝুলে রইলাম। আমার এই অবস্থা দেখে রাদ একটু পিছনে চেপে গেল। হাতের মুঠোফোন টেবিলের উপর রেখে আমার উদ্দেশ্যে বলল,
– এসব কি আয়মান? একটু দূরে গিয়ে বসো। এভাবে একজন ছেলের পাশে বসা ঠিক না।
তাদের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি একমাত্র গুলুমুলু রাদের বিয়ে করা বউ তা কি রাদ ভলে গিয়েছে? এখন সে আমাকে বলে কিনা বল পরনারী!
– আমাকে কেন বিয়ে করেছেন?
আমার এই প্রশ্নটা রাদের অপছন্দনীয় তা আমার জানা কিন্তু কি করবো! এভাবে জীবন কাটানো সম্ভব না।
– আমি আমার মায়ের কাছে যাবো সাদা বিলাই। মা অনেক অসুস্থ আমি জানি।
আমার কথায় রাদের কোন হেলদোল নেই। টেবিলের উপর থেকে মুঠোফোন নিয়ে আমাকে কিছু না বলে গর থেকে বেরিয়ে গেল। আর যাওয়ার আগে ” ঘুমিয়ে যাও” বলে গেল।
আমি এবার আমার রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আমি স্বাধীনভাবে চলতে চাই। রাদকে আমার কোনদিক দিয়ে খারাপ মনে হয় না। আমি রাদের চেহারা দেখেই বুঝেছি সে মনের দিক দিয়ে অনেক ভালো। কিন্তু আমার সাথে এমন হওয়ার কারণ কি। সিসি ক্যামেরার সামনে গিয়ে রাগান্বিত স্বরে মুখে যা আসছে তাই বলতে শুরু করলাম,
– তোর কোনদিনও ভালো হবে না সাদা বিলাই! আরেকবার এই ঘরে আয়! তোকে মেরে আলু ভর্তা, কচু ভর্তি, চেপা-শুটকি ভর্তি কররে ফেলবো।
অভিশাপ দিলাম সাদা বিলাই। আজীবন আমার মতো হাতিকে বহন করতে হবে তোর হুহ।
চলবে…….
[]