প্রণয়িনী পর্ব -০৫

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|৫ম পর্ব |

মধ্যরাত। নিস্তব্ধ হয়ে আছে চারিদিক। স্তব্ধ রজনীতে শহর যেন একদম ঘুমিয়ে গিয়েছে। সাথে সারিদিনের চঞ্চল তুবাও। রাদ ল্যাপটপে তুবাকে দেখছে। কেমন গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। রাদ এখনও বুঝতে পারছে না সে কি ভুল কাজ করেছে নাকি ঠিক।
রাদ নিজের মুঠোফোন নিয়ে কাউকে ফোন করল।
অপরপাশে ফোন রিসিভ হতেই রাদ বলে উঠল,

– কেমন আছিস?

– রাদ ভাই আমার, তুবা দেশেই আছে। সেদিন তুবা দেশের বাইরে যায়নি। আমি খবর নিয়েছি সেটা তুবা ছিলো না, অন্যকেউ ছিলো।

– তুই শিওর তো আবরার?

রাদের চাচাতো ভাই আবরার। প্রেমিক পুরুষ। তুবা নামক একজন মেয়েকে মন দিয়ে বসে আছে কিন্তু মেয়েটা প্রতিনিয়ত আবরারকে কষ্ট দেয়। আবরার যখনই তুবাকে মনের কথা বলতে চায় তখনই তুবা নানান কথা বলে অপমান করে দেয়। এতে করে দুই থেকে তিনবার সুইসাইড করতে চেষ্টা করে আবরার।
রাদ আবরারের উদ্দেশ্যে বলল,

– তুবার ছবি সেন্ড কর আমাকে।

রাদের কথায় আবরার ক্ষিপ্ত কন্ঠস্বরে বলল,

– আরে শা** তোর দেশে আসার দিন না তোকে সরাসরি দেখিয়েছি?

আবরারের কথা শুনে রাদ আশ্বস্ত কন্ঠস্বরে বলল,

– আবরার আমার জান, তোর তাঁর ছবি দিলে তো আর আমি তাঁকে বিয়ে করছি না তাই না!

আবরারকে বলা কথাটা বলে রাদ নিজেই থমকে গেল। সে তো তুবাকে বিয়ে করেই নিয়েছে রাগের বশে এখন কি বলল সে,

– আচ্ছা দিচ্ছি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবরার তুবার ছবি পাঠায়। তুবার ছবি দেখে রাদের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যায়।

তুবার ছবি দেখার মাঝেই রাদের ঘরে ছোট্ট হামি প্রবেশ করে। হাতে রিমোট কন্ট্রোল কার। ঘুম ঘুম চোখে হেলে দুলে ভাইয়া বলে ঘরে ঢুকছে।
হামিকে দেখে রাদ নিজের হাতের মুঠোফোন পাশে রেখে হামিকে ডাক দিলো।

– হামি, ভাইয়া এখানে। তুমি ঘুমাওনি?

হামি চোখ কচলে প্রত্যুওরে ঘুম ঘুম কন্ঠস্বরে বলল,

– আমি ভাইয়ার সাথে ঘুমাবো।

হামির কথায় রাদ মুচকি হাসে। হাত বাড়িয়ে হামিকে নিয়ে এসে রাদ নিজের পায়ে শুইয়ে দিলো। এক হাতে হামির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ল্যাপটপে তুবাকে দেখছে।

– এই পিচ্ছি আপুটা কে ভাইয়া?

রাদ ভেবেছিল হামি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু হামির কথা শুনে রাদ চমকে উওর দিলো,

– এটা একটা দুষ্টু পরী।

পরীর কথা শুনতেই হামির ঘুম উধাও। শোয়া থেকে এক লাফে উঠে আনন্দিত হয়ে বলল,

– পরীর গল্প শোনাও ভাইয়া।

রাদ মুচকি হেসে ল্যাপটপ বন্ধ করে হামিকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথায় হাত বুলিয়ে পরী অর্থাৎ তুবার গল্প শোনাচ্ছে।

————-
সাত সকালে কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছি না তাই একমনে ভেবে যাচ্ছি কি করা যায়। একে তো এই লম্বাটে ঘরের মধ্যেই বন্দী আমি, তার উপর একা। আলমারির যত কাপড় আছে সব বের করেছি। কোণা চোখে একবার সিসি ক্যামেরার দিকে তাকালাম। মনের যত ক্ষোভ আছে সব এই সিসি ক্যামেরার উপর ঢালতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কেননা সাদা বিলাইয়ের সামনে আমি ছোট্ট ইঁদুর ছানা যার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। এটা মিথ্যা কথা হি হি হি। তুবা মানেই কথার ভাণ্ডার।
এক এক করে ওয়াসরুমে বালতির ভেতর কাপড় ভিজাচ্ছি। আজ আমি বাহিরে বের হয়েই ছাড়বো এজন্য এত ব্যবস্থা। কাপড় ভেজা থাকলে অবশ্যই ঐ সাদা বিলাই রেগে যাবে। আর রেগে অন্যান্য স্বামীদের মত বলবে,
– কত বড়ো সাহস তোমার? আমার অন্ন ধ্বংস করো! এক্ষুনি কাপড় বাহিরে নেড়ে আসো।

আহা আমার কত বুদ্ধি! সাবানের ফেনা দিয়ে সারা শরীর মাখামাখি অবস্থা ঠিক তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। আমি জানি সাদা বিলাই এসেছে। আমি প্রস্তুত আজকের যুদ্ধের জন্য হি হি হি।

– ইয়া আল্লাহ মিষ্টিপরী, তোমার একি অবস্থা! দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলে রাখি।

ছোট বাচ্চার কন্ঠস্বর শুনে চমকে গেলাম। ওয়াসরুমে থেকে উঁকি দিয়ে দেখি একটা ছোট ছেলে বাচ্চা দৌঁড়ে বাহিরে চলে গেল। মিনিট দুয়েক পর হাতে মুঠোফোন নিয়ে এসে ক্লিক ক্লিক করে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। আর আমি বোকা মেয়ের মত ঐভাবেই তাকিয়ে রইলাম। যখন ছোট বাচ্চাটার কান্ডের কথা হুস আসলো তাড়াতাড়ি এক চিৎকার দিয়ে ওয়াসরুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। কারন আমার এমন ফানি অবস্থা বাহিরে লিক হলে মান সম্মান কিছুই থাকবে না।

কাপড় ধোঁয়া বাদ দিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হলাম সামনে তাকিয়ে দেখি সাদা বিলাই এবং সাথে আরেক মিনি সাদা বিলাই কোমড়ে হাত রেখে এক স্টাইলে দাঁড়িয়ে আছে। উভয়ের চোখে ফালতু রাগ।

– এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? আলমারি খালি কেন? কি করেছ কাপড়গুলো? পালানোর পথ খুঁজছিলে বুঝি?

সাদা বিলাইয়ের কথার প্রত্যুওরে বোকা হাসি উপহার দিয়ে বললাম,

– আরে কি যে বলেন সাদা বিলাই, পালাবো কেন! আমি তো জমের, আরে না না শ্বশুর বাড়িতে আছি। কোন কাজ পাচ্ছিলাম না তাই কাপড় ধুঁয়ে দিচ্ছিলাম। হয়েছে কি! অনেক বছর ধরে আলমারির কাপড় ধোঁয়া হয়নি তাই আর কি।

আমার কথা যেন সাদা বিলাই বিশ্বাস করল না। ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকিয়ে রইল আমার পানে। রাদের পাশের সেই মিনি সাদা বিলাই হা করে আমার কথা গিলছে। কয়েক সেকেন্ড আমার পানে পিটপিট করে তাকিয়ে হু হা করে অট্টহাসিতে হাসতে লাগল। ছেলেটার হাসি দেখে আমারও প্রচুর হাসি পাচ্ছে কিন্তু আমি হাসবো না; হাসলে পিচ্চি বাচ্চা আমাকে পাগল বলবে। ছোট ছেলেটা হাসি থামিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– মিষ্টি পরী তোমাকে তখন দেখতে না খুব মিষ্টি লাগছিল। আর এখন তো একদম ছোট বাচ্চা লাগছে। আমি না! তোমার কয়েকটা ছবি তুলেছি এবং সেগুলো ভাইয়াকে দেখিয়েছি।

ভাইয়া ডাক শুনে আমি সাদা বিলাইয়ের দিকে তাকালাম। সাদা বিলাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,

-তোমার ছোট দেবর।

– এমা আমার জামাইয়ের সাথে একটা ছোট দেবর আছে। তারমানে আমার আরেক সঙ্গী আছে যার সাথে সারাদিন দুষ্টুমি করতে পারব। মন খুলে কথা বলতে পারব।

সাদা বিলাই এবার আমার ছোট দেবরের উদ্দেশ্যে বলল,

– হামি ভাইয়া, তুমি বাহিরে গিয়ে তোমার মাসুদ আঙ্কেলকে ডেকে নিয়ে আসো। ততক্ষণে আমি তোমার মিষ্টিপরীর দুষ্টু-মিষ্টি করা কাজের ক্লাস নেই।

হামি আমার ছোট দেবরটা ‘আচ্ছা ভাইয়া’ বলে দৌড়ে চলে গেলো বাহিরে। আর এদিকে সাদা বিলাই দরজা বন্ধ করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এই প্রথম সাদা বিলাইকে ভয় পাচ্ছি আমি কোনো এক অজানা কারণে। সাদা বিলাই আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর আমি পিছনে পিছিয়ে যাচ্ছি।

– দেখুন সাদা বিলাই, একদম ভয় দেখাবেন না। আমি আপনার মত সাদা বিলাইকে ভয় পাইনা।

– আমি কখন তোমাকে ভয় দেখালাম! আমিতো শুধু দরজা বন্ধ করলাম। যা সবসময় করি! এখন বলো কাপড়চোপড় ভিজিয়েছ কেন?

রাদের এগিয়ে আসায় আমি পিছিয়ে যেতে যেতে একদম দেয়ালের সাথে লেগে গেলাম। রাদ এই সুযোগে দুই হাত দিয়ে আমাকে আটকে ফেললেন। রাদ অনেক লম্বা হওয়ায় তার বুক সমান আমি। রাদ আমার দিকে একটু ঝুঁকে এতক্ষণ কথাগুলো বলছিলো।
রাদের কথার প্রত্তুত্তরে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম,

– কতদিন হয় বাহিরের আলো-বাতাস দেখিনা। হাওয়া খাওয়ার জন্য কাপড় ভিজিয়েছিলাম। যেন এই সুযোগে আপনি আমাকে বাইরে যেতে দিন।

– কিন্তু তোমার সব পরিকল্পনার মধ্যে আমি পানি ঢেলে দিলাম। এক্ষুনি মাসুদ আসবে এবং এই সব কাপড় বাহিরে নিয়ে যাবে।

সাদা বিলাইয়ের কথার মাঝে কেউ দরজায় নক করল। সাদা বিলাই আমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে দরজা খুলে দিল আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
মাসুদ নামের ছেলেটি সেই যাকে আমি আমাদের বিয়ের দিন দেখেছিলাম প্রথম এবং যে আমাকে সকালে কিডন্যাপ করেছিল। মাসুদকে দেখেই আমি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলাম। এক প্রকার রেগে বলতে লাগলাম,

– এই অসভ্য ইতর কিডনাপার ছেলে। আমার জীবনটা নরক বানিয়ে এখানে দাঁত কেলানো হচ্ছে!আমি আপনাকে মেরে ফেলব। আপনার জন্য আজ আমি চার দেয়ালের মাঝে বন্দী। আপনার জন্যই সাদা বিলাইয়ের সাথে আজ আমার বিয়ে হয়েছে। আপনাকে তো আমি একদম শুটকি ভর্তা করব। শুটকির কথা মনে আসায় মনে পড়লো, কত দিন হয় শুটকি ভর্তা খাইনা।

আমার উল্টাপাল্টা কথা শুনে সাদা বিলাই আমাকে ধমকাল।
– আয়মান চুপ থাকো। আর মাসুদ বাথরুম থেকে বাড়তি গুলো নিয়ে বের হো।

মাসুদ নামের ছেলেটি দাঁত কেলিয়ে হেসে আচ্ছা বলে বাথরুম থেকে কাপড় ভর্তি বালতি নিয়ে বাইরে চলে গেল। আমিও মাসুদের পেছনে যেতে নিলে রাদ আটকে ফেলল।

– তুমি কোথায় যাচ্ছো সুন্দরী! তোমার তো বাহিরে যাওয়া মানা। তোমার শাস্তি এই ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাহিরে যাওয়া মানে তোমার শাস্তি শেষ হয়ে যাওয়া।

সাত বিলায়ের কথা শুনে ইচ্ছে করছে নিজের চুল ধরে কতক্ষণ টানি। এভাবে কি চার দেয়ালের মাঝে বন্দী থাকা যায়? কখনো যায় না। আর আমিতো থাকতেই পারিনা কিন্তু সাদা বিলাইয়ের জন্য থাকতে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে কচু গাছের সাথে ফাঁসি দিয়ে মরি।

হামি ছেলেটা একদম রাদের কার্বন কপি। রাদের হাঁটাচলা, কথাবার্তা সবকিছু হামির সাথে মিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হামি আমার সাথে একদম মিশে গিয়েছে। আমি আর হামি নিচে বসে আছি। হামিকে ধরে ধরে হিন্দিতে ‘ক’ লিখা শিখাচ্ছি। হামি বরাবর ভুল করে যাচ্ছে। যতবার বুঝাচ্ছি ততবার ভুল করছে। অবশেষে না পেরে হামির হাত ধরে কাগজে আঁকছি আর এই বলে শিখাচ্ছি,

– গোল গোল আন্ডা
সিপাহি কি ডান্ডা
বিলাই কি পোচ
মামাজি কি মোচ
জোরসে বলো বাবু এ ‘ক’

চলবে………..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here