#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৪
__________________________
–‘ মা-বাবা হারানো সন্তানদের সুখে থাকা কিন্তু আসলেই সহজ না,,তার ওপর অন্য কাউকে খুশি রাখা তো তার চেয়ে ও কঠিন।
প্রণয়ের করা উক্ত উক্তি শুনে চমকে তার দিকে তাকালো সূচনা।তার মানে প্রণয় সব শুনেছিল কালকে।আসরের নামাজ শেষে ব্যালকনিতে দাড়িয়েছিল সূচনা।একটু পর প্রণয় এসে ও দাঁড়ালো তার পাশে।মিনিট দুয়েক এর মতো নিরব থেকে করলো এই উক্তি।সূচনার দৃষ্টি দেখে হাসলো প্রণয়।বাইরের দিকে চোখ রেখে মিহি স্বরে বললো-
–‘যা ভাবছ তাই।ওনার কথা শুনে খা/রাপ লেগেছে কিন্তু তোমার দেয়া জবাবে তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালো লাগা কাজ করেছে।আমি তো জবাব দিতে পারতমনা আর দেইওনা কিন্তু তুমি দিয়েছ।আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এতই চুপচাপ স্বভাবের যে কেউ ভুল বা খা/রাপ কিছু বললেও তার প্রতিবাদ করোনা।আমার হয়ে কথা বলার জন্য ধন্যবাদ। তবে সত্যি কি জানো মামা মামি না থাকলে আমাদের অবস্থা হয়তো ফুপির দেয়া বর্ণনার মতোই হত।হয়তো,,
এতটুকু বলেই থামলো প্রণয়।তার দিকে চোখ রেখে ই সূচনা নিচু স্বরে বললো-
–‘আস, আসলে উনি এমনই। চও/ড়া কথা বলেন এজন্য আমার ও তেমন একটা পছন্দ না।আপনি তার কথায় কিছু মনে করবেন না।এত বার বলি আমি কিন্তু উনি তবুও এমনই। কিছু মানুষ আসলে নিজেদের কিছু স্বভাব কখনোই পরিবর্তন করতে পারে না।আমার তো মনে হয় উনি পরিবর্তন করতেই চায়না।
–‘কিন্তু ইরাদ ,নিহাদ ভাইয়া, রিশা ওরা কিন্তু অনেক ভালো,মিশুক অনেক।
ইরাদের নাম শুনে মুখটা মলিন হয়ে গেল সূচনার।ছোট্ট করে –‘হুম। বললো শুধু।ব্যালকনিতে থাকা সন্ধ্যা-মালতী গাছে ফুল ফুটেছে আট দশটার মতো।
কোনোটা হলুদ রঙের তার মধ্যিখানে গাঢ় গোলাপি রঙের আভা।আবার কোনোটা পুরো গাঢ় গোলাপি রঙের।সূচনার দৃষ্টি আপাদত প্রণয়কে ছাপিয়ে সে ফুলের মধ্যে ই।সূচনার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্রণয় ও তাকালো সেই দিকে।সেখানে তাকিয়েই প্রণয় বলে উঠলো –
–‘যা সুন্দর তা দূর থেকেই সুন্দর।আর কাছ থেকে দেখা যদি তার সৌন্দর্যের পতনের, সৌন্দর্য ফি’কে হয়ে যাওয়ার কারণ হয় তাহলে তো অবশ্যই।
প্রণয়ের কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয়নি সূচনার।প্রণয়ের দিকে তাকাতেই হাঁটু হালকা ভাজ করে ফ্লোরে বসল প্রণয়।ভ্রু কুটি করল সূচনা।সন্ধ্য-মালতী গাছের টবের দিকে হালকা ঝুকে কিছু একটা করছে প্রণয়।কিন্তু কী?ফ্লোর থেকে উঠে আবার সূচনার সম্মুখে দাড়ালো প্রণয়।আলতো স্পর্শ করলো তার বাম হাত সূচনার ডান হাতে।সূচনার ডান হাত মেলে ধরল তার সামনে।নিজের ডান হাতে থাকা গাঢ় গোলাপি রঙা সন্ধ্যা-মালতী ফুলখানা রাখল সূচনার হাতে।তারপর মিহি স্বরে শোধালো-
–‘যদি সে সৌন্দর্য নিজ থেকেই কারো হাতে ধরা দেয় তাহলে তা ছুয়ে দিলে ও সৌন্দর্য বহাল থাকবে।
সূচনা মৃদু হাসলো।তার হাতের নিচে তখনও প্রণয়ের হাত। হাত সরিয়ে আনতে নিলে বাধ সাধলো প্রণয়।চেপে ধরল হাত।হাত থেকে ফুল নিয়ে সন্তপর্ণে গুজে দিল কানের পিঠে।ফিচেল কণ্ঠে বললো –
–‘হাত থেকে তার খোলা চুলে কানের পিঠে বেশি সুন্দর লাগে।
প্রণয়ের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সূচনা।তাকিয়ে থাকা দায় তার জন্য।অদ্ভুত তার দৃষ্টি, যেই দৃষ্টিতে আছে অন্যরকম কিছু। কিন্তু কী?গ্রিলে হাত রেখে প্রণয় আবারো দৃষ্টি রাখলো বাইরে।নরম কণ্ঠে বললো –
–‘ইরাদ তোমাকে সত্যি ই ভালোবাসে।
চমকিত,বিস্ময়াহত সূচনা। অক্ষি যুগল তার কোটর থেকে বের হবার উপক্রম। প্রণয় কি করে জানল?এত বছরে কাউকে জানতে দেয়নি আর শেষে কি না।সূচনা ভাবতে পারল না আর।কম্পন রত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
–‘আপ,,আপনি ক,,কী বলছেন?কী,,কীভাবে জানলেন?
সামনে তাকিয়ে ই প্রণয় উত্তর দিলো-
–‘কালকে কথা বলতে দেখেছিলাম দুজনকে।কথাগুলো ক্লিয়ারলি শুনিনি।আড়ি পেতে অন্যের কথা শোনা নট আ গুড হেবিট রাইট?তবে আজকের সকালের চিঠি টা দেখে বুঝেছি।
সূচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
–‘চিঠি? কিসের চিঠি?
প্রণয় ট্রাউজারের পকেট থেকে সাদা রঙের একটা ভাজ করা কাগজ ধরল সূচনার সামনে।এটা পেয়েছি তোমার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারটা আছে না ওখানে।আমার মানিব্যাগ রেখেছিলাম সেখানে।সেটা নিতে যেয়েই পেয়েছি।
কি লেখা আছে তা কে জানে?ভাবতে ভাবতে কাঁপা কাঁপা হাতে নিল সূচনা।এর মধ্যে প্রণয় বললো –
–‘আমি চিঠি পড়িনি,শুধু উপরের লিখাটা পড়েছি “প্রিয় বেলী রাণী,ইতি ইরাদ। কী সুন্দর সম্বোধন!
বলে হালকা হাসল প্রণয়।
সূচনার কাছে এই মুহূর্ত টা লজ্জাজনক। বিয়ে হয়েছে দুইদিন কি তিনদিন এর মধ্যে বরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ভালোবাসে এমন একজনের চিঠি পড়তে হচ্ছে তাও সেই চিঠি নিজের বরই তার কাছে পোঁছে দিয়েছে।আবার তার করা সম্বোধন কে বলছে সুন্দর।ভাজ খুলে কাগজে চোখ রাখল সূচনা।কালো কালিতে স্পষ্ট লেখা-
“বেলী রাণী,
চিঠির শুরুতে তে প্রিয় বলে সম্বোধন করে কিন্তু তোকে প্রিয় বলার বিন্দুমাত্র অধিকারটুকু আমার নেই।দিসনি তুই আমাকে।তোকে ভালো বাসি,কত টুকু তা পরিমাপ করতে পারবনা।আর করেই বা কি তুই তো এখন অন্য কারোর ঘরের ঘরণী।অন্য কারো রাণী কিন্তু বিশ্বাস কর আমি সত্যি তোকে ভালোবাসি।আমার পক্ষে সম্ভব না তোকে অন্য কারো সাথে দেখা।কষ্ট হয় অনেক,পুড়ে যায় একদম।আমার
অত শক্তি নেই বেলী রাণী,অত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবনা,তোকে অন্য কারোর সাথে চোখের সামনে চুপচাপ দেখে যেতে পারবনা।কিন্তু আমি যে এখন পথের কা/টা হব তাও না।তুই যখন বলছিলি যে তুই মেনে নিয়েছিস তোর বিয়ে তখন অনেক কষ্ট হয়েছিল জানিস।ইচ্ছে করছিল চেচিয়ে বলি ” আমার তোকে লাগবে,আমার বেলী রাণীকে লাগবে।”কিন্তু পারিনি,সাহস হয়নি।আমি পারছি না এখানে থাকতে তাই চলে যাচ্ছি পরীক্ষার বাহানা দিয়ে।কিন্তু ইরাদ সত্যি ই তার বেলী রাণী কে ভালোবাসে, অনেক বেশি ভালোবাসে।
সূচনা চিঠি টা পড়ে হাতে মুঠ করে নিল দলা পাকিয়ে।
–‘এমন করলে কেন?
–‘রেখে কী লাভ?
–‘সামান্য চিঠিই তো ছিল।সে ভালোবাসে তোমায়।
–‘তাহলে কি বলছেন আমিও যেয়ে বলব?সাড়া দিব তার ভালোবাসায়?
–‘যদি ভালোবাসা থাকে দুজনায় তাহলে আটকানোর সাধ্য নেই।
–‘মজা করছেন?
–‘তা কেন করতে যাব?
–‘শুনে মনে হলো।
–‘মোটেও না।
–‘আমি তাকে ভালেবাসিনা,না বেসেছি কখনো।আমার জন্য নিহাদ ভাইয়া যেমন ইরাদ ভাইয়া ও তেমনই।এই কথাটা শুরু থেকেই ওনাকে বলে এসেছি কিন্তু উনি তাও পিছু হাটেননি।ওনার জন্য সূচনার মনে কোনো অনুভূতিরা জন্ম নেয়নি।
–‘জন্মেছিল কারো জন্য
–‘হ্যা তবে মিলিয়ে যাচ্ছে তা ধুলোয়।
–‘নতুন অনুভূতির কি জোগান হবে?
–‘আর একটু সময় লাগবে ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগতে।
–‘দিব সময় যত প্রয়োজন। তবে
–‘তবে?
–‘বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা কি রাখে এই অধম?
ক্ষণিকের নিরবতা।তারপর স্মিত হেসে জবাব-
–‘রাখে তবে সে নিশ্চয়ই অধম না, বেস্ট কেউ।
–‘এত বড় উপাধি কেন?
–‘জানিনা,,শুনলাম যে সে মামা-মামীর আদর্শ ছেলে,,ইরা,তিথি দিনাপুর দায়িত্ববান ভাই।আর..
–‘আর?
–‘কিছু না।
–‘ বলো বলো।
–‘সত্যি ই কিছু না।
–‘আমি কিন্তু জানি।
সূচনা হালকা অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
–‘কী জানেন?
সূচনার কানের সামনে প্রণয় ফিসফিস করে বললো-
–‘এটাই যে খুব শীঘ্রই কেয়ারিং আর দায়িত্ববান হাসবেন্ডের উপাধিও পেয়ে যাব।
বলেই উচ্চ স্বরে হাসলো।সূচনা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল হয়তো।গালে লাল আভা ধরা দিল তার।
.
.
.
–‘এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করবে তো ঠিকঠাক মতো?
ড্রয়িংরুমে ইরা আর সূচনা বসে কথা বলছিল।মিহু, দিনা ওপরের রুমে।তিথি পড়তে বসেছে।ইরা আর সূচনার কথার মাঝখানে ই প্রণয়ের এই উক্তি। সূচনা আর ইরা দুজনই ভ্রু কুচকে তাকালো প্রণয়ের দিকে।প্রণয় আয়েশি ভঙ্গিতে সোফায় বসতে বসতে বললো-
–‘এভাবে তাকানোর কি আছে?ইরা পানি দে তো এক গ্লাস।
সোফা থেকে উঠে ইরা পা বাড়ালো রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।সূচনা কপাল কুচকে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো-
–‘কাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি?
–‘দুজনকেই তবে তুমি যেহেতু আছ এখন তুমিই আগে বলো।পাস তো করবে নাকি আবার আমার মান সম্মান ডুবাবে?
–‘আপনার কি আমাকে গো/বর মার্কা স্টুডেন্ট মনে হয়?
–‘সন্দেহ নেই হতেই পারে।
–‘ আমি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সবসময় ক্লাসের টপার হিসেবেই থেকেছি।
–‘ আই থিংক ভুল শুনেছি আমি, তুমি কি বিল্ডিং স্টুডেন্ট বললে?
–‘মজা করছেন আমাকে নিয়ে।
–‘হ্যা সেটা মাত্র বুঝলে বুঝি।
–‘আপনি কিন্তু,,
সূচনা দাড়িয়ে প্রণয়ের দিকে আঙুল তাক করে কিছু বলতে নিয়ে থেমে গেল।খেয়াল হলো তার আঙুল নামিয়ে নিল সাথে সাথে।প্রণয় মুখে হাত দিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বললো-
–‘তুমি দেখি সুহাসিনী হয়ে যাচ্ছ মিস রঙ্গন।
ভ্রু কুচকালো সূচনা।তারপর এক হাত কোমরে রেখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
–‘ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আর এখন মিস নেই মিসেস হয়ে গেছি।
প্রণয় ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো-
–‘হ্যা তাইতো।তাহলে তো নতুন কোনো নাম ভাবতে হবে।কি দেয়া যায় বলোতো।
সূচনা বললো না কিছু। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের পানে।এমনিতে তার দেয়া রঙ্গন নামটাই তার জন্য অন্য রকম কিছু তার ওপর নাকি নতুন নাম?তার ভাবনার মাঝেই প্রণয় একেবারে তার সন্নিকটে দাড়ালো।মৃদু কেঁপে উঠলো সূচনা।সূচনার কানের সামনে এসে বললো-
–‘তোমার নতুন নাম প্রণয়ী,প্রণয়ের প্রণয়ী।
প্রণয়ের শীতল কণ্ঠের অদ্ভুত সম্মোধনে মৃদুমন্দ কেঁপে উঠলো সূচনার সমস্ত কায়া।অজান্তেই বুজে এলো চোখ জোড়া কিঞ্চিৎ। প্রণয় সরে এসে আগের ভঙ্গিতে ই বসে পড়লো সোফায়।সরে আসার আগে হালকা করে ফু দিক সূচনার মুখশ্রীতে। চোখ খুললো সূচনা,হুশ ফিরল তার।সরে আসল সেও।
_____________________________________
–‘ আমরা সবাই হসপিটালে সূচি। ইরাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে।অবস্থা বেগতিক।
মাঝ রাতে মিসেস দিশার উদ্বেগ মিশ্রিত গলায় করা উক্তি।চমকে উঠলো সূচনা।
#চলবে