#প্রণয়ের_পরিণতি
#পর্ব_১৩
#writer_sadia_afrin_nishi
প্লেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে তনয়া।এখান থেকে সবকিছু ধোঁয়াশা লাগছে। গাছের সবুজ রঙে পতাকার মতো ছেয়ে আছে কিছু কিছু জায়গা।আবার নদীর পানিও সরু রাস্তার ন্যায় মনে হচ্ছে।তনয়া খুব উপভোগ করছে এই দৃশ্য।সে এই প্রথম প্লেনে উঠছে। এটা তার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার পাশের সিটে বসেছে রিশান। তনিমা বসতে চেয়েছিল কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে তাড়াহুড়ো করে যে যেখানে পেরেছে বসেছে।
তনয়া বাহিরের দৃশ্য দেখছে আর রিশান তারদিকে দেখছে।তনয়ার খুশি খুশি মুখটা বেশ লাগছে রিশানের কাছে। রিশান এবার আর চুপ করে থাকতে না পেরে তনয়াকে ডেকেই ফেলল।
রিশান:তনয়া কেমন লাগছে প্লেনে চড়ে?
তনয়া:অসম্ভব ভালো লাগছে স্যার।আমি খুব ইনজয় করছি এই মোমেন্টটা।
রিশান:ভালো। জানালা দিয়ে কী দেখলে আমাকেও বলো আমিও শুনি।
তনয়া:এই তেমন কিছু তো বোঝা যাচ্ছে না শুধু মাঝে মাঝে সবুজ গাছগাছালি আবার মাঝে মাঝে সরু রাস্তার মতো নদী আবার মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাখিদের উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে।
রিশান:তো তুমি কী প্রকৃতি খুব ভালোবাসো?
তনয়া:হুমম আই লাভ ন্যাচারাল বিউটি।প্রকৃতির মাঝে ডুবে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে।
রিশান:আমারও ভালো লাগে তবে তোমার মতো এতটা মন থেকে হয়তো ফিল করতে পারি না।
এভাবেই ওদের মধ্যে নানা কথা চলতে লাগল।
_______
প্লেনের চলমান গতির জন্য তনিমার বেশ অসুবিধা হচ্ছে। বারবার কোমড়ে ব্যথা পাচ্ছে। ব্যথায় ওর চোখে পানি টলমল করছে। বেশি জোরে কাঁনতেও পারছে না। এমনিতেই সকালের জন্য কাব্য সেই রেগে আছে। তাই ও এখন আর কাব্যকে রাগাতে চায় না। শুধু শুধু ঝগড়া করার মতো মুড এখন ওর নেই। সকালের কথা মনে হতেই তনিমার বুকের মাঝে কেমন জানি করতে লাগল।
সকালে তনিমার পায়ে ব্যথার জন্য রিসোর্ট থেকে বাহিরে আসতে পারছিল না। তনয়া ওকে ধরে নামানোর চেষ্টা করে কিন্তু তনিমা একটুও হাঁটতে পারছিল না। রিশানও তখন ছিল রিসেপশনিস্ট এর সাথে বিল মেটাতে ব্যস্ত।তনয়া তখন কাব্যকে বলে কী করবে তাই। কীভাবে তনিমাকে নামিয়ে গাড়ি অব্দি আনবে। তারপর কাব্য কিছু না বলে সোজা তনিমাকে কোলে তুলে এনে গাড়িতে ছুড়ে মারে।কাব্য তনিমাকে কোলে নেওয়াতে তনিমা যেন পাথর হয়ে গেছে। এই প্রথম কোনো ছেলে তার এতটা কাছে এসেছে। আর কাব্য তো রেগে লাল হয়ে আছে। সে তো বাধ্য হয়ে এমনটা করেছে।তারপর আবার গাড়ি থেকে এয়ারপোর্টে প্লেনে বসা পর্যন্ত কাব্য ওই একইভাবে তনিমাকে নিয়ে আসে। সেই থেকে তনিমা ভয়ে চুপ করে আছে। কাব্যকে রাগানোর মতো কিছুই সে আর করছে না।
_________
তনয়ার ফোন পেয়ে তনয়ার মা এখন অনেকটা চিন্তা মুক্ত। মেয়েদুটো বাড়ি ফিরছে সে অনেক খুশি।এই প্রথম তার মেয়েরা বাড়ি ছেড়ে দুরে কোথাও গেল । তৃপ্তির অবস্থা ও এখন অনেকটা ভালো। কিন্তু সারাদিন মন মরা হয়ে থাকে। ওর মা মনে করে হয়তো শরীর উইক লাগে তাই এমন করে থাকে।
রিশি আজ আর কলেজ যায়নি। তৃপ্তি আসছে না তাই রিশির ও কলেজ যেতে ইচ্ছে করে না। এদিকে সে জানতে পেরেছে যে তৃপ্তির শরীরও প্রচন্ড খারাপ তাই ও আসছে না। আর এক সপ্তাহ আসতে পারবে না। এই খবর রিশি নীতির কাছ থেকে জেনেছে।নীতি তৃপ্তির বাসায় গিয়েছিল সেখান থেকে সবটা জেনে রিশিকেও বলেছে।
তনয়ারা ফিরেছে অনেক রাতে। রিশান ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে। আর তনিমাকেও কোলে করে রুমে দিয়ে তারপর গেছে। ওদের মা তো প্রথমে তনিমাকে এভাবে দেখে অনেক উত্তজিত হয়ে পরেছিল।পরে সবটা শুনে শান্ত হয়েছে। বাড়ি ফিরে তো ওরা অনেক রাগ করেছে ওদের মায়ের ওপর। সে কেন তাদের আদরের বোনের এই অবস্থা ওদের জানায়নি। তাহলে ওরা আরও আগে চলে আসতো।
রিশি রোজ ওই নদীর তীরে এসে বসে থাকে মন খারাপ করে। কলেজ টাইম শেষ হলে আবার বাড়ি চলে যায়। তারপর সারাদিন ঘরে একাই বসে থাকে বাহিরে আর যাওয়া হয় না। রাত কাটে নির্ঘুম।রিশি এবার সিদ্ধান্ত নিল সে তৃপ্তিকে তার মনের কথা সবটা খুলে বলবে। এভাবে এই কয়েকদিনে সে হারে হারে টের পেয়েছে যে তৃপ্তিকে ছাড়া সে কতটা নিঃস্ব। তাই সে চায় যতটা দ্রুত সম্ভব সবটা তৃপ্তিকে বলবে।কিন্তু কীভাবে বলবে?তৃপ্তি কী তার প্রস্তাবে রাজি হবে?নাকী তাকে ফিরিয়ে দেবে? এইসব চিন্তা করতে করতে রিশি পাগল হওয়ার উপক্রম এবার।এক মনে সে খুশি হচ্ছে তো আবার অন্যকিছু ভেবে মন খারাপ করে ফেলছে।যা হয় হবে এবার রিশি তৃপ্তিকে বলবেই বলবে।
__________
আজ বারো দিন পর তৃপ্তি কলেজে এসেছে। এক সপ্তাহে সে সুস্থ হলেও তার মা তাকে এই পাঁচ দিন কলেজে আসতে দেয়নি।আজ খুব জোরাজুরি করে মা কে রাজি করিয়ে সে কলেজে এসেছে। এসেই সে তার ফ্রেন্ডদের সাথে ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতে বসেছে। হঠাৎ তার চোখ গেল কলেজ গেটে সাদা শার্ট, ডেনিম জিন্স,ব্ল্যাক চশমা, হাতে রোলেক্স ঘড়ি পরিহিত ছেলেটির দিকে। ছেলেটি হাতের আঙুলে করে গাড়ির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে কলেজে ঢুকছে।তৃপ্তি এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে।মনের কোণে এক ঠান্ডা শীতল বাতাস বয়ে চলেছে। এই কদিনের দুর্বলতা নিমেষেই যেন হারিয়ে গিয়ে মনটা স্বতেজ ফুরফুরে হয়ে উঠছে।ছেলেটিও কিছু দুর এসে থমকে দাড়ালো।কালো চশমার ভেতর দিয়ে ছেলেটি স্পষ্ট মেয়েটিকে দেখতে পেল।এই কদিনের অসুস্থতায় মেয়েটি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। চেহারায় এখনো অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট ।সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি ছুট লাগাল কাঙ্খিত মানুষটির কাছে।
আশেপাশের সব মানুষ ছেলেটির হন্তদন্ত দৌড় দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইল।ছেলেটির সেদিকে কোনো ভাবান্তর নেই। সে তো তার প্রেয়সীর কন্ঠ শোনার জন্য অতীব ব্যস্ত।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি।ছেলেটিও ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির।দুজনে চোখে চোখে চেয়ে রইল অনেকক্ষণ।চোখে চোখে বলা হলো জমে থাকা অনেক কথা। এমনি কথার মাঝে নীল উঠে এসে রিশিকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিল সবার মাঝে।রিশি বেশ বিরক্ত হলো নীলের কাজে কিন্তু তা প্রকাশ করল না। তৃপ্তি একটু অপ্রস্তুত হয়ে আবার স্বাভাবিকভাবে বসে পরল সবার সাথে। তারপর অনেক আড্ডা চললো। অনেকদিন পর সবাই রিশি আর তৃপ্তিকে পেয়ে অনেক খুশি।
ওইদিনের মতো সবাই অনেক ইনজয় করে তারপর বাড়ি ফিরে গেল।রাতে রিশি সবার প্রথমে নীলকে সবটা বললো।নীলের কাছে হেল্প চাইল তৃপ্তিকে প্রপোজ করার জন্য। নীলও রাজি হয়ে গেল। তারপর ইতু আর নীতিকেও সে জানালো সবকিছু।
তৃপ্তি বাড়ি গিয়ে বোনদের সাথে হাসি মজায় ভালোই ছিল। হঠাৎ তনয়া বললো সে চায় তৃপ্তি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করুক।তনয়ার খুব ইচ্ছে ছিল বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করার কিন্তু তখন তাদের সে রকম পরিস্থিতি ছিল না। তনিমার ও এখন বিদেশে যেয়ে পড়া সম্ভব নয়। তাই তনয়া চায় তৃপ্তি বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা কম্পিলিট করুক।এই সিদ্ধান্তে তনিমা খুব খুশি হয়। সেও চায় তার বোন অনেক বড় হোক।কিন্তু তাদের মা একটু আপত্তি জানায়। একা একটা মেয়ে অতদুরে গিয়ে কী করে কী করবে ইত্যাদি ইত্যাদি নানা রকম চিন্তা তার। আর চিন্তা তো হওয়ারই কথা দিনশেষে সে তো মা। সন্তানদের কাছ ছাড়া করতে কী করেই বা চাইবে।তবুও তনয়া আর তনিমা অনেক বুঝিয়ে তাকে কোনো রকম রাজি করিয়েছে।
এতো কিছুর মধ্যে তৃপ্তি এখনো চুপ করে বসে আছে। সে যেন পাথর হয়ে গেছে। সে এখন কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। বোনদের ইচ্ছের অমর্যাদা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ওদিকে সে পাঁচ বছর বাইরে কী করে থাকবে সকলকে ছেড়ে। এতো দুর দেশে মা,বোনদের ছেড়ে সে কী পারবে থাকতে।আর রিশি, রিশিকে কী করে ভুলে থাকবে।রিশিকে তো তার মনের কথা এখনো বলাই হয়ে উঠল না। রিশি কী অপেক্ষা করবে তার জন্য? এইসব ভাবতে ভাবতে তৃপ্তির মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। সে কোনো কথা না বলে চুপচাপ রুমে চলে গেল।
সে রাতে তৃপ্তি আর ঘুমোতে পারল না। সারা রাত দুশ্চিন্তায় মাথা চেপে ধরে খাটে হেলান দিয়ে বালিশ কোলে নিয়ে বসে থাকল।আর চোখের পাশ দিয়ে বিসর্জন দিতে লাগল নোনাজল।
এদিকে রিশি তো মহা খুশি সে কাল তৃপ্তিকে তার মনের কথা বলবেই। উত্তেজনায় তার ও আজ রাতে আর ঘুমানো হলো না।
একজন নির্ঘুম রাত কাটালো প্রিয়জন থেকে দুরে যাওয়ার ভয়ে আর একজন নির্ঘুম রাত কাটালো প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার আনন্দে।
চলবে,
(বাপের জন্মে জীবনে প্লেনে না ওঠা আমি😥তাই নিজের অনুমান শক্তি দিয়ে যেটুকু পারছি প্লেন সম্পর্কে লিখে দিছি🙂)