#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|১৮তম পর্ব |
অন্ধকার শহরে সবকিছুই একদম নিস্তব্ধ। টপটপ পানি পড়ার আওয়াজ হচ্ছে যা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। আবরার পানির সুইচটা টাইট করে বন্ধ করে বন্ধ ঘরের দরজা খুলে দিলো। দরজা পাড় করে ঘরে ঢুকবে তখনও কানে পানি পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছি। পানি পড়ার আওয়াজ শুনে আবরার বাঁকা হাসে। মুঠোফোন পকেট থেকে বের করে ফোন করে কাউকে,
– পাখির তেজ কমেছে রে ভাই? উড়ে যাবার শক্তিটাও নেই। কি করব পাখিকে? আর খাঁচায় বন্দী থাকা পাখিটার জন্মদাত্রী যে ঘুমন্ত অবস্থায় আছে তাকে কি করব?
,,,,,,,,,
– আচ্ছা আয় তাহলে। হ্যালো হ্যালো শুন না! আমার ডার্লিং কেমন আছে এখন? খুব জ্বালাতন করছে কি তোকে?
,,,,,,,
– আরে চেতস কেন? আয় তাড়াতাড়ি।
প্রায় বিশ মিনিট পর আবরারের ফোনে কথা বলা ব্যক্তিটির আগমন ঘটে। আবরার তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কালো হুডি পরিহিত লোকটি মুখে কালো মাক্স পরে আবরারের সামনে এসে দাঁড়ায়। আবরার লোকটিকে দেখে এবার প্রশস্ত হেসে লোকটিকে আলিঙ্গন করে।
– কেমন আছিস আমার জান?
– কেমন আর থাকবো ভাই, আমার শুভ্রপরী যে হাসপাতালের সাদা বিছানায় আমার চোখের সামনে ছটফট করছে। আয়মানের এই অবস্থা দেখে ভালো থাকি কি করে?
মাথা থেকে হুডি আর মুখ থেকে মাক্স সরিয়ে আবরারের উদ্দেশ্যে বলল রাদ। রাদকে এখন দেখে খুবই ভয়ংকর দেখাচ্ছে। আবরার রাদের রক্তিম নেত্রদ্বয় দেখে ভয় পেয়ে যায়। আজ যে খারাপ কিছু হতে চলেছে পাখিদ্বয়দের সাথে তা বুঝতে পারছে আবরার। রাদের এমন চেহারা দেখে আবরার রাদকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে,
– রাদ ভাই আমার, শুধু শুধু এদের আঘাত করে নিজের হাত অপবিত্র করিস না। এমনিতে কয়েকদিন পর মারা যাবে; অনাহারে।
আবরারের কথায় রাদ রক্তিম চোখে আবরার পানে তাকায়। কঠোর কন্ঠস্বরে আবরারকে বলতে শুরু করে,
– আঘাত করব না মানে! ঐ কু** বাচ্চা লিজার জন্য আজ আমার আয়মানের এই অবস্থা। এতদিন তুই আমার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিস এর জন্য ঐ লিজা দায়ী। কিভাবে ক্ষমা করব আমি! বল? আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনা ভাই! চোখ বন্ধ করলেই দু’দিন আগের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠে।
রাদ চোখ বন্ধ করে নিজের চোখের অশ্রু আড়াল করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অবাধ্য অশ্রুগুলো রাদের কথা না শুনে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। রাদ চিন্তা করছে দুই দিন আগের কথা,
দু’দিন আগে রাদ তার শুভ্রপরীর জন্য কেনা লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি নিয়ে যখন ছাদে আসে যেটা সে আজ শুভ্রপরীকে জন্মদিনের উপহার দিবে। তখন রাদ লিজাকে নিচের দিকে উঁকি দিয়ে হাসতে দেখে। রাদ লিজার অবস্থান দেখে ভ্রু কুঁচকে সারা ছাদ তুবাকে খুঁজে। পুরো ছাদ খুঁজে তুবার কোন দেখা মিলল না রাদ তখন ভয় পেয়ে যায় এবং বুঝতে পারে লিজা কিছু একটা করেছে তুবার সাথে। রাদ হাতের বেনারসি ফেলে দিয়ে ছাদের রেলিং এর পাশে দৌঁড়ে চলে যায়। লিজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রাদ নিচের দিকে তাকিয়ে থমকে যায়। নিচে যে রাদের শুভ্রপরী লাল রক্তে রাঙানো জমিনে শায়িত আছে। রাদ তুবার এই অবস্থা দেখে আয়মান বলে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে থাকে,
রাদের চিৎকারে রাদের বাবা-মা, তুবার মা এবং লিজার মা সকলে একসাথে ছাদে চলে আসে। রাদের বাবা রাদের কান্না দেখে এগিয়ে গিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রাখেন। কারও স্পর্শে রাদের কান্না থেমে যায়। পাগলের মত আয়মান বলে ছাদ থেকে দৌঁড়ে নিচে চলে যায়। রাদের চলে যাওয়া দেখে সকলেই রাদের পিছু নেয়।
এদিকে লিজা সকলের এমন আগমনে ভয় পেয়ে যায়। রাগের মাথায় লিজা তুবাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। লিজা চেয়েছিল ধাক্কা দেয়ার সাথে সাথে নিচে চলে যাবে যেন কেউ বুঝতে না পারে কিন্তু এর মধ্যেই রাদের যে আগমন ঘটবে তা বুঝতে পারেনি।
রাদ তুবার কাছে গিয়ে দেখে তুবার রক্তে নিচের জমি অনেকটাই লাল রঙের রাঙিয়ে আছে। রাদ আর সময় ব্যয় না করেই তুবাকে কোলে তুলে নেয়। গাড়িতে তুবাকে বসিয়ে তুবার মা এবং রাদের মাকে বসতে বলে। আর রাদ নিজের বাবাকে বলে যায় যে, ‘লিজা এবং নিজের মাকে যেন তার বাবার ঘরে আটকে রাখে।’
হাসপাতাল নিয়ে আসতেই ডাক্তাররা তুবাকে ইমারজেন্সি বিভাগে নিয়ে যায়। যেখানে ডাক্তাররা দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা পর বের হয়ে এসে রাদকে সংবাদ দেয়,
– আল্লাহর অসীম কৃপায় রোগীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমরা তো ভেবেছিলাম রোগী মাথায় আঘাত পেয়েছে; কিন্তু পায়নি। যেহেতু রোগীর আগেই ব্রেনের সমস্যা ছিল তাই ভয়টাও বেশি ছিল। কিন্তু আমরা বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখেছি যে, রোগী মাথায় চোট পায়নি বেশি। পাথরের সাথে চেহারার এক অংশ থেঁতলে গিয়েছে যা আমরা সার্জারি করে ঠিক করে দিয়েছি। আর ডান হাত-পা ভেঙে গিয়েছে। চিন্তার কোন কারন নেই কয়েক মাসের মধ্যেই রোগী ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
আপনারা রোগীকে কেবিনে দেয়া হলে দেখা করতে পারবেন আর কোন সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাবেন।
ডাক্তারের এতটুকু কথায় সেদিন রাদ সহ সকলের দেহে প্রাণ ফিরে আসে। ডাক্তাররা তুবাকে কেবিনে শিফ্ট করার পর রাদ এসে তুবাকে একপলক দেখে নিজের বাসায় চলে আসে। মাঝপথে কাউকে ফোন করে আবরারকে খুঁজতে বলে।
দুই ঘন্টার মধ্যেই আবরারের লোকেশন রাদ পায় এবং সর্বপ্রথম রাদ আবরারের নিকটে যায়। শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে এক ভাঙ্গা হোটেলে আবরারের দেখা মিলে। যেখানে আবরার নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে কলিজার ভাইয়ের ক্ষতি করার জন্য।
রাদ সরাসরি আবরার যে ঘরে উঠেছে সে ঘরে প্রবেশ করে। আবরার রাদকে দেখে অপরাধী নয় দাঁড়িয়ে থাকে। এতদিন পর আবরারকে দেখে রাদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আবরারের চোখে পানি এসে যায় রাদের জড়িয়ে ধরাতে। আবরার জানত, রাদ তাঁকে ভুল বুঝবে না। আবরারকে ছেড়ে দিয়ে রাত বলতে শুরু করে,
– তোর কোন কথা শুনব না। আমি জানি, তোর কোন দোষ নেই এখানে। যা করেছে সব লিজা করেছে এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে আয়। অপরাধের শাস্তি দিতে হবে যে। তোকে আমার প্রয়োজন।
সেই রাতেই আবরারকে সাথে নিয়ে রাদ নিজের বাসায় চলে আসে। লিজা এবং নিজার মাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে উঠিয়ে অচেনা এক জায়গায় নিয়ে যায় এবং সেখান কিছু মহিলাদের ভাড়া করে
আচ্ছামতো লিজাকে পিটিয়ে ভাসমান পানির উপর ঝুলিয়ে রাখে। যার নিজে তিন দেকে চারটা ক্ষুধার্ত কুমির উৎ পেতে আছে কখন সে খাবার পাবে। আর এদিকে মেয়ের অবস্থা দেখে চিৎকার করে কাঁদছে লিজার মা। কিন্তু লিজার মা মেয়ের কাছে আসতে পারছে না কারণ তাকেও একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে যার জানালা দিয়ে নিজের মা তখন লিজাকে দেখছিল।
সেদিনের পর থেকে আবরার এদেরকে দেখে রাখে আর রাত তুবা কাছে চলে যায়।
বর্তমানে রাদ চোয়াল শক্ত করে আবরারের পানে তাকায়। আর আবরার অসহায় চোখে রাদের পানে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
– রাদ ভাই আমার, পুলিশকে খবর দে। পুলিশ এদের ব্যবস্থা করে নিবে। তোর এখন ঝামেলায় জড়ানো উচিত হবে না। এখন তুবার পাশে তোকে প্রয়োজন। তুবা চোখ খুলে যদি তোকে পাশে না পায় তাহলে খুব কষ্ট পাবে।
রাদ আবরারের কথা মনোযোগ সহকারে শুনে পুলিশ অফিসারকে ফোন দেয়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে এবং ওদের এরেস্ট করে নিয়ে যায়
———-
চেহারার একপার্শ্ব সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো। ডান হাত প্লাস্টার করে পেটের উপর রাখা আর ডান পা একটু উঁচু করে স্ট্যানের সাথে একটু উঁচু করে।বেঁধে রাখা। তুবার এই অবস্থা দেখে রাদের চোখে জল এসে যায়। রাদ একটু একটু পা ফেলে তুবার কাছে গিয়ে বসে। রাদের এখন মনে হচ্ছে, তুবার শরীরে হালকাভাবে ধরলেই তুবা ব্যাথা পাবে। তাই পাঁচ ছয়েকবার নিজের হাত তুবার দিকে বাড়িয়েও গুটিয়ে নেয়। তুবার ভালো থাকা চেহারার অংশে নিজের হাত দিয়ে কিছুক্ষণ স্পর্শ করে। রাদের সাতের ছোয়া পেতেই ঘুমের ঘোরে তুবা কেঁপে উঠে। কান্নার মাঝেও রাদ তুবার কান্ডে হেসে উঠে।
চলবে……
]